উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হুকুকুল ইসলাম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

প্রতিবেশীর হকসমূহ
সাধারণ মুসলমান হওয়া ছাড়া যাদের মধ্যে অন্য কোন বৈশিষ্ট্য থাকবে, তাদের হকও অধিক হবে। যেমন প্রতিবেশীর এ সমস্ত হক রয়েছে-
১. তার সঙ্গে সদয় ও ছাড়ের আচরণ করবে।
২. তার পরিবার-পরিজনের মান-সম্মানের হেফাযত করবে।
৩. মাঝে মাঝে তার বাড়ীতে হাদিয়া-উপঢৌকন পাঠাতে থাকবে। বিশেষতঃ যখন তারা অনাহারক্লিষ্ট হয়, তখন অবশ্যই অল্পবিস্তর খাবার তাদেরকে দিবে।
৪. তাকে কষ্ট দিবে না। সাধারণ সাধারণ ব্যাপারে তার সাথে কলহে লিপ্ত হবে না। তার কষ্ট প্রতিহত করার লক্ষ্যে শরীয়ত তার জন্য ‘শোফ’য়ার’ হক রেখেছে।
আলিমগণ বলেছেন যে, যেমন আবাসে প্রতিবেশী হয়, তেমনি প্রবাসে বা সফরেও প্রতিবেশী হয়। অর্থাৎ, সফরসঙ্গী, সে বাড়ী থেকে এক সঙ্গে সফর আরম্ভ করুক, বা পথে ঘটনাচক্রে সফরসঙ্গী হোক, উভয়েই প্রতিবেশী বলে গণ্য হবে। হাদীস শরীফে প্রথমোক্তজনকে ‘জারে মাকাম’ শেষোক্তজনকে ‘জারে বাদিয়াহ’ বলা হয়েছে। আবাসের প্রতিবেশীর ন্যায় সফরের প্রতিবেশীরও হক রয়েছে। তার হকের সারকথা হলো-তার আরামকে নিজের আরামের উপর প্রাধান্য দিবে। কিছু কিছু লোক ট্রেনের সফরে যাত্রীদের সঙ্গে অনেক বাকবিতন্ডা করে থাকে, যা নেহায়েতই মন্দ স্বভাব।

ইয়াতীম ও দুর্বলদের হকসমূহ

যে সমস্ত লোককে অন্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হয়, যেমন-ইয়াতীম, বিধবা, অক্ষম, দুর্বল, অসহায়, অসুস্থ, পঙ্গু, পথিক বা ভিক্ষুক। তাদের অতিরিক্ত এ সমস্ত হক রয়েছে-
১. তাদের আর্থিক সহযোগিতা করবে।
২. নিজের হাত-পা দ্বারা তাদের কাজ করে দিবে।
৩. তাদের মনোরঞ্জন ও সান্তনা দান করেন।
৪. তাদের অভাব মোচন করবে এবং তাদের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করবে না।

মেহমানের হকসমূহ
মেহমানের হকসমূহ এই-
১. তার আগমনের সময় হাসিমুখে তাকে বরণ করা। যাওয়ার সময় কমপক্ষে দরজা পর্যন্ত সাথে যাওয়া।
২.তার কার্যাবলী সম্পাদন এবং প্রয়োজনসমূহ পূরণের সুব্যবস্থা করা, যেন সে আরাম পায়।
৩. বিনয়, সম্মান ও ভদ্র আচরণ করা, বরং স্বহস্তে তার সেবা করা।
৪. কমপক্ষে একদিন তার জন্য খাবারের আয়োজনে মধ্যম পর্যায়ের আড়ম্বর করা। তবে তা হতে হবে সীমিত পর্যায়ে, যেন নিজেরও সংশয় না হয় এবং তারও সংকোচ না হয়। কমপক্ষে তিনদিন পর্যন্ত তার মেহমানদারী করা। এতটুকু তো তার জরুরী হক। এরপর যে কয়দিন সে অবস্থান করে, এটা মেজবানের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ। তবে মেহমানের সমীচীন, অধিকদিন অবস্থান করে বা অনর্থক ফরমায়েশ করে মেজবানকে বিরক্ত না করা। খাদ্য নির্ধারণ, বসার স্থান নির্ণয় ও সেবাযত্ন ইত্যাদি বিষয়ে দখলদারী না করা।

বন্ধু-বান্ধবের হকসমূহ
যার সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব রয়েছে, পবিত্র কুরআনে তাকে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। তার আদব ও হকসমূহ এই-
১. যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, তার আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ও লেন-দেন ভালো করে যাচাই করে নেবে, সব বিষয়ে তাকে ভালো ও সঠিক পেলে তার সাথে বন্ধুত্ব করবে। তা না হলে দূরে থাকবে। মন্দ লোকের সংসর্গ থেকে দূরে থাকার খুব তাকিদ এসেছে। তাছাড়া বাস্তব অভিজ্ঞতাতেও তার ক্ষতি দেখতে পাওয়া যায়। সমজাতের ও সমচিন্তার কোন লোক পাওয়া গেলে তার সাথে বন্ধুত্ব করায় কোন ক্ষতি নেই। বরং পৃথিবীতে সবচে’ বড় আরামের জিনিস হলো বন্ধুত্ব।
২. নিজের জানমাল তার জন্য ব্যয় করতে কখনো পিছপা হবে না।
৩. নিজের রুচিবিরুদ্ধ কোন কাজ তার থেকে দেখা দিলে তা এড়িয়ে যাবে। ঘটনাচক্রে মনোমালিন্য হলে অবিলম্বে মিটমাট করে নিবে। তা দীর্ঘায়িত করবে না। বন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং বন্ধুর বিষয়ে আলোচনার মাঝে মজা আছে, তাই বলে সারাদিন এ নিয়েই বসে থাকবে না।
৪. তার কল্যাণ কামনায় কোনরুপ ত্রুটি করবে না। সৎপরামর্শ দিতে কখনো পিছপা হবে না। তার পরামর্শ সৎনিয়তে শুনবে। বাস্তবায়নযোগ্য হলে গ্রহণ করবে।

মনে রাখতে হবে যে, ভারতে পালক ছেলে বানানোর যে নিয়ম চালু রয়েছে যে, সমস্ত বিধানের ক্ষেত্রে তাকে পরিপূর্ণরুপে নিজের সন্তানের মত মনে করে, শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই। পালক সন্তান বানানোর প্রতিক্রিয়া বন্ধুত্বের প্রতিক্রিয়ার অধিক নয়। যেহেতু তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে, তাই বন্ধুত্বের নিয়ম-কানুনে তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। উত্তরাধিকার ইত্যাদি সে পাবে না। কারণ, উত্তরাধিকার বাধ্যতামূলক বিষয়, ঐচ্ছিক বিষয় নয় যে, যাকে ইচ্ছা উত্তরাধিকার দিয়ে দিলো, আর যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করলো।
এ থেকে আরো জানা গেলো যে, ভারতবর্ষে যেরুপ ত্যাজ্যপুত্র করার প্রচলন রয়েছে যে, মৃত্যুর সময় কোন সন্তানের বিষয়ে এ কথা বলে মারা যায় যে, তাকে যেন উত্তরাধিকার দেওয়া না হয়-তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ, উপরে জানা গেছে যে, উত্তরাধিকার বাধ্যতামূলক বিষয়, ঐচ্ছিক নয়।