আদাবুল মুআশারাত – ৬

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আদাবুল মুআশারাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
মেহমান হওয়ার আদব
আদব-৭৭: এক ব্যক্তি তার চিঠিতে কয়েকটি বিষয় লেখে। সাথে এ কথাও লেখে যে, পাঁচ টাকার মানি অর্ডার পাঠাচ্ছি। টাকার অপেক্ষায় এ কথা চিন্তা করে চিঠির উত্তর দিতে বিলম্ব করি যে, টাকা উসূল হওয়ার পর চিঠির উত্তরের সাথে রসিদও লিখে দেওয়া হবে। এভাবে কয়েকদিন কেটে যায়। অজ্ঞাত কোন কারণে টাকা আর আসে না। ওদিকে চিঠির অন্যান্য বিষয়ের কারণে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হয়েচ্ছিলো। কয়েকদিন পর্যন্ত এই অপেক্ষা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। অবশেষে তাকে লেখা হয় যে, হয় চিঠিতে টাকা পাঠানোর বিষয়টি না জানানো উচিত ছিলো, বা ঐ চিঠিতে অন্য বিষয়ের উত্তর না চাওয়া উচিত ছিলো।
আদব-৭৮: এক ব্যক্তি তার ছেলেকে সাথে নিয়ে আমার কাছে এসে মক্তব সম্পর্কে অভিযোগ করে বলে যে, সেখানকার মুহতামিম সাহেব আমার ছেলেকে বের করে দিয়েছে। আমি নরমভাবে বুঝিয়ে বলি যে, আমার ঐ মক্তবে কোন দখল নেই। সে বললো-আমি শুনেছি যে, তুমি সেখানকার পৃষ্ঠপোষক। আমি বললাম যে, হাঁ, ওখানকার বেতন তো আমার মাধ্যমে দেওয়া হয়, তবে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমার কোন কর্তৃত্ব নেই। সে পুনরায় ঐ মুহতামিমের শেকায়েত করতে থাকে। আমি বললাম-এ আলোচনার কোন ফল নেই। এভাবে অভিযোগ করার দ্বারা গীবত শুনানো ছাড়া আর কী লাভ? কিছুক্ষণ পর সে চলে যাওয়ার সময় বিদায়ী মুসাফাহা করতে করতে আবার বলে যে, ‘ঐ মুহতামিম আমার ছেলেকে বের করে দিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করছে।’ যেহেতু আমি প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা সহ আসল অবস্থা জানিয়ে তাকে আমার নিকট এই অভিযোগ করতে নিষেধ করেছিলাম তাই তার এই বারংবার অভিযোগ করতে থাকায় আমার রাগ হয়। আমি তাকে কঠোরভাবে ধরে বসি। এবং বলি যে, আফসোস! এতভাবে নিষেধ করা সত্ত্বেও সেই রুচিবিরুদ্ধ নিষ্ফল কথা আবার বলছো। সে তার কথার কিছু ব্যাখ্যা দিতে চায়, কিন্ত্ত সব অর্থহীন। ঐ অবস্থায়ই তাকে বিদায় করে দেই।
আদব-৭৯: এক ব্যক্তি আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলো। ইশার পর যেখানে বসে আমি ওযীফা পাঠ করছিলাম, সে একটু থেমে থেমে এবং আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেদিকে আসছিলো। যার দ্বারা বোঝা যাচ্ছিলো যে, সে আমার নিকটেই আসতে চাচ্ছে তবে অনুমতির অপেক্ষায় থেমে যাচ্ছে। একে তো ইশার পরে দেখা-সাক্ষাতের সময় নয়। বিশেষ করে সে পূর্বেও সাক্ষাত করেছে। উপরন্ত্ত যখন এ কথাও জানা থাকে যে, তার এখানে বিশেষ কোন কাজ নেই, কেবলই মজলিস ও দরবার জমানোর উদ্দেশ্যে আসছে-যেমন বেশীর ভাগ মানুষের এ অভ্যাস আছে। তাছাড়া ওযীফা পড়ার সময় অন্যমনস্ক হওয়া কষ্টকর বিষয়। বিশেষ করে বিনা প্রয়োজনে। আবার অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিলো যে, সে অনুমতি নেওয়ার জন্য এমন করছে, তাই তার সাথে কথা বলারও মনে ইচ্ছা জাগছিলো। এ সমস্ত বিষয় একত্রিত হয়ে আমার অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ওযীফা বন্ধ করে বলতে বাধ্য হই যে, সাহেব! এখন কাছে বসার সময় নয়। সে বললো-আমি তো পানি পান করতে যাচ্ছিলাম। এতে আরো অধিক কষ্ট হয় যে, বানিয়ে কথা বলছে। কিন্ত্ত সে বলে যে, বাস্তবেই পানি পান করতে যাচ্ছিলাম। আমি তখন বললাম যে, তাহলে এমন রুপ কেন ধরলে যে, সন্দেহ সৃষ্টি হয়? তোমার না থেমে অন্যদিক দিয়ে সোজা চলে যাওয়া উচিত ছিলো।
আদব-৮০: একজন ছাত্র-যেমন ধরুন ‘যায়েদ’-আমার নিকট অনুমতি চাইলো যে, অমুক ছাত্রের-যেমন ধরুন ‘আমর‘এর-সাথে বিকালবেলা মাঠে ঘুরতে যাবো। ওদিকে দ্বিতীয়জন অর্থাৎ, আমরের সাথে অন্য একজন কমবয়সী ছাত্র-যেমন ধরুন ‘বকর’-উস্তাদের অনুমতিক্রমে আগে থেকে মাঠে যায়। আমাদের মতে বকরের সাথে যায়েদের একত্র হওয়ায় সমস্যা রয়েছে। তাই যায়েদের দায়িত্বে জরুরী ছিলো যে, সে অনুমতি চাওয়ার সময় এ কথাও আমাকে বলা যে, তার সাথে বকরও (প্রায়ই) গিয়ে থাকে। যাতে পুরো বিষয়টির প্রতি নজর দিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি। কিন্ত্ত জানিনা, সে ইচ্ছা করে নাকি অবহেলা করে বিষয়টি গোপন করে। এমতাবস্থায় তার আবেদন রক্ষা করায় কোন সমস্যা নাই মনে করে আমি অবশ্যই অনুমতি দিতাম। তখন এটা বড় ধরনের একটা প্রতারণা হতো। কিন্ত্ত ঘটনাচক্রে বিষয়টি আমার জানা ছিলো, তাই বিষয়টি তখন আমার স্মরণ হয়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি যে, আমরের সাথে আরো কেউ যায় কি? সে বললো-বকর যায়। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম-তাহলে সে কথা তুমি আগে বললে না কেন? ধোঁকা দিতে চাচ্ছিলে? আমি তার এ অপরাধের কারণে খুব তিরস্কার করি। তাকে বুঝিয়ে দেই যে, সাবধান! যাকে নিজের মরুব্বী এবং কল্যাণকামী মনে করো, তার সঙ্গে কখনোই এমন আচরণ করা উচিত নয়।
আদব-৮১: একজন ছাত্রের নিকট একজন কর্মচারী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি যে, সে কী করছে? সে বললো যে, ঘুমাচ্ছে। পরে জানতে পারি যে, নিজ কক্ষে সে জাগ্রত ছিলো। এ প্রেক্ষিতে ঐ ছাত্রকে শাসন করে বলি যে, একে তো শুধুমাত্র ধারণার ভিত্তিতে কোন বিষয়কে নিশ্চিত করে বলা ভুল। তোমার সন্দেহ থাকলে এভাবে বলতে যে, সে হয়তো ঘুমাচ্ছে। আর পুরাপুরি সঠিক হতো যদি বলতে যে, আমি জানি না, দেখে এসে বলছি। তারপর জেনে এসে সঠিক উত্তর দিতে। দ্বিতীয়ত, তার জাগ্রত থাকার কথা যদি পরে আমি না জানতে পারতাম এবং এ ধারণায় থাকতাম যে, সে ঘুমাচ্ছে, তাহলে বিনা প্রয়োজনে ঘুমন্ত মানুষকে জানানো এবং তার আরামে ব্যাঘাত ঘটানো নির্দয় আচরণ মনে করে তাকে জাগাতাম না। ফলে তখন হয়তো কোন জরুরী কাজের ক্ষতি হয়ে যেতো। যে ক্ষতি এ কারণে আমি মেনে নিতাম যে, ঘুমন্তকে জাগানো আরো অধিক কষ্টকর। পরবর্তীতে যখন জানতে পারতাম যে, সে ঘুমাচ্ছিলো না, তখন ঐ ক্ষতির কারণে মনে কষ্ট হতো। ফলে যে বলেছিলো যে, ঘুমাচ্ছে তার উপর রাগ হতো। এতোগুলো কষ্ট ও পেরেশানী হতো। তাই এ ব্যাপারে সবসময় সাবধান ও সতর্ক থাকা উচিত।
একজন ছাত্র কর্তৃক লিখিত এবং লেখক কর্তৃক সংশোধিত কয়েকটি আদব
আদব-৮২: একবার এক ব্যক্তি এলো। হযরত তাকে জিজ্ঞাসা করলেন-কী উদ্দেশ্যে এসেছেন, কিছু বলবেন কি? সে উত্তরে বললো-জি না। এমনি দেখা করতে এসেছিলাম। তারপর লোকটির চলে যাওয়ার সময় হলে মাগরিবের পর ফরয ও সুন্নাতের মধ্যবর্তী সময়ে সে হযরতের নিকট তাবীজ চেয়ে বসলো। হযরত বললেন-প্রত্যেক কাজের জন্য উপযুক্ত সময় ও ক্ষেত্র রয়েছে। এটি তাবীজ দেওয়ার সময় নয়। যখন আপনি এসেছিলেন, তখনই আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি উদ্দেশ্যে এসেছেন। আপনি বলেছিলেন-এমনিই সাক্ষাত করতে এসেছি। এখন আবার এ হুকুম কেন করেছেন? ঐ সময় জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই বলা উচিত ছিলো। মানুষ প্রয়োজনের কথা সময় মত না বলাকে আদব মনে করে। আমার মতে এটি মারাত্মক বেয়াদবী। এর অর্থ তো এই যে, অপর ব্যক্তি আমার চাকর। যখন ইচ্ছা হুকুম করবো, তার তা পালন করতে হবে। এখন আপনিই একটু চিন্তা করে দেখুন, আমার এখন কত কাজ। প্রথমত, সুন্নাত ও নফল নামাযসমূহ পড়তে হবে। তারপর মুরীদদের কিছু কথা রয়েছে, সেগুলো শুনতে হবে। মেহমানদের খানা খাওয়াতে হবে।
আফসোস, বর্তমান যামানায় আদব-কায়দা ও ভদ্রতা-সভ্যতা দুনিয়া থেকে একেবারেই উঠে গেছে। এখন যান, তাবীজ নেওয়ার জন্য আবার আসবেন। মনে রাখবেন! যেখানে যাবেন, প্রথমে যাওয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ব্যক্ত করবেন। বিশেষ করে জিজ্ঞাসা করলে আর গোপন করবেন না। আমি তো প্রত্যেককে আসার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করি। যাতে করে তার যা বলার আছে, বলে দেয়। তারও যেন সমস্যা না হয় এবং আমারও যেন ক্ষতি না হয়। আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে এজন্য জিজ্ঞাসা করি যে, বেশীর ভাগ মানুষই কোন না কোন প্রয়োজন নিয়ে আমার কাছে এসে থাকে। আর তাদের কেউ কেউ লজ্জা ও সংকোচের কারণে নিজের থেকে বলতে পারে না। বা লোকজন থাকার কারণে তাদের গোপন কথা প্রকাশ করতে পারে না। কিন্ত্ত আমি জিজ্ঞাসা করলে তার প্রয়োজনের কথা জানায় বা বলে যে, গোপনে বলতে হবে। তখন আমি সুযোগমত আলাদা ডেকে নিয়ে তার কথা শুনে থাকি। কিন্ত্ত কেউ যদি মুখই না খোলে তাহলে আমি কি করে জানতে পারবো। আমার তো আর গায়েবের ইলম নেই।
আদব-৮৩: একজন মুরীদের চাহিদার ভিত্তিতে তাকে মাগরিবের পরের সময় দেই। এ সময় তাকে কিছু তা’লীম দেবো। সে কিছুটা দূরে ছিলো বলে তাকে আওয়াজ দিয়ে কাছে ডাকি। সে ব্যক্তি মুখে কিছুই না বলে নিজের জায়গা থেকে উঠে আমার নিকট আসতে থাকে, যা আমি বুঝতে পারিনি। ডাক শুনে নাই মনে করে আমি পুনরায় তাকে সজোরে ডাক দেই। ইতিমধ্যে সে আমার কাছে চলে আসে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-কোন কারণে আমার ডাকের উত্তর দেননি, নাকি আমাকে উত্তরদানের যোগ্য মনে করেননি? উত্তর দিলে আহবানকারী বুঝতে পারে যে, আহুত ব্যক্তি তার আহবান শুনতে পেয়েছে। আর উত্তর না দিলে দ্বিতীয়বার তৃতীয়বার ডাকতে হয়, ফলে তার কষ্ট হয়। শুধুমাত্র আপনার অলসতা ও উদাসিনতার ফলে ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণে অন্যের কষ্ট হলো। আপনি ‘হাঁ’ বলে সাড়া দিলে এমন কী জটিলতা ছিলো? আজকাল ইলমের শিক্ষা তো সর্বত্রই রয়েছে, কিন্ত্ত আখলাকের শিক্ষা বিরল ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। এখন মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আপনাকে পরে সময় দেওয়া হবে, তখন এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন।
আদব-৮৪: হযরতের তা’লীম দেওয়ার মাঝখানে কথা শেষ না হতেই একজন মুরীদ তার স্বপ্ন বলতে আরম্ভ করে। তখন হযরত বলেন- এ কেমন আচরণ? এক কথা শেষ না হতেই তার মধ্যে আরেক কথা আরম্ভ করেছো। কবি বলেন-
অর্থঃ ‘হে বুদ্ধিমান! কথারও মাথা আছে। তাই কথার মাঝখানে কথা বলতে এসো না। জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষ কথার মাঝে কথা বলে না।’
আমার কথার মাঝে আপনার কথা বলার অর্থ এই যে, আপনার উদ্দেশ্য ছিলো স্বপ্নের কথা বলা। তা’লীম ও তালকীন আপনার নিকট অর্থহীন। তাই আমার এতক্ষণের আলোচনা বিফল হলো। আগামীতে এমন আচরণ আর কখনো করবেন না। এখন চলে যান। অন্য সময় তা’লীম দেওয়া হবে। এখন আপনি তা’লীমের অবমূল্যায়ন করেছেন।
ছাত্র কর্তৃক লিখিত আদবসমূহ শেষ হলো।
আদব-৮৫: তোমার সঙ্গে কেউ কথা বললে অমনোযোগী হয়ে কথা শুনো না। এতে তার মন নিরুৎসাহী ও নির্জীব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যে ব্যক্তি তোমারই উপকারের জন্য কোন কথা বলে বা তোমার প্রশ্নের উত্তর দেয়। আরো বিশেষ করে তার সঙ্গে যদি তোমার তা’লীম ও ইসলাহের সম্পর্ক থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে অমনোযোগী হওয়া অধিকতর দোষণীয়।
আদব-৮৬: যে ব্যক্তির নিকট তুমি নিজেই নিজের দ্বীনী বা দুনিয়াবী কোন প্রয়োজনের কথা তুলে ধরো, আর সে তোমার কাছে সে বিষয়ে কিছু জানতে চায়, তাহলে তাকে তুমি অস্পষ্ট উত্তর দিও না। তার সাথে ঘুরিয়ে কথা বলো না, যার ফলে তার ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়, বা জটিলতা ও পেরেশানী সৃষ্টি হয়। বারংবার জিজ্ঞাসা করায় অনর্থক তার সময় নষ্ট হয়। কারণ, সে তোমার স্বার্থেই জিজ্ঞাসা করছে। তার নিজের কোন স্বার্থ নেই। যদি তাকে পরিষ্কার উত্তর দেওয়ার তোমার ইচ্ছাই না থাকে, তাহলে তার কাছে তোমার প্রয়োজনের কথা নাই বলতে। নিজেই এদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারপর নিজেই তাকে বিরক্ত করলে।
আদব-৮৭: কোন বিষয়ে আলোচনার সময় প্রতিপক্ষ তোমার যে যুক্তি-প্রমাণ প্রত্যাখ্যান করেছে বা তোমার যে দাবীর বিপরীত কথা সে প্রমাণ করেছে, তার প্রমাণের উপর তোমার কথা বলায় তো সমস্যা নেই, কিন্ত্ত ঠিক পূর্বোক্ত দাবী বা দলিলেরই পুনরাবৃত্তি করায় প্রতিপক্ষকে কষ্ট দেওয়া হয়। এ বিষয়টির প্রতি খুব খেয়াল রাখবে।
আদব-৮৮: অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, কর্মরত মানুষের নিকট বিনা প্রয়োজনে বেকার মানুষ বসে থাকলে তার মন অন্যমনস্ক ও বিক্ষিপ্ত হয়। বিশেষ করে তার কাছে বসে যদি তাকে দেখতে থাকে। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা দরকার।
আদব-৮৯: বিল্ডিংয়ের কোন কোন পাইপ বা নালা সড়কমুখী থাকে, যা শুধুমাত্র বর্ষাকালের জন্য লাগানো হয়ে থাকে। অন্য সময়ে ঐ পাইপ বা নালা দিয়ে পানি ফেললে পথচারীদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়। যদিও তোমার দিকে তাকিয়ে কেউ তোমাকে কিছু বলে না, কিন্ত্ত তোমারও তো অন্যদের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত।
আদব-৯০: এক জায়গা থেকে খামে করে পঞ্চাশ টাকার বীমা (পার্শেল) আসে। খাম খোলা ছাড়া কী উদ্দেশ্যে এ অর্থ এসেছে তা জানার উপায় ছিলো না। অপরদিকে খাম খোলার পর এমন কোন উদ্দেশ্য লিখিত থাকার সম্ভাবনা ছিলো, যা আমি পুরা করতে পারবো না। তখন সে টাকা ফেরত পাঠাতে হবে। কিংবা অস্পষ্টতার কারণে তার উদ্দেশ্য বুঝতে সমস্যা হলে সঠিকতা জানার জন্য পুনরায় তার উদ্দেশ্য তার নিকট যাচাই করতে হবে। এটা যাচাই করা পর্যন্ত সে টাকা বিনা প্রয়োজনে আমানত রাখতে হবে। আর ফেরত পাঠাতে হলে অনর্থক আমাকে তার খরচ বহন করতে হবে। কারণ, অনেক সময় এমন হয়েছে যে, আমাকে জিজ্ঞাসা না করেই আমার রাহ খরচ পাঠিয়ে দিয়েছে, অথচ আমি যেতে পারিনি। কিংবা টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্র অস্পষ্ট থাকার ফলে কিংবা ব্যয়ের ক্ষেত্র স্পষ্ট থাকলেও তার বিশেষ কোন দিক অস্পষ্ট থাকার ফলে এখান থেকে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ওদিকে উত্তর দিতে তারা দেরী করেছে। ফলে তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে আমাকে প্রতীক্ষা করতে হয়েছে। কর্মব্যস্ত লোকের এতে কষ্ট হয়। তাই বীমার সে খাম আমি ফেরত পাঠাই। আমার মত ব্যস্ত লোকদের সাথে জরুরী আর অন্যদের সাথে উত্তম হলো, এমন ক্ষেত্রে প্রথমে জানিয়ে বা জিজ্ঞাসা করে অনুমতি নিয়ে নিবে, তারপর টাকা পাঠাবে। কিংবা মানিঅর্ডার ফরমে পরিষ্কারভাবে উদ্দেশ্য লিখে দিবে। যাতে প্রাপক উদ্দেশ্য জানতে পারে। তারপর সে চাইলে তা গ্রহণ করবে, না হয় ফেরত পাঠাবে।
আদব-৯১: জালালাবাদের এক মক্তবের শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়ে। মক্তবের মুহতামিম আমার কাছে দু’চারদিনের জন্য একজন উস্তাদ পাঠানোর আবেদেন করে। আমি নিজে কাউকে যেতে বললে অনিচ্ছা থাকলেও যেতে বাধ্য হবে মনে করে সেই মুহতামিম সাহেবকে বলে দেই যে, এখানে যারা আছে তাদেরকে আপনি জিজ্ঞাসা করুন। কেউ স্বেচ্ছায় রাজি হলে আমার পক্ষ থেকে অনুমতি আছে। তিনি একজন মুরীদকে রাজি করেন। সেই মুরীদ বলে যে, অমুকের (অর্থাৎ, আমার) নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে চলে আসবো। তারপর ঐ মুহতামিম সাহেব চলে যায়। পরের দিন ঐ মুরীদ আমার কাছে এসে নিজের সমস্যার কথা বলে বলছে যে, আমি যেতে পারবো না। আমি বললাম যে, এ সমস্যার কথা ঐ মুহতামিম সাহেবের নিকট বলা উচিত ছিলো। তার নিকট আমার অনুমতি সাপেক্ষে যাওয়ার ওয়াদা করেছো। এখন হয়তো সে মনে মনে বলবে যে, সে তো আসার জন্য রাজি ছিলো, কিন্ত্ত অমুক ব্যক্তি হয়তো আসতে বারণ করেছে। তুমি আমার উপর দোষ চাপাতে চাও। এ কেমন অশালীন আচরণ। এখন তুমি জালালাবাদ যাও। গিয়ে বলো যে, অমুক ব্যক্তি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলো, কিন্ত্ত আমার এই সমস্যা রয়েছে, তাই আমি থাকতে পারবোনা। সুতরাং তাকে আমি সেখানে পাঠিয়ে দেই। এ উপদেশ সবার জন্যই প্রযোজ্য। নিজেকে নির্দোষ আর অন্যকে মিথ্যা দোষী সাব্যস্ত করা চরম অন্যায় কাজ।
আদব-৯২: একবার এক ব্যক্তির এই ঘটনা ঘটে যে, তার অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গেও কিছু কথা ছিলো, আর আমার নিকটেও কাজ ছিলো। উভয় উদ্দেশ্য নিয়েই সে এখানে এসেছিল। সে ঐ ব্যক্তিকে চিনতো না। তাছাড়া সেসময় ঐ ব্যক্তি কাউকে সাক্ষাতও দেয় না। তাই তাকে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, সন্ধ্যার সময় তার সাথে সাক্ষাৎ করো। এ পরামর্শ মত কাজ করার ফলে আর কোন সমস্যা হয় না। কিন্ত্ত অন্য কিছু মেহমানের এমন ঘটনা ঘটে যে, তারা তাদের প্রয়োজনীয় কাজে অন্যত্র চলে যায়, সেখান থেকে তাদের আসতে দেরী হয়ে যায়। ফলে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এখানকার লোকদের কষ্ট হয়। বাড়ীর লোকেরা অনেকক্ষণ পর্যন্ত খাবার নিয়ে বসে থাকে। ফলে ক্ষতিও হয় আবার কষ্টও হয়। তাই যেখানে প্রত্যাশী ও প্রার্থী হয়ে যাবে, সেখানে অন্য কোন প্রয়োজন না নিয়ে যাওয়া উচিত। অনেক সময় উদ্দেশ্যহীন ব্যস্ততায় জরুরী এবং মূল উদ্দেশ্যের প্রতি অবহেলা হয় এবং ক্ষতি হয়।
আদব-৯৩: অন্য এক ব্যক্তি ইশার পর বললো যে, আমি এক জায়গা থেকে লেপ নিয়ে আসবো। তখন তাকে বলা হলো যে, এ সময় তো মাদরাসার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তুমি ডাকাডাকি করে সবার আরামের ব্যাঘাত করবে। তারপর তাকে কাপড় দেওয়া হলো। তখন তার এ আচরণের জন্য আফসোস হলো যে, সে কি সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে? লেপ আনা যখন জরুরী ছিলো, তখন আগে আগেই আনা দরকার ছিলো।
Leave a Reply