হুকুকুল ওয়ালিদাইন – ২

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হুকুকুল ইসলাম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করার সঠিক অর্থ
হাদীসে আছে যে, মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করা নামায, রোযা, হ্জ্জ, ওমরা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকে উত্তম। (হাদীসটি প্রমাণিত নয়, বিধায় গ্রহণযোগ্যও নয় এবং এটিকে হাদীস বলা বৈধ নয়। যেমন কিনা ইমাম শাউকানী ‘মুখতাসারের’ উদ্ধৃতিতে ‘ফাওয়ায়িদে মাজমুয়ায়’ বর্ণনা করেছেন। এটি শরীয়তের নীতিরও পরিপন্থী, যে সম্পর্কে পরবর্তীতে জানা যাবে।
মিশকাত শরীফের ‘বাবুল বিররি ওয়াস সিলা’ অধ্যায়ে তিরমিযী শরীফের বর্ণনাসূত্রে উল্লেখ আছে যে, প্রভুর সন্ত্তষ্টি মা-বাবার সন্ত্তষ্টির মধ্যে এবং প্রভুর অসন্তুষ্টি মা-বাবার অসন্তুষ্টির মধ্যে (অর্থাৎ, মা-বাবা সন্তুষ্ট থাকলে আল্লাহ তাআলাও সন্তুষ্ট থাকবেন, আর তারা অসন্তুষ্ট থাকলে আল্লাহ তাআলাও অসন্তুষ্ট থাকবেন)।
ফায়দাঃ এ হাদীস থেকে মানুষের ধারণা হয় যে, প্রত্যেকটি কাজ মা-বাবার সন্তুষ্টি মত করা জরুরী। তা নাহলে গুনাহ হবে। অথচ ইসলামের নির্দেশ তা নয়। তাই এই হাদীসের সঠিক অর্থ হলো, শরীয়তের দৃষ্টিতে যে সমস্ত বিষয়ে মা-বাবার আনুগত্য জরুরী, ঐ সমস্ত বিষয়ে যদি ত্রুটি করে তাহলে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হবে। আর মা-বাবার অবাধ্য তখন গণ্য হবে, যখন তাদের জরুরী হকসমূহ আদায় না করবে। তাই এ নির্দেশ নিঃশর্তভাবে নয়, বরং এটাও ঐ মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত, যা শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, যা করলে মা-বাবার কষ্ট হয় সে কাজ না করা ওয়াজিব।
যে ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসূল এ হাদীস বর্ণনা করেছেন তা মা-বাবার হকসমূহের গুরুত্ব বর্ণনা করে থাকে এবং আমি এ হাদীসের যে ব্যাখ্যা করেছি তা পরিষ্কার বুঝিয়ে থাকে। যা ‘আশিয়্যাতুল লুমআত’ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে।
আর এর মূল রহস্য হলো, যদি সব বিষয়ে সন্তানকে মা-বাবার আনুগত্য করার এবং একইভাবে স্ত্রীকে সববিষয়ে স্বামীর আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হতো, তাহলে অনেক লোক আল্লাহর ইবাদত থেকে-যা মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য-বঞ্চিত হতো। নিজের প্রকৃত প্রিয়জন আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং তার যিকিরের প্রকৃত স্বাদ এবং উচ্চ মার্গে পৌঁছা থেকে বঞ্চিত থাকতো। যা ছাড়া মহান স্রষ্টার অন্বেষীর কোন শান্তিই নেই। এবং এটাই জীবনের মূল লক্ষ্য। যা ভূমিকায় আলোচনা করেছি।
মানব-সৃষ্টির মূল লক্ষ্য
আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন-
‘এবং আমি জিন ও ইনসানকে কেবল আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা যারিয়াত-৫৬)
মা-বাবার নির্দেশে স্ত্রীকে তালাক দিবে কি?
মিশকাত শরীফের উক্ত অধ্যায়ে হযরত আবুদ দারদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি তার নিকট এসে বললো যে, আমার একজন স্ত্রী আছে, আমার মা তাকে তালাক দেওয়ার হুকুম দিচ্ছে (এখন আমি তালাক দিব কি দিব না?) তখন তিনি ঐ লোককে বললেন-আমি হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, বাপ(এবং মা) বেহেশতের শ্রেষ্ঠ দরজা। (অর্থাৎ, বেহেশতে প্রবেশের কারণসমূহের শ্রেষ্ঠ দরজা হলো বাপ (এবং মা’র) সন্তুষ্টি)। এখন তুমি চাইলে এ দরজার হেফাজত করো, আর চাইলে তা নষ্ট করো। হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এবং ইবনে মাজাহ (রহঃ) রেওয়ায়েত করেছেন।
বাহ্যতঃ ঐ মহিলার দ্বারা ঐ লোকের মা (বাস্তবিক) কষ্ট পেতো, যার কারণে সে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিতো। তা নাহলে বিনা কারণে তালাক দেওয়ানো জুলুম। আর জুলুমের কাজে সাহায্য করা জুলুম। তাই হযরত আবুদ দারদা (রাযিঃ) কি করে সেই জুলুমের কাজের অনুমতি প্রদান করতে পারেন।
এই একই উত্তর ঐ হাদীসেরও, যার মধ্যে একথা বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর (রাযিঃ) চাইতেন যে, তার ছেলে স্ত্রীকে তালাক দিক। ওদিকে তার ছেলে তালাক দিতে চাচ্ছিলেন না। তখন তিনি হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন। তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তালাক দিতে বললেন। হাদীসটি ইমাম তিরমিযী ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হযরত উমর (রাযিঃ) এর ন্যায় মকবুল সাহাবী কারো উপর জুলুম করতে পারেন না। অসম্ভবকে মেনে নিয়ে যদি বলাও হয় যে, তিনি জুলুম করেছেন, তাহলে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা কি করে মেনে নিতে পারেন এবং জুলুমের কাজে কি করে সহযোগিতা করতে পারেন? এ হাদীসের প্রায় এমনই ব্যাখ্যা ইমাম গাযযালী (রহঃ) ইহ্ইয়াউল উলূম গ্রন্থে প্রদান করেছেন।
মা-বাবার হক আদায় করার উপর বেহেশতের সুসংবাদ
মিশকাত শরীফের উক্ত অধ্যায়ে বাইহাকীর সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনাব রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় ভোর করে যে, সে মা-বাবার (জরুরী) হক আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর অনুগত, তাহলে সে এমন অবস্থায় ভোর করে যে, তার জন্য বেহেশতের দু’টি দরজা উন্মুক্ত থাকে। আর যদি মা-বাবার মধ্যে থেকে একজন জীবিত থাকে, আর তার সঙ্গে এরুপ আচরণ করা হয়, তাহলে উল্লেখিত পন্থায় তার জন্য বেহেশতের একটি দরজা উন্মুক্ত থাকে। একইভাবে যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় ভোর করে যে, সে মা-বাবার (জরুরী) হকের ক্ষেত্রে আল্লাহর নাফরমানী করে, তাহলে তার জন্য জাহান্নামের দু’টি দরজা উন্মুক্ত হয়। আর যদি মা-বাবার মধ্যে থেকে একজন জীবিত থাকে তাহলে একটি দরজা উন্মুক্ত হয়। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, যদিও তার মা-বাবা তার উপর জুলুম করে? (অর্থাৎ, তাদের জুলুম-অত্যাচার সত্ত্বেও কি তাদের আনুগত্যই করবে?) হুযুর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার ইরশাদ করলেন, যদি তারা উভয়ে তার উপর জুলম করে। (তারপরও তার আনুগত্য করা উচিত এবং তা জরুরী।) উল্লেখ থাকে যে, এ হাদীসের অর্থ এই যে, মা-বাবা জুলুম করার কারণে, তাদের যে সমস্ত হক সন্তানের উপর ফরয, তা পুরা করতে ত্রুটি করবে না। এমন বলবে না যে, তারা আমাদের সাথে অসদ্ব্যবহার করেছে তাই আমরাও এমনই করবো।
আল্লাহর অবাধ্য হয়ে কারো নির্দেশ মানা যাবে না
মা-বাবা জুলুম করলেও তাদের অনুগত থাকার অর্থ এই নয় যে, তারা যদি এমন কোন কাজের হুকুম করে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে জুলুম, তাহলে তাও মানতে হবে। কারণ, সহীহ হাদীসে আছে-
‘খালেকের নাফরমানী করে কোন মাখলুকের কোনরুপ আনুগত্য নেই।’
কোন মাখলুকের এমন কোন হুকুম মানা, যা আল্লাহর হুকুমের বিরোধী, কখনোই জায়িয নয়।
(হাদীসের বাক্যটি বাহ্যত ‘খবর’ হলেও অর্থের দিক থেকে এটি ‘নাহী’ বা নিষেধাজ্ঞাসূচক। ‘খবরের’ রুপে ‘নাহী’ সরাসরি ‘নাহী’র তুলনায় অধিক জোরালো হয়ে থাকে। তাই এ হাদীস দ্বারা অত্যধিক তাকিদ সহকারে এ বিষয়টি প্রমাণিত হলো যে, কোন মাখলুকের এমন কোন কথা মানা, যার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানী রয়েছে, মোটেও জায়িয নেই। বিষয়টি খুব ভালো করে বুঝে নাও।
মা-বাবার ব্যয়ভার কখন ওয়াজিব হয়
স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যয়ভার ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়ের ব্যয়ভার বহন করা পুরুষের উপর তখন ওয়াজিব হয়, যখন সে এ পরিমাণ মালের মালিক হয়, যার দ্বারা সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। মা-বাবাও এ হুকুমেরই অন্তর্ভুক্ত। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ সর্বাবস্থায় ফরয। স্বামী দরিদ্র হোক চাই ধনী হোক। (হাশিয়ায়ে শরহে বেকায়া)
উপরোক্ত মূলনীতি থেকে জানা গেলো যে, কোন পুরুষের নিকট যখন পর্যন্ত উপরোক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপর মা-বাবার ভরণপোষণ (জরুরী খরচা) ওয়াজিব হবে না। এ কথার অর্থ এ নয় যে, মানুষ মা-বাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে, তাদের হক আদায়ে ত্রুটি করবে এবং তাদের ব্যাপারে অকৃতজ্ঞ হবে। বরং এ সমস্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি দূর করা, যাতে যে সমস্ত হক ওয়াজিব, সেগুলোর বর্ণনাও হয় এবং যেগুলো জরুরী নয়, বরং মুস্তাহাব বা মুবাহ, সেগুলোর আলোচনাও হয়। মা-বাবা রুপক অর্থে প্রতিপালনকারী বা ‘রব’, তাই তাদের অত্যাধিক সম্মান ও আনুগত্য করা উচিত। তাছাড়া মা-বাবার হকসমূহ প্রসিদ্ধ বিধায় সেগুলো বর্ণনা করার প্রয়োজন নাই। অধিকন্তু এ কিতাব যে অতিরঞ্জনকে দূর করার জন্য লিখিত হয়েছে, সেটাই এর মূল লক্ষ্য। আর উপরোক্ত পরিস্থিতিতে বিশেষ কোন অক্ষমতা না থাকলে ঐ পরিমাণ মালের মালিক না হলেও তাদের খেদমত করা কঠোরভাবে মুস্তাহাব। এমনকি নিজের কষ্ট হলেও।
Leave a Reply