ভুল সংশোধনের আলোচনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: তা’লীমুদ্দীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
আধ্যাত্মিকতার পথে মানুষ অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি করে থাকে। তবে বর্তমান যুগে মানুষ যে সমস্ত ভুলের মধ্যে অধিক লিপ্ত, কয়েকটি পরিচ্ছেদে সেগুলোর সংশোধনী আলোচনা করা হচ্ছে।
পরিচ্ছেদ-১: ‘ফকিরীর পথে শরীয়তের অনুসরণ জরুরী নয়’
এই ভ্রান্তির নিরসন
‘ফুতুহাত’ গ্রন্থে আছে-
অর্থাৎ, যে হাকীকত শরীয়ত বিরোধী তা ধর্মহীনতা ও প্রত্যাখ্যাত (বাতেল)।
ঐ গ্রন্থে আরো আছে-
অর্থাৎ, আমাদের জন্য শরীয়তের পন্থা ছাড়া আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার অন্য কোন পন্থা নেই এবং আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার আমাদের জন্য একমাত্র পন্থা ঐটাই, যা তিনি শরীয়তে বলে দিয়েছেন।
ঐ গ্রন্থে আরো আছে-
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার শরীয়ত পরিপন্থী আধ্যাত্মিকতার আরো পথ রয়েছে, তাহলে তার কথা মিথ্যা। এ রকম শিষ্টাচারবর্জিত শাইখকে অনুসরণীয় বানাবে না।
হযরত বায়েযীদ (রহঃ) বলেন-
অর্থাৎ, তোমরা যদি এমন কাউকে দেখতে পাও, যাকে অনেক কারামত দেওয়া হয়েছে-এমনকি সে বাতাসে উড়ে-তাহলেও ধোঁকা খেয়ো না। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তের আদেশ-নিষেধ, সীমারেখা রক্ষা ও শরীয়তের অনুসরণের ক্ষেত্রে তাকে যাচাই করে না দেখো।
হযরত জুনায়েদ (রহঃ) বলেন-
অর্থাৎ, সমস্ত মাখলুকের জন্য সমস্ত পথ রুদ্ধ, কেবলমাত্র তার জন্যই পথ উন্মুক্ত, যে পদে পদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে।
‘ফুতুহাত’ গ্রন্থে আরো আছে-
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমের কোন মর্যাদা জানে না, আল্লাহর কাছে তার কোন মর্যাদা নেই। কারণ, আল্লাহ কোন জাহেলকে ওলী বানাননি। ঐ ‘ফুতুহাত’ গ্রন্থে আরো আছে যে, ইলমের সাথে অনর্থ করা উত্তম, অজ্ঞতার সাথে আমল করার চেয়ে।
তার কারণ হলো, একজন আলেম কোন মন্দ কথা বললেও তা এমন শরীয়তবিরোধী ও জঘন্য হয় না যে, কুফর ও শিরকের পর্যায়ে পৌঁছবে। তাছাড়া সে যেহেতু তার কথার খারাপ দিক সম্পর্কে অবগত তাই তাওবা করার আশা রয়েছে। পক্ষান্তরে জাহেল মানুষের অনেক সময় নামায-রোযার মত জরুরী আমলও ঠিক থাকে না, উপরন্ত্ত অজ্ঞতাবশত কুফর ও শিরক করে বসে। আর যেহেতু সে এর মন্দ দিক সম্পর্কে অবগত থাকে না, তাই তাওবাও করে না।
এ সম্পর্কিত বুযুর্গদের হাজারও উক্তি রয়েছে। কতটা লেখা সম্ভব? ‘কুশাইরিয়া’ গ্রন্থে হযরত যুন্নুন মিসরী, সারী সাকাতী, আবু সুলায়মান, আহমাদ বিন আবিল হাওয়ারী, আবু হাফস হাদ্দাদ, আবু উসমান নূরী এবং আবু সা’য়ীদ খাররায (রহঃ) থেকে এবং আরো অন্যান্য কিতাবের মধ্যেও-যেমন, হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর বাণী সংকলন ‘দালীলুল আরেফীন’, হযরত শাইখ কুতুবুল আলম আবদুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী (রহঃ) এর চিঠিপত্রের সংকলন ‘মাকতুবাতে কুদ্দুসীয়া’ এবং আবু তালিব মাক্কী (রহঃ)এর ‘কুতুল কুলুব’ প্রভৃতি কিতাবে এ বিষয়টি অত্যন্ত মজবুতভাবে উল্লেখিত ও উদ্ধৃত হয়েছে। যার দ্বারা জানা যায় যে, আধ্যাত্মিকতার পথে প্রথমতঃ শরীয়তের ইলম, তারপর শরীয়তের উপর আমল করা কঠোরভাবে জরুরী। এছাড়া সম্মুখের পথ উন্মোচিত হয় না। কখনই কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধীতা করে এবং বিদআতের পথ গ্রহণ করে আল্লাহর ওলী হতে পারে না। বিদআতই যেখানে পথ সংহারক, সেখানে কুফর ও শিরকের তো কোন কথাই নেই। বর্তমানে মানুষ ইলম ও আমলকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য দু’টি শব্দ মুখস্থ করে নিয়েছে। ইলম সম্পর্কে বলে যে, এটা ‘হিজাবে আকবার’ বা বড় পর্দা আর আমলের সম্পর্কে ‘আযাদী’ তথা স্বাধীনতার দাবী করে থাকে।
বন্ধুরা! ‘হিজাবে আকবারের’ যদি এ অর্থই হয়ে থাকে, তাহলে যত বুযু্র্গের নাম লেখা হয়েছে এরা সবাই মিথ্যুক, বরং পর্দার আড়ালে বলে সাব্যস্ত হয়। ‘হিজাবে আকবার’ একটি পারিভাষিক শব্দ। এর মূল তত্ত্ব অনেক সূক্ষ্ম। তবে স্থূলভাবে এর এ অর্থ বোঝো যে, ‘হিজাবে আকবার’ ঐ পর্দাকে বলে, যা বাদশাহের নিকটে ঝুলে থাকে। সেখানে পৌঁছে বাদশাহর অতীব নৈকট্য লাভ হয়। তাই ইলমকে ‘হিজাবে আকবার’ বলার মধ্যে তো ইলমের প্রশংসা রয়েছে। অর্থাৎ, যখন একজন মানুষ ইলম অর্জন করলো, তখন তার জন্য সমস্ত পর্দা উন্মোচিত হয়ে গেলো, এমনকি সে হিজাবে আকবার বা বড় পর্দার নিকট পৌঁছে গেলো। এখন একটি তাজাল্লি হলে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে এ পর্দাও উঠে যাবে। তখন সে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি লেখাপড়া করে বা আলেমদের সুহবতে থেকে ইলমই অর্জন করলো না, সে তো এখনও অনেক পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে। এবং আল্লাহ থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছে।
আর আমল সম্পর্কে যে তারা আযাদী বা স্বাধীনতার দাবী করে, কামনা ও গাফলতির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াই ‘আযাদী’ বা স্বাধীনতা। ‘আযাদী’ বা স্বাধীনতা পরমপ্রিয় আল্লাহ তাআলার বিধিবিধান থেকে মুক্ত হওয়ার নাম নয়। কবি বলেন-
অর্থঃ ‘তুমি যদি মনের স্বাধীনতা চাও তাহলে আল্লাহর দাসত্ব করো! দাসত্ব করো, দাসত্ব করো!
এ জীবনের লক্ষ্যই হলো, আল্লাহর দাসত্ব করা। যে জীবনে আল্লাহর দাসত্ব নেই, তা লজ্জার কারণ হবে।
আল্লাহর দাসত্ব, বিনয় ও তার জন্য ছটফট করা ছাড়া, আর কোন কিছুরই এখানে মূল্য নেই।
যে প্রেমের জীবন লাভ করেছে, তার জন্য দাসত্বমুক্ত জীবন কুফরী।
ইবাদতের পাখায় উড়তে চাইলে দাসত্বের রস-রুচি চাই। বীজ থেকে গাছ চাইলে বীজে শাস থাকা চাই।’
যদি এই সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, ‘ইলমে হাকীকত’ যদি ‘ইলমে শরীয়তের’ বিপরীতই না হবে, তাহলে বুযুর্গরা ইলমে হাকীকতের রহস্যকে কেন গোপন করেছেন? কারণ, শরীয়তের ইলম তো প্রকাশ করার জন্যই। এ প্রশ্নের উত্তর ভালো করে বুঝে নাও যে, আমাদের দাবী এটা নয় যে, ইলমে শরীয়ত ও ইলমে হাকীকত একই জিনিস। বরং আমাদের দাবী হলো, ইলমে হাকীকত ইলমে শরীয়তের বিপরীত নয়। অর্থাৎ, শরীয়ত একটি জিনিসকে হারাম বা কুফর বলেছে। হাকীকতের মধ্যে তা হালাল বা ঈমান হবে, তা নয়। যেমন, দেওয়ানীর আইন ভিন্ন, আর ফৌজদারীর আইন ভিন্ন। এর অর্থ এই নয় যে, দেওয়ানীর আইনে যেটা বৈধ, ফৌজদারীর আইনে তা অবৈধ বা এর বিপরীতে ফৌজদারীর আইনে যেটা বৈধ, দেওয়ানীর আইনে সেটা অবৈধ। তবে প্রত্যেকটির বিষয়বস্ত্ত অবশ্যই ভিন্ন। তাছাড়া শরীয়তের মধ্যেও যেমন বিভিন্ন বিষয়বস্ত্ত রয়েছে, তেমনি হাকীকতের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন বিষয়বস্ত্ত। কিন্ত্ত ঐ বিষয়বস্ত্ত শরীয়তের বিষয়বস্ত্তকে অস্বীকার করে, তা নয়।
এখন বোঝার বিষয় হলো, হাকীকতের ইলমকে গোপন রাখার কারন কী? তাহলে বুঝে নাও যে, গোপন করার মত বিষয় রয়েছে তিনটি। প্রথম হলো, ভেদের বিষয়সমূহ। ইমাম গাযযালী (রহঃ) ভেদের বিষয়সমূহকে গোপন করার অনেকগুলো কারণ লিখেছেন। যার সারকথা হলো, এ সমস্ত বিষয় শরীয়ত বিরোধী তো নয়, কিন্ত্ত অত্যন্ত সূক্ষ্ম, যা সাধারণ মানুষের বুঝে আসবে না, যার ফলে তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, আধ্যাত্মিকতার শিক্ষাদান পদ্ধতিসমূহ। এগুলো গোপন করার কারণ এই যে, এগুলো প্রকাশ করলে এগুলোর অবমূল্যায়ন হবে এবং অতিউৎসাহীরা এগুলোকে তামাশার পাত্র বানাবে।
গোপন করার তৃতীয় বিষয় হলো, সাধনার ফলসমূহ ও কাশফ ইত্যাদি। এগুলো গোপন করার কারণ হলো, এগুলো প্রকাশ করার মধ্যে রিয়া বা মানুষকে দেখানোর প্রবৃত্তি এবং নিজের বুযুর্গীর দাবীর সম্ভাবনা রয়েছে। মোটকথা, কোন বিষয়েই গোপন করার কারণ এটা নয় যে, তা শরীয়তবিরোধী। আর ধরে নাও যদি কোনটা এ রকমই হয়ে থাকে, তাহলে তা অগ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যাত সাব্যস্ত হবে।
সারকথা এই যে, আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সৌভাগ্য যার হয়, শরীয়ত ও সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমেই হয়। আর যদি কোন বুযুর্গ থেকে সুন্নাত বিরোধী কোন কাজ বা কথা বর্ণিত হয়ে থাকে, তা হয়তো ভাবোন্মত্ত অবস্থায় হয়েছে, অথবা ঐ বুযু্র্গের দিকে এ কথার সম্পর্ক মিথ্যাভাবে করা হয়েছে, কিংবা কোন সূক্ষ্ম মাসআলার ক্ষেত্রে শরীয়তের দলীল সূ্ক্ষ্ম হওয়ার ফলে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার ভুল হয়েছে। শরীয়ত তাকে এক্ষেত্রে মা’যুর বলে গণ্য করে। এর ফলে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হবে না। কিন্ত্ত আমাদের সমাজে তো মা’রেফাতের নামে শরীয়তের খোলামেলা বিরোধীতা, বরং শরীয়তকে অস্বীকার ও তার সঙ্গে ঠাট্রা ও উপহাস করা হয়, যা কুফরী কাজ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা জানা গেলো যে, শরীয়তবিরোধী কাজ করার কোন বৈধতা নেই। যেমন, কবরের চতুর্দিকে তওয়াফ করা, পীরকে সিজদাহ করা ইত্যাদি। এগুলোর আলোচনা মাসায়েল অধ্যায়েও এসেছে। আরো জানা গেলো যে, অতক্ষণ পর্যন্তই পীরের কথা মেনে চলা হবে, যতক্ষণ তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের বিরোধী না হবে। অন্যথায় ঐ পীরকেই ছেড়ে আসতে হবে। হযরত নূরী (রহঃ) বলেন-
অর্থঃ ‘যাকে দেখো যে, আল্লাহর নৈকট্যের ব্যাপারে এমন অবস্থার দাবী করে, যা তাকে শরীয়তের সীমারেখা থেকে বের করে দেয়, তার কাছেও যেয়ো না।’
শাইখ সা’দ উদ্দীন (রহঃ) ‘রিসালায়ে মাক্কিয়্যাহ’ কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থে লেখেন যে, যদি কোন জাহেল বা বিদআতী লোকের সাথে সম্পর্ক হয় বা তার হাতে বাতিলের পোশাক পরিধান করে, তাহলে পুনরায় হক্কানী পীরের কাছে যাবে এবং নতুন করে মুরীদ হবে, যাতে করে গোমরাহ হয়ে না যায়।
পরিচ্ছেদ-২: নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষতির বর্ণনা
‘জাওয়াহেরে গাইবী’ কিতাবে একটি ঘটনা লিখেছে যে, এক ব্যক্তি তওয়াফ করছিলো, আর বলছিলো-
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আপনার থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’
এক ব্যক্তি তার এভাবে দু’আ করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলে যে, একবার এক সুন্দর বালকের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। তখনই অদৃশ্যই থেকে এক চপেটাঘাত মারা হয়। যার ফলে আমার চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ইউসুফ বিন হুসাইন বলেন-
অর্থঃ ‘আমি সুফীদের বিপদ দেখেছি-বালকদের সঙ্গে মেলামেশা করার মধ্যে, ভিন্ন শ্রেণীর সঙ্গে একত্র হওয়ার মধ্যে এবং নারীদের সঙ্গে নরম ব্যবহার করার মধ্যে।’
শাইখ ওয়াসেতী বলেন-
অর্থঃ ‘যখন আল্লাহ তাআলা কোন মানুষের লাঞ্ছনা চান, তখন তিনি তাকে এ সমস্ত আবর্জনা ও বিগলিত বস্ত্তর দিকে নিক্ষেপ করেন। তিনি এর দ্বারা বালকদের সঙ্গে মেলামেশা করাকে বুঝিয়েছেন।’
মুযাফফর কারমীনসী বলেন-
অর্থঃ ‘যে কোনভাবে নারীদের সঙ্গে নম্রতা প্রদর্শন করা সর্বনিকৃষ্ট নম্রতা প্রদর্শন।’
জনৈক ব্যক্তি শাইখ নাসীরাবাদী (রহঃ)কে বলে যে, মানুষ নারীদের নিকট বসে আর বলে যে, আমরা এদেরকে পবিত্র নিয়তে দেখি। তখন তিনি বলেন-
অর্থঃ ‘যতক্ষণ মানবদেহে টিকে আছে, ততক্ষণ আদেশ-নিষেধও বলবৎ থাকবে এবং সে হালাল-হারামের সম্বোধিত হবে।’
মারাত্মক ব্যাপার হলো, কতক লোক একে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে। এহেন গর্হিত কাজ থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। গুনাহই যদি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় হয়, তাহলে তো সমস্ত বেশ্যা-বদমায়েশই কামেল ওলী হয়ে যেতো। যে কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, কৃত্রিম প্রেম ছাড়া প্রকৃত প্রেম লাভ হয় না, এর উত্তরে বলবো যে, এটি কোন স্বতঃসিদ্ধ বিষয় নয়। তাছাড়া কৃত্রিম প্রেম বৈধ ক্ষেত্রেও তো হতে পারে। এ কথাটির রহস্য মাত্র এতটুকু যে, কৃত্রিম প্রেম দ্বারা অন্তরের নানামুখি সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। নফস লাঞ্ছিত হয়ে যায়। এখন রয়ে যায় শুধুমাত্র এই বিপদটি দূর করা। এটি দূর করতে পারলেই উদ্দেশ্য সাধন হয়ে যায়। তবে কথা হলো, এ উদ্দেশ্য তো নিজের সন্তান, স্ত্রী, গরু, মহিষ সব জিনিসের সঙ্গে ভালোবাসা বৃদ্ধি করার দ্বারাই হতে পারে। পরনারী আর বালকের সঙ্গেই হতে হবে, এর কী অর্থ? আর যদি ঘটনাচক্রে, অনিচ্ছায় কোথাও অন্তর ফেঁসেই যেয়ে থাকে, তাহলে ঐ কৃত্রিম প্রেম থেকে প্রকৃত প্রেম লাভের শর্ত হলো, প্রেমিক ও প্রেমাষ্পদের মধ্যে দূরত্ব হতে হবে। তার নৈকট্যে থাকলে সারাজীবন এই কৃত্রিম প্রেমেই আক্রান্ত থাকবে। তাই মাওলানা জামী (রহঃ) বলেন-
অর্থঃ ‘ওলীর জন্য রুপ প্রদর্শনের সেতুর উপর দিয়ে নিজেকে দ্রুত অতিক্রম করাতে হবে।’
এ পথে তো নিত্যদিন নিত্যপ্রেমাস্পদ হয়ে থাকে। জনৈক কবি বলেন-
অর্থঃ ‘হে বন্ধু! প্রতি বসন্তে নতুন স্ত্রী গ্রহন করো। কারন, পুরাতন কাঠামো কাজে আসে না।’
প্রবৃত্তির চাহিদা ও কামনার স্বাদ উপভোগের জন্য তারা আল্লাহর ওলীদের কথাকে আড়াল বানিয়ে নিয়েছে। কিন্ত্ত মনের অবস্থা আল্লাহ ভালো করেই জানেন। আর তাদের নিজেদের কাছেও তা গোপন নয়। ন্যায় বিচারক ও সত্য পূজারী হলে সবকিছুই আশা করা যায়। কবি বলেন-
অর্থঃ ‘মেনে নিলাম যে, ধোঁকায় ফেলে বিশেষ ও সাধারণ সবাইকে ভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করছো।’
‘মানুষের সাথে যা কিছু করছো, সব ঠিক আছে, কিন্ত্ত আল্লাহর সঙ্গে চতুরতা কি বৈধ হতে পারে?’
‘আল্লাহর সঙ্গে সব কাজ সঠিকভাবে করা উচিত। নিষ্ঠা ও সততার পতাকা উত্তোলন করা উচিত।’
পরিচ্ছেদ-৩ পীরকে খোদা মনে করার বর্ণনা
মাসায়েল অধ্যায়ে এ ভ্রান্তির সংশোধন করা হয়েছে।
পরিচ্ছেদ-৪: বেহেশত ও দোযখকে বিদ্যমান মনে না করা কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বিবৃতির পরিপন্থী বিশ্বাস। এর বিস্তারিত আলোচনা মাসায়েল অধ্যায়ে রয়েছে। সেখানে অধ্যয়ন করে মনের খটকা দূর করে নাও।
পরিচ্ছেদ-৫: পবিত্র কুরআনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী মনে করা। তাই যদি হতো, তাহলে এ সমস্ত আয়াতের কী অর্থ হবে-
অর্থঃ ‘এটি একটি কিতাব, যা আমি আপনার নিকট অবতীর্ণ করেছি।’ (সূরা ইবরাহীম-১)
এ কথা কে বলছেন এবং কাকে বলছেন? হায় খোদা! ঈমান তো আগেই গেছে, বিবেক-বুদ্ধিও হারিয়েছে।
অর্থঃ ‘দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি।’
(সূরা হাজ্জ-১১)
হযরত ইবারাহীম খাওয়াস (রহঃ) বলেন যে, এক ব্যক্তির উপর শয়তান সওয়ার হয়ে তাকে মাটিতে ফেলে রেখেছিল। আমি শয়তান দূর করার জন্য ঐ ব্যক্তির কানে আযান দিতে আরম্ভ করি। তখন তার ভিতর থেকে ঐ শয়তান চিৎকার করে বলতে থাকে যে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি ওকে হত্যা করবো। এ ব্যক্তি কুরআনকে ‘মাখলুক’ (সৃষ্ট) বলে।
আল্লাহু আকবার! কুরআনকে মাখলুক বা সৃষ্ট বলার প্রতি শয়তানেরও ঘৃণা রয়েছে। আফসোস, যদি কোন মানুষের এরুপ বিশ্বাস থাকে। তার উপর আবার ওলী হওয়ার দাবী!
পরিচ্ছেদ-৬: একটি ভুল এই করে থাকে যে, জিহ্বা ও পেটের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে না। অর্থাৎ, মুখ দিয়ে যা চায় লাগামহীনভাবে বলে ফেলে। তাতে কুফরী হোক বা আল্লাহ তাআলার সাথে বেয়াদবী হোক, তার কোন পরোয়া করে না। তারা বুঝতে চায় না-
অর্থঃ ‘এ পথে বেয়াদবের কোন অংশ নেই। তার জায়গা শূলের উপর, ঘরের ভিতরে নয়।
আল্লাহর কাছে আদবের তাওফীক কামনা করছি। বেয়াদব আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত রয়।
বেয়াদব নিজেই শুধু ধ্বংস হয় না, সে সারা পৃথিবীতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আল্লাহর পথে যে বেয়াদবী করে, সে অনুতাপের সাগরে নিমজ্জিত হয়।
বন্ধুর পথে যে বেয়াদবী করে, সে আল্লাহওয়ালাদের ডাকাত, আল্লাহওয়ালা নয়।
বেয়াদবীর কালিমায় সূর্যগ্রহণ হয়, বেয়াদবী করার ফলে শয়তান (আল্লাহর দরবার থেকে) বিতাড়িত হয়।’
বিশেষতঃ ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’-এর দাবীর ক্ষেত্রে তো মুখের কোন লাগামই থাকে না। কখনও খোদাকে বান্দা বানিয়ে দেয়, আবার কখনও বান্দাকে খোদা সাব্যস্ত করে।
‘ওয়াহদাতুল উজুদ’-এর যে মূল লক্ষ্য ছিলো অন্তর থেকে গায়রুল্লাহকে বের করে দেওয়া, তার ছিটে ফোঁটাও তো লাভ করতে পারেনি। শুধু কথার ফুলঝুরিতে কি লাভ হয়।
অর্থঃ ‘একত্ববাদের ব্যাপারে প্রলাপ বকার চেয়ে অন্তরের আঙ্গিনা থেকে বহুত্ববাদের ধূলি বের করে দেওয়া উত্তম। কথায় প্রতারিত হয়ো না, একত্ববাদ তো আল্লাহকে এক দেখার নাম, এক বলার নাম নয়।’
পেটের ক্ষেত্রে অসতর্কতা এই যে, হালাল ও হারামের কোন পরোয়া করে না। সুদখোর, পতিতা নারী সবার দাওয়াত ও নজরানা গ্রহণ করে। আল্লাহর ওলীরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন-হালাল খাওয়া ছাড়া আল্লাহ প্রদত্ত নূর লাভ হয় না।
শাহ কিরমানী (রহঃ) বলেন-
অর্থঃ ‘যে নিষিদ্ধ জিনিস থেকে নিজের দৃষ্টিকে আনত রাখলো, নিজের নফসকে কামনা ও অবৈধ উপভোগ থেকে বিরত রাখলো, নিজের অভ্যন্তরকে নিয়মিত মুরাকাবার মাধ্যমে এবং নিজের বাহ্যিক দিককে সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমে গড়লো এবং নিজের নফসকে হালাল খাওয়ায় অভ্যস্ত করলো, তার অন্তর্দৃষ্টি বিভ্রান্ত হবে না।’
পরিচ্ছেদ-৭: একটি ভুল এই প্রচলিত আছে যে, কিছু কিছু লোকের এরুপ বিশ্বাস আছে যে, আধ্যাত্মিকতার লাইনে এমন একটি স্তর রয়েছে, যেখানে পৌঁছলে শরীয়তের বিধান স্থগিত এবং মাফ হয়ে যায়। এটি স্পষ্ট কুফরী বিশ্বাস। যতক্ষণ পর্যন্ত হুঁশ ঠিক আছে, শরীয়তের বিধান কোনভাবেই মাফ হয় না। তবে অচেতন হয়ে গেলে মা’যুর বলে গণ্য হবে।
হযরত ইবরাহীম বিন শাইবান (রহঃ) বলেন-
অর্খঃ ‘অস্তিত্ব ও বিলুপ্তির জ্ঞান অর্থাৎ, ইলমে তাসাওউফের ভিত্তি আল্লাহর একত্ববাদের মধ্যে ইখলাস এবং ইবাদতকে বিশুদ্ধ করার উপর। এছাড়া যা কিছু আছে, তার সবই ধোঁকাবাজি ও বদদ্বীনী।’
জনৈক ব্যক্তি হযরত জুনায়েদ (রহঃ) কে বললো যে, কেউ কেউ বলে যে, আমরা তো আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। তাই এখন শরীয়তের বিধি-বিধানের আমাদের কী প্রয়োজন?
তিনি বললেন-ওরা নিঃসন্দেহে পৌঁছেছে, তবে জাহান্নামে পৌঁছেছে। আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছেনি।
তিনি আরও বলেন যে, ব্যভিচারকারী ও চোর এ ধরনের বিশ্বাসপোষণকারীর চেয়ে উত্তম।
তিনি আরও বলেন, আমি যদি এক হাজার বছরও বেঁচে থাকি শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া ওযীফা পর্যন্তও কামাই করবো না।
পরিচ্ছেদ-৮: একটি ভুল এই যে, স্পষ্টভাষায় বা ইঙ্গিতে গর্ব সহকারে নিজের কামেল হওয়ার দাবী করে। অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের পবিত্রতা বর্ণনা করো না।’ (সূরা নাজম-৩২)
তবে নেয়ামত প্রকাশের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন কথা বললে এবং তা নিজের পূর্ণতা মনে না করে নিছক আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করলে কোন ক্ষতি নেই।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘এবং আপনার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।’ (সূরা যুহা-১১)
কতক জাহেল লোক এক অদ্ভুত দাবী করে যে, আমাদের ‘নিসবত’ এমন শক্তিশালী যে, গুনাহ করার দ্বারাও তা দুর্বল হয় না। কেউ কেউ বলে যে, নারী ও পতিতাদের দিকে দৃষ্টি দিলে আমাদের আধ্যাত্মিকতার উন্নতি হয়।
মনে রাখা উচিত যে, যে ‘নিসবত’ গুনাহ করলেও ঠিক থাকে বা উন্নত হয় তা ‘শয়তানী নিসবত’। এ ধরনের উন্নতিকে ধোঁকা ও আল্লাহর তরফ হতে ঢিল দেওয়া বলা হয়। আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন। এ ধরনের মানুষের সঠিক পথে আসার কোন আশা নেই। তারা সারা জীবন এই ধোঁকায় পতিত থাকে।
‘রুশহাত’ গ্রন্থে আছে- হযরত খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার বলেন- আল্লাহর পক্ষ থেকে দুই ধরনের কৌশল হয়ে থাকে। এক ধরনের হয়ে থাকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে, আর এক ধরনের হয়ে থাকে বিশেষ মানুষের সঙ্গে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে কৌশল হয়, তা হলো কাজে ত্রুটি করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাকে নেয়ামত দিতে থাকেন। আর বিশেষ লোকদের ক্ষেত্রে যে কৌশল হয় তা হলো, আদব বিবর্জিত হওয়া সত্ত্বেও হালাত ঠিক থাকে।
হযরত শাইখ কুতবুল আলম আবদুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী (রহঃ) বলেন-অবিরাম কাজ করো এবং শরীয়তের উপর অবিচল থাকো। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তের উপর অবিচল থাকবে এবং অবিরাম কাজ করতে থাকবে। কেবলই নূর এবং ভেদ অর্জিত হবে।
জনৈক মুরীদ নূর দেখতে পেলো। সে তার পীরের নিকট বললো, আমি এ ধরনের নূর দেখতে পাই। যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পীর সাহবে বললেন, যাও! অন্যের এক মুঠ ঘাস তার অনুমতি ছাড়া নিয়ে নাও! মুরীদ তাই করলো। ফলে নূর বিলুপ্ত হয়ে গেলো। মুরীদ পীরের নিকট তার অবস্থা জানালো। সত্যপন্থী পীর বললেন, মন স্থির রাখো! এটি আল্লাহর নূর। শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও যদি ঐ নূর দেখা যেতো তাহলে তা নূর হতো না, অন্ধকার হতো। হক হতো না, বাতিল হতো। কবি বলেন-
অর্থঃ ‘যা কিছু শরীয়তের দাবী অনুপাতে নয়, বিনা বাক্যে তা শয়তানের কুমন্ত্রনা।’
পরিচ্ছেদ-৯: একটি ভুল এই করা হয় যে, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে চরম অসতর্কতা করা হয়। হাদীসের আলেমদের নিকট হাদীস যাচাই করা উচিত। কোন অনির্ভরযোগ্য উর্দূ, ফারসী বা আরবী কিতাবে হাদীস শব্দ লেখা দেখলেই তা দিয়ে প্রমাণ দেওয়া ঠিক নয়। নাম ঠিকানাবিহীন অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত হাদীস প্রসিদ্ধ রয়েছে। যেমন-
অর্থঃ আমি ‘আইন ছাড়া ‘আরব’। অর্থাৎ, ‘রব’।
এ জাতীয় আরও যেসব হাদীস আছে, সেগুলোর না শব্দের ঠিক ঠিকানা আছে, না অর্থের নামগন্ধ আছে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে।
অর্থঃ যে ইচ্ছা করে আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে, সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেয়।
এ দাবীটিও একই ধরনের ভ্রান্ত ও অজ্ঞতাপ্রসূত যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী (রাযিঃ)কে আধ্যাত্মিকতার কয়েক হাজার কথা গোপনে শিখিয়েছিলেন। সেগুলো তিনি মে’রাজ রজনীতে এনেছিলেন। অন্য কেউ এগুলোর উপযুক্ত ছিলো না। এ দাবীর মধ্যে অনেকগুলো মিথ্যার সমন্বয় ঘটেছে।
প্রথমত এই যে, মেরাজ রজনীতে তাকে কয়েক হাজার আধ্যাত্মিক কথা দান করা হয়েছে। এ কথার দাবীদার কি করে তা জানতে পারলো? সেখানে তো এমন গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে যে, ফেরেশতারা পর্যন্ত জানতে পারেনি। এ লোক কোথায় দাঁড়িয়ে তা শুনছিলো? এ স্তরের রহস্য কে জানতে পারে?
এর মধ্যে দ্বিতীয় মিথ্যা এই যে, হযরত আলী (রাযিঃ)কে তিনি গোপনে এ আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। খোদ হযরত আলী (রাযিঃ)কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলো যে, আপনাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ কোন কথা শিক্ষা দিয়েছেন কি? তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তা অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, ‘কুরআন মাজীদ বোঝার আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতা ছাড়া আমার নিকট বিশেষ কিছু নেই।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে থাকার বদৌলতে তার অন্তরে নিসবতের যে নূর এসেছিল, তারই ফল ছিলো পবিত্র কুরআন বোঝার এ যোগ্যতা। আর তা-ই এখন পর্যন্ত সিনায় সিনায় স্থানান্তরিত হয়ে আসছে। আধ্যাত্মিকতা সিনায় সিনায় চলে আসছে প্রসিদ্ধ এ কথাটির অর্থ এটাই। এর অর্থ এ নয় যে, হযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে গোপন কিছু কথা তিনি কানে কানে শুনেন, যা এখন পর্যন্ত চলে আসছে। যদি এমন ভিত্তিহীন দাবী মেনে নেওয়া হয়, তাহলে সমস্ত ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রনই ভেঙ্গে পড়বে। তখন কেউ দাবী করতে পারে যে, বই-পুস্তকে যদিও লেখা আছে যে, হাতেম তাঈ একজন দানশীল লোক ছিলেন। কিন্ত্ত আমার কাছে আমার বুযুর্গদের থেকে সিনায় সিনায় এ রহস্যজ্ঞান লাভ হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে সে একজন অতি কৃপণ লোক ছিলো। কিন্ত্ত একথা কাউকে বলবে না, নইলে নিরস মৌলভীরা তোমাকে মিথ্যুক বলবে। এমনিভাবে যা ইচ্ছা সিনায় সিনায় এনে পেশ করো, তখন কোন জিনিসের আর গ্রহণযোগ্যতা অবশিষ্ট থাকবে?
তৃতীয় মিথ্যা এই যে, একথায় সমস্ত সাহাবী অযোগ্য সাব্যস্ত হলো। নাউযুবিল্লাহ। কুরআন ও হাদীসে সাহাবীদের-বিশেষ করে প্রথম খলীফার-যে সমস্ত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে সেগুলো দেখো, তাহলে সব সন্দেহ দূরীভূত হবে। ‘সীরাতে আউলিয়া’ গ্রন্থে আছে যে, এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর সিদ্দীকী (রাযিঃ)। আধ্যাত্মিকতার লাইনের শীর্ষস্থানীয়, শাইখগণ তাকে শীর্ষ তালিকায় মনে করতেন। (জাওয়াহেরে গায়বী)
পরিচ্ছেদ-১০: একটি ভুল এই যে, বেহেশতের মধ্যে যেভাবে আল্লাহর দীদার বা দর্শন হবে, দুনিয়াতে ঐ রকম দীদার বা দর্শনের তারা দাবী করে থাকে। জেনে রাখা উচিত যে, পবিত্র কুরআনে মূসা (আঃ)এর ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে যে, তিনি দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখার বাসনা পোষণ করেছিলেন। তিনি উত্তর পেয়েছেন-
অর্থঃ ‘কিছুতেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।’ (সূরা আ’রাফ-১৪৩)
হাদীস শরীফে আছে-
অর্থাৎ, ‘মৃত্যুর পূর্বে কখনই আল্লাহ তাআলাকে তোমরা দেখতে পাবে না।’
অপর হাদীসে আছে-
অর্থঃ ‘তার পর্দা হলো নূর। যদি সে পর্দা তুলে দেওয়া হয়, তার সত্তার নূর সমস্ত সৃষ্টিকে জ্বালিয়ে দিবে।’ (মুসলিম)
কুরআন ও হাদীস ছাড়া আর কোন জিনিস বিশ্বাস করার আছে? আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তারা এরপর আর কোন কথায় বিশ্বাস পোষণ করবে?’ (সূরা আ’রাফ-১৮৫)
এবার এ প্রসঙ্গে আল্লাহর আরেফদের উক্তি শুনুন- ‘মিসবাহুল হিদায়াহ’ গ্রন্থে আছে- দুনিয়াতে আল্লাহকে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়। কারণ, নশ্বর বস্ত্ত অবিনশ্বর সত্তাকে আয়ত্ব করতে পারে না। তবে আখিরাতে ঈমানদারদের জন্য দীদারের ওয়াদা রয়েছে। কিন্ত্ত কাফেররা তা থেকে বঞ্চিত থাকবে।
‘কাশফুল আসার’ গ্রন্থে আছে, একদিন গাউসুল আযম শাইখ মুহীউদ্দিন আবু মুহাম্মাদ সাইয়েদ আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ)এর এক মজলিসে আলোচনা হলো যে, আপনার অমুক মুরীদ বলে যে, আমি আমার চোখ দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে দেখেছি। তখন তিনি ঐ মুরীদকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন-তখন সে স্বীকার করলো। তখন আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ) তাকে এ ধরনের কথা বলতে বারণ করলেন এবং তার থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, সে এরুপ কথা আর দ্বিতীয়বার বলবে না। উপস্থিত লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে, এ লোক সত্যবাদী, নাকি মিথ্যাবাদী? তিনি বললেন, সে সত্যবাদী, তবে ব্যাপারটি তার কাছে গুলিয়ে গেছে। তার কারণ হলো, সে মূলত বাহ্যিক চোখ দ্বারা আল্লাহর নূর দেখেছে। আর সে সময় তার বাহ্যিক দৃষ্টির দিকে তার অন্তর্দৃষ্টির একটি পথ উন্মোচিত হয়েছে। ফলে তার দৃষ্টির রশ্মি আলোকিত হয়ে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিণতিতে সে অন্তর্দৃষ্টির প্রত্যক্ষকে বাহ্যদৃষ্টির প্রত্যক্ষ বলে ধারণা করেছে। এখানে যে, মূলত দুই ধরনের দৃষ্টি কাজ করেছে, সে তার পার্থক্য করতে পারেনি।
হযরত শাইখ কিওয়ামুদ্দীন বলেন- ‘মুকাশাফা’ আল্লাহ তাআলাকে দর্শন করা বা উপলব্ধি করার নাম নয়। অন্তর্দৃষ্টির দর্শনকে তুমি ‘মুকাশাফা’ বা ‘মুশাহাদা যে কোন নামেই আখ্যায়িত করো না কেন, সুফীদের পরিভাষায় তাকে অন্তর্দৃষ্টির দর্শনই বলা হবে। ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত বাহ্যদৃষ্টির দর্শন বলা হবে না।
মসনবী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বাহরুল উলূম’-এ আছে যে, হযরত মূসা (আঃ) তাজাল্লীর মধ্যে আল্লাহতাআলাকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করেন। কিন্ত্ত প্রত্যক্ষকারী নশ্বর হওয়ার ফলে তার দর্শন হয়নি। ‘মাকতুবাতে কুদ্দুসী’তে আছে যে, আমি নিশ্চিত করে বলছি যে, এখানে যা কিছু হয়, তার মধ্যে পর্দা থাকে। আর ওখানে যা কিছু হবে, সেটা প্রত্যক্ষ দর্শন হবে। মাঝে কোন পর্দা থাকবে না।
‘আনওয়ারুল আরিফীন’-এর মধ্যে আছে-
‘চিরস্থায়ী ঘর আখিরাতেই আল্লাহকে চাক্ষুস দর্শন করা যাবে। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে নয়।’
তাসাওউফের বিভিন্ন কিতাবে ‘মাকামে ফানাতে’ আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করার যে কথা লেখা আছে, তা মূলত অন্তর্দৃষ্টির দর্শন। যেমনটি উপরে আলোচিত হয়েছে। ‘মাকামে ফানা’ স্বপ্নসদৃশ হয়ে থাকে, আর স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা সম্ভব।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কতক সময় মুরীদ ‘রুহানী তাজাল্লীকে’ ‘রব্বানী তাজাল্লী’ মনে করে গোমরাহ হয়। এ পর্যায়ে মুহাক্কেক কামেল শাইখের প্রয়োজন রয়েছে। হযরত ইয়াহইয়া মুনীরী (রহঃ)এর চতুর্থ মাকতুবের মধ্যে রয়েছে-জেনে রাখো যে, মহান আল্লাহর জাত ও সত্তার আত্মপ্রকাশকে ‘তাজাল্লী’ বলে। অপরদিকে রুহেরও তাজাল্লী রয়েছে। অনেক মুরীদই এক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা ভেবেছে যে, তারা আল্লাহর ‘তাজাল্লী’ প্রাপ্ত হয়েছে। পীর সাহেব যদি তাসররুফের অধিকারী না হন, তাহলে এ জটিল স্তর অতিক্রম করা কঠিন। এখন ‘রব্বানী তাজাল্লী’ ও ‘রুহানী তাজাল্লী’র পার্থক্য বুঝে নাও। অন্তরের আয়না যখন আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর অস্তিত্বের ক্লেদ থেকে পরিচ্ছন্নতা লাভ করে আল্লাহর নূরের সূর্যের উদয়াচলে পরিণত হয় এবং আল্লাহ তাআলার জাত ও সিফাতের ‘তাজাল্লীর’ উপযুক্ত পাত্র হয়-তবে সবাই এ সৌভাগ্য লাভ করতে পারে না। মুরীদদের মধ্যে দুই-একজন এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হয় যে, যখন তারা অন্তরের আয়নাকে মানবীয় বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত করে, তখন কিছু রুহানী সিফাত বা আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য তার অন্তরের উপর ‘তাজাল্লী’ ফেলে। তখন কখনো কখনো আত্মার সত্তা-যা কিনা আল্লাহর প্রতিনিধি-তাজাল্লী ফেলে। আর এ প্রতিনিধিত্বের ফলে সে ‘আনাল হক’ দাবী করে। আর কখনো প্রতিনিধি আত্মার সিংহাসনের সামনে সমস্ত সৃষ্টিকে সিজদাবনত দেখতে পায়। ফলে ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়। রুহের তাজাল্লীকে আল্লাহর তাজাল্লী মনে করে। তারা এ হাদীসের উপর কিয়াস করে-
অর্থঃ ‘আল্লাহ যখন কোন জিনিসের উপর ‘তাজাল্লী’ ফেলেন, তখন সব জিনিস তার সামনে নত হয়ে যায়।’
এ জাতীয় বহুবিধ বিভ্রান্তিতে তখন নিপতিত হয়। ‘রুহানী তাজাল্লী’ নশ্বর বস্ত্ত। তা অন্যকে ধ্বংস করার শক্তি রাখে না। ‘রুহানী তাজাল্লী’র কারণে অহংকার ও গরিমা সৃষ্টি হয়। আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায় শিথিলতা আসে। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর ‘তাজাল্লী’র ফলে এ সবকিছু বিলুপ্ত হয়। অস্তিত্ব অনস্তিত্বে পরিণত হয়। আল্লাহ প্রাপ্তির তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়। সাধনা অধিকতর হয়।
কোন কোন বুযুর্গের এ ধরনের উক্তি রয়েছে-
অর্থঃ ‘অন্যদের জন্য আখিরাতে (দর্শনদানের) ওয়াদা রয়েছে, আর আমরা দুনিয়াতেই নগদ পেয়ে থাকি?’
এ কথার ব্যাখ্যায় শাইখ আবদুল কুদ্দুস (রহঃ) বলেন-এর অর্থ হলো, আখিরাতে চাক্ষুষ দর্শনের ওয়াদা রয়েছে, সেটা এখানে বিশ্বাসের চোখে প্রত্যক্ষ করা হয়। এটাকেই মুহাক্কিকগণ’ ‘মুশাহাদা’ (প্রত্যক্ষ করা) ও ‘রুয়াত’ (দর্শন করা) বলেন এবং জানেন।
একটি সংশয়ের নিরসন
কতক বুযুর্গের কথায় ‘আল্লাহর জাতের তাজাল্লী’ কথাটি পাওয়া যায়। এতে ধোঁকা খাবেন না। কারণ, এটি একটি পারিভাষিক শব্দ। যার অর্থ হলো, আল্লাহর সত্তার দিকে মুরীদের মনোযোগ এমন গভীরভাবে নিবদ্ধ হয়ে যায় যে, আল্লাহর সত্তা ভিন্ন অন্য কোন বস্ত্তর দিকে তার কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ থাকে না। এমনকি আল্লাহর জাত ছাড়া তার সিফাতসমূহও তার স্মরণে উপস্থিত থাকে না। এক জানা বিষয়ের উপস্থিতির ফলে অন্যান্য জানা বিষয়ের অনুপস্থিত থাকা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এমন অনেক ঘটে থাকে। আল্লাহকে দেখার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। ‘ইলমুল কুতুব’-এর মধ্যে এ ব্যাখ্যা উল্লেখিত হয়েছে।
তাছাড়া আভিধানিক অর্থের দিক থেকেও ‘তাজাল্লী’ ও ‘রুয়াত’এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ‘তাজাল্লী’ অর্থ আত্মপ্রকাশ করা, যা আল্লাহ তাআলার গুণ। আর ‘রুয়াত’ অর্থ দেখা, যা বান্দার কাজ। তাই ‘তাজাল্লী’ হলেই ‘রুয়াত’ হবে, এটা জরুরী নয়। কারণ, এর অর্থ হলো জাতের পক্ষ থেকে তাজাল্লী বা আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, কিন্ত্ত বান্দার পক্ষ থেকে দেখা হয়নি। এটা হতেই পারে। এতে সংশয়ের কিছু নেই। এ কারণে হযরত মূসা (আঃ)এর ঘটনায় আয়াতে তাজাল্লী হয়েছে তা বলা হয়েছে। কিন্ত্ত তার দর্শনকে অস্বীকার করা হয়েছে।
মোটকথা, কুরআন ও হাদীস এবং সত্যপন্থী আলেমদের কথা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আখিরাতে আল্লাহ তাআলার জাতের দীদার হবে, কিন্ত্ত কিভাবে হবে তা জানা নেই। তবে দুনিয়াতে আল্লাহর দীদার অসম্ভব। তবে কতক বুযুর্গের কথায় যে, দেখা সম্ভব বলা হয়েছে এবং দেখা অসম্ভবকে হওয়াকে মু’তাযিলাদের মাযহাব বলা হয়েছে। এর দ্বারা এর যৌক্তিকতা অর্থাৎ, দেখা সম্ভব ও অসম্ভব হওয়ার যৌক্তিক দিক তুলে ধরা হয়েছে। শরীয়তের বিধান বলা হয়নি। আর আমরা বলছি শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি অসম্ভব হওয়ার কথা। কারণ, দুনিয়াতে আল্লাহর দর্শন হবে না এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে অনেক প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহকে দেখা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব- এটি আমাদের দাবী নয়। তাই যদি হতো, তাহলে আখিরাতে কি করে দেখা সম্ভব হতো? কারণ, যা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব, তা কখনই সম্ভব হতে পারে না। বাস্তবে ঘটা তো আরো দূরের কথা।
পরিচ্ছেদ-১১: একটি ভুল এই যে, নিজের পীরকে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সশরীরে খোদা বিশ্বাস করা-এটা স্পষ্ট কুফুরী বিশ্বাস। এতে রয়েছে আল্লাহ তাআলার বিবর্তিত হওয়া, নশ্বর হওয়া, মুখাপেক্ষী হওয়া, আবদ্ধ হওয়া, আরেক বস্ত্তর মধ্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটা এবং তার মধ্যে একাকার হওয়া এ জাতীয় অসংখ্য বাতেল বিষয়। বাহ্যিক দেহ বাহ্য ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত হয়, আর আল্লাহ তো এতো পবিত্র যে, বাতিনী ইন্দ্রিয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধিও তার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। কল্পনায় যা আসে, আল্লাহ তা থেকেও পবিত্র।
আমর ইবনে উসমান মাক্কী বলেন-
‘তোমার অন্তর যাকিছু ধারণা করে, বা তোমার চিন্তার সাগরে যা কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়, অথবা তোমার মনের আয়নায় যে কোন সৌন্দর্য, রুপ-লাবণ্য, প্রেম-ভালোবাসা, প্রশান্তি-পরিতৃপ্তি, স্নিগ্ধতা, উজ্জ্বলতা, শাইখ, আলো, ব্যক্তি বা কল্পনার উদয় হয়, আল্লাহ তাআলা এসবকিছু থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। তুমি কি আল্লাহর এ বাণী শোনো না?’
‘তার সাথে তুলনীয় কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা শুরা-১১)
Leave a Reply