আদাবুল মুআশারাত – ৪

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আদাবুল মুআশারাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
মেহমান হওয়ার আদব
আদব-৪২: অনর্থক পশ্চাতে বসার দ্বারা ভীষণ মানসিক চাপ অনুভব হয়। তীব্র প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও তার সম্মানার্থে ওঠা যায় না। তাই এভাবে বসা উচিত নয়।
আদব-৪৩: একজনের জুতা রাখা আছে, সেখান থেকে তার জুতা হটিয়ে নিজের জুতা রেখে মসজিদ ইত্যাদিতে যাওয়া উচিত নয়। যেখানে যার জুতা রাখা আছে, তা তারই হক। সে ওখানে এসেই তার জুতা খুঁজবে, সেখানে জুতা না পেয়ে সে পেরেশান হবে।
‘বেহেশত এমন জায়গা যেখানে কোন কষ্ট থাকবে না।’
এভাবে জীবন কাটানো উচিত।
আদব-৪৪: ওযীফা পড়ার সময় কাছে বসে অপেক্ষা করে মনকে আকৃষ্ট করার দ্বারা ওযীফাতে বিঘ্ন ঘটে। তবে নিজের জায়গায় বসে থাকায় কোন অসুবিধা নেই।
আদব-৪৫: সবসময় সহজ-সরলভাবে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলবে। কৃত্রিমভাবে ভূমিকা টানবে না।
আদব-৪৬: বিনা প্রয়োজনে কারো মধ্যস্থতায় পয়গাম পাঠাবে না। যা কিছুর বলার আছে, নিজে সরাসরি বলবে।
আদব-৪৭: হাদীয়া গ্রহণ করার পর হাদীয়া দাতার সামনেই ঐ হাদীয়াপ্রাপ্ত জিনিস জনকল্যাণলমূলক কাজে চাঁদা হিসেবে দেওয়াও হাদীয়াদাতার মনঃকষ্টের কারণ হয়। তাই (সে জিনিস চাঁদা হিসেবে দিতে হলে) এমন সময় দিবে, যাতে সে জানতে না পারে।
আদব-৪৮: এক গ্রাম্য লোক আমার সাথে কিছু কথা বলছিলো। কথার মাঝে সে কিছু অশালীন কথাও বলছিলো। মজলিসে উপবিষ্ট এক ব্যক্তি ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। আমি তখন ঐ ব্যক্তিকে কঠোরভাবে সতর্ক করে বলি যে, তুমি তাকে বাধা দেওয়ার অধিকার কোথায় পেলে? তোমরা মানুষদেরকে সন্ত্রস্ত করো। আমার মজলিসকে ফেরাউনের মজলিস বানাও। যদি বলো যে, সে বেয়াদবী করছিলো তাহলে বেয়াদবী থেকে বাধা দেওয়ার জন্য আল্লাহ আমাকেও তো মুখ দিয়েছেন। তুমি কেন নাক গলাও। আর গ্রাম্য লোকটিকে বললাম যে, তোমার যা বলার আছে, স্বাধীনভাবে বলো।
আদব-৪৯: কোন বুযুর্গের সাথে তার কোন মুরীদকেও দাওয়াত দিতে চাইলে ঐ বুযুর্গকে বলবে না যে, অমুককেও নিয়ে আসবেন। কারণ, অনেক সময় মনে থাকে না। তাছাড়া তার দ্বারা নিজের কাজ নেওয়া আদবেরও খেলাপ। বরং বুযুর্গের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে মুরীদকে নিজেই বলবে। আর মুরীদেরও উচিত, নিজের পীরের নিকট জিজ্ঞাসা করে তবে দাওয়াত কবুল করা।
আদব-৫০: এক ব্যক্তি পানি পড়ার জন্য গ্লাস ভরে পানি আনতো। কখনো নিজের জন্য পানি পড়া নিতো, আর কখনো অন্যের জন্য নিতো। কিন্ত্ত জিজ্ঞাসা না করলে বলতো না যে, এখন কার জন্য পানি পড়া নিচ্ছে। তাই তাকে বুঝিয়ে দেই যে, আমার তো পার্থক্য করার জন্য ইলমে গায়েব জানা নাই বা কোন পারিভাষিক শব্দও নির্দিষ্ট নাই যে, সেই শব্দ দেখে বুঝবো যে, কার জন্য পানি পড়া নিচ্ছো। প্রত্যেকবার জিজ্ঞাসা করার বোঝা আমার উপর চাপানো আদবের খেলাপ। গ্লাস রেখে নিজের থেকেই বলে দিবে যে, অমুকের জন্য পানি পড়া নিবো।
আদব-৫১: অনেক লোক শুধু এতটুকু বলে যে, একটি তাবীজ দিন। জিজ্ঞাসা না করলে বলে না যে, কিসের তাবীজ। এতেও কষ্ট হয়।
আদব-৫২: এক ব্যক্তি কিছু আটা এনে বলে-এটি এনেছি। কিন্ত্ত কেন এনেছে, তা বলে নাই। ঐ আটা ফেরত পাঠিয়ে দেই এবং বলি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আটা দিয়ে নিজের থেকে বলবে না যে, আমার জন্য এনেছো, নাকি মাদরাসার জন্য, ততক্ষণ পর্যন্ত এ আটা নেওয়া হবে না।
আদব-৫৩: এস্তেঞ্জাখানায় যাওয়ার পথে দেখি যে, একজন তালিবে ইলম সেখানে পেশাব করছে। তার কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আমি একটু দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে যাই। যখন অনেক দেরী হলো, তখন এগিয়ে গিয়ে দেখি ঐ তালিবে ইলম পেশাব শেষ করে ঢিলা নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তখন তাকে আমি বুঝিয়ে দেই যে, এখন এ জায়গা আটকিয়ে রাখার কি প্রয়োজন রয়েছে? এখান থেকে সরে গিয়ে ঢিলা ব্যবহার করা দরকার ছিলো। অনেক লোক সংকোচের কারণে ঐ জায়গা খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। তারা অন্য লোক থাকাবস্থায় এস্তেঞ্জাখানায় যেতে লজ্জাবোধ করে।
আদব-৫৪: এক ব্যক্তিকে দেখি যে, ঢিলা নিয়ে সাধারণের চলাচলের পথে হাঁটাহাঁটি করছে। তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, যতদূর সম্ভব মানুষের চোখের আড়ালে দূরে গিয়ে এস্তেঞ্জা শুকানো উচিত।
আদব-৫৫: আমার একবার মাদরাসার একটি কিতাবের প্রয়োজন হয়। কিতাবটি আমার এক বন্ধুর নিকট আমানত ছিলো। সে ঐ সময় উপস্থিত ছিলো না। আমি তার বসার জায়গায় কিতাবটি খোঁজ করাই, কিন্ত্ত পাওয়া যায় না। আমি নিজে গিয়ে তালাশ করেও পেলাম না। হঠাৎ একজনের চোখে পড়ে যে, একজন তালিবে ইলম ওখানে বসে একটি কিতাব ‘তাকরার করছে, আর মাথার নীচে মাদরাসার সেই কিতাবটি বালিশরুপে রেখেছে। মাদরাসার কিতাবটি তার কিতাবের আড়ালে ছিলো বলে দেখা যাচ্ছিলো না। হঠাৎ তা চোখে পড়ার ফলে চেনা যায় এবং পাওয়া যায়। ঐ তালিবে ইলমকে তিরস্কার করে বলি যে, না জানিয়ে কোন জিনিস ব্যবহার করা নাজায়িয তো বটেই, তাছাড়া তোমার কারণে এতোগুলো মানুষ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পেরেশান হলো। এমন আচরণ আর কখনো করো না।
আদব-৫৬: তোমার কোন মুরুব্বী কোন কাজ করতে বললে তা সম্পাদন করে তাকে অবহিত করা উচিত। যাতে ঐ মুরুব্বীর সেই কাজের অপেক্ষায় কষ্ট না হয়।
(টীকাঃ এ নম্বর এবং বিশ নম্বরের বিষয়বস্ত্ত একই। বাহ্যতঃ ভুলে এই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।–মুহাম্মাদ শফী’)
আদব-৫৭: পাখা দ্বারা বাতাসকারীদেরকে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখার কথা বলা হয়েছে।
প্রথম এই যে, পাখা হাত বা কাপড় দিয়ে খুব ভালো করে পরিষ্কার করে নিবে। কারণ, অনেক সময় পাখা বিছানার উপর পড়ে থাকার ফলে তাতে ধুলাবালি, কখনো মাটি, চুনা বা পাথরের ছোট টুকরা লেগে থাকে। পাখা নাড়া দিলে সেগুলো চোখে মুখে বা অন্য কোন অঙ্গের উপর গিয়ে পড়ে। ফলে কষ্ট হয়।
দ্বিতীয়, হাত এমন বরাবর রাখে, যেন মাথায় বা অন্য কোথাও বাড়ি না লাগে। আবার এতো উঁচুতেও রেখো না যে, বাতাসই না লাগে। এতো জোরেও পাখা চালিয়োনা যে, যাকে বাতাস দিচ্ছো তার কষ্ট হয়।
তৃতীয়, এদিকে লক্ষ্য রাখবে যে, পাশে উপবিষ্ট কারো যেন কষ্ট না হয়। যেমন, পাখা তার মুখে গিয়ে আঘাত করলো, বা তার সম্মুখে দেওয়ালের মত আড়াল হয়ে গেলো।
চতুর্থ, যাকে বাতাস করছো, তিনি উঠতে চাইলে তার প্রতি খেয়াল রেখে আগেই পাখা সরিয়ে ফেলো, যেন তার (গায়ে) আঘাত না লাগে।
পঞ্চম, কাগজ বা অন্য কিছু বের করতে আরম্ভ করলে পাখা ঝুলানো বন্ধ করে দাও। মেশিনের মত একাধারে ঝুলাতে থেকো না।
আদব-৫৮: কারো কারো জন্য এমন ব্যক্তি থেকে হাদীয়া নেওয়া খুব কষ্টকর হয়, যার কোন প্রয়োজন তার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। যেমন, দু’আ করানো, তাবিজ নেওয়া, সুপারিশ করানো, মুরীদ হওয়া বা এ জাতীয় অন্য যে কোন কাজ। তাই এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে। হাদীয়া তো কেবলই মুহাব্বতের খাতিরে হওয়া উচিত। যার মধ্যে কোন স্বার্থ থাকবে না। যদি কোন প্রয়োজন থাকেই তবে তাকে এর সাথে মেলাবে না। বরং যখন প্রয়োজনের কথা বলবে, তখন যেন এ সন্দেহ না হয় যে, ঐ হাদীয়া এ কারণে দিয়েছিলো। আর যখন হাদীয়া দিবে, তখন যেন এ সন্দেহ না হয় যে, এ হাদীয়া কোন প্রয়োজনের খাতিরে দিয়েছে।
আদব-৫৯: এক ব্যক্তি ফজর নামাযের পূর্বে আমি ঘর থেকে এসে ওযু করবো একথা চিন্তা করে আমার জন্য লোটায় পানি ভরে তার উপর আমার মেসওয়াক রেখে প্রস্ত্তত করে রাখে। যখন আমি মসজিদে আসি, ঘটনাচক্রে তখন আমার ওযু ছিলো। তাই আমি সোজা মসজিদে চলে আসি। মসজিদে আসার পর হঠাৎ করে ঐ লোটার উপর আমার চোখ পড়ে। আমার মেসওয়াক চিনে বুঝতে পারি যে, ঐ লোটা আমার জন্য ভরে রাখা হয়েছে। যে বদনা ভরে রেখেছে আমি তাকে খোঁজ করি। অনেক পেরেশানীর পর যে রেখেছিলো, সে নিজেই স্বীকার করে। আমি সে সময় সংক্ষেপে এবং নামাযের পর বিস্তারিতভাবে ঐ ব্যক্তিকে বুঝাই যে, দেখো! তুমি শুধু এ সম্ভাবনার ভিত্তিতে যে, আমি ওযু করবো, লোটা ভরে রেখে দিয়েছো। কিন্ত্ত এ সম্ভাবনার কথা তোমার মনে হলো না যে, ওযু থাকতেও পারে। অথচ যে সম্ভাবনার কথা তুমি ভেবেছিলে বাস্তবে তা ভুল প্রমাণিত হলো। আর এ দ্বিতীয় সম্ভাবনাই বাস্তব প্রমাণিত হলো। এমতাবস্থায় যদি হঠাৎ আমার চোখ লোটার উপর না পড়তো, এ লোটা এমনই ভরা অবস্থায় থেকে যেতো। অন্য কেউ তা ব্যবহারও করতে পারতো না। কারণ, একে তো লোটা ছিলো ভরা যা এ কথার নিদর্শন ছিলো যে, কেউ ব্যবহারের জন্য এটি ভরে রেখেছে।
দ্বিতীয়ত, তার উপর মেসওয়াক থাকা একথার নিশ্চিত আলামত ছিলো। বিধায়, তুমি এমন একটি জিনিসকে বিনা প্রয়োজনে আটকিয়ে রেখেছিলে, যার সঙ্গে জনসাধারণের উপকারিতা জড়িত রয়েছে। যা এ বদনা তৈরীর উদ্দেশ্য এবং এর ওয়াকফকারীর নিয়তের পরিপন্থী কাজ, তাই এটা কি করে জায়েয হতে পারে? এতো হলো লোটা সংক্রান্ত কথা।
এখন হলো মেসওয়াক সংক্রান্ত কথা। তুমি মেসওয়াকটি বিনা প্রয়োজনে সংরক্ষিত জায়গা থেকে সরিয়ে এনে এমন এক জায়গায় রেখেছো, যা নিরাপদ নয়। মেসওয়াক রেখে তার তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থাও করোনি যে, কাজ শেষ হলে তা এনে পুনরায় পূর্বের জায়গায় রেখে দিবে। কারণ, মিসওয়াকটি লোটার উপর রেখে দিয়ে তুমি মনে করেছো যে, আমি সেটি ব্যবহার করে উঠিয়ে রাখবো। ফলে এটা হারিয়ে যাওয়ার আশংকা ছিলো। তোমার এ খেদমত এতোগুলো নাজায়েজ কাজ এবং কষ্টের কারণ হলো। ভবিষ্যতে কখনোই আর এমন করবে না। হয় অনুমতি নিয়ে এমন করবে, অথবা যখন দেখবে যে, ওযু করার জন্য উদ্যত হয়েছে, তখন এমন করায় কোন ক্ষতি নেই। অন্যথায় উলটপালট খেদমতের দ্বারা আরামের পরিবর্তে উল্টো আরো কষ্ট হয়ে থাকে।
লতীফাঃ এই একই অবস্থা বিদআতেরও। তার বাইরের আকৃতি তো ইবাদতের হয়ে থাকে, যেমন এ কাজটির বাইরের আকৃতি ছিলো খেদমতের। কিন্ত্ত বিদআতের ভেতরে অনেক ক্ষতি ও দোষ লুকায়িত থাকে, যেগুলো স্বল্প বুঝের লোকেরা জানে না। যেমন, এই খেদমতের মধ্যে সূ্ক্ষ্ম সূক্ষ্ম খারাপ দিকসমূহ ছিলো, যা খেদমতকারী বুঝতে পারেনি।
আদব-৬০: একজন ছাত্র মাদরাসায় থাকাবস্থায়ই একটি চিরকুটে কাপড়ের প্রয়োজনের কথা লিখে অন্য ছাত্রের হাতে পাঠিয়ে দেয়। আবেদনকারীকে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলো। সে বললো, আমার একটি কাজ ছিলো, তাই অন্যের হাতে পাঠিয়েছি। এ প্রেক্ষিতে তাকে উপদেশ দেই-
একে তো এর মধ্যে আদবের কমতি রয়েছে যে, সবসময় এ জায়গায় থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র একটি কাজ দেখা দেওয়ার কারণে লজ্জা ও সংকোচের কারণেও নয় (কারণ, এটাও এক ধরনের অপারগতা) নিজে এসে কাপড় না চেয়ে অন্যের হাতে চেয়ে পাঠিয়েছো। যা সমকক্ষদের মধ্যে চলে। কিন্ত্ত বড়দের সাথে এমন করা বেয়াদবী।
দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে অনাগ্রহ প্রকাশ পায়, যেন বেগার খাটার ন্যায় তুমি এড়িয়ে গেলে।
তৃতীয়ত, এতে অন্যের দ্বারা খেদমত নেওয়া হলো, এখন থেকেই খেদমত নেওয়া শিখছো। তাকে আরো বলি যে, এ বেয়াদবীর শাস্তি হলো, চার দিনের জন্য এ দরখাস্ত ফিরিয়ে দিচ্ছি। তারপর নিজের হাতে দরখাস্ত দিবে। সুতরাং চতুর্থ দিন সে নিজ হাতে পুনরায় দরখাস্ত দেয় এবং খুশি মনে তা গ্রহণ করা হয়।
Leave a Reply