উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হায়াতুল মুসলিমীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

জাতীয় স্বকীয়তা বলতে নিজের পোশাক-আশাক, বেশ-ভুষা, চলন-বলন, আচার-আচরণ ইত্যাদি ভিন্নধর্মীদের থেকে ভিন্নতর রাখাকে বুঝায়। অন্যান্য জাতির বেশ-ভুষা ও আচার-আচরণ ও স্বভা্ব-চরিত্র বিনা প্রয়োজনে গ্রহণ করতে শরীয়ত নিষেধ করেছে। উপরন্ত্ত এর মধ্যে কিছু বিষয় তো এমনও রয়েছে যে, সেগুলো বিজাতির বৈশিষ্ট্য যদি নাও হয়, তবুও গুনাহের কাজ। যেমন, দাড়ি মুন্ডানো বা এক মুঠের (চেয়ে ছোট থাকতে বা ছোট করে) কাটা, হাঁটুর উপরে পায়জামা বা (শুধু) জাঙ্গিয়া পরিধান করা। কারণ, এগুলো সর্বাবস্থায় নাজায়েয। এর সাথে সাথে যদি শরীয়তসম্মত বেশ-ভুষাকে তুচ্ছ মনে করে বা তাকে নিন্দনীয় মনে করে, তাহলে তো সাধারণ গুনাহ থেকে অতিক্রম করে কুফুরী গুনাহ হয়ে যাবে।

আর কিছু বিষয় এমন রয়েছে, যেগুলো বিজাতির বৈশিষ্ট্য রুপে থাকলে তো গুনাহের কাজ হবে, আর তা না থাকলে গুনাহের কাজ হবে না। বিজাতির বৈশিষ্ট্য না হওয়ার পরিচয় হলো, সেগুলো দেখার দ্বারা সাধারন লোকদের মনে এ খটকা সৃষ্টি হয় না যে, এই বেশ বা পোশাক তো অমুক জাতির লোকদের। যেমন, আচকান বা শেরওয়ানী পরিধান করা। যতক্ষণ এগুলো বিজাতির বৈশিষ্ট্যরুপে থাকবে, ততক্ষণ নিষেধ করা হবে। যেমন, আমাদের দেশে কোট-প্যান্ট, বিজাতীয় জুতা বা ধুতি পরিধান করা। নারীদের জন্য ঘাগরা পরিধান করা ইত্যাদি।

আর যে সমস্ত জিনিস বিজাতির শুধুমাত্র জাতীয় পোশাক ও বেশ-ভুষার অন্তর্ভুক্ত তাদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য নয়-যেমন, কোট-প্যান্ট ইত্যাদি, বা জাতীয় বেশ ভুষার অন্তর্ভুক্ত নয় তবে তাদের স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত, যেমন-চেয়ার টেবিলে বা ছুরি-কাঁটা দ্বারা আহার করা-এগুলো গ্রহণ করায় শুধু গুনাহই হবে, কোথাও কম কোথাও বেশী। তবে কুফুরী হবে না। আর যে সমস্ত জিনিস বিজাতির ধর্মীয় প্রতীক বা বেশ-ভুষার অন্তর্ভুক্ত, সেগুলো অবলম্বন করায় কুফুরী গুনাহ হবে। যেমন, ক্রুশ ঝুলান, মাথায় টিকি রাখা, পইতা বাঁধা, কপালে তিলক লাগান, জয়ধ্বনি করা ইত্যাদি।

যে সমস্ত জিনিস বিজাতির জাতীয় বেশিষ্ট্য নয় এবং ধর্মীয় প্রতীকও নয়- যদিও সেগুলো তাদের আবিষ্কৃত এবং সাধারণ প্রয়োজনীয় বস্ত্ত-যেমন, দিয়াশলাই, ঘড়ি, হালাল ঔষধ, বিভিন্ন বাহন বা প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি-যেমন, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বা আধুনিক অস্ত্র বা আধুনিক ব্যায়াম-যেগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে নেই-সেগুলো ব্যবহার করা জায়েয। তবে গানবাদ্যের যন্ত্র-যেমন, গ্রামোফোন, হারমোনিয়াম ইত্যাদি জায়িয নয়। জায়েয বস্ত্তসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা করবে না, বরং আলেমদের থেকে জিজ্ঞাসা করে নিবে।

মুসলমানদের মধ্যে যারা পাপাচারী বা বিদ’আতী-সে বিদআত দ্বীনের বেশে হোক বা দুনিয়ার বেশে-তাদের বেশ-ভুষা অবলম্বন করা গুনাহের কাজ। যদিও কাফেরদের বেশ-ভুষা গ্রহণের চেয়ে এতে কম গুনাহ হবে। বরং পুরুষ নারীর বেশ ধারণ করা বা নারী পুরুষের বেশ ধারণ করাও গুনাহের কাজ।

নিষিদ্ধ বেশ-ভুষা পরিপূর্ণরুপে ধারণ করলে অধিক গুনাহ হবে, আর আংশিক ধারণ করলে কম গুনাহ হবে। এ বিষয়টি শরীয়ত নির্দেশিত যেমন, তেমনি আবার বিবেকসম্মতও। কারণ, পুরুষ হয়ে নারীর বেশ ধারণ করা প্রত্যেকে নিজের বিবেকেও খারাপ মনে করে। অথচ উভয়েই মুসলমান ও নেককার। তাহলে যে ক্ষেত্রে মুসলমান ও কাফেরের পার্থক্য বা নেককার ও বদকারের পার্থক্য সেখানে কাফির বা ফাসেকের বেশ-ভুষা ধারণ করা কার বিবেক অনুমতি দিতে পারে?

এখন এ প্রসঙ্গে কিছু আয়াত ও হাদীস লিখছি।

১. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘(শয়তান বললো যে,) এবং আমি তাদেরকে (আরো এমন সব বিষয়) শিক্ষা দিবো, যার কারণে তারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করবে। (যেমন, দাড়ি কামানো, দেহে উল্কি আঁকা ইত্যাদি)।’ (সূরা নিসা-১১৯)

ফায়দা: কিছু পরিবর্তন তো এমন আছে যে, যার দ্বারা আকৃতির পরিবর্তন ঘটে, তা হারাম। যেমন, উপরে তার অনেকগুলো দৃষ্টান্ত লেখা হয়েছে, আর কিছু পরিবর্তন আছে এমন, যার দ্বারা আকৃতি গড়ানো হয়, তা ওয়াজিব। যেমন, মোচ খাটো করা, বোগল ও নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করা। আর কিছু পরিবর্তন আছে জায়েয। যেমন, পুরুষের মাথার চুল নেড়ে করা বা কাটা, এক মুঠের বেশী(লম্বা) দাড়ি কাটা। কোন পরিবর্তন কোন ধরনের অন্তর্ভুক্ত তার ফয়সালা শরীয়ত দ্বারা করতে হবে, প্রচলন দ্বারা নয়। কারণ, প্রথমতঃ প্রচলনের স্তর শরীয়তের সমান নয়। দ্বিতীয়তঃ একেক জায়গার প্রচলন একেক রকম। তাছাড়া প্রত্যেক যুগে প্রচলনের পরিবর্তনও ঘটতে থাকে।

২. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘(আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী) জালেমদের দিকে (বন্ধুত্ব ও অনুসরণ-অনুকরণ করে) ঝুঁকে যেয়ো না। (যদি তোমরা এমন করো, তাহলে জেনে রেখো।) জাহান্নামের আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে।’ (সূরা হুদ-১১৩)

ফায়দা: এ কথা নিশ্চিত যে, নিজেদের পন্থা-পদ্ধতি ও বেশ-ভুষা পরিত্যাগ করে বিজাতির পন্থা-পদ্ধতি ও বেশ-ভুষা স্বেচ্ছায় কেউ তখনই গ্রহণ করে, যখন সে দিকে তার মন ধাবিত হয়। আর অবাধ্যদের দিকে ধাবিত হওয়ার উপর দোযখের ধমকি এসেছে। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, এমন বেশ-ভুষা ও পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করা গুনাহ।

৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার দেহে কুসুম রঙ্গের দু’টি কাপড় দেখে ইরশাদ করেন-এগুলো কাফিরদের কাপড়ের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো পরো না।

ফায়দা: এ ধরনের কাপড় পুরুষদের জন্য এমনিতেও হারাম। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পেছনে উপরোক্ত কারণটিও উল্লেখ করেছেন। এতে জানা গেলো যে, এ ধরনের কাপড় হারাম হওয়ার পেছনে এ কারণটিরও প্রভাব রয়েছে। তাই এ কারণটি যেখানেই পাওয়া যাবে, তারও এই একই বিধান হবে।

৪. হযরত রুকানা (রাযিঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘টুপির উপর পাগড়ী থাকা আমাদের এবং মুশরিকদের মধ্যে পার্থক্য।’ (তিরমিযী)

ফায়দা: মিরকাত গ্রন্থে এ হাদীসের অর্থ এই আছে যে, আমরা টুপির উপর পাগড়ী বাঁধি, আর মুশরিকরা শুধু পাগড়ী বাঁধে।

৫. হযরত ইবনু উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি (বেশ-ভুষা প্রভৃতিতে) কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আহমাদ, আবু দাউদ)

ফায়দা: অর্থাৎ, যদি কাফির-ফাসিকদের বেশ-ভুষা অবলম্বন করে, তাহলে এ গুনাহে তাদের অংশীদার হবে।

৬. হযরত আবু রায়হানা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশটি জিনিস থেকে দশটি জিনিস থেকে বারণ করেছেন (তার মধ্যে এটিও আছে যে,) এবং কাপড়ের নীচে অনারবদের ন্যায় রেশম লাগানো বা কাঁধের উপর অনারবদের ন্যায় রেশম লাগানো থেকেও নিষেধ করেছেন।… (আবু দাউদ, নাসায়ী)

ফায়দা: এ হাদীসের ব্যাখ্যায়ও ঐ কথাই প্রযোজ্য-যা তিন নম্বরের ব্যাখ্যায় চলে গেছে।

৭. হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহ তাআলা লা’নত করুন ঐ সমস্ত পুরুষের উপর, যারা নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং ঐ সমস্ত নারীর উপর যারা পুরুষদের অবলম্বন করে বানায়।’ (বুখারী)

৮. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ পুরুষের উপর অভিসম্পাত করেছেন, যে নারীদের ন্যায় পোশাক পরে এবং ঐ নারীর উপর অভিসম্পাত করেছেন, যে পুরুষদের পোশাক পরে।’ (আবু দাউদ)

৯. হযরত ইবনে আবি মুলাইকা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে- ‘হযরত আয়েশা (রাযিঃ) কে বলা হলো যে, জনৈকা মহিলা (পুরুষালী) জুতা পরিধান করে। তিনি বললেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষবেশী নারীদের উপর অভিসম্পাত করেছেন।’
(আবু দাউদ)
ফায়দা: বর্তমানে মহিলাদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। আবার কেউ কেউ তো ইংরেজী জুতা পরিধান করে। যে কারণে দ্বিগুণ গুনাহ হয়। এক. পুরুষের বেশ ধারণ করা, দুই. বিজাতির বেশ ধারণ করা।

১০. হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) হতে বর্নিত আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করুন-চুলের মধ্যে চুল সংযোগকারীদের উপর এবং যারা এটা করায় তাদের উপর (এর দ্বারা ধোঁকা দেওয়া উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে, দর্শকরা দীর্ঘ চুলধারী মনে করবে) এবং উল্কি অংকনকারী এবং যারা উল্কি অংকন করায় তাদের উপর। (বুখারী ও মুসলিম)

ফায়দা: পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই বিধান।

১১. হযরত হাজ্জাজ বিন হাসসান (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে-‘আমরা হযরত আনাস (রাযিঃ) এর খেদমতে যাই। (হাজ্জাজ তখন শিশু ছিলেন। তিনি বলেন যে,) আমার বোন মুগীরা আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, তুমি তখন শিশু ছিলে, তোমার (মাথার উপর) চুলের দু’টি ঝুটি বা টিকি ছিলো। হযরত আনাস (রাযিঃ) তোমার মাথার উপর হাত ফিরালেন এবং বরকতের দু’আ করলেন এবং বললেন-এগুলোকে মুন্ডিয়ে ফেলো বা কেটে ফেলো। কারণ, এটা ইহুদীদের বেশ। (আবু দাউদ)

১২. আমের বিন সা’আদ (রাযিঃ) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘নিজের বাড়ীর আঙ্গিনাকে পরিষ্কার রাখো। ইহুদী সদৃশ হয়ো না। (তারা নোংরা থাকতো।)’ (তিরমিযী)

ফায়দা: যখন ঘরের বাইরের আঙ্গিনা অপরিষ্কার রাখা ইহুদীদের সাদৃশ্যের কারণে নাজায়িজ, তখন নিজের পোশাক-পরিচ্ছদে সাদৃ্শ্য কি করে জায়িয হবে।

১৩. হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- (অজ্ঞ) বেদুঈনরা যেন মাগরিব নামাযের নামের ক্ষেত্রে তোমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করে। বেদুঈনরা মাগরিবকে ইশা বলতো। (অর্থাৎ, তোমরা ইশা বলো না, মাগরিব বলো) তিনি আরো ইরশাদ করেন-(অজ্ঞ) বেদুঈন লোকেরা যেন ইশার নামাযের নামের ক্ষেত্রে তোমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করে। কারণ, আল্লাহর কিতাবে এর নাম ‘ইশা’ রয়েছে। (বেদুঈনরা একে ‘আতামা’ বলতো। কারণ, আতামা অর্থাৎ, অন্ধকারে উটের দুধ দোহন করা হতো।)’ (মুসলিম)

ফায়দা: এতে জানা গেলো যে, কথাবার্তায়ও বিনা প্রয়োজনে তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা উচিত নয়, যারা দ্বীন সম্পর্কে অবগত নয়।

১৪. হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে আরবীয় ধনুক বিদ্যমান ছিলো। তিনি এক ব্যক্তির হাতে পারস্যের ধনুক দেখতে পেলেন। তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন-এটি ফেলে দাও এবং (আরবীয় ধনুকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন) এটি এবং এর অনুরুপ নাও। (ইবনে মাজা)

ফায়দা: পারস্যের ধনুকের পরিবর্তে আরবীয় ধনুক ছিলো। তাই ওটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। এতে জানা গেলো যে, ব্যবহার্য বস্ত্তসমূহে বিজাতীয় সাদৃশ্য পরিহার করা উচিত। যেমন, কাঁসা ও পিতলের পাত্র কোন কোন জায়গায় বিজাতিদের বৈশিষ্ট্য।

১৫. হযরত হুযায়ফা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- আরবদের বাচনভঙ্গি ও সূরে কুরআন পাঠ করো (অর্থাৎ, বিশুদ্ধ ও অকৃত্রিম আঙ্গিকে) এবং নিজেদেরকে প্রেমিকদের বাচনভঙ্গি এবং উভয় কিতাবধারী সম্প্রদায় (অর্থাৎ, ইহুদী ও খৃষ্টান) এর বাচনভঙ্গি থেকে দূরে রাখো।’ … (বাইহাকী, রাযীন)

ফায়দা: জানা গেলো যে, পড়ার ক্ষেত্রেও বিজাতি ও শরীয়ত পরিপন্থী লোকদের সাদৃশ্য থেকে বাঁচা উচিত।

১৬. এক ব্যক্তি বর্ণনা করে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস আবু জাহেলের মেয়ে উম্মে সা’য়ীদকে ধনুক ঝুলিয়ে পুরুষদের ভঙ্গিতে পথ চলতে দেখতে পেলেন। হযরত আবদুল্লাহ (রাযিঃ) জিজ্ঞাসা করলেন-এটি কে? আমি বললাম- এটি আবু জাহেল কন্যা উম্মে সা’য়ীদ। তিনি বললেন-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-এমন ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে নারী হয়ে পুরুষদের অবলম্বন করে। বা পুরুষ হয়ে নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। (তারগীব, আহমাদ, তাবরানী)

১৭. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-যে ব্যক্তি আমাদের মত নামায পড়ে, আমাদের কিবলার দিকে মুখ করে এবং আমাদের জবাইকৃত পশু ভক্ষণ করে, সে এমন মুসলমান, যার জন্য আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের জিম্মাদারী রয়েছে। তাই তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারীতে খিয়ানত করো না। (অর্থাৎ, তার ইসলামী অধিকার নষ্ট করো না।)’ (বুখারী)

ফায়দা: এতে জানা গেলো যে, যে সমস্ত খাদ্যবস্ত্ত মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য, সেগুলো খাওয়াও নামায প্রভৃতির ন্যায় ইসলামের নিদর্শন। তাই কিছু মানুষ যে বিনা কারণে কারো খাতিরে গরুর গোশত খাওয়া পরিহার করে তা অপছন্দনীয় হওয়ার বিষয়টি এ হাদীস দ্বারা জানা গেলো।
নিম্নেক্তে আয়াতের শানে নুযুলও এ বিষয়টি প্রমাণ করে।
‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণরুপে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করো।’ (সূরা বাকারা-২০৮)

মোটকথা, সর্ববিষয়ে ইসলামী পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। দ্বীনী বিষয়েও এবং দুনিয়াবী বিষয়েও, সুতরাং হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে-

১৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
‘বনী ইসরাঈল বায়াত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিলো, আর আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত। একটি দল ছাড়া সব কয়টি জাহান্নামে যাবে। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো-সে দল কোনটি? (যেটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে?) তিনি ইরশাদ করলেন-যে (দল) ঐ পদ্ধতির উপর থাকবে যার উপর আমি এবং আমার সাহাবীগণ রয়েছি।’ (তিরমিযী)

ফায়দা: পদ্ধতি দ্বারা ওয়াজিব পদ্ধতি বুঝানো হয়েছে। যার বিরুদ্ধাচরণে দোযখের ভয় রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পদ্ধতির ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট করে দেননি। তাই এর মধ্যে দ্বীন এবং দুনিয়া উভয় বিষয় চলে এসেছে। তবে কোন বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের পদ্ধতি হওয়া এবং তা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারটি কখনও তার উক্তি দ্বারা জানা যায় যে, কখনও তার কর্ম দ্বারা। কখনও ‘নস’ অর্থাৎ, পরিষ্কার ভাষ্য দ্বারা, কখনও ‘ইজতিহাদ’ এবং ইঙ্গিত দ্বারা জানা যায়। যা কেবলমাত্র আলেমগণই বুঝতে পারেন। সাধারণ লোকদের জন্য আলেমদের অনুসরণ ছাড়া উপায় নেই। তাদের অনুসরণ করা ছাড়া (সাধারণ গায়রে আলেম) লোকদের দ্বীন রক্ষা পেতে পারে না।

শেষ কথা:

যে সমস্ত আমলের তালিকা ভূমিকায় উল্লেখিত হয়েছে-চিন্তা করলে তার প্রত্যেকটি এ পঁচিশ রূহে উল্লেখিত বিষয়সমূহের মধ্যে পেয়ে যাবে। কোনটা সংক্ষিপ্তাকারে, কোনটা বিস্তারিতভাবে। তাই এখন কিতাব শেষ করছি। তবে কারো মস্তিষ্কে অন্য কোন আমলের চাহিদা উদয় হলে বা এর কোন অংশের বিস্তারিত আলোচনা উপকারী মনে হলে, তা এ কিতাবের উপসংহাররুপে যোগ হতে পারে।

কৃতজ্ঞতা:

১৯. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমার পক্ষ থেকে পৌঁছিয়ে দাও, যদি একটি আয়াতও হয়।’ (বুখারী)

২০. হযরত আবুদ দারদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি দ্বীনের বিধান সংক্রান্ত চল্লিশটি হাদীস সংরক্ষণ করে আমার উম্মতের নিকট তুলে ধরবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ‘ফকীহ’ রুপে উঠাবেন। এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য সুপারিশকারী ও সাক্ষী হবো।’ (বাইহাকী)

আলহামদুলিল্লাহ! এ কিতাবে নব্বয়ের অধিক আয়াত এবং তাকরারহীন ও ‘মরফু’ (অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি বর্ণিত) ৩৪০টির অধিক হাদীসের তাবলীগ হয়ে গেলো। কোন ব্যক্তি যদি এ কিতাব ছাপিয়ে বিতরণ করে, এ সওয়াব সেও লাভ করবে। যেগুলোতে কোন কিতাবের নাম লেখা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া বাকী হাদীসগুলো মিশকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত।