উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হুকুকুল ইসলাম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

মা-বাবার নির্দেশে সন্দেহযুক্ত মাল ভক্ষণ করা ওয়াজিব নয়
মা-বাবার কথায় সন্দেহযুক্ত খাবার খাওয়া ওয়াজিব হয় না। (কতিপয় আলেমের এটিই অভিমত। ইমাম গাযযালী (রহঃ) এ মত নকল করেছেন। আমি বলি, যিনি এ মতানুসারে ফতওয়া দেন, তিনি মুহাক্কিক-গবেষক পন্ডিত আলেম।) কারণ, সন্দেহযুক্ত খাদ্য না খেলে মা-বাবার উল্লেখযোগ্য এবং বাস্তবিক কোন কষ্ট নেই। হাঁ, যদি সন্তান মরণোন্মুখ হয় এবং তার খুব কষ্ট হতে থাকে ফলে মা-বাবা সন্দেহযুক্ত মাল ভক্ষণের জন্য পীড়াপীড়ি করে এবং পবিত্র হালাল খাবারের ব্যবস্থা করার সামর্থ্য তাদের না থাকে, তাহলে তাদের আনুগত্যের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ সন্দেহযুক্ত মাল ভক্ষণ করবে। তবে যদি ভক্ষণকারী নিষ্কলুষ আত্মার অধিকারী বুযুর্গ ব্যক্তি হয়, তাহলে সে এমতাবস্থায়ও সন্দেহযুক্ত মাল ভক্ষণ করবে না। কারণ, এমন ব্যক্তির জন্য এ ধরনের মাল দৈহিক ও আত্মিকভাবে মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এ ব্যাপারে এ বান্দার ও অন্যান্যদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মা-বাবার কথা মান্য করা ওয়াজিব নয়। এ জন্যই নিজেকে নিজে ধ্বংসে নিপতিত করা নিষিদ্ধ। তাছাড়া এতে আল্লাহর নাফরমানী রয়েছে, আর খালেকের অবাধ্য হয়ে মাখলুকের বাধ্য হওয়া জায়েয নেই। এ ধরনের কষ্টের শিকার হয়ে খারাপ মাল না খেয়ে মারা গেলে অনেক সওয়াব হবে।

জিহাদে কাফের পিতাকে হত্যা করা জায়েয
‘লুবাবুন নুকুল’ কিতাবে আছে যে, বদরের যুদ্ধে আল্লাহর পক্ষের মুসলিম বাহিনীতে হযরত আবূ উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (তিনি অনেক উচুঁ স্তরের একজন দুনিয়া বিরাগী সাহাবী) ছিলেন। অপরদিকে শয়তানের পক্ষের কাফির বাহিনীতে ছিলো তার মুশরিক পিতা। মুশরিক পিতা সন্তানকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধানে ছিলো। হযরত আবু উবাইদাহ (রাযিঃ) যখন লক্ষ্য করলেন যে, আমার কাফির বাপ আমাকে ইসলামের কারণে হত্যা করার চেষ্টায় আছে, তখন তিনি এদিক সেদিক সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে থাকলেন। অবশেষে এক সুযোগে তিনি তার পিতাকে হত্যা করলেন। তখন নিম্নোদ্ধৃত আয়াতসমূহ নাযিল হয়।
একইভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযিঃ) এর বাবা আবু কুহাফা (তিনি পরবর্তীতে ইসলাম কবুল করেছিলেন) কাফের থাকা অবস্থায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে কোন অশালীন উক্তি করলে হযরত আবু বকর (রাযিঃ) সাথে সাথে তার মুখে থাপ্পর বসিয়ে দেন। ফলে সে মাটিতে পড়ে যায়। পরে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়ে হযরত আবু বকর (রাযিঃ)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর (রাযিঃ)-এর নিকট এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তখন আমার নিকট তরবারী ছিলো না, নইলে এমন অসমীচীন উক্তির কারণে তার কল্লা উড়িয়ে দিতাম। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নিম্নের আয়াতসমূহ নাযেল হয়। (নিম্নের আয়াতগুলো নাযেল হওয়ার পেছনে উপরোক্ত উভয় ঘটনাই কারণ ছিলো। আয়াতগুলো এই-
অর্থঃ যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না। যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন (অর্থাৎ, গভীরভাবে প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন) এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তার অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-২২, পারা-২৮)
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা আল্লাহর হকের সামনে মা-বাবার হকের গুরুত্ব কতটুকু তা সুস্পষ্ট হয়ে গেলো। এবং এ কথাও প্রমাণিত হলো যে, জিহাদে নিজের বাপকে নিজে হত্যা করা জায়েয আছে। ‘হিদায়া’ কিতাবে যে মাসআলা লেখা আছে যে, জিহাদের ময়দানে নিজের বাপকে হত্যা করার জন্য অন্যকে ইঙ্গিত করবে, নিজে মারবে না। বাহ্যত এটা মুস্তাহাব হুকুম। যাতে করে বাপের সম্মানও রক্ষা হয় এবং উদ্দেশ্যও হাসিল হয়। আর এ হুকুম তখনই প্রযোজ্য, যখন অন্য লোক সেখানে উপস্থিত থাকবে এবং সহজে তাকে হত্যা করতে পারবে। কুফরী ও ফাসেকীর পরিণাম লাঞ্ছনা। ফলে এ ক্ষেত্রে পিতৃসম্মান পুরোপুরি রক্ষা হওয়া সম্ভব নয়।

পাপাচারী মা-বাবাকে উত্তমভাবে উপদেশ দিবে

মা-বাবা ফাসিক তথা পাপাচারী হলে অতি উত্তম পন্থায় তাদেরকে উপদেশ দিবে। প্রয়োজন হলে ধমক দিলেও গুনাহ নেই, বরং সওয়াব হবে।
দ্বীনি বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া জায়েয নেই। তবে যতদূর সম্ভব বিশেষভাবে আদব রক্ষা করে চলবে। মূর্খতাসুলভ আচরণ করবে না। গাম্ভির্য ও শিষ্টাচারপূর্ণ আচরণ করবে। শরীয়তের সীমার মধ্যে থাকবে। বিষয়টি ভালো করে বুঝে নাও।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর বাপ কাফির হওয়া সত্ত্বেও এবং উপদেশ না মানা সত্ত্বেও তাকে তিনি কোন কষ্ট দেননি, তার কারণ এই ছিলো যে, বাহ্যত তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, তার সঙ্গে নম্র ব্যবহার করলে সে উপদেশ গ্রহণ করবে। আর এ ধরনের প্রীতির বশবর্তী হয়েই তিনি তার জন্য ইস্তিগফারের তথা আল্লাহর কাছে তার জন্য মাফ চাওয়ার ওয়াদা করেছিলেন। কিন্ত্ত তার এ আশা যখন নিরাশায় পরিণত হলো এবং যখন তার পরিষ্কার জানা হয়ে গেলো যে, সত্যিই সে আল্লাহর দুশমন এবং তার কুফরীর কারণে ইস্তিগফার তার কোন উপকারে আসবে না, তখন তিনি তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যান।
‘ইহইয়াউল উলূম’ কিতাবে আছে যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর আল্লাহ তাআলা ওহী নাযেল করেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বাধ্য হয় না, কিন্ত্ত মা-বাবার বাধ্য হয় (মা-বাবার আনুগত্যের কারণে তার আমলনামায়) তাকে নেক লোক লেখা হয়। আর যে এর বিপরীত হয়, তাকে বদ লোক লেখা হয়।
(এ বর্ণনা যদি নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত থাকে তাহলে এতে ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে, আল্লাহর আনুগত্যের স্তর এবং আল্লাহর হকের মর্যাদা সর্বক্ষেত্রে মা-বাবার হকের চেয়ে কম। কিন্ত্ত বাস্তবে তা নয়। হাদীসের সঠিক অর্থ হলো, যে সমস্ত বিষয়ে মা-বাবার আনুগত্য জায়িয, তা ওয়াজিব হোক চাই মুস্তাহাব হোক, সে সমস্ত বিষয়ে যে ব্যক্তি তাদের আনুগত্য করবে, তার বরকতে আল্লাহর হকসমূহ পালন করা মাফ হয়ে যায়। আর মা-বাবার জরুরী হকসমূহ আদায় না করলে আল্লাহর হক সংক্রান্ত অন্যান্য আমল পালন করায় মা-বাবার এ নাফরমানী মাফ হয় না। তাই তাকে নাফরমান বা অবাধ্য লেখা হয়। কারণ, বান্দার হক শক্তি থাকা সত্ত্বেও পালন না করলে বা পাওনাদার মাফ না করলে এ দায়িত্ব মাথা থেকে নামে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা হলেন অভাবমুক্ত, আর বান্দা হলো অভাবী। এ হাদীসের অর্থ এ নয় যে, মা-বাবার অপ্রয়োজনীয় নির্দেশ অমান্য করলে আল্লাহর হকসমূহ পুরা করা সত্ত্বেও বান্দাকে নাফরমান বা অবাধ্য লেখা হবে। খুব ভালো করে বুঝে নাও।

সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়া পিতার উপর ফরয
হযরত উমর ফারুক (রাযিঃ)-এর খেদমতে এক পিতা তার পুত্রের বিরুদ্ধে তাকে কষ্ট দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করে। তখন হযরত উমর (রাযিঃ) ছেলেটিকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন এবং বললেন যে, তুমি আল্লাহকে ভয় করো না? বাপের হক অনেক বড়।
ছেলেটি বললোঃ হাদীসের হুকুম অনুপাতে তার দায়িত্বে আমার (বিশেষভাবে) তিনটি হক ছিলো-
ক. ভালো নাম রাখা।
খ. শিক্ষাদান করা।
গ. (শরীয়তের মাপকাঠিতে) ভালো জায়গায় বিবাহ করা, যেন মায়ের নীচুতার কারণে সন্তানকে তিরষ্কার করা না হয়।
কিন্ত্ত তিনি কোন হকই আদায় করেননি। (সঠিক শিক্ষা ছাড়া কারো হক কি করে জানবে যে, তা আদায় করবে।) তখন হযরত উমর ফারুক (রাযিঃ) সন্তানের কাছে কোন কিছুর দাবী করেননি। বরং বাপকে বললেন-তুমি বলছো তোমার ছেলে তোমাকে কষ্ট দেয়, বরং তুমি তো তাকে আগে কষ্ট দিয়েছো। তুমি আমার সামনে থেকে উঠে যাও।
হাদীসটি ইমাম ফকীহ আবুল লাইস রেওয়ায়েত করেছেন, যা আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম।
শরীয়তে সবার হকের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং সে অনুপাতে হকের দাবী করা হয়েছে। ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) ‘তাযকিরাহ’ কিতাবে লিখেছেন যে, হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহঃ) যিনি অনেক উঁচুস্তরের একজন তাবেয়ী ছিলেন। কোন তাবেয়ীই ইলমের দিক থেকে তার পর্যায়ে পৌঁছেননি। তিনি সাহেবে কারামাত বুযুর্গ ছিলেন। তার পিতা থেকে পৃথক হয়ে যান। তাকে (শরীয়তসম্মত কারণে) সম্পূর্ণরুপে পরিত্যাগ করেন। এমনকি এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায়। (অর্থাৎ, তার নিজের বা তার বাপের মৃত্যু হয়) সুবহানাল্লাহ! আল্লাহওয়ালাগণ কাউকে ছাড় দেন না। মহান স্রষ্টা আল্লাহর বিরোধিতা তারা সহ্য করেন না। তাতে কেউ খুশি হোক, চাই নারাজ হোক।
মা-বাবার বা অন্য কারো অপ্রয়োজনীয় আর্থিক খেদমত বা অন্য কোন অপ্রয়োজনীয় খেদমতের চেয়ে যিকির করা উত্তম এবং ইলমী ইবাদতে লিপ্ত হওয়া তো অধিকতর উত্তম। বিষয়টি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (যিকিরের ফযীলত সম্পর্কিত আলোচনায় এ জাতীয় হাদীস এসেছে। এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানতে চাইলে শাইখ দেহলভী কৃত ‘মিশকাত শরীফের’ শরাহ দ্রষ্টব্য।)
আলহামদুলিল্লাহ, এতক্ষণের আলোচনায় উত্তমরুপে প্রমাণিত হয়েছে যে, মা-বাবার শরীয়তবিরোধী হুকুম মান্য করা জায়েয নয়। মা-বাবার আনুগত্য কোন কোন ক্ষেত্রে ফরয এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুস্তাহাব উপরোক্ত আলোচনায় তাও জানা হয়েছে। মোটকথা, মা-বাবার সব হুকুম পালন করা জরুরী নয়।
নির্ভরযোগ্য হাদীসে এসেছে-
মানুষদেরকে তাদের স্তরে অধিষ্ঠিত করো।’
কাউকে সীমাতিরিক্ত উঠাইও না এবং সীমাতিরিক্ত নামাইও না। খোদ আফযালুল বাশার, সায়্যিদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সীমাতিরিক্ত প্রশংসা করতে নিষেধ করেছেন। অথচ তার মর্যাদা মা-বাবা ও সবার চেয়ে বেশী।