অন্যান্য অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের বর্ণনা – ২

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
সদকা করা বা দান করা
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিয়েছেন, আর সে তার যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে একটি নেড়ে সাপের রুপ দেওয়া হবে। যার চোখের উপর বিন্দু থাকবে। (এ ধরনের সাপ খুব বিষাক্ত হয়) ঐ সাপ তার গলায় বেড়ীর মত পরিয়ে দেওয়া হবে। সাপ তার দুই চোয়াল কামড়ে ধরবে, আর বলবে-‘আমি তোমার সম্পদ।’ ‘আমি তোমার সঞ্চিত ধন।’
তারপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করেন-
(এ আয়াতের মধ্যে সম্পদ বেড়ীর আকারে পেঁচিয়ে ধরার কথা উল্লেক আছে।) (বুখারী)
যাকাত প্রদানে অবহেলাকারীদের ভ্রান্ত চিন্তার যৌক্তিক অপনোদন
অধিকাংশ সম্পদশালী লোক যাকাত দিতে অবহেলা করে থাকে। ভয় পায় যে, টাকা কমে যাবে। বন্ধুগণ! প্রথমতঃ অভিজ্ঞতার দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, যাকাত ও সদকা দেওয়ার দ্বারা সম্পদ কখনই কমে না। তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা কমলেও অন্য সময় আবার এর চেয়ে অধিক চলে আসে। হাদীস শরীফেও এ বিষয়টি এসেছে।
দ্বিতীয়তঃ যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আসলেই সম্পদ কমে যায়, তাতে কী আসে যায়? নিজের মনের কামনা পূরণের জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করো। তখনো তো সম্পদ কমে যায়। সরকারের কর ও শুল্কের খাতে অনেক কিছু দিতে হয়। না দিলে বিদ্রোহী ও আসামী সাব্যস্ত করা হয়। এতেও তো সম্পদ কমে যায়। তাই এটাকেও আল্লাহর কর মনে করো।
তৃতীয়তঃ বাহ্যিকভাবে এখানে কম হতে দেখা গেলেও তা তো আখেরাতে জমা হচ্ছে। ডাকঘরে ও ব্যাংকে যখন সঞ্চয় করো, তখনো তো সম্পদ তোমার হাত থেকে বের হয়ে যায়। কিন্ত্ত তৃপ্তিতে থাকো যে, এটা নির্ভরযোগ্য জায়গা। এখানে রাখলে মুনাফা হতে থাকবে। একইভাবে ঈমানদার ব্যক্তির আল্লাহ প্রদত্ত ওয়াদার উপর আস্থা পোষণ করে বোঝা উচিত যে, সেখানে সঞ্চয় হচ্ছে। এবং কিয়ামতের দিন মূলধন ও লাভ একত্রে এমন সময় পাওয়া যাবে, যখন এটার তীব্র প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া সম্পদ সংরক্ষণের জন্য পাহারাদার রাখো, চাকর রাখো, তাদেরকে বেতন দিতে হয়। তখনও বেতন পরিমাণ সম্পদ কমে যায়। কিন্ত্ত এ অল্প টাকা বাঁচতে গিয়ে সব টাকা চুরি না হয়ে যায় এই ভয়ে ঐ টাকা ব্যয় করাকে মেনে নাও। একইভাবে যাকাত প্রদান করাকে মাল সংরক্ষণের উপায় মনে করো। হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় যে, যাকাত না দিলে সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়।
হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
‘যে মালের মধ্যে এই যাকাত মিশ্রিত হয়, সে মালকেই তা ধ্বংস করে ফেলে।’
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ), ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘তারীখ’ গ্রন্থে এবং হুমাইদী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
তবে হুমাইদীর বর্ণনায় এতটুকু অতিরিক্ত আছে যে, ‘তোমার উপর যাকাত ওয়াজিব হলো, আর তুমি তা দিলে না, তাহলে এ হারাম মাল ঐ হালাল মালকে ধ্বংস করে ফেলবে।’
তাই যাকাতকে নিজের মালের হিফাযতের জন্য চৌকিদারের বেতনই মনে করো। তাছাড়া অভাবীদের পিছনে কিছু না কিছু খরচ করতেই হয়। এটাই যদি হিসাব করে খরচ করতে তাহলে যাকাত দেওয়া সহজ হয়ে যেতো।
সদকায়ে ফিৎর
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রমাযানের শেষে বলেন- তোমাদের রোযার সদকা দাও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সদকা নির্ধারণ করেছেন। এক ‘সা’ খুরমা বা যব অথবা আধা ‘সা’ গম প্রত্যেক স্বাধীন বা দাস, পুরুষ বা নারী, শিশু বা বৃদ্ধের পক্ষ থেকে।’ (আবু দাউদ, নাসায়ী)
তার থেকে আরো বর্ণিত আছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদকায়ে ফিতর এজন্য নির্ধারণ করেছেন, যেন রোযা অনর্থক কাজ ও অশ্লীলতা থেকে পবিত্র হয়ে যায় এবং গরীব মানুষেরা খাদ্য পায়।’ (আবু দাউদ)
সদকায়ে ফিতরের বিস্তারিত মাসআলা ফিকহের কিতাবসমূহ থেকে জেনে নিতে হবে।
সম্পদের মধ্যে যাকাত ছাড়া আরো হক রয়েছে
একটি ভ্রান্তির নিরসনঃ বেশীর ভাগ কঠিন মনের লোক মনে করে যে, আমরা যখন যাকাত দিয়েছি, তখন আর আমাদের দায়িত্বে অন্য কোন হক নেই। তাদের হৃদয় এত কঠিন হয়ে থাকে যে, কোন অসহায় দরিদ্র মানুষ না খেয়ে মারা গেলেও, তাদের কাছে হাজার হাজার টাকা থাকলেও তার প্রতি তাদের কোনরুপ দয়ার উদ্রেক হয় না। একটি পয়সাও দান করে না। তারা একথা ধারণা করে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকে যে, আমরা তো যাকাত দিয়েছি। আমাদের আর কোন দায়্ত্বি নেই। এটা একান্তই ভুল ধারণা। খোদ হাদীস শরীফে আছে-
‘নিশ্চয়ই মালের মধ্যে যাকাত ছাড়া আরো হক রয়েছে। তারপর তিনি এর সত্যায়নে ‘লাইসাল বিররা’ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজা, দারামী)
আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে প্রথমে সম্পদ দান করার কথা বলেছেন, তারপর যাকাত দেওয়ার কথা বলেছেন। এতে বোঝা যায় যে, এ দান যাকাতের বাইরে। একইভাবে অনেক হাদীস দ্বারা সম্পদের যাকাত ছাড়া আরো অনেক হক প্রমাণিত হয়। আসল কথা হলো, মালের মধ্যে দুই ধরনের হক রয়েছে। নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট। যাকাত নির্দিষ্ট হক-যা বিশেষ সময়ে, বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে বিশেষ পরিমাণে নির্ধারিত হয়।
দ্বিতীয় প্রকারের হলো, অনির্দিষ্ট হক। হকদারদের প্রয়োজনের মাত্রা তার ভিত্তি। এর কোন মূলনীতি নেই। যেমন, কোন অভাবী প্রার্থীর একটাকা প্রয়োজন, আর আমার নিকট আমার প্রয়োজনের চেয়ে একটাকা অতিরিক্ত রয়েছে, তখন কি তাকে সাহায্য করা আমার জন্য জরুরী হবে না? অবশ্যই হবে। এমনিভাবে কাউকে ঋণ দেওয়া, কোন জিনিস ধার দেওয়া, কাজে সহযোগিতা করা- এগুলোও সামর্থ্য মোতাবেক জরুরী।
রোযা রাখা
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘মানুষের সমস্ত আমলের ক্ষেত্রে বিধান হলো, একটি নেকী দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-তবে রোযা ছাড়া। কারণ, তা বিশেষভাবে আমার জন্য, আর তার প্রতিদান আমি নিজে দেবো। আমার খাতিরে রোযাদার নিজের কামনা, বাসনা ও পানাহার ত্যাগ করে।
রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে। একটি আনন্দ হলো, ইফতারের সময়, আর দ্বিতীয়টি হলো, নিজের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। নিঃসন্দেহে রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়ে অধিক পবিত্র এবং রোযা ঢালস্বরুপ। তোমাদের কেউ রোযা রাখলে সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং হৈচৈ না করে। কেউ যদি গালিগালাজ করে বা ঝগড়া করে তাহলে বলে দেওয়া উচিত যে, ভাই! আমি তো রোযাদার।’ (বুখারী, মুসলিম)
রোযায় অবহেলা ও ত্রুটিকারীদের সংশোধন
রোযার ফযীলত এবং রোযা না রাখার নিন্দা সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্ত্ত আফসোস! এ যুগের অধিকাংশ সচ্ছল লোক রোযা থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। তারা বলে-ক্ষুৎপিপাসা সহ্য করতে পারি না। অবাক ব্যাপার যে, ডাক্তার যদি কোন রোগের কারণে বলেন যে, চারবেলা উপোস করতে হবে। তা না হলে মরে যাবে। তখন তিনি চারবেলার জায়গায় সতর্কতাস্বরুপ পাচঁবেলা উপোস করার জন্য আনন্দচিত্তে তৈরী হয়ে যায়। আফসোস! আল্লাহর হুকুম, ডাক্তারের হুকুমের সমানও হলো না। আফসোস! আখিরাতের জীবন দুনিয়ার জীবনের সমানও হলো না। হে আল্লাহ! আমার ভাইদেরকে সুবুদ্ধি দান করুন। নফস ও শয়তানের প্রভাব তাদের থেকে দূর করে দিন।
রোযা তিন প্রকার-১. ফরয রোযা, অর্থাৎ, রমাযান শরীফের রোযা, মান্নতের রোযা, কাফফারার রোযা, কাযা রোযা এবং ‘হাদী’র পরিবর্তে রোযা।
২. নফল রোযা, এর মধ্যে ঈদুল ফিতরের পরের ছয় রোযা, যিলহজ্জ মাসের নয় রোযা, আশুরার দিনের রোযা, শাবান মাসের পনেরো তারিখের রোযা। এগুলো নির্দিষ্ট সময়ের নফল রোযা।
৩. অনির্দিষ্ট নফল রোযাসমূহ-
ঈদুল ফিতর, কুরবানীর ঈদ এবং কুরবানীর ঈদের পরের তিন দিন রোযা রাখা নিষেধ। বাকি যে কোন দিন নফল রোযা রাখতে পারবে।
হজ্জ ও উমরাহ
হযরত আবু উমামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তির জন্য স্পষ্ট অভাব, অত্যাচারী বাদশাহ এবং এমন রোগ, যার কারণে হজ্জে যাওয়া অসম্ভব হয়, হজ্জ করতে বাধা সৃষ্টিকারী না হয়-আর সে হজ্জ না করে মারা যায়, তাহলে তার ইচ্ছা সে ইহুদী হয়ে মরুক বা খৃষ্টান হয়ে মরুক।’ (দারামী)
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘হজ্জ ও উমরাহকারীগণ আল্লাহ তাআলার মেহমান। এরা আল্লাহ তাআলার নিকট দু’আ করলে তিনি তা কবুল করেন এবং গুনাহ মাফ চাইলে তিনি তাদেরকে মাফ করে দেন।’ (ইবনে মাজা)
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি হজ্জ, উমরাহ বা জিহাদ করার জন্য বাড়ী থেকে বের হয়, তারপর সে পথেই মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য হজ্জকারী, উমরাহকারী ও জিহাদকারীর সওয়াব লিখেন।’
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) ‘শুয়াবুল ঈমান” গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হজ্জ সংক্রান্ত কিছু ভ্রান্ত চিন্তার সংশোধন
বেশীর ভাগ টাকাওয়ালা হজ্জের ক্ষেত্রেও ত্রুটি করে। কেউ নিজের ব্যবসাকে বাহানা বানায়। কেউ সাগরের (ঢেউয়ের) কারণে ভিমড়ি খায়। কেউ বেদু্ঈনদেরকে আযরাঈল মনে করে।
বন্ধুগণ! এ সমস্ত হিলা-বাহানা কেবলমাত্র হজ্জের গুরুত্ব অন্তরে না থাকা এবং আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেওয়াকে জরুরী মনে না করার কারণেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত থেকে অন্তর খালী, তা না হলে কোন কিছুই প্রতিবন্ধক হতো না। নিম্নে একটি সাধারণ দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি-বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট যদি নিজে পথ খরচ দিয়ে তার সমীপে সসম্মানে আপনাকে ডেকে পাঠান তাহলে শপথ করে বলুন, আপনি কি তার উত্তরে বলবেন যে, আমার বাড়ীতে ব্যবসা দেখার কেউ নাই, আমি আসতে পারবো না। বা আমি নৌপথে ভ্রমন করতে ভয় পাই, তাই আমি আসতে পারবো না। বা পথের অমুক জায়গায় ছিনতাই হয়, তাই যাওয়াটাকে আমি অসতর্কতা মনে করি। মহাত্মন! তখন এ ধরনের কোন বাহানাই অন্তরে আসবে না। সমস্ত প্রয়োজন আর সমস্যা চুলোয় নিক্ষেপ করে অত্যন্ত আনন্দ-উদ্দীপনার সঙ্গে প্রাণপণে দৌড়ে যাবেন। তখন সব সমস্যা সহজ মনে হবে।
আসল ব্যাপার হলো, সংকল্প থাকলে সব কাজই সহজ হয়ে যায়। আর যদি সংকল্পই না করো, তখন সহজ কাজও কঠিন হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে বেদুঈনদের বদনাম করা সম্পূর্ণই অজ্ঞতা। যে সমস্ত লোক হজ্জ করে এসেছে এবং বাস্তব অবস্থা জানার আগ্রহও তাদের অন্তরে রয়েছে, তারা ভালো করেই জানে যে, বেদুঈনদের এটা কোন নতুন অবস্থা নয় বা নতুন কোন ঘটনাও সেখানে দেখা দেয় না, বরং ভারতে যে ধরনের ঘটনা ঘটে এবং যে সমস্ত কারণ দেখা দেয় সেখানেও একই ঘটনা এবং একই কারণ দেখা দেয়। এদেশেও গাড়ী চালকদেরকে একটু ভালো কথা বলে, খাবার দিয়ে, তামাক দিয়ে খুশী রাখলে তারা দাসে পরিণত হয়। আর যদি কঠোর কথা বলেন, গালি দেন তাহলে গাড়ী উল্টিয়ে দিবে বা অস্থির করে মারবে। একইভাবে এমন কঠোর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ষ্টেশন থেকে শহরে আসার এ সামান্য পথেই নানারকম দুর্ঘটনা ঘটে। সমস্যা দেখা দেয়। ওখানেও একই অবস্থা মনে করুন। বরং ওখানকার অবস্থা অনুপাতে যা ঘটে তা কিছুই নয়। ওখানে কোন চৌকিদার নেই, পাহারাদার নেই, তারপরও এত অল্প দুর্ঘটনা ঘটা আসলেই বিস্ময়কর ব্যাপার। আর যেটুকু সমস্যা হয়, তাও যাত্রীদের অনিয়ম ও অসতর্কতার কারণেই হয়, তা না হলে সবদিক থেকে শান্তি আর নিরাপত্তা রয়েছে।
বেশীর ভাগ মানুষের এ সমস্ত ঘটনা মারাত্মক মনে হওয়ার কারণ হলো- অপরিচিত দেশ, অপরিচিত ভাষা, তাই তারা এগুলো সহ্য করতে পারে না। সব কথার পরও আমি বলবো যে, এসব কিছুই হয়, তাতে কী? মানুষ কারো প্রেমে পড়ে সব ধরনের কষ্ট-লাঞ্ছনা সহ্য করে, তাহলে আল্লাহর মত প্রেমাস্পদের কী এতটুকু হকও নেই।
কবি বলেন-
‘হে মন! এটাই উত্তম যে, (ভালোবাসার) মদিরা পান করে উন্মাদ হয়ে থাকো। স্বর্ণ ও ধনভান্ডার ছাড়াই কারুণের চেয়ে অধিক প্রতাপের অধিকারী হয়ে থাকে। ‘লাইলী’র (অর্থাৎ প্রিয়ার) বাড়ীর পথে জানের অনেক বিপদ রয়েছে। কিন্ত্ত প্রেমপথের প্রথম শর্ত হলো, তোমাকে ‘মজনু’ হতে হবে।
হাজী সাহেবদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশ
হাজী সাহেবদের কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরী-
১. হজ্জের সফরে বিশেষতঃ বিমানে ও জাহাজে নামায কাযা করবে না। একটি ফরযের জন্য এতগুলো ফরযকে ছেড়ে দেওয়া অত্যন্ত খারাপ কথা।
২. হজ্জের সফরে কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করবে না। কারো উপর নির্ভরও করবে না।
৩. এমন ব্যক্তিকে মুয়াল্লিম নির্ধারণ করবে, যিনি হজ্জের মাসআলা খুব ভালো জানেন এবং বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা নিয়ে যাবে। খরচ করতে কার্পণ্য করবে না। এতে নানাপ্রকার কষ্ট সহ্য করতে হয়। আবার অপচয়ও করবে না। তাতে অভাবে পড়ে পেরেশান হতে হয়।
৫. কাফেলা ছেড়ে কখনোই বাইরে যাবে না।
৬. বেদুঈনদেরকে খুশী রাখবে। তারা অল্পতেই সন্ত্তষ্ট হয়।
৭. হজ্জের সফরকে প্রেমের সফর মনে করবে।
এতেকাফ
হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযান শরীফের শেষ দশদিনে এতেকাফ করতেন। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে ওফাত দেন। তারপর তার বিবিগণ ই’তিকাফ করতেন।’ (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই’তিকাফকারী সম্পর্কে বলেন- সে সমস্ত গুনাহ থেকে বিরত থাকে এবং এত অধিক নেক কাজের সওয়াব পায়, যেমন সমস্ত নেক কাজকারী ব্যক্তি সওয়াব পায়।’ (ইবনে মাজা)
এতেকাফের উদ্দেশ্য
গবেষক আলেমগণের মতে ই’তিকাফের ফায়দা হলো, শবে কদর তালাশ করা। কারণ, বেশীর ভাগ হাদীস অনুপাতে শবে কদর শেষ দশদিনে হয়ে থাকে। শবে কদরের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আনাস বিন মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘পবিত্র রমাযান মাস এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-তোমাদের নিকট এমন একটি মাস এসেছে, যার মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। (সেই রাতটিই শবে কদর) যে এ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। নিতান্ত বঞ্চিত ব্যক্তিই এ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে।’ (ইবনে মাজা)
কতক লোক দশদিন মসজিদের মধ্যে আটকে থাকাকেই ই’তিকাফ মনে করে। চাই সেখানে বসে সারা দুনিয়ার অর্থহীন কাজে লিপ্ত থাকুক না কেন। এমন ই’তিকাফ তো অর্থশূণ্য ও আকৃতিসর্বস্ব। ই’তিকাফের মগজ হলো, যিকির-ফিকির ও ইবাদতে রত থাকা। তাওবা ও ইস্তিগফার করা। নামাযের অপেক্ষায় থাকা ইত্যাদি। নিজের সময়গুলো এ সব কাজে ব্যস্ত রাখা উচিত। বেজোড় রাতসমূহে শবে কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। যতদূর সম্ভব এ রাতগুলোতে জাগ্রত থাকবে। ঘুমে কথা এলোমেলো হয়ে গেলেও, রুকু-সিজদাহর মধ্যে ভুল হয়ে গেলেও, ঘুমের তোড়ে পড়ে গেলেও সারারাত জেগে কাটাতে হবে, তা জরুরী নয়। এমন অবস্থা হলে কিছু সময় ঘুমানো উচিত। নিজেকে নিজে ধ্বংস করে ফেলো, এটা শরীয়তের হুকুম নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো, উদাসিনতা, অলসতা, বিমুখিতা ও বিস্মৃতির মধ্যে না থাকা। ইবাদতের চিন্তায় মগ্ন থাকবে। সামর্থ্য মোতাবেক চেষ্টার ত্রুটি করবে না। ক্লান্ত হলে নির্দ্বিধায় বিশ্রাম করবে। এমন বিশ্রামও ইবাদতের চেয়ে মর্যাদায় কম নয়।
Leave a Reply