উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হায়াতুল মুসলিমীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রেও ইসলাম পরিপন্থী কিছু না করা এবং তা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ইসলাম-বিরুদ্ধ পথে না চলা।

১. হযরত ইবনু মাসঊদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘কিয়ামত দিবসে কোন মানুষের পা (হিসাবক্ষেত্র থেকে) সরবে না, যতক্ষণ না তার থেকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় (ঐ পাঁচটির দু’টি এও যে,) তার সম্পদের বিষয়ে (জিজ্ঞাসা করা হবে) যে কোথ্থেকে উপার্জন করেছে? (অর্থাৎ, হালাল পন্থায়, না হারামপন্থায়) এবং কোথায় ব্যয় করেছে…।’ (তিরমিযী)

ফায়দা: এ হাদীসের ব্যাখ্যা এই যে, উপার্জনের ক্ষেত্রেও ধর্মবিরোধী কোন কাজ করবে না- যেমন, সুদ গ্রহণ করা, ঘুষ গ্রহণ করা, কারো অধিকার হরণ করা –যেমন, কারো জমিন জবর-দখল করা বা উত্তরাধিকারের দাবী করা, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা। উপার্জনের মধ্যে এমন আত্মনিয়োগ করা যে, নামাযে অবহেলা হয়। আখেরাতকে বিস্মৃত হওয়া। যাকাত ও হজ্জ আদায় না করা। দ্বীন শিক্ষা করাকে বা আল্লাহ ওয়ালাদের নিকট যাতায়াত করাকে পরিত্যাগ করা।

একইভাবে খরচ করার ক্ষেত্রেও ধর্মবিরোধী কোন কাজ করবে না, যেমন, গুনাহের কাজে ব্যয় করা, আনন্দ-বেদনার প্রচলিত প্রথা পূরণের কাজে ব্যয় করা, যশ-খ্যাতি লাভের জন্য ব্যয় করা, কেবলমাত্র মনকে পরিতৃপ্ত করার জন্য প্রয়োজনাধিক খাদ্য, বস্ত্র, গৃহনির্মাণ, সাজসজ্জা, বাহন, শিকারী বা শিশুদের খেলনা- সামগ্রীতে ব্যয় করা। এ সব বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে সম্পদ উপার্জন করা বা সঞ্চয় করাতে কোন ভয় নেই।

বরং কোন কোন ক্ষেত্রে এরুপ করা উত্তম এবং জরুরী। যেমন, পরিবার-পরিজন আছে। তাদের পানাহারের ব্যবস্থার জন্য বা তাদেরকে দ্বীন শেখানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। বা দ্বীনের হেফাযতের জন্য অর্থের প্রয়োজন। যেমনঃ ধর্মীয় মাদরাসায়, মুসলমানদের সেবায় বা ইসলামের প্রচার-প্রসারের সংস্থাসমূহে, এতীমখানায় বা মসজিদে অর্থের প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে ইসলামের শত্রুরা যখন এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করার জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং পরিস্থিতি এরুপ হয় যে, অর্থের মোকাবেলা অর্থের দ্বারাই করা সম্ভব। যেমন, আল্লাহ তাআলা (সূরা তাওবায়) এমনতর পরিস্থিতির জন্য পালিত ঘোড়া প্রস্ত্তত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় ঘোড়া প্রতিপালনে বিশেষ সওয়াবের এবং এ জাতীয় ঘোড়ার মধ্যে সর্বাবস্থায় অনেক সওয়াবের ওয়াদা করেছেন। (মুসলিম)

অতএব এ জাতীয় পরিস্থিতির মধ্যে দ্বীন ও দুনিয়ার বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজন পূরণ পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা ইবাদত। নিম্নের হাদীসসমূহে এ কথারই উল্লেখ রয়েছে।

২. হযরত আবদুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘হালাল উপার্জন অণ্বেষণ করা ফরয (ইবাদতসমূহ)-এর পর একটি ফরয।’ (বাইহাকী)

৩. আবু কাবশাহ আনসারী (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘দুনিয়া চার ব্যক্তির জন্য (তার মধ্য থেকে) এক ঐ ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদও দান করেছেন এবং দ্বীনের জ্ঞানও দান করেছেন। ফলে সে এক্ষেত্রে স্বীয় প্রতিপালককে ভয় করে, নিজের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করে এবং এক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে তার হকসমূহ পুরা করে। এ ব্যক্তি সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। (তিরমিযী)

৪. হযরত আবু সা’য়ীদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘এই সম্পদ সুদৃশ্য ও সুস্বাদু বস্ত্ত। যে ব্যক্তি একে ন্যায়ভাবে (অর্থাৎ, শরীয়তসম্মত পন্থায়) অর্জন করে এবং ন্যায়ভাবে (অর্থাৎ, বৈধক্ষেত্রে) ব্যয় করে তাহলে তা উত্তম সাহায্যকারী বস্ত্ত…।’ (বুখারী ও মুসলিম)

৫. হযরত আমর ইবনুল আস (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘উত্তম সম্পদ উত্তম ব্যক্তির জন্য উত্তম বস্ত্ত।’ (আহমাদ)

৬. হযরত মিকদাম বিন মা’দী কারাব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি-
‘মানুষের উপর এমন একটি যুগ আসবে, যখন শুধুমাত্র অর্থই কাজে আসবে।’

৭. হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘পূর্ব যুগে (সাহাবায়ে কেরামের যুগে) অর্থসম্পদকে অপছন্দ করা হতো, (কারণ, তাদের অন্তরে ধর্মীয় শক্তি মজবুত ছিলো, বিধায় অর্থসম্পদ দ্বারা শক্তি অর্জনের প্রয়োজন ছিলো না। উপরন্ত্ত এর অনিষ্টসমূহ দেখে দূরে থাকাই তারা পছন্দ করতেন)।কিন্ত্ত এ যুগে অর্থসম্পদ মুমিনের ঢাল (অর্থাৎ, তাকে ধর্মহীনতা থেকে রক্ষা করে। কারণ, বর্তমানে অন্তরে সেই শক্তি নেই, ফলে অর্থসম্পদের অভাবে বিচলিত হয়, পরিণতিতে দ্বীনকে ধ্বংস করে)। তিনি আরো বলেন, যদি আমাদের নিকট এ মোহরগুলো না থাকতো, তাহলে বড়লোকেরা আমাদেরকে ময়লা পরিষ্কার করার ছিন্নবস্ত্র বানাতো। অর্থাৎ, লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করতো। (আর লাঞ্ছনার কারণে অনেক সময় দ্বীনেরও ক্ষতি হয়ে যায়। বর্তমান যুগে সম্পদের কারণে আমাদেরকে সম্মান করে, যার ফলে আমাদের দ্বীন নিরাপদ থাকে।) তিনি আরো বলেন- যার হাতে টাকা পয়সা রয়েছে সে যেন তা অক্ষত রাখে। (অর্থাৎ, তা বৃদ্ধি করে কিংবা কমপক্ষে তা নষ্ট না করে।) কারণ, এটি এমন একটি যুগ, যখন কেউ অর্থসম্পদের অভাবী হয়ে যায়, তখন সর্বপ্রথম নিজের দ্বীনকে খোয়ায় (অর্থ-সম্পদ ঢাল হওয়ার ব্যাখ্যায় একটু পূর্বে একথাই চলে গেছে)। তিনি আরো বলেন- হালাল মাল অপচয় সহ্য করে না। (অর্থাৎ, হালাল মাল এত অধিক পরিমাণ হয়ই না যে, তার অপচয় করা হবে বা করলেও তা শেষ হবে না। বিধায় খুব বিচার-বিবেচনা প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা ব্যয় করবে, যাতে করে দ্রুত শেষ হওয়ায় বিচলিত হতে না হয়। (শরহুস সুন্নাহ)

সম্মুখের হাদীসগুলোতে হালাল মাল উপার্জনের মাধ্যম ও উপকরণসমূহের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।

৮. হযরত আবু সা’য়ীদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিবসে) নবী, ওলী ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিযী, দারামী, দারা কুতনী)

ফায়দা: এ হাদীসে হালাল ব্যবসার ফযীলত বিবৃত হয়েছে।

৯. হযরত মিকদাম বিন মা’দী কারাব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘কোন ব্যক্তি স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য খায়নি।’ (বুখারী)

আল্লাহর নবী দাউদ (আঃ) স্বহস্তে উপার্জন করে খেতেন।
তাঁর হস্তকর্ম ছিলো বর্ম তৈরী করা। তা পবিত্র কুরআনে এসেছে। এ হাদীস দ্বারা বৈধ হস্তশিল্পের ফযীলত জানা যায়। তবে অবৈধ হস্তশিল্প গুনাহের কাজ-যেমন প্রাণীর ছবি ধারণ করা, ছবি তৈরী করা বা বাদ্যযন্ত্র তৈরী করা।

১০. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি, যিনি ছাগল চরাননি। সাহাবাগণ নিবেদন করলেন- আপনিও কি ছাগল চরিয়েছেন? তিনি ইরশাদ করলেন- হাঁ, আমি মক্কার লোকদের ছাগল কয়েকটি ‘কিরাতের’ বিনিময়ে চরাতাম।’ (বুখারী)

ফায়দা: ‘কিরাত’ স্বর্ণমুদ্রার এক-চতুর্থাংশ। সে যুগের একটি স্বর্ণমুদ্রা আমাদের দেশীয় মুদ্রায় প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা। তাই এক কিরাত দুপাই কম দুই আনা। সম্ভবতঃ প্রত্যেকটি ছাগল চরানোর বিনিময় এ পরিমাণ ছিলো। এ হাদীস দ্বারা এমনভাবে শ্রম দানের ফযীলত জানা গেলো, যার মধ্যে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তির কাজ করা হয়।

১১. হযরত উতবা বিন নযর (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘হযরত মূসা (আঃ) আট বা দশ বছরের জন্য চাকুরী করেছেন।

ফায়দা: এ ঘটনা পবিত্র কুরআনেও বিবৃত হয়েছে। এর দ্বারা নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির কাজে শ্রমদানের ফযীলত জানা গেলো।

১২. হযরত ছাবিত বিন যাহহাক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জমিন ভাড়া দেওয়ার অনুমতি দিয়ে ইরশাদ করেছেন-’এতে কোন দোষ নেই।’ (মুসলিম)

ফায়দা: এ হাদীস দ্বারা বৈধ ভাড়ার আমদানীর অনুমতি জানা যায়।

১৩. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্নিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

‘যে কোন মুসলমান কোন বৃক্ষ রোপণ করলো বা ক্ষেত চাষ করলো, তারপর কোন মানুষ, কোন পাখী বা কোন পশু তা থেকে খেলে ঐ ব্যক্তির জন্য তা দান বলে গণ্য হয়। (অর্থাৎ, সে দানের সওয়াব পায়।) (বুখারী ও মুসলিম)

ফায়দা: এ হাদীস দ্বারা ক্ষেত চাষ করা এবং বৃক্ষ রোপণ করা বা বাগান লাগানোর কত বড় ফযীলত প্রমাণিত হলো। বিধায় এটিও আমদানীর একটি সুন্দর পন্থা।

১৪. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, এক আনসারী ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট কিছু (ভিক্ষা) চাইতে এলো। তিনি (তার অর্থাৎ, ভিক্ষাপ্রার্থীর বাড়ী থেকে) একটি চাটাই এবং পানি পান করার একটি পেয়ালা আনালেন এবং সেগুলো নিলামে বিক্রি করলেন। তারপর তার মূল্য দিয়ে তাকে কিছু খাদ্য এবং একটি কুড়াল ক্রয় করে দিয়ে ইরশাদ করলেন-
‘যাও ! কাঠ কেটে বিক্রি করো। তারপর তিনি ইরশাদ করলেন- এ কাজ তোমার জন্য ভিক্ষাবৃত্তি (কিয়ামত দিবসে) তোমার মুখমন্ডলে (লাঞ্ছনার) একটি দাগরুপে প্রকাশ পাওয়ার চেয়ে উত্তম।’ (আবু দাউদ, ইবনু মাজা)

ফায়দা: এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হালাল পেশা, তা যত নিম্নমানেরই হোক না কেন (তবে শর্ত হলো, এমন কাজ না হতে হবে, যার দ্বারা ধর্মের অবমাননা হয়। যেমন, মুসলমান হয়ে কোন কাফিরের অতি হীন মানের কাজ করে দেওয়া।) এমনকি ঘাস কাটাও ভিক্ষা করার চেয়ে উত্তম। যদিও ভিক্ষার কাজ জাঁকজমকের সাথেই করা হোক না কেন। যেমন, অনেক লোক চাঁদা সংগ্রহের পেশা অবলম্বন করে। যার দ্বারা নিজের এবং অন্যের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। হাঁ, তবে যদি ধর্মীয় কাজের জন্য চাপ না দিয়ে সাধারণভাবে চাঁদার প্রয়োজন তুলে ধরা হয়- তাতে ক্ষতি নেই।

১৫. হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা (বৈধ) পেশা অবলম্বনকারী ঈমানদারকে ভালোবাসেন।’
(তারগীব, তাবরানী, বাইহাকী)

ফায়দা: এর মধ্যে সবধরনের বৈধ পেশাই অন্তর্ভুক্ত। কোন বৈধ পেশাকে তুচ্ছ মনে করা উচিত নয়।
পরবর্তী হাদীসগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে যে, নিজের মনোতৃপ্তির জন্য হালাল মাল সঞ্চয় করে রাখাতেও কল্যাণ রয়েছে।

১৬. হযরত উমর (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে-
‘বনী নযীরের (ইহুদীদের) সম্পদসমূহ (অর্থাৎ, জমিনসমূহ, যেগুলো যুদ্ধবিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের হস্তগত হয়নি বরং বিনা যুদ্ধে হস্তগত হয়েছিলো)। জনাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের (ব্যয়ের) জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। তিনি এ থেকে স্বীয় স্ত্রীদের এক বছরের খরচ দিতেন। (এবং) তা থেকে যা বাঁচতো তা অস্ত্র ও ঘোড়া (অর্থাৎ,যুদ্ধ সরঞ্জাম) ক্রয়ের কাজে ব্যয় করতেন।’ (বুখারী)

১৭. হযরত কা’বাব বিন মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার তাওবা এই যে, আমি সর্বদা সত্য বলবো এবং আমার সমস্ত ধনসম্পদ আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সমীপে পেশ করে তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। তিনি ইরশাদ করলেন-
‘কিছু সম্পদ রেখে দেওয়া উচিত। এটি তোমার জন্য উত্তম (এবং কল্যাণকর)।(সেই কল্যাণ এই যে, নিজের জীবিকা নিজের কাছে থাকলে দুশ্চিন্তা থাকে না।) তখন আমি নিবেদন করলাম, তাহলে খাইবারের যুদ্ধে আমি যে অংশ পেয়েছি তা রেখে দিলাম।
(তিরমিযী)

ফায়দা: প্রথম হাদীস দ্বারা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ সঞ্চিত রাখা এবং দ্বিতীয় হাদীস দ্বারা তাঁর এজন্য পরামর্শ দান করা প্রমাণিত হয়।

১৮. হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘আমি এমন ব্যক্তিকে ঘৃণা করি, যে নিছক বেকার। না দুনিয়ার কোন কাজে লিপ্ত, না আখেরাতের কোন কাজে।’ (মাকাসিদে হাসানা, বাইহাকী, ইবনু আবি শাইবা)

ফায়দা: এ হাদীস দ্বারা জানা গেলো যে, যে ব্যক্তির দায়িত্বে ধর্মীয় কোন কাজ নেই, তার উচিত উপার্জনের বৈধ কোন কাজে লিপ্ত থাকা। বেকার জী্বন কাটাবে না। তবে ধর্মের কাজে রত ব্যক্তিদের দায়িত্ব খোদ আল্লাহর উপর। তারা জীবিকার ফিকির করবে না।

এ পর্যন্ত আয়ের আলোচনা ছিলো। সম্মুখে ব্যয়ের আলোচনা করা হচ্ছে।

১৯. হযরত মুগীরা (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সম্পদ নষ্ট করাকে অপছন্দ করেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)

ফায়দা: সম্পদ নষ্ট করার অর্থ অনুপযুক্ত স্থানে ব্যয় করা। যার কিছু বিবরণ এক নম্বর হাদীসের অধীনে আলোচিত হয়েছে।

২০. হযরত আনাস, আবু উমামা, হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘মধ্যপন্থায় চলা (অর্থাৎ, কৃপণতাও না করা এবং অপচয়ও না করা। বরং বুঝে- শুনে নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে হাতে রেখে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যের সঙ্গে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যয় করা) অর্ধেক উপার্জন। যে ব্যক্তি (ব্যয়ের ক্ষেত্রে এভাবে) মধ্যম পন্থায় চলবে, সে অভাবী হবে না, আর অপচয় করলে অধিক সম্পদও থাকে না।’ (মাকাসিদ, আসকারী, দায়লামী)

ফায়দা: এ হাদীসে ব্যয়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষার মূল রহস্য বলে দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতায়ও দেখা যায় যে, বেশীর ভাগ ধ্বংস ও পেরেশানীর কারণ হয়ে থাকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্কলা রক্ষা না করা। পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, হাতের যাবতীয় সম্পদ শেষ হয়ে যায়। তারপর ঋণ নিতে থাকে, যার মন্দ ফল অসংখ্য। দুনিয়াতেও- যা অভিজ্ঞতায় দেখা যায়- আবার আখিরাতেও, যেমন পরবর্তী হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

২১. হযরত আবদুল্লাহ বিন জাহাশ (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঋণ (অর্থাৎ, কারো অর্থনৈতিক হক, যা অন্যের দায়িত্বে থাকে) সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
‘যেই সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! যদি কোন ব্যক্তি জিহাদে শহীদ হয়ে যায়, পুনরায় জীবিত হয়ে আবার শহীদ হয়ে যায়, পুনরায় জীবিত হয়ে (তৃতীয়বার) শহীদ হয়ে যায়, আর তার দায়িত্বে কারো ঋণ থাকে, তাহলে ঐ ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত সে জান্নাতে যাবে না।’ (তারগীব, নাসায়ী, তাবরানী, হাকিম)

ফায়দা: তবে যে ঋণ এমন কোন প্রয়োজনে নেওয়া হয়েছে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতেও প্রয়োজন বলে বিবেচিত এবং তা পরিশোধ করার চিন্তাও সবসময় থাকে এমন ঋণ নেওয়ার অনুমতি রয়েছে।

এ সকল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, সম্পদের আয়-ব্যয় যদি শরীয়ত অনুপাতে হয়, তাহলে তা আল্লাহ তাআলার একটি নেয়ামত। এতে কোন দোষ নেই। আর তা নিন্দিত হয় ঐ সময়, যখন তার আয়-ব্যয় শরীয়ত পরিপন্থী হয়। যেমনঃ বিভিন্ন হাদীসে বিবাহ করা ও বংশ বৃদ্ধির তাকীদও এসেছে (যার বিবরণ পরবর্তী রূহে আসছে)। আবার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে শত্রুও বলা হয়েছে। (যেমন সূরা তাগাবুনে এসেছে) অর্থাৎ, যখন তারা আখিরাতে কাজে বাধা দেয়। (যেমন, জালালাইন শরীফের তাফসীরে এসেছে)। একই অবন্থা সম্পদেরও। এ কারণেই এগুলো ফেতনা হওয়ার আলোচনা করতে গিয়ে (সূরা তাগাবুনে) সম্পদ ও সন্তানকে যুগপৎভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিধায় আখিরাত থেকে গাফেল করলে সন্তান ও সম্পদের অবস্থা একই। তাই আল্লাহ তাআলার নেয়ামতসমূহ খুব করে উপভোগ করো। তবে আল্লাহর দাস হয়ে বিদ্রোহী হয়ে নয়।

এ সমস্ত হাদীস মেশকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত এবং এর বাইরে যে কয়টি হাদীস আছে, তার সাথে মূল উৎস গ্রন্থের নামও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।