উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হুকুকুল ইসলাম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

অমুসলিমদের হকসমূহ
আত্মীয়তা বা ইসলামে শরীক থাকার কারণে যেমন অনেক হক প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি শুধু জাতীয়তায় শরীক থাকার দ্বারাও কিছু হক প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ, শুধু মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখা ওয়াজিব হয়ে থাকে। যদিও সে মুসলমান না হয়। সে হকগুলো এই-
১. কোন নিষ্পাপ লোকের জানমালের ক্ষতি করবে না।
২. শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া কারো সাথে বচসা করবে না।
৩. বিপদ, উপবাস বা রোগে আক্রান্ত দেখলে তার সাহায্য করবে। খাদ্য ও পানীয় দিবে। চিকিৎসা ও ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করবে।
৪. যে সমস্ত অবস্থায় শরীয়ত শাস্তি প্রদানের অনুমতি দিয়েছে, সে সমস্ত অবস্থাতেও বাড়াবাড়ি ও অত্যাচার করবে না। তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করবে না।

জীব-জন্ত্তর হকসমূহ

জীব-জন্ত্ত প্রাণী জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখাও জরুরী। জীব-জন্ত্তর হকসমূহ এই-
১. যে জীবের সঙ্গে উল্লেখ্যযোগ্য কোন উপকারিতা সম্পৃক্ত নয় তাকে বন্দী করবে না। বিশেষতঃ বাসা থেকে বাচ্চা বের করে এনে তার মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া বড়ই নির্দয় ব্যাপার।
২. উপকারী কোন জীবকেও নিছক শখ পূরণের জন্য হত্যা করবে না। শিকারীরা এতে খুবই আক্রান্ত।
৩. যে পশু তোমার কাজে নিয়োজিত আছে, যত্ন সহকারে তার পানাহার, সেবা-যত্ন ও আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা নিবে। তার শক্তির অধিক তার দ্বারা কাজ করাবে না। তাকে সীমাতিরিক্ত প্রহার করবে না।
৪. যে জীবকে জবাই করবে বা কষ্টদায়ক হওয়ার কারণে হত্যা করবে, তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করবে। তাকে কষ্ট দিবে না বা ক্ষুৎপিপাসায় কষ্ট দিয়ে ধুকে ধুকে মারবে না।

ব্যক্তির নিজের উপর আরোপিত হকসমূহ
উপরোক্ত হকসমূহ তো এমন ছিলো, যেগুলো প্রথম থেকেই মানুষের দায়িত্বে অর্পিত ছিলো। আর কিছু হক এমন রয়েছে, যেগুলো মানুষের দায়িত্বে না থাকলেও সে স্বেচ্ছায় নিজের দায়িত্বে জরুরী করে নেয়। সেগুলোর মধ্যে কিছু হক রয়েছে আল্লাহর। সেগুলো আবার তিন প্রকারের-
প্রথম প্রকারঃ প্রথম প্রকার ঐ হক, যা ইবাদত হওয়ার কারণে করা হয়ে থাকে। তা হলো ‘মান্নত’। প্রত্যক্ষ ইবাদতের মান্নত করলে তা পুরা করা ফরয এবং ওয়াজিব। আর পরোক্ষ ইবাদতের মান্নত করলে তা পুরা করা মুস্তাহাব। আর ‘মোবাহ’ কাজের মান্নত করলে তা অর্থহীন মান্নত, যা পুরা করতে হবে না। পাপ কাজের মান্নত করলে তা পুরা করা হারাম। গাইরুল্লাহর নামে মান্নত করা শিরকের কাছাকাছি।
দ্বিতীয় প্রকারঃ যে হকের কারণ মোবাহ কাজ, যেমন-‘মোবাহ’ বা জায়িয শপথের কাফফারা এবং মুসাফির ও অসুস্থ ব্যক্তির রমাযানের রোযা কাযা করা। এ সমস্ত হক আদায় করা ওয়াজিব।
তৃতীয় প্রকারঃ যে হকের কারণ গুনাহের কাজ। যেমন ঐ সমস্ত ‘হদ্দ’ ও ‘কাফফারা’, যেগুলো শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া রোযা ভাঙ্গার কারণে বা ভুলবশতঃ হত্যা করার কারণে বা ‘যিহারের’ কারণে ওয়াজিব হয়। এ সমস্ত হক আদায় করাও ওয়াজিব।

যে সমস্ত হক মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের উপর জরুরী করে নেয়, তার মধ্যে কিছু রয়েছে বান্দার হক। এটিও তিন প্রকার-

প্রথম প্রকারঃ প্রথম প্রকার ঐ হক, যার কারণ ইবাদত। তা হলো অঙ্গিকার পূর্ণ করা। এর মধ্যে ত্রুটি করাকে মুনাফেকীর আলামত বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকারঃ যে হকের কারণ ‘মোবাহ’ বা বৈধ কাজ। আর তা হলো দেনা বা দেনার মত জিনিস। যেমন, বিক্রিত পণ্য হস্তান্তর করা, বিবাহিতা নারী নিজেকে স্বামীর হাতে সমর্পণ করা, ‘শোফ’য়ার’ অধিকারীকে তার প্রার্থিত সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া, ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা, মহর পরিশোধ করা, শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেওয়া এবং ধার নেওয়া জিনিস এবং আমানতের বস্ত্ত ফেরত দেওয়া। এ সবই ওয়াজিব।
তৃতীয় প্রকারঃ যে হকের কারণ পাপ কাজ। যেমন, কাউকে হত্যা করা, কারো সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া, চুরি করা, খিয়ানত করা বা কটু কথা বলে বা গীবত করে কারো মানহানী করা। এ সবের ক্ষতিপূরণ করা এবং ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ফরয। তা না হলে আখিরাতে এর পরিবর্তে ইবাদত দিতে হবে বা শাস্তি ভোগ করতে হবে।

পরিশিষ্ট
যার দায়িত্বে অপরিশোধিত হকসমূহ রয়েছে, (অর্থাৎ, কারণ ছাড়া যে সকল অলসতা ও অমনোযোগিতার কারণে আদায় করা হয়নি) সেগুলো যদি আল্লাহর হক হয় এবং ইবাদত সংক্রান্ত হয়, তাহলে সেগুলো কাযা করবে। যেমন, কারো দায়িত্বে কিছু নামায, রোযা বা যাকাত ইত্যাদি রয়ে গেছে, তাহলে সেগুলো হিসাব করে পুরা করবে। আর এমতাবস্থায় সময় বা সম্পদের সুযোগ না হলে সেগুলো আদায় করার ইচ্ছা অন্তরে পোষণ করবে। সুযোগ-সামর্থ্য হলে তখন আর ত্রুটি করবে না। আর যদি সে হক গুনাহ সংক্রান্ত হয়, তাহলে সেগুলো থেকে খাঁটি মনে তাওবা করবে। ইনশাআল্লাহ সব মাফ হয়ে যাবে।
অপরিশোধিত হকসমূহ যদি বান্দার হয়ে থাকে, তাহলে যেগুলো পরিশোধযোগ্য, সেগুলো পরিশোধ করবে এবং মাফ নিয়ে নিবে। যেমন-ঋণ, খিয়ানত ইত্যাদি। আর যেগুলো শুধু মাফ চেয়ে নেওয়ার যোগ্য, সেগুলো শুধু মাফ করিয়ে নিবে। যেমন-গীবত ইত্যাদি। আর কোন কারণে যদি পাওনাদারের থেকে মাফও করানো না যায় এবং পরিশোধও করা না যায়, তাহলে তাদের জন্য সবসময় আল্লাহ তাআলার নিকট মাফ চাইতে থাকবে। আশ্চর্যের কিছু নয় যে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাদেরকে খুশী করে মাফ করিয়ে দিবেন। কিন্ত্ত যখন পরিশোধ করার বা মাফ চেয়ে নেয়ার সামর্থ্য হবে, তখন এতে পিছপা হবে না।
নিজের যে সমস্ত হক অন্যের দায়িত্বে রয়ে গেছে, তার মধ্যে যাদের থেকে উসুল হওয়ার আশা আছে, সেগুলো নরমভাবে উসুল করবে। আর যাদের থেকে উসুল হওয়ার আশা নেই বা যেগুলো উসুলযোগ্য নয়, যেমন-গীবত ইত্যাদি, কিয়ামতে এগুলোর বিনিময়ে সওয়াব পাওয়ার আশা আছে ঠিক, তবে মাফ করে দেওয়ার ব্যাপারে আরো অধিক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তাই একেবারে মাফ করে দেওয়া সবচাইতে ভালো। বিশেষতঃ যখন কেউ ভুল স্বীকার করে এবং মাফ চায়।