অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের বর্ণনা – ২

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
ওয়াহদাতুল উজুদঃ সুফীদের পরিভাষায় তাওহীদের আরেকটি অর্থ রয়েছে। তা হলো, ‘লা মাওজুদা ইল্লাল্লাহ’। অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যাকে তারা ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ বলে। এ অর্থটিকে কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা করা-বাহুল্য চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। এ কথার ব্যাখ্যা এমনভাবে দেওয়া, যাতে কুরআন ও হাদীসের পরিপন্থী না হয়-তাই শ্রেয়। বর্তমান যুগে এ বিষয়টি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে বিষয়টি সূক্ষ্ম, অপরদিকে এর ভিত্তি কেবলমাত্র মনে উদ্রেক হওয়া ধারণা ও কাশফের উপর। তাই প্রথমতঃ বিষয়টিকে উপস্থাপন করার মত যথাযথ ও যথেষ্ট পরিমাণ ভাষা পাওয়াই জটিল। কারণ, ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আর সামান্য যা কিছু উপস্থাপন সম্ভব, তা বোঝার জন্যও এ ধরনের রুচি-প্রকৃতির অধিকারী হওয়া প্রয়োজন এবং কাশফের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা ছাড়াও কুরআন হাদীস ও যুক্তি শাস্ত্রে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন।
এ যুগে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’-এর বেশীর ভাগ দাবীদারের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয়। তাদের এ সম্পর্কে না ইলম আছে, না রুচি ও প্রকৃতি আছে। কেবলই মৌখিক ও ভাসা ভাসাভাবে কথাটি বলে দেওয়াই তাদের কাজ। তাদের এ পরোয়া নাই যে, না বুঝে কেবলই মৌখিকভাবে এ ধরনের ধর্মহীন কথা উচ্চারণ করায় ঈমান চলে যাবে। তাদের এদিকেও কোন খেয়াল নাই যে, সাধারণ মানুষ আমাদেরকে এ বিষয়ে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মনে করে আমাদের অন্ধ অনুকরণ করে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’-এর বিশ্বাস পোষণ করে। উপরন্ত্ত তারাও ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’-এর দাবী করতে আরম্ভ করবে। যার পরিণতিতে ভাঙ্গা-চুরা যাওবা ঈমান তাদের ছিলো তাও হাতাছাড়া হয়ে যাবে। নামায-রোযা পরিত্যাগ করবে। তারা মনে করবে যে, যখন আমিই খোদা হয়ে গেছি, তখন আর নামায রোযা কিসের? নাউযুবিল্লাহ। ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’-এর কখনই এ অর্খ নয়। মূলতঃ এটি একটি আধ্যাত্মিক বিশেষ অবস্থা। যার উপর এ অবস্থা বিরাজ করে সেই তা বুঝে। তাই অবস্থা প্রবল না হলে ইচ্ছা করে এটি মুখে উচ্চারণ করাও উচিত না এবং অন্যদের জন্য তা বোঝাও সম্ভব না। এ ভাব প্রবল রুপ ধারণ করলে তার যে অবস্থা সৃষ্টি হয়, কবির ভাষায় তা হলো এই-
‘আমার ব্যথিত হৃদয় ও বিনিদ্র নয়নে তুমিই ছেয়ে আছো। এমনকি যত ব্যথা-বেদনা সব তোমারই দান মনে করি।
‘যখন থেকে আমার নয়ন যুগলে তুমি ছেয়ো আছো। তখন থেকে যেদিকে তাকাই কেবল তোমাকেই দেখতে পাই।’
কখনো এ ভাব ও অবস্থা স্থায়ী হয়, কখনো বা ক্ষণস্থায়ী হয়। ইনশাআল্লাহ সুস্থ থাকলে কোন সুযোগে এ বিষয়টি নিয়ে অধিক গবেষণা করার ইচ্ছা আছে। এখানে কেবলই হিতাকাংখীতাপূর্ণ এ নিবেদন করে এ সম্পর্কিত আলোচনা শেষ করছি যে, আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের উপর এবং উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার উপর দয়া করে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা পরিহার করুন। বরং সতর্ক পন্থা এই যে, কাশফ হওয়ার পরও একে চূড়ান্ত মনে করবেন না। কারণ, কাশফের মধ্যে বিশেষতঃ ‘কাশফে ইলাহিয়্যাতের’ মধ্যে কখনো কখনো বিচ্যুতি ঘটে। মূল লক্ষ্য ইবাদতে রত থাকুন। মৌখিক জমা-খরচ পরিহার করুন।
‘কথা ছেড়ে কাজ করুন।’
‘আল্লাহর পথে নিছক দাবী নয়, সাহস করে অগ্রসর হতে হবে। কাজে অগ্রসর না হয়ে নিছক দাবীর কোন মূল্য নেই।’
শিরকের প্রকারসমূহ
শিরক দুই প্রকার-
ক. আকীদার ক্ষেত্রে শিরক।
খ, আমলের ক্ষেত্রে শিরক।
আকীদার ক্ষেত্রে শিরক হলো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের উপযুক্ত মনে করা। এ শিরক সম্পর্কেই পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
অর্থঃ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে কাউকে শরীক করে, এছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’ (সূরা নিসা-১১৬)
আমলের ক্ষেত্রে শিরক হলো- যে সমস্ত কাজ ও আচরণ আল্লাহর জন্য করা উচিত, সেগুলো আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা। এ প্রকারের শিরকের মধ্যে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ, বিশেষতঃ নারীরা অধিক লিপ্ত। যেমনঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা। কারো নামে মান্নত করা। কোন জিনিসকে স্বভাবগতভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী মনে করা। কাউকে সম্মান করে সিজদাহ করা। বাইতুল্লাহ ছাড়া অন্য কোন জিনিসের তওয়াফ করা। সওয়াবের নিয়তে কবরে কোন কিছু দেওয়া। এরুপ বলা যে, উপরে আল্লাহ নীচে তুমি। এ জাতীয় আরো অসংখ্য কাজ আছে, যেগুলো মারাত্মক গুণাহ। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য নিজেদের পরিবার থেকে এগুলো সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে দেওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।’ (সূরা তাহরীম-৬)
ফেরেশতাদেরকে নারী বা পুরুষ বলা
ফেরেশতাদের নারী বা পুরুষ হওয়ার বিষয়টি যেহেতু কোন প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তাই তাদের নারী বা পুরুষ হওয়ার বিশ্বাস পোষণ করবে না। এ বিষয়টি আল্লাহর হাতে অর্পণ করবে। কালাম শাস্ত্রবিদদের (তাদেরকে নারী বা পুরুষ বিশেষণে ভূষিত করা যাবে না) কথার অর্থও এটাই। বিষয়টি ভালো করে বুঝে নাও।
রাসূল ও আসমানী কিতাবের সংখ্যা নির্ধারণ না করা
নবীদের সংখ্যা যেহেতু কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, তাই কোন নির্দিষ্ট সংখ্যায় বিশ্বাস পোষণ করবে না। কারণ, তখন কম বেশী হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। একইভাবে আসমানী কিতাবের সংখ্যাও নির্দিষ্ট করবে না।
ফায়দা: আখিরাতের উপর ঈমান আনার মধ্যে নিম্নের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- কবরের সওয়াব ও আযাবকে বিশ্বাস করা। হাশর-নাশরের উপর বিশ্বাস করা। পুলসিরাত, হাউজে কাউসার ও আমল মাপার ‘মীযান’ বা নিক্তির উপর ঈমান আনা। কিয়ামতের সব ঘটনার উপর ঈমান আনা।
এসব বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে।
তাকদীরের বিশ্লেষণ:
মানুষের যে, কিছু পরিমাণ এখতিয়ার বা ইচ্ছাশক্তি রয়েছে তা প্রশ্নাতীত। এ কারণেই মানুষ তার কতক অশালীন আচরণের কারণে চরমভাবে অনুতপ্ত হতে বাধ্য হয়। তার মন কোনভাবেই শান্তি পায় না। স্থির হয় না। মানুষের যদি ইচ্ছাশক্তি না থাকতো তাহলে সে অনুতপ্ত হতো না, অস্থির হতো না। যেমন, কম্পনের রোগীকে তার কম্পনের কারণে কখনো অনুতপ্ত হতে বা ভুল স্বীকার করতে কেউ দেখেনি। এতে নিশ্চিত করে জানা গেলো যে, মানুষের ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব প্রমাণ করার অপেক্ষা রাখে না। তবে এর সঙ্গে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট যে, তার ইচ্ছাশক্তি সৃষ্ট বস্ত্ত। আর প্রত্যেক সৃষ্ট বস্ত্তর ধারাবাহিকতা স্রষ্টা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। বিধায় অবশ্য-অবশ্যই তার ইচ্ছাশক্তি অপর এক মহান সত্তার ইচ্ছাশক্তির অধীন। মানুষের এ পর্যায়টি তার শক্তিহীনতার প্রমাণ করে। তাই মানুষ পুরোপুরি অক্ষম বা পূর্ণাঙ্গ সক্ষম নয়। তাকদীরের সারকথা এটাই। আর এতটুকু বিষয় বুঝতে কোন জটিলতা বা প্রশ্ন সৃষ্টি হয় না। আমাদেরকে তাকদীর বিষয়ে এতটুকুই বোঝার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর অধিক বোঝার যোগ্যতাও আমাদের নেই এবং সে নির্দেশও আমাদের দেওয়া হয়নি। বরং অধিক বিশ্লেষণে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কারণ, এর জন্য কুরআন-হাদীস, যুক্তি-তর্ক ও অন্যান্য শাস্ত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে কাশফের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বরং এতসব পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ পরিষ্কার হতে চায় না। এক প্রকারের দ্বিধা ও অস্পষ্টতা কাজ করে। এ বিষয়টি সম্পর্কিত সাধারণ মানুষের কিছু সন্দেহের জওয়াব ‘জাযাউল আ’মাল’ পুস্তিকার শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, যা অধ্যয়ন করা সবার জন্য জরুরী।
Leave a Reply