উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

সন্তান প্রতিপালন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তির তিনটি মেয়ে হলো বা তিনটি বোন হলো এবং সে তাদেরকে ইলম ও আদব শিক্ষা দিলো, তাদের প্রতিপালন করলো এবং তাদের প্রতি সদয় আচরণ করলো, তার জন্য অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।’
ইমাম বুখারী (রহঃ) আদব গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘আদব’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন-
‘যেমন তোমাদের পিতার তোমাদের উপর হক রয়েছে, তেমনিভাবে তোমাদের সন্তানদের তোমাদের উপর হক রয়েছে।’
ফায়দাঃ ছেলে সন্তানদের প্রতি সহজাত ভালোবাসা থাকে বিধায় শরীয়ত তাদের হক বর্ণনার প্রতি বেশী গুরুত্বারোপ করেনি। আর মেয়ে সন্তানকে যেহেতু তুচ্ছ মনে করা হয়, তাই তাদের প্রতিপালনের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে।

আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি আত্মীয়দের সঙ্গে অসদাচরণ (আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন) করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারী)

মনিবের আনুগত্য
রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে দাস নিজের মনিবের কল্যাণ কামনা করবে এবং নিজের প্রভুর ইবাদত উত্তমভাবে পালন করবে, সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে।’ (বুখারী)

ন্যায়ভাবে শাসন পরিচালনা করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘সাত ব্যক্তি এমন রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন আরশের ছায়া দান করবেন। তাদের মধ্যে একজন হলো, ন্যায়বিচারক বাদশাহ।’ (বুখারী, মুসলিম)

মুসলমান জামাআতের অনুসরণ করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমি তোমাদের এমন পাঁচটি বিষয়ের আদেশ করছি, যেগুলোর আদেশ আল্লাহ তাআলা আমাকে করেছেন। (দ্বীন ও আমীরের কথা) শ্রবণ করা, (দ্বীন ও আমীরের কথা) মান্য করা, দ্বীনের জন্য জিহাদ করা, হিজরত করা ও জামাআতের সাথে থাকা। কারণ, যে ব্যক্তি জামাআত থেকে অর্ধ হাতও বের হয়ে গেলো, সে ইসলামের বেড়ী নিজের গলা থেকে বের করে ফেললো। তবে যদি সে আবার জামাআতে ফিরে আসে সে ভিন্ন কথা।’ (তিরমিযী, নাসায়ী)
ফায়দাঃ অর্থাৎ, আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে হকপন্থী দলের অনুসরণ করবে। হকপন্থী দলের আলামত এই যে, তারা কিতাব ও সুন্নাত অনুপাতে চলে। কিতাব ও সুন্নাত মত চলার স্পষ্ট আলামত হলো, পূর্ব যুগের নেককার লোকদের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকা। সাহাবা ও তাবেঈদের সঙ্গে যত অধিক সাদৃশ্য থাকবে, কিতাব ও সুন্নাতের সঙ্গে তত অধিক মিল থাকবে।

শাসকের আনুগত্য
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো এবং শাসকের কথা শোনো ও মানো। যদিও সে হাবশী-গোলাম হোক না কেন।’ (আবু দাউদ)
ফায়দাঃ হাবশী-গোলাম যদিও শরীয়তের বিধানমতে ইমাম ও খলীফা হতে পারে না। কিন্ত্ত শরীয়তে ইমাম ও খলীফার আনুগত্য যেমন ওয়াজিব, সুলতানের আনুগত্যও তেমন ওয়াজিব। অর্থাৎ, যার প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ হয়েছে এবং মুসলমানগণ তার আশ্রয়ে শান্তি ও নিরাপত্তায় থাকতে পারে, তারও আনুগত্য করতে হবে। আর সুলতান হওয়ার জন্য ঐ সমস্ত শর্ত নেই, ইমাম ও খলীফা হওয়ার জন্য যে সমস্ত শর্ত রয়েছে। তবে তার মুসলমান হওয়া শর্ত। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘এবং তোমাদের শাসকগণের।’ (সূরা নিসা-৫৯)
আর যদি কাফের শাসকের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি হয়, তাহলে ঐ চুক্তি বাস্তবায়ন করা ওয়াজিব। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘এবং তোমরা অঙ্গীকার পুরা করো।’ (সূরা বানী ইসরাঈল-৩৪)
তবে যদি শরীয়তসম্মত প্রয়োজনে ঐ অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে হয়, তাহলে প্রথমেই প্রতিপক্ষকে অঙ্গীকার তুলে নেওয়ার ব্যাপারে অবহিত করবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘সমানভাবে তাদের নিকট তা নিক্ষেপ করো।’ (সূরা আনফাল-৫৮)
তা না হলে বিশ্বাসঘাতকতার গুনাহ হবে, যা খুব মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বিশ্বাসঘাতকদেরকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনফাল-৫৮)

বিবাদী দুই দলের মাঝে সন্ধি স্থাপন
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপরদলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমনকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’ (সূরা হুজরাত-৯)
এ আয়াত দ্বারা দু’টি বিষয় জানা গেলো। প্রথমতঃ বিবাদকামী উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের চেষ্টা করো। দ্বিতীয়তঃ এর পরও যদি কেউ জুলুম করার জন্য উঠে পড়ে লাগে তাহলে মাজলুমকে একা ছেড়ে দিও না, তার সাহায্য করো এবং জালেমের জুলুমকে প্রতিহত করো।

সৎকাজে সাহায্য করা
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘সৎকাজে এবং পরহেযগারীর কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো।’ (সূরা মায়িদা-২)
ফায়দাঃ বর্তমান জামানায় কোন ব্যক্তি যদি কোন ভালো কাজ করার জন্য দাঁড়ায়, তাহলে মানুষ ঐ কাজের সম্পূর্ণ বোঝা তার মাথায় চাপিয়ে দেয়। এটাকে তার ব্যক্তিগত কাজ মনে করে। কেউ এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করে না, সহযোগিতা করে না।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা জানা গেলো যে, সবারই যে পরিমাণ ও যেভাবে সম্ভব তাকে সাহায্য করা জরুরী।

ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজে নিষেধ করা
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা আবশ্যক, যারা সৎকাজের দিকে আহ্বান করবে এবং ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে এবং তারাই হবে সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান-১০৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন মন্দ কাজ হতে দেখলে নিজ হাতে তা মিটিয়ে দেওয়া দরকার। সে ক্ষমতা না থাকলে মুখে নিষেধ করবে। এটাও করতে না পারলে নিজের মনে তাকে মন্দ জানবে। এটা ঈমানের খুবই দুর্বল স্তর। (মুসলিম)
ফায়দাঃ এর দ্বারা জানা গেলো যে, শক্তি ও সামর্থ্য পরিমাণ ভালো কাজে আদেশ করা এবং মন্দ কাজে বারণ করা ওয়াজিব। যে নিজ হাতে তা বিলুপ্ত করতে পারবে, যেমন, দেশের শাসক, বাড়ীর প্রধান, কোন দল ও সমিতির নেতা, তাহলে সে হাত দ্বারা বিলুপ্ত করবে। আর যে মুখে নিষেধ করতে পারে, যেমন, বক্তা, উপদেশদাতা বা যার কথা মানুষ মানে, সে মুখে বলবে। আর এরুপ না হলে চুপ করে থাকাই ভালো। ফিৎনা-ফাসাদ করে কী লাভ? শুধুমাত্র মনে মনে তাকে খারাপ জানবে। আর যদি অন্তরেও ঘৃণা না থাকে তাহলে তার অন্তরের হিফাযতকারী আল্লাহই। ওয়াজিব তো এতটুকুই। বাকী কারো যদি অধিক সাহস থাকে, বিপদের ভয় থাকা সত্ত্বেও সব বিপদ-আপদ সহ্য করতে পারে, তাহলে তো অনেক উঁচু সাহসিকতার কথা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘যা কিছু (কষ্ট) তোমার উপর পতিত হয়, তাতে তুমি সবর করো। নিশ্চয় এটা দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’ (সূরা লুকমান-১৭)

ইসলামী দন্ডবিধির বাস্তবায়ন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহর রাজ্যে আল্লাহ তাআলার দন্ডসমূহের একটি দন্ডকে প্রতিষ্ঠা করা চল্লিশ দিনের বৃষ্টির চেয়ে উত্তম।’ (ইবনে মাজা)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলার দন্ডবিধি প্রতিষ্ঠা করো, আপনদের মধ্যেও এবং পরদের মধ্যেও। কোন তিরষ্কারকারীর তিরষ্কার যেন আল্লাহর পথে তোমাদেরকে বাধাগ্রস্ত না করে।’ (ইবনে মাজা)
কতক গুনাহের উপর শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে শাস্তি রয়েছে তাকে ‘হদ্দ’ বলে। ‘হদ্দ’ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কারো পক্ষপাতিত্ব করা জায়িয নেই। তা নামায-রোযার মতই ফরয। এর মধ্যে হস্তক্ষেপ করা নামায-রোযার মধ্যে হস্তক্ষেপ করার সমতুল্য। আর যে সমস্ত অন্যায়ের শাস্তি নির্ধারিত নাই, সেক্ষেত্রে শাস্তি দেওয়াকে ‘তা’যীর’ বলে। এটিই শাসকের মতামতের উপর নির্ভর করে। কোন কল্যাণকে সামনে রেখে এর পরিমাণ কম করা বা কাউকে ক্ষমা করা জায়েয আছে। বরং কতক ক্ষেত্রে উত্তম। একটি হাদীসে এমনই উল্লেখ আছে।