পূর্ণাঙ্গ অসীয়তসমূহের বর্ণনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: তা’লীমুদ্দীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
এ অধ্যায়ের অধীনে কয়েকটি পরিচ্ছেদ রয়েছে।
পরিচ্ছেদ-১: ইমাম কুশাইরী (রহঃ)এর অসীয়তের সারকথা এই যে, প্রথমে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুপাতে নিজের আকীদা-বিশ্বাসকে দুরন্ত করবে। তারপর প্রয়োজন পরিমাণ ইলম অর্জন করবে। তা কিতাব পড়েও হতে পারে, আলিমদের সান্নিধ্যে থেকেও হতে পারে। বিরোধপূর্ণ মাসআলাসমূহে সতর্কতার উপর আমল করবে। সমস্ত গুনাহ থেকে খাঁটিভাবে তওবা করবে। পাওনাদারকে খুশী করবে। পদ ও সম্পদের সম্পর্কসমূহ ছিন্ন করবে। নিজের পীরের বিরুদ্ধাচরণ করবে না। তার উপর কোন প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। নিজের বাতিনী অবস্থা পীরের কাছে গোপন করবে না এবং অন্য কারো নিকট প্রকাশ করবে না। কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে অবিলম্বে ভুল স্বীকার করবে। কথা ঘুরাবে না। তীব্র প্রয়োজন ছাড়া সফর করবে না। বেশী হাসবে না, কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করবে না। নিজের পীরভাইদের সঙ্গে হিংসা করবে না। বালক ও বেগানা নারীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে। এমনকি তাদের সঙ্গে মন খুলে কথাও বলবে না। ‘নিসবত’ লাভ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে মুরীদ করবে না। শরীয়তের আদব রক্ষার ব্যাপারে খুব যত্নবান হবে। মুজাহাদা ও ইবাদতে অলসতা করবে না। নির্জনে থাকবে। লোকসমাজে থাকার পরিস্থিতি হলে তাদের খেদমত করবে। নিজেকে তাদের চেয়ে ছোট মনে করে আচরণ করবে। দুনিয়াদারদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে।
পরিচ্ছেদ-২: শাহ ওয়ালীউল্লাহ সাহেব (রহঃ)এর অসীয়তসমূহের সারকথা এই যে, দ্বীনী জরুরত ও মাসলেহাত ছাড়া ধনী লোকদের সংস্পর্শে যাবে না। মূর্খ পীর, মূর্খ আবেদ ও আধ্যাত্মিকতা বিবর্জিত আলেম এবং যে সমস্ত মুহাদ্দিস ফকীহদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং যে সমস্ত লোক কালাম ও দর্শন শাস্ত্রে ব্যাপৃত থাকে-এ ধরনের লোকদের সুহবত থেকে দূরে থাকবে। এমন লোকের নিকট বসবে, যিনি আলেম, বুযুর্গ, দুনিয়াবিরাগী, আল্লাহর যিকির ও ইত্তেবায়ে সুন্নাতের আশেক। ফিকহ-এর মাযহাবসমূহের মধ্যে থেকে একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দিবে না। এরুপ বলবে না যে, হানাফী মাযহাব সবচেয়ে ভালো, বা শাফেয়ী মাযহাব সবচেয়ে বড়। বরং নিজের মাযহাবের উপর আমল করতে থাকবে। একইভাবে বুযুর্গদের তরীকাসমূহের মধ্য থেকে একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দিবে না। এরুপ বলবে না যে, চিশতিয়া তরীকার নিসবত খুব শক্তিশালী, আরেকজন বললো, না নকশবন্দীদের মধ্যে সুন্নাতের ইত্তেবা বেশী, এ ধরনের অনর্থক কথা থেকে বেঁচে থাকবে। যে সমস্ত লোক ভাবাবেগে পরাভূত হয়ে বা কোন ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে কোন কাজ করে-যে কাজ তোমার মতে সুন্নাতের খিলাফ-তাদেরকে ভালোমন্দ কিছুই বলবে না। নিজে শরীয়তের বিধান মোতাবেক কাজ করবে।
পরিচ্ছেদ-৩: এ পরিচ্ছেদে হযরত সাইয়্যেদুনা, মুরশিদুনা আশ্ শাইখ, আল হাফেজ, আলহাজ্জ মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ সাহেব (রহঃ)এর অসীয়তসমূহের সারকথা লিখে এ পুস্তিকা সমাপ্ত করছি। এ অসীয়তটিকে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে সবার শেষে লিখছি। অন্যথায় আমার কর্তব্য ছিলো, একে সবার আগে আনা।
অর্থঃ প্রত্যেকের পছন্দের পথ ভিন্ন ভিন্ন।
সত্যের সন্ধানী মুরীদের জন্য আবশ্যক হলো- প্রথমে জরুরী মাসআলাসমূহের ইলম শিখবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুপাতে নিজের আকীদা ঠিক করবে। তারপর এসব বিষয় থেকে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করবে-লোভ, দীর্ঘ আশা, ক্রোধ, মিথ্যা, গীবত, কৃপণতা, হিংসা, রিয়া বা প্রদর্শন প্রবৃত্তি, তাকাব্বুর বা অহংকার ও বিদ্বেষ। এবং নিজের মধ্যে এ গুণগুলো অর্জন করবে-সবর, শোকর, কানা’আত (অল্পেতুষ্টি), ইলম, ইয়াকীন, তাফবীয (আত্মনিবেদন), তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা পোষণ), রাযা (আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্ত্তষ্ট থাকা), তাসলীম (আত্মসমর্পণ)। শরীয়তের অনুগামী থাকবে। কোন গুনাহ হয়ে গেলে নেক আমল দ্বারা অবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণ করবে। যথাসময়ে জামাআতের সঙ্গে নামায পড়বে। কোন সময় আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হবে না। যিকিরের মধ্যে স্বাদ পেলে শোকর আদায় করবে। কাশফ ও কারামতের সন্ধানী হবে না। নিজের আধ্যাত্মিক অবস্থা ও তাসাওউফের কথা পরলোককে বলবে না। দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্ত্তকে আন্তরিকভাবে বর্জন করবে।
শরীয়ত পরিপন্থী পীর-ফকিরদের কাছে যাবে না। মানুষের সাথে প্রয়োজন পরিমাণ মিশবে। নিজেকে সবচেয়ে তুচ্ছ মনে করবে। কারো উপর আপত্তি করবে না। নম্রভাবে কথা বলবে। নীরবতা ও নির্জনতাকে ভালোবাসবে। সময়কে নিয়ন্ত্রনে রাখবে অর্থাৎ, রুটিন মত চলবে। মনে অস্থিরতা আনবে না। যে কোন পরিস্থিতি দেখা দিবে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনে করবে। গায়রুল্লাহর খেয়াল মনে আসতে দিবে না। দ্বীনী কাজে সহযোগিতা করবে। নিয়্যত খাঁটি রাখবে। পানাহারের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে। এত বেশী খাবে না যে, অলস হয়ে পড়ে।’ আবার এত কমও খাবে না যে, দুর্বল হয়ে পড়ে। হালাল উপার্জন উত্তম। আর যদি আল্লাহর উপর ভরসা করে তাতেও ক্ষতি নেই। তবে শর্ত হলো, কারো কিছুর প্রতি লোভ করবে না। কারো প্রতি আশা বা ভয়ও করবে না। আল্লাহর সন্ধানে অস্থির চিত্ত থাকবে।
নেয়ামতের শোকর আদায় করবে। অভাব অনটনে পড়লে মন খারাপ করবে না। নিজের অধীনস্থদের সাথে নরম ব্যবহার করবে। তাদের ভুল-ত্রুটি মাফ করে দিবে। তাদের সমস্যা গ্রহণ করবে। কারো গীবত করবে না। দোষ তালাশ করবে না। মানুষের দোষ গোপন করবে। নিজের দোষ সামনে রাখবে। কারো সঙ্গে ঝগড়া করবে না। মেহমান ও মুসাফিরদের সেবা করবে। গরীব, মিসকিন, আলেম ও নেককার লোকদের সান্নিধ্য গ্রহণ করবে। অল্পেতুষ্টি এবং নিজে ত্যাগ স্বীকার করে অন্যকে সুবিধা দেওয়ার অভ্যাস রাখবে। ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে প্রিয় মনে করবে। কম হাসবে। বেশী কাঁদবে। আল্লাহর আযাব ও তার অমুখাপেক্ষিতার কথা স্মরণ করে প্রকম্পিত থাকবে। সর্বদা মৃত্যূর কথা স্মরণ রাখবে। প্রতিদিন নিজের আমলের হিসাব নিবে। নেককাজের জন্য শোকর আদায় করবে। গুনাহের জন্য তাওবা করবে।
সত্য কথা বলা এবং হালাল খাবার খাওয়াকে নিজের নীতি বানাবে। শরীয়তবিরোধী সমাবেশে যাবে না। অজ্ঞতাপ্রসূত প্রথা থেকে দূরে থাকবে। লজ্জাশীল, স্বল্পভাষী, আপোষকামী, সদাচারী, ব্যক্তিত্বপূর্ণ ও সহনশীল হয়ে থাকবে। এ সমস্ত গুণের কারণে অহংকারী হবে না। ওলীদের মাযার থেকে উপকৃত হতে থাকবে। মাঝে মাঝে সাধারণ মুসলমানদের কবরস্থানে গিয়ে সওয়াব পৌঁছাবে। পীরের আদব ও আনুগত্য পরিপূর্ণরুপে বজায় রাখবে। সর্বদা দ্বীনের উপর অবিচল থাকার জন্য দু’আ করবে।
আলহামদুলিল্লাহ, ২৭শে সফর ১৩১৫ হিজরী বৃহস্পতিবার চাশতের সময় কানপুরস্থ জামিউল উলূম মাদরাসায় ‘তা’লীমুদ্দীন’ পুস্তিকাটি সমাপ্ত হলো।
হে আল্লাহ! আপনি একে কবুল করে আপনার বান্দাদেরকে উপকৃত করুন।
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! কল্যাণ ও সৌভাগ্যের সঙ্গে সমাপ্তি দান করুন।’
Leave a Reply