ইবাতদ-বন্দেগী ও নেক আমলের দুনিয়াবী উপকারিতার বর্ণনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: জাযাউল আ’মাল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
নেক আমলের যে সমস্ত উপকারিতা ইতিপূর্বে আনুসাঙ্গিক বা প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখিত হয়েছে, বা বুঝতে পারা গিয়েছে, সেগুলো ছাড়া অন্যান্য উপকারিতার বর্ণনা। এ অধ্যায়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-১: ইবাদতের দ্বারা রিযিক বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের নিকট যে কিতাব এখন নাযিল করা হয়েছে অর্থাৎ, কুরআন কায়েম রাখতো’-অর্থাৎ, সেগুলোর উপর পরিপূর্ণরুপে আমল করতো। তাওরাত ও ইঞ্জীলের উপর আমল করা এটাই যে, তাওরাত ও ইঞ্জীলের অঙ্গিকারমত মুহাম্মাদুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনতো এবং তার অনুসরণ করতো, তাহলে অবশ্যই তারা তাদের উপর থেকে এবং পদতল থেকে খাবার খেতো। উপর থেকে খাবার খাওয়ার অর্থ, বৃষ্টি হতো এবং নীচে থেকে খাবার খাওয়ার অর্থ ফসল উৎপাদিত হতো। এ আয়াত দ্বারা স্পষ্টরুপে জানা গেলো যে, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী আমল করলে রিযিক বৃদ্ধি পায়। (সূরা মায়িদা-৬৬)
অনুচ্ছেদ-২: আল্লাহর হুকুম মানার দ্বারা বিভিন্ন ধরনের বরকত লাভ হয়ে থাকে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং পরহেযগারী অবলম্বন করতো, তাহলে অবশ্যই আমি তাদের উপর আসমান ও জমিন থেকে বহুসংখ্যক বরকত (-এর দ্বার) খুলে দিতাম; কিন্ত্ত তারা তো মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, ফলে তাদের কৃতকর্মের দরুন তাদেরকে পাকড়াও করলাম।’ (সুরা আ’রাফ-৯৬)
এ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বন্দেগীর দ্বারা নানা প্রকারের বরকত লাভ হয়ে থাকে।
অনুচ্ছেদ-৩: ইবাদত করার দ্বারা সব ধরনের দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য মুক্তির পথ করে দেন, অর্থাৎ, সে সর্বপ্রকার জটিলতা ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি লাভ করে। এবং এমন জায়গা থেকে তাকে রিযিক দান করেন, যা সে ধারণাও করে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক-২-৩)
এ আয়াত দ্বারা জানা গেলো যে, তাকওয়ার বরকতে সমস্ত জটিলতা থেকে মুক্তি লাভ হয়।
অনুচ্ছেদ-৪: বন্দেগী করার দ্বারা উদ্দেশ্যে সাধন সহজ হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য তার কাজকে সাহজসাধ্য করে দেন।’
(সূরা তালাক-৪)
এ আয়াত দ্বারা উপরোক্ত বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
অনুচ্ছেদ-৫: ইবাদত করার দ্বারা জীবন আনন্দপূর্ণ হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি নেক কাজ করবে, সে পুরুষ হোক, চাই নারী-যদি সে ঈমানদার হয়- তবে আমি তাকে অবশ্যই পূত-পবিত্র জীবন দান করবো।’ (সূরা নাহাল-৯৭)
অর্থাৎ, আমি তাকে সুখময় ও শান্তিময় জীবন দান করবো।
বাস্তবিকই পরিষ্কার দেখা যায় যে, এমন ব্যক্তিদের মত সুখ-শান্তি রাজা-বাদশাহদেরও ভাগ্যে জোটে না।
অনুচ্ছেদ-৬: ইবাদত করার দ্বারা বৃষ্টি হয়। সম্পদ বৃদ্ধি পায়। সন্তান হয়। বাগান ফলে ভরে যায়। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর প্রবাহমান বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন এবং তোমাদেরকে বাগানসমূহ ও নহরসমূহ দান করবেন।’
(সূরা নুহ ১০-১২)
অনুচ্ছেদ-৭: ঈমান গ্রহণ করার দ্বারা কল্যাণ ও বরকতসমূহ নসীব হয় এবং সবধরনের বিপদ কেটে যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের উপর থেকে (সব ধরনের বিপদাপদ) হটিয়ে দেন।’
(সূরা হাজ্জ-৩৮)
আল্লাহ তাআলা ঈমানদারগণের সহায় ও সাহায্যকারী হন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের সাহায্যকারী।’ (সূরা বাকারা-২৫৭)
আল্লাহ তাআলা ঈমানদারগণের অন্তরকে দৃঢ় রাখার জন্য ফেরেশতাদেরকে হুকুম করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘(তোমরা ঐ সময়কে স্মরণ করো) যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদরেকে হুকুম করেছিলেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি। তাই তোমরা ঈমানদারদেরকে দৃঢ়পদ রাখো।’ (সূরা আনফাল-১২)
প্রকৃত সম্মান লাভ হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহর জন্য ইজ্জত এবং তার রাসূল ও ঈমানদারদের জন্য।’ (সূরা মুনাফিকুন-৮)
পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, যারা তোমাদের মধ্যে ঈমান গ্রহণ করেছে।’
(সূরা মুজাদালা-১১)
সকলের অন্তরে তার ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, অতিসত্বর আল্লাহ তাআলা (সকলের অন্তরে) তাদের মুহাব্বত সৃষ্টি করে দিবেন।’ (সূরা মারয়াম-৯৬)
একটি হাদীসেও এ বিষয়টি এসেছে যে, আল্লাহ তাআলা যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন প্রথমে ফেরেশতাদের হুকুম করা হয় যে, অমুককে ভালোবাসে। তারপর পৃথিবীতে এ কথার ঘোষণা দেওয়া হয়-
ফলে পৃথিবীতে তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। তার গ্রহণযোগ্যতার প্রভাব এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় যে, জীবজন্ত্ত ও জড়বস্ত্তসমূহ পর্যন্ত তার আনুগত্য করতে থাকে।
কবি বলেন-
‘তুমি তার হুকুমের অবাধ্য হয়ো না। তাহলে কেউ তোমার অবাধ্য হবে না।’
কুরআন শরীফ তার ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ের কারণ হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আপনি বলে দিন যে, এ কুরআন ঈমানদারদের জন্য হিদায়াত ও শিফা তথা পথনির্দেশ ও রোগ নিরাময়ের কারণ।’ (সূরা হা-মীম সিজদা-৪৪)
একইভাবে ঈমানের বদৌলতে সমস্ত কল্যাণ ও নিয়ামত লাভ হয়। ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসসমূহ খুঁজে দেখলে এ দাবী সত্যায়িত হবে।
অনুচ্ছেদ-৮: ইবাদত করার দ্বারা সম্পদের ক্ষতির ক্ষতিপূরণ হয় এবং তার উত্তম বিনিময় লাভ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘হে নবী! যে সমস্ত বন্দী আপনার হাতে এসেছে, তাদেরকে আপনি বলে দিন যে, যদি আল্লাহ তাআলা তোমাদের অন্তরে ঈমান আছে জানতে পারেন- তাহলে তোমাদের থেকে (মুক্তিপণ স্বরুপ) যে মাল নেওয়া হয়েছে-এর চেয়ে উত্তম মাল তিনি তোমাদেরকে দান করবেন এবং তোমাদের গুনাহও মাফ করে দিবেন। আল্লাহ তাআলা বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা আনফাল-৭০)
ফায়দা: উপরোক্ত আয়াত বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, তাদের থেকে মুক্তিপণ স্বরুপ কিছু মাল নেওয়া হয়েছিলো। এ আয়াতে তাদের সঙ্গে ওয়াদা করা হয় যে, যদি তোমরা খাঁটি মনে ঈমান আনো তাহলে তোমরা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী সম্পদ লাভ করবে। সুতরাং এমনটিই হয়েছিলো।
অনুচ্ছেদ-৯: আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করার দ্বারা তা অনেক (গুণ) বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহর সন্ত্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা যে যাকাত দান করে থাকো-তা (সম্পদকে) দ্বিগুণকারী।’ (সূরা রুম-৩৯)
অর্থাৎ, দুনিয়াতে তাদের সম্পদ এবং আখিরাতে তাদের প্রতিদান বৃদ্ধি পায়।
অনুচ্ছেদ-১০: ইবাদত করার দ্বারা অন্তরে এক প্রকারের শান্তি ও তৃপ্তি লাভ হয়। যার স্বাদের সম্মুখে সারা পৃথিবীর রাজত্বের সুখও ধূলিতুল্য।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘মনে রেখো! কেবলমাত্র আল্লাহর স্মরণেই মন শান্তি লাভ করে।’ (সূরা রা’দ-২৮)
এ প্রসঙ্গে আ’রেফ সিরাজী (রহঃ) বলেন-
অর্থ: ‘নিভৃত মনে এক প্রহর চন্দ্রমুখী প্রেমাষ্পদের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপণ, দিনভর অশান্তিময় রাজমুকুটের চেয়ে উত্তম।’
অপর এক বুযুর্গ নিমরোযের বাদশাহ সানজারকে উদ্দেশ্যে করে তার চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন-
অর্থ: ‘সানজারের বাদশাহের (কালো) মুকুটের ন্যায় আমার ভাগ্য কালো হোক, যদি আমার অন্তরে সানজারের রাজত্বের বাসনা জাগে। যখন থেকে নীমশব (অর্ধরাত্রির) রাজত্বের সন্ধান আমি লাভ করেছি। (তখন থেকে) আমি নীমরোজ (অর্ধদিবস) এর রাজত্বকে একটি যবের বিনিময়েও ক্রয় করবো না।’
জনৈক বুযুর্গ বলেন- আমরা যে অবস্থায় আছি, জান্নাতের লোকেরা যদি এমন অবস্থায় থেকে থাকে তাহলে তো তারা বড় স্বাদের জীবনে আছে।
অপর এক বুযুর্গ বলেন-আফসোস! এ হতভাগা দুনিয়াদাররা দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেলো, কিন্ত্ত তারা না সুখ দেখলো, না শান্তি।
আরেক বুযুর্গ বলেন- বাদশাহ যদি আমাদের স্বাদের বিষয়ে অবগত হয়, তাহলে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাদের উপর তরবারী পরিচালনা করবে।
কখনো আল্লাহর প্রেমের স্বাদের এ প্রাবল্য এই পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যে, তখন আল্লাহর প্রেমিকগণ একে জান্নাতের উপর প্রাধান্য দেয়। বরং আল্লাহর নৈকট্যের স্বাদ পেলে দোযখে যেতেও রাজী হয়ে যায়। আর এ স্বাদ বিনে বেহেশতকেও তুচ্ছ মনে করে।
আরেফ রুমী (রহঃ) বলেন-
অর্থ: প্রেমাষ্পদ সানন্দে যেখানেই বসবে তা পাতাল হলেও মহাকাশের ঊর্ধ্বে।
যেখানেই চন্দ্রমুখী ইউসুফ (প্রেমাষ্পদ) থাকবে তা কূপের তলদেশ হলেও বেহেশততুল্য।
হে হৃদয়কাড়া প্রেমাষ্পদ! তুমি থাকলে দোযখও বেহেশত। হে চিত্তহারী! তুমি বিনে বেহেশতও দোযখতুল্য।
তাই ভেবে দেখা দরকার কি অপূর্ব এ স্বাদ।
অনুচ্ছেদ-১১: ইবাদতের বরকতে ইবাদতকারীর সন্তানেরা পর্যন্ত উপকার পেয়ে থাকে।
আল্লাহ তাআলা খিযির (আঃ)-এর ঘটনা প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন-
‘(হযরত খিযির (আঃ) হযরত মূসা (আঃ)কে বললেন- আমি যে, সেই দেওয়ালটি বিনা পারিশ্রমিকে ঠিক করে দেই) সেই দেওয়ালটি ঐ শহরের দু’টি ইয়াতীম বালকের ছিলো, সেই দেওয়ালের নীচে তাদের ধনভান্ডার রয়েছে। আর তাদের পিতা ছিলেন নেককার লোক। তাই আপনার প্রতিপালক চাইলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পন করুক এবং তাদের ধনভান্ডার উত্তোলন করুক। এটি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ।’ (সূরা কাহাফ-৮২)
এ ঘটনা দ্বারা জানা গেলো যে, এ ছেলেদের সম্পদ হেফাযতের নির্দেশ খিযির (আঃ)-এর প্রতি এ কারণে হয় যে, এদের পিতা নেককার মানুষ ছিলেন। সুবহানাল্লাহ!
নেককাজের ভালো প্রভাব বংশধরদের উপরও হয়ে থাকে। বর্তমানে মানুষ সন্তানদের জন্য বিভিন্ন ধরণের আসবাব-পত্র, জায়গা-জমি, টাকা-পয়সা ইত্যাদি রেখে যাওয়ার চিন্তায় থাকে। কিন্ত্ত সবচেয়ে দামী সম্পদ হলো, নেক কাজ করা, যার বরকতে সন্তান-সন্ততি সব বিপদ-আপদ থেকে হেফাযতে থাকবে।
অনুচ্ছেদ-১২: ইবাদতের দ্বারা ইহজীবনে অদৃশ্য সুসংবাদ লাভ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘জেনে রেখো! আল্লাহর ওলীদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না। এরা ঐ সমস্ত লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করে। তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে দুনিয়ার জীবনেও এবং আখিরাতেও।’ (সূরা ইউনুস ৬২-৬৪)
হাদীস শরীফের মধ্যে এ আয়াতের ‘সুসংবাদ’ এর তাফসীর ভালো স্বপ্ন বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা মন আনন্দিত হয়। যেমন স্বপ্নে দেখলো যে, বেহেশতে চলে গেছে বা আল্লাহ তাআলার দর্শন লাভ হয়েছে বা এ জাতীয় অন্য কোন স্বপ্ন দেখলো, যার ফলে আশা শক্তিশালী এবং অন্তর পুলকিত হলো।
অনুচ্ছেদ-১৩: ইবাদতের কারণে মৃ্ত্যুর সময় ফেরেশতারা সুসংবাদ শোনায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যারা বলেছে যে, ‘আল্লাহ আমাদের প্রভু’ তারপর তার উপর অবিচল রয়েছে, (মৃত্যুর সময়) ফেরেশতাগণ তাদের নিকট অবতরণ করে বলেন- তোমরা ভয় করো না এবং দুশ্চিন্তা করো না এবং তোমরা বেহেশতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার ওয়াদা তোমাদেরকে করা হতো। দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতে আমরা তোমাদের সাথী ও সাহায্যকারী। এবং বেহেশতে তোমাদের জন্য রয়েছে ঐ সমস্ত জিনিস, যা তোমাদের মন কামনা করবে এবং তোমাদের জন্য সেখানে রয়েছে এ সমস্ত জিনিস, যা তোমরা চাইবে। ক্ষমাশীল দয়াবান আল্লাহর পক্ষ থেকে মেহমানদারী স্বরুপ এসব হবে। (সূরা হা-মীম সিজদা ৩-৩২)
লক্ষ্য করুন! বিজ্ঞ মুফাসসিরগণের তাফসীর অনুপাতে মৃত্যুর সময় ফেরেশতাগণ কত ধরনের সুসংবাদ শুনিয়ে থাকেন।
অনুচ্ছেদ-১৪: কোন কোন ইবাদত দ্বারা প্রয়োজনে পূরণে সহযোগিতা লাভ হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘ধৈর্য ও নামাযের দ্বারা (তোমাদের প্রয়োজন পূরণে) আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো।’
(সূরা বাকারা-৪৫)
হাদীস শরীফে এ সাহায্য প্রার্থনার একটি বিশেষ পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রহঃ), হযরত আবদুল্লাহ বিন আবি আউফা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-যে ব্যক্তির কোন অভাব বা প্রয়োজন দেখা দেয়-চাই তা আল্লাহ তাআলার নিকট হোক বা কোন মানুষের নিকট-সে খুব ভালো করে ওযু করবে এবং দু’রাকআত নামায পড়বে। তারপর আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করবে। উদাহরণস্বরুপ সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করলো। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরুদ পাঠ করবে।
অনুচ্ছেদ-১৫: কতক ইবাদতের ফল এই যে, কোন কাজ করলে ভালো হবে, নাকি না করলে- এই দ্বিধা দূর হয়ে সেদিকে সিদ্ধান্ত স্থির হয়, যার মধ্যে লাভই লাভ, ক্ষতির মোটেই সম্ভাবনা থাকে না। এভাবে যেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পরামর্শ লাভ হয়। ইমাম বুখারী (রহঃ) হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘যখন তোমদের কোন কাজে দ্বিধা হয়, অর্থাৎ, কোনটা ভালো হবে তা বুঝে না আসে-যেমন কোন ভ্রমনের ব্যাপারে সংশয় হলো যে, এতে লাভ হবে নাকি ক্ষতি, বা এরুপ অন্য কোন কাজে দ্বিধা হলো, তাহলে দুই রাকআত নফল নামায পড়বে।
অনুচ্ছেদ-১৬: কতক ইবাদতের ফলে সমস্ত বিষয়ের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেন। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হযরত আবুদ দারদা ও আবু যর (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –‘হে আদম সন্তান! দিনের শুরুভাগে আমার জন্য চার রাকআত নামায পড়ো, দিন শেষ হওয়া পর্যন্ত তোমার সব কাজ আমি সমাধা করে দেবো।’
অনুচ্ছেদ-১৭: কতক ইবাদতের ফলে ধনসম্পদে বরকত হয়। হাকীম ইবনে হিযাম (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
যদি ক্রেতা ও বিক্রেতা সত্য বলে এবং তার মালের প্রকৃত অবস্থা গোপন না করে তাহলে উভয়ের ব্যবসায় বরকত হয়, আর যদি মিথ্যা বলে এবং প্রকৃত অবস্থা গোপন করে তাহলে উভয়ের কারবারে বরকত বিলুপ্ত হয়।
হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-১৮: দ্বীনদারীর ফলে রাজত্ব টিকে থাকে। ইমাম বুখারী (রহঃ) হযরত মুআবিয়া (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি যে, ‘এ খেলাফত ও রাজত্ব কুরাইশদের হাতে থাকবে, যতদিন তারা দ্বীনের উপর অবিচল থাকবে। যে ব্যক্তি তাদের বিরোধীতা করবে আল্লাহ তাআলা তাকে অধঃমুখে পতিত করবেন।’
অনুচ্ছেদ-১৯: কতক আর্থিক ইবাদতের ফলে আল্লাহ তাআলার ক্রোধ নিভে যায় এবং অপমৃত্যু হয় না। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে-
‘দান-খয়রাত আল্লাহ তাআলার ক্রোধ নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু প্রতিহত করে।’ অর্থাৎ, যে মৃত্যুতে লাঞ্ছনা, অবমাননা বা মন্দ পরিণতি হয় তা প্রতিহত করে। নাউযুবিল্লাহ।
অনুচ্ছেদ-২০: দু’আ করার দ্বারা বিপদ কেটে যায় এবং নেককাজ করার দ্বারা বয়স বৃদ্ধি পায়। সালমান ফারসী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘দু’আই একমাত্র ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায় এবং নেককাজই একমাত্র বয়স বৃদ্ধি করে (আর এ পরিবর্তনও ভাগ্যেরই ফল, তাই এ হাদীস দ্বারা ভাগ্যের অস্বীকৃতি হয় না)
হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-২১: সূরা ইয়াসীন পড়ার দ্বারা সমস্ত কাজ সমাধান হয়। আতা ইবনে আবি রাবাহ (রাযিঃ)থেকে বর্ণিত আছে যে, আমার নিকট এ খবর এসেছে- যে ব্যক্তি দিনের প্রথম ভাগে সূরা ইয়াসীন পড়বে, তার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়া হবে।
হাদীসটি ইমাম দারামী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-২২: সূরা ওয়াকিয়াহ পড়ার ফলে উপবাস হয় না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তি প্রতি রাতে সূরা ওয়াকেয়াহ পড়বে তাকে কখনো উপবাস স্পর্শ করবে না।
হাদীসটি ইমাম বাইহাকী শুআবুল ঈমান গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-২৩: ঈমানের বরকতে অল্প খাওয়ায় পরিতৃ্প্তি হয়।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘এক ব্যক্তি খুব বেশী খাবার খেতো। সে মুসলমান হয়ে অল্প খেতে আরম্ভ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে বিষয়টির আলোচনা হলো। তখন তিনি ইরশাদ করলেন-‘ঈমানদার ব্যক্তি এক নাড়ীতে খায় আর কাফির সাত নাড়ীতে খায়।
হাদীসটি ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-২৪: কতক দু’আর বরকতে রোগ-ব্যাধি বা বালা-মুসীবত আসার ভয় থাকে না। হযরত উমর (রাযিঃ) এবং হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি কোন রোগাক্রান্ত বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখে নিম্নের দু’আটি পড়বে-সে কখনো ঐ রোগ বা বিপদে আক্রান্ত হবে না। সে রোগ বা বিপদ যে ধরনেরই হোক না কেন।
হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-২৫: কতক দু’আর বরকতে দুশ্চিন্তা দূর হয় এবং ঋণ পরিশোধ হয়। হযরত আবু সা’য়ীদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি নিবেদন করলো-ইয়া রাসূলুল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বহুবিধ চিন্তা ও ঋণ পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। তিনি ইরশাদ করলেন-তোমাকে কি এমন কথা শিখিয়ে দেবো না, যা পড়লে আল্লাহ তাআলা তোমার সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিবেন এবং তোমার ঋণও পরিশোধ করে দিবেন? সে ব্যক্তি বললো-খুব ভালো হয়। সেই ব্যক্তির বক্তব্য এই যে, আমি তাই করলাম। ফলে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তাও দূর হলো এবং ঋণও পরিশোধ হলো।
হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ-২৬: কতক দু’আর ফলে যাদু ইত্যাদির কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকা যায়। হযরত কা’বুল আহবার (রাযিঃ) বলেন যে, এ কয়টি কথা যদি আমি নিয়মিত না বলতাম তাহলে ইহুদীরা আমাকে গাধা বানিয়ে দিতো। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো-সেই কথাগুলো কি?
হাদীসটি ইমাম মালিক (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
এমনিভাবে ইবাদতের আরো অসংখ্য কল্যাণ ও উপকারিতা রয়েছে, যেগুলো কুরআন, হাদীস এবং দৈনন্দিনের ব্যাপারসমূহে চিন্তা করলে বুঝে আসবে। আমরা তো স্পষ্ট দেখতে পাই যে, যারা আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, তাদের জীবন এমন মধুময় ও আনন্দপূর্ণ যে, তার দৃষ্টান্ত রাজা-বাদশাহদের মধ্যেও পাওয়া যায় না। তাদের অল্প সম্পদে বরকত হয়। তাদের অন্তরসমূহ আলোকিত হয়। যা প্রকৃত আনন্দপোকরণ।
হে আল্লাহ! সবাইকে আপনার আনুগত্যের তাওফীক দান করুন এবং আপনার সন্ত্তষ্টি ও নৈকট্য প্রদান করুন। আমীন।
Leave a Reply