অন্যান্য অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের বর্ণনা – ৬

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
দ্বীন প্র্রচার করা
এ ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত আছে।
আমানত আদায় করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যার মধ্যে আমানতদারী নাই, তার মধ্যে ঈমান নাই।’ (আহমাদ)
ইমাম তাবরানী (রহঃ) একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন-
‘ইলমের ব্যাপারে কল্যাণ কামনা করো। কারণ, ইলমের মধ্যে খিয়ানত করা মালের মধ্যে খিয়ানত করার চেয়ে মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন।’
অর্থাৎ, কাউকে ইলমের মধ্যে ধোঁকা দিও না। ভুল শিক্ষা দিওনা। না জানলে বলে দাও আমি জানি না।
ঋণ দেওয়া
ইবনে মাজা শরীফে হাদীস রয়েছে-
‘দান করার দ্বারা দশগুণ সওয়াব পাওয়া যায়, আর কাউকে ঋণ দেওয়ার দ্বারা আঠার গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। এর কারণ হলো-বিনা প্রয়োজনেও দান চাওয়া হয়। কিন্ত্ত ঋণ শুধু প্রয়োজনেই চাওয়া হয়।’
তাছাড়া দান করে দাতা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। কিন্ত্ত ঋণ দিলে ঋণদাতার সেদিকে মনোযোগ থাকে ও টান থাকে। ফলে দেরীতে উসুল হলে, বিশেষতঃ নিজের প্রয়োজনের সময় উসূল না হলে অনেক কষ্ট হয়। তাই এর সওয়াব অধিক।
ফায়দাঃ আঠার গুণ সওয়াব হওয়ার রহস্য এই যে, আসলে ঋণ দেওয়ার দ্বারা দান করার দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এক টাকা দান করলে দশ টাকা দান করার সওয়াব পাওয়া যায়, আর ধার দিলে পাওয়া যায় বিশ টাকার। কিন্ত্ত ঋণদাতা যেহেতু নিজের এক টাকা ফিরিয়ে নেয়, তাই দুই টাকা পরিমাণ কমে আঠার টাকা থেকে যায়। (প্রকৃত অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন)
প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদাচরণ করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার উপর এবং কিয়ামতের দিনের উপর ঈমান রাখে, সে যেন নিজের প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (বুখারী, মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘নিজের প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করো, তাহলে তুমি ঈমানদার হয়ে যাবে।’ (তিরমিযী)
অপর একটি হাদীসে এসেছে-
‘নিজে পেট ভরে খাবে আর প্রতিবেশী উপবাস থাকবে এটি ঈমানদারের কাজ নয়।’
উত্তমভাবে লেনদেন করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদেরকে পাপীরুপে উঠানো হবে। তবে যে আল্লাহকে ভয় করলো, পবিত্র লেনদেন করলো এবং সত্য বললো।’ (তিরমিযী)
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট তার পাওনার দাবী জানালো এবং খুব কঠোর আচরণ করলো। সাহাবাগণ তাকে সাবধান করতে চাইলে তিনি বললেন, একে কিছু বলো না। কারণ, পাওনাদারের কথা বলার অধিকার রয়েছে এবং তাকে একটি উট ক্রয় করে দাও। লোকেরা বললো, তার উটের চেয়ে ভালোটা পাওয়া যায়। তিনি বললেন, ওটাই কিনে দাও। নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম ঐ ব্যক্তি, যে অন্যের পাওনা উত্তমভাবে পরিশোধ করে।’ (বুখারী, মুসলিম)
ফায়দাঃ বন্ধুগণ! আপনারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম লেনদেনের নমুনা দেখলেন। আপনাদের নিকট একটু জোরালোভাবে চাইলেই মেজাজ বিগড়ে যায়। আফসোস! আমরাই আমাদের বড়দের দুর্নাম রটাচ্ছি।
সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সম্পদ নষ্ট করাকে অপছন্দ করেন।’ (বুখারী, মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘অনর্থক অপব্যয় করো না।’ (সূরা বানী ইসরাঈল-২৬)
হালাল সম্পদের মূল্যায়ন করা
হালাল মালের মূল্যায়ন করা উচিত। তা নষ্ট করা উচিত নয়। হাতে টাকা থাকলে মন নিশ্চিন্ত থাকে। হাতে টাকা না থাকলে মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘মানুষের উপর এমন এক সময় আসবে, যখন দিনার ও দিরহাম ছাড়া কোন কিছু কাজে আসবে না।’ (আহমাদ)
অর্থাৎ,যার কাছে টাকা থাকবে সে টাকার বদৌলতে হারাম উপার্জন থেকে, হিংসা থেকে, দ্বীন বিক্রি করা থেকে, ভিক্ষা করা থেকে, লাঞ্ছনা থেকে, ধনীদের দুয়ারে যাওয়া থেকে, তাদের তোষামোদ করা থেকে, অত্যাচারীদের অত্যাচার থেকে, নিজের দ্বীন ও ইলমকে ধ্বংস ও লাঞ্ছিত করা থেকে বেঁচে থাকবে। তাই হিসেব করে অর্থ ব্যয় করা উচিত। জায়েয কাজেও অপচয় করবে না। আর নাজায়েয কাজে খরচ করা তো পরিষ্কার হারাম, তাই তা বলারও অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে যাদের বিভিন্ন জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে এবং যারা উপকরণের মধ্যে আবদ্ধ, তাদের জন্য তো এটি খুবই জরুরী বিষয়। বরং যে পরিমাণ আয় হয় তা থেকে যতদূর সম্ভব সঞ্চয় করবে, যেন অভাবের সময়, বার্ধক্যের সময়, দুর্ভিক্ষের সময় ও দুর্দিনের সময় কাজে আসে। এভাবে সঞ্চয় করায় গুনাহ নেই। বরং ভালো নিয়্যত থাকলে সওয়াব আছে। হাদীস শরীফে এসেছে-
‘সৎলোকের জন্য সৎ মাল খুবই উত্তম।’
সালাম ও হাঁচির জওয়াব দেওয়া
ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের হক পাঁচটি। তার মধ্যে দু’টি এই-
১. সালামের উত্তর দেওয়া। ২. হাঁচিদাতার উত্তর দেওয়া।
ফায়দাঃ কুরআন শরীফে আছে-
‘তোমাকে কেউ সালাম দিলে তার চেয়ে উত্তমভাবে সালামের জওয়াব দাও বা তাই ফিরিয়ে দাও।’
এর দ্বারা জানা গেলো যে, সালামের উত্তরে মাথা নাড়া বা হাত উঠানোই যথেষ্ট নয়। হাদীস শরীফের মধ্যে সালাম দেওয়ার জন্য ‘আসসালামু আলাইকুম’ বা এর কাছাকাছি শব্দ এসেছে। ‘আদাব’, ‘বন্দেগী’, ‘কুর্নিশ’ ইত্যাদি বলে সালাম দেওয়া জঘন্য বিদআত। হাঁ, কেউ যদি সালাম শব্দ ব্যবহার করা খুবই খারাপ মনে করে তাহলে তার জন্য ‘হযরত সালামত’ বা ‘তাসলিম’ বা ‘তাসলিমাত’ বলার সুযোগ আছে মনে হয়।
হাঁচিদাতার উত্তর দেওয়ার অর্থ এই যে, কেউ হাঁচি দিয়ে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বললে তার উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা উচিত।
কাউকে কষ্ট না দেওয়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘এক পক্ষ থেকেও ক্ষতি করা উচিত নয়। উভয়পক্ষ থেকেও ক্ষতি করা উচিত নয়।’ (দারে কুতনী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘মুসলমান তো সেই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে।’ (বুখারী)
ফায়দাঃ দ্বিতীয় হাদীসে মুসলমানকে এবং প্রথম হাদীসে সমস্ত সৃষ্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে। চাই তা মুখ দ্বারা হোক, যেমনঃ কাউকে গালি দেওয়া এবং গীবত শেকায়েত করা, বা হাত দ্বারা হোক, যেমনঃ মারা, জুলুম করা।
ক্রীড়া-কৌতুক থেকে দূরে থাকা
উকবা বিন আমের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘ক্রীড়া-কৌতুকের সবকিছুই অনর্থক। তবে ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও স্ত্রীর সঙ্গে হাসি-তামাশা করা এ তিনটি খেলা উপকারী।’ (তিরমিযী)
ফায়দাঃ মনোরঞ্জনের বেশীর ভাগ জিনিসই সময়ের মত অমূল্য সম্পদের অপচয়কারী ও অর্থহীন। তবে এ তিনটি জিনিস বা এগুলোর মতো উল্লেখযোগ্য উপকার যার মধ্যে রয়েছে, তা খেলায় দোষ নেই। এর দ্বারা তাস, পাশা ইত্যাদি আরো হাজার প্রকার খেল-তামাশা সম্পর্কে শরীয়তের বিধান অবগত হওয়া যায়। বরং এগুলোর মন্দ প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে এগুলোকে নিছক অনর্থকই দেখা যাবে। এসব খেলার পিছনে যে সমস্ত উপকারিতার কথা বলা হয় বিবেকবানদের নিকট সেগুলোর কোনই মূল্য নেই।
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা
এক হাদীসে বর্ণিত আছে-
‘একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলার পথে একটি কাঁটাওয়ালা ডাল পড়ে থাকতে দেখতে পেলো। পথচারীদের যেন কষ্ট না হয় এজন্য সে ডালটি পথ থেকে সরিয়ে ফেললো। আল্লাহ তার এ কাজের মূল্যায়ন করলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন।’ (বুখারী, মুসলিম)
বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলাকে ঈমানের শাখাসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন বলা হয়েছে। তাই আল্লাহর মেহেরবানীতে এর উপরই ঈমানের শাখাসমূহের আলোচনা সমাপ্ত হলো।
দু’আ ও শোকর
হে আল্লাহ! এ পুস্তিকাকে যেমনিভাবে আপনার মেহেরবানীতে সমাপ্ত করালেন তেমনিভাবে আপনার হাবীবের উসীলায় একে কবুলের মর্যাদায় ভূষিত করুন। সমস্ত মুসলমানের জন্য এটিকে উপকারী ও কল্যাণকর করুন। তারা যেন এটি পড়ে, বুঝে এবং সে অনুপাতে আমল করে নিজেদের ঈমানকে পরিপূর্ণ বানায়। সকল মুসলমানের উসীলায় ও বরকতে এ অধমকে পরিপূর্ণ ঈমান দান করুন এবং এ পুস্তিকাকে মুক্তির উসীলা এবং আপনার নৈকট্য ও সন্ত্তষ্টির মাধ্যমরুপে কবুল করুন।
‘আমার পক্ষ থেকে এ দু’আ, আর সারা জগতবাসীর পক্ষ থেকে ‘আমীন’ হোক।’
আলহামদুলিল্লাহ! ১৩১৫ হিজরীর মুহাররম মাসের মাঝামাঝি কানপুর শহরের জামিউল উলূম মাদরাসায় এ পুস্তিকার পান্ডুলিপি তৈরীর কাজ সমাপ্ত হয়।
Leave a Reply