উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

দ্বিতীয় অধ্যায়
জিহ্বার সঙ্গে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের বর্ণনা

জিহ্বার সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখা সাতটি-
১. ‘তাওহীদ’ তথা একত্ববাদের কালিমা পাঠ করা।
২. পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা।
৩. ইলম শিক্ষা করা।
৪. ইলম শিক্ষা দেওয়া।
৫. দু’আ করা।
৬. যিকির করা।
৭. অনর্থক ও নিষিদ্ধ কথা থেকে বিরত থাকা।
অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত শাখাসমূহের ন্যায় এ শাখাগুলোরও সংক্ষিপ্ত ফযীলত ও আনুসাঙ্গিক আলোচনা কয়েকটি পরিচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।

প্রথম পরিচ্ছেদ:
হযরত আবু যর গিফারী (রাযিঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে কোন মানুষ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, আর তার উপর তার মৃত্যু হবে, সে অবশ্যই বেহেশতে প্রবেশ করবে। আমি নিবেদন করলাম-সে জেনা করলেও এবং চুরি করলেও? তিনি বললেন-সে জেনা করলেও এবং চুরি করলেও। এভাবে তিনবার প্রশ্নোত্তর হয়।’ (বুখারী, মুসলিম)

হযরত আবু সা’য়ীদ ও আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের মৃত্যুবরণকারীদেরকে তোমরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শিক্ষা দাও।’ (মুসলিম)

হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা’ বলার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের সাথে লড়ার হুকুম করা হয়েছে। তাই যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, সে তার জান ও মাল আমার থেকে রক্ষা করলো। তবে তার হকের কারণে (অর্থাৎ, এ ব্যক্তি যদি অন্যের জানমালের ক্ষতি করে, তাহলে তার বদলা নেওয়া হবে। এবং এমন যে কোন অপরাধ করলে, যার ফলে আর্থিক বা দৈহিক শাস্তিযোগ্য প্রমাণিত হয়, তখনও তার বদলা নেওয়া হবে) এবং তার হিসাব আল্লাহর হাতে।’ (বুখারী, মুসলিম)
ইমাম আহমাদ (রহঃ) এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেন-
‘তোমরা নিজেদের ঈমান তাজা করো। আরয করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! ঈমান কীভাবে তাজা করবো? তিনি ইরশাদ করলেন-অধিক হারে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো।’
ফায়দাঃ উপরোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অনেক ফযীলত প্রমাণিত হয়। পীর, মাশাইখগণ এর অনুশীলনের বিভিন্ন পন্থা উদ্ভাবন করেছেন।
এখানে কয়েকটি বিষয় বিশ্লেষণযোগ্য রয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা হলো।
মৌখিক স্বীকৃতি ঈমানের শর্ত ও অঙ্গ হওয়ার বিশ্লেষণ:
ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য ঈমানের বাস্তবায়ন সকল হকপন্থীর নিকটই জরুরী। তবে ঈমানের মৌখিক স্বীকৃতি এবং তাকে কাজে পরিণত করা ঈমানের অঙ্গ নাকি শর্ত? অর্থাৎ, ঈমানের ভিতরের বিষয়, নাকি বাইরের বিষয় এটি একটি আলোচনা সাপেক্ষ ব্যাপার। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এ মতবিরোধ নিছক উপস্থাপনের ভিন্নতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, মৌখিক স্বীকৃতি ছাড়া ঈমান অস্তিত্ব লাভ করে না। তাই বোঝা গেলো যে, মৌখিক স্বীকৃতি ঈমানের শর্ত হওয়া বা অঙ্গ হওয়ার দ্বারা তার পারিভাষিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। কারণ, কোন জিনিসই তার শর্ত বা অঙ্গ অস্তিত্ব লাভ করা ছাড়া অস্তিত্ববান হতে পারে না। তাই যিনি মৌখিক স্বীকৃতিকে ঈমানের শর্ত বলেছেন, তিনি বাহ্যিক বিধানবলীর বাস্তবায়নের জন্য তা বলেছেন। আর যিনি একে ঈমানের অঙ্গ বলেছেন-তিনি এ কথাও স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, এটি অতিরিক্ত একটি অঙ্গ, যা বিলুপ্ত হতে পারে। তাই এমতবিরোধ কেবলই উপস্থাপনের ভিন্নতা মাত্র। অন্যথায় অর্থের দিক থেকে উভয় পক্ষ একই বিষয়ের প্রবক্তা। অর্থাৎ, মৌখিক স্বীকৃতি ঈমানের হাকীকতের ভিত্তি নয়। পক্ষান্তরে মৌখিক স্বীকৃতি ছাড়া ইসলামের বিধি-বিধানও প্রয়োগ করা হবে না। এ বিষয়টিকেই কেউ শর্ত বলেছে, কেউ অঙ্গ বলেছে। আর পরিভাষার ক্ষেত্রে এ ধরনের মতবিরোধের সুযোগ রয়েছে।

আমল ঈমানের শর্ত ও অঙ্গ হওয়ার বিশ্লেষণ:
আমল ঈমানের ভিতরের অঙ্গ নাকি বাইরের অঙ্গ এ মতবিরোধটিও বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে দেখলে একটি শাব্দিক মতবিরোধ মাত্র। কারণ, যারা আমলকে ঈমানরের ভিতরের অঙ্গ বলেন-তারা একথাও স্বীকার করেন যে, নেক আমল ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা ঈমান বিলুপ্ত হয় না। তাই বোঝা গেলো, তাদের মতে ঈমানের দ্বারা পরিপূর্ণ ঈমান উদ্দেশ্য, যা ঈমানের সাথে আমলের সমন্বয় হলেই লাভ হয়। আর যারা আমলকে বাইরের অঙ্গ বলেন-তারা ঈমান দ্বারা কেবলমাত্র অন্তরের বিশ্বাসকে বুঝিয়েছেন। অতএব ঈমানের দু’টি অর্থ হলো। প্রথম অর্থ-পরিপূর্ণ ঈমান, যা অন্তরের বিশ্বাস ও আমলের সমন্বয়ে লাভ হয়। যে ঈমান জাহান্নামে প্রবেশ করা থেকে পরিত্রান দেবে। আর ঈমানের দ্বিতীয় অর্থ- শুধুমাত্র অন্তরের বিশ্বাস। যা চিরতরে জাহান্নামী হওয়া থেকে পরিত্রান দেবে।

ঈমান কি বাড়ে কমে?
ঈমান কম-বেশী হওয়ার মতবিরোধ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যায় যে, এ বিষয়ে আসলে কোন মতবিরোধ নাই। কারণ, পরিপূর্ণ ঈমান আমলের সমন্বয়েই লাভ হয়। তাই আমলের কম-বেশীর কারণে ঈমান কম-বেশী হয়। আর শুধু অন্তরের বিশ্বাস-যা ঈমানের মানকে নির্ণয় করে, পরিমাণকে নয়-তা বাড়ে-কমে না। কারণ, বাড়া-কমা পরিমাণের বিষয়, মানের বিষয় নয়। তবে ঈমান সবল ও দুর্বল হয়, আর কখনোও সবল ও দুর্বল হওয়াকেও বাড়া-কমা বলা হয়। এ অর্থে অন্তরের বিশ্বাসও কম-বেশি হয়। কুরআন শরীফে যে, ঈমান বাড়ে বলা হয়েছে, এর দ্বারা সবল হওয়া বুঝানো হয়েছে। তাতে বৃদ্ধি শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। যদিও প্রকৃত অর্থে সবল হওয়া এবং বৃদ্ধি পাওয়া ভিন্ন জিনিস। এদিক থেকে ঈমানের মান কম-বেশী হয় ঠিকই, কিন্ত্ত পরিমাণের কম-বেশী হয় না। তাই এটি কোন মৌলিক মতবিরোধ নয়।

পবিত্র কু্রআন তিলওয়াত করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তোমরা কুরআন পাঠ করো। নিঃসন্দেহে তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীদের জন্য সুপারিশকারী হয়ে আসবে।’ (মুসলিম)
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) হাদীস উদ্ধৃত করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমার উম্মতের সমস্ত ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা।’
ইমাম আহমাদ (রহঃ) হাদীস বর্ণনা করেন-
‘কুরআন ওয়ালারাই আল্লাহ ওয়ালা এবং তার খাস লোক।’
পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে আরো অনেক হাদীসই বর্ণিত হয়েছে।

পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের জরুরী আদবসমূহ:
পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের অনেকগুলো আদব রয়েছে। তার মধ্যে কিছু রয়েছে জাহেরী আদব, আর কিছু রয়েছে বাতেনী আদব। সংক্ষিপ্ত এই যে, কুরআন শরীফ পড়ার সময় ওযু থাকতে হবে। কাপড় পবিত্র হতে হবে। জায়গা পবিত্র হতে হবে। সেখানে দুর্গন্ধ না থাকতে হবে। কিবলামুখী হয়ে বসা ভালো। হরফসমূহ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করবে। একদম মন না বসলে তখন পড়া বন্ধ রাখবে। মনোযোগ সহকারে পড়বে। তিলাওয়াতের সময় মনোযোগ রাখার সহজ পদ্ধতি এই যে, তিলাওয়াত আরম্ভ করার পূর্বে এ চিন্তা করবে-যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে হুকুম করেছেন-আমাকে কিছু কুরআন পড়ে শোনাও! আমি তার হুকুম পালনের জন্য পড়ছি এবং তাকে শুনাচ্ছি। এভাবে চিন্তা করার দ্বারা সহজেই সমস্ত আদব নিজে নিজেই রক্ষা হবে।

পবিত্র কুরআনের সাথে আমাদের আচরণ:
আফসোস! এ যুগে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ, বরং বিশেষ মানুষেরাও পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সম্পূর্ণরুপে উদাসীন হয়ে গেছে। কতক লোক তো কুরআন মাজীদ পড়া ও পড়ানোকে বেকার মনে করে। নাউযুবিল্লাহ! অতি কষ্টে কেউ পড়লেও তা মনে রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় না। আর যারা নিয়মিত পড়ে তারা বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের প্রতি লক্ষ্য করে না। কতক ছাত্রের কুরআন পড়ার উপর এই কবিতা পরিপূর্ণরুপে ফিট হয়-
‘তুমি যদি এভাবে কুরআন পড়ো, তাহলে মুসলমানিত্বের সৌন্দর্যই বিলুপ্ত করে ছাড়বে।’
আর যারাও বা শুদ্ধ করে, তারা অর্থ বোঝার দিকে মনোযোগ দেয় না। যারা তরজমা ও তাফসীরও পড়ে, তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে না। আর যারা এ ধাপও অতিক্রম করে, তাদের এর উপর আমলের প্রতি কোন যত্ন থাকে না। আর এ অভিযোগ তো বর্তমান যুগে ব্যাপক। অধিকাংশ আলেম ‘মুতাওয়াতির’ সাত কিরাত সম্পর্কে অবগত নয়। যেন এক কিরাত ছাড়া অন্যান্য কিরাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত ও প্রমাণিতই নয়। মোটকথা, সবাই সম্মিলিতভাবে পবিত্র কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে। ভয় করা উচিত। কিয়ামতের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করেন-যেমন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
অর্থঃ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে পরিত্যাগ করে রেখেছে।’ (সূরা আল ফুরকান-৩০)