সুলক্ষণ-কুলক্ষণ ও বিবিধ মাসআলা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আগলাতুল আওয়াম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
সুলক্ষণ-কুলক্ষণ:
মাসআলা-১: কতক লোক বলে যে, অমুক প্রাণী ডাকার ফলে মৃত্যু ছড়িয়ে পড়ে। এটি নিছক ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-২: কতক ছাত্রকে ‘সবকের’ ব্যাপারে এ বিশ্বাস পোষণ করতে দেখেছি যে, ’শনিবারের সবক হাতছাড়া হলে পুরো সপ্তাহ হাতছাড়া হলো।’ এটিকে আকস্মিক ব্যাপার মনে করলে তো ঠিক আছে, কিন্তু আবশ্যিক মনে করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট এবং এটি দিনের প্রভাবে বিশ্বাসী হওয়া, যা জ্যোতিষ শাস্ত্রের একটি শাখা এবং শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-৩: একইভাবে কতক ছাত্রকে বুধবার দিন কিতাব শুরু করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতে দেখা গেছে। তারা এটাকে হাদীসের ন্যায় প্রামাণ্য মনে করে। মূলত এ ব্যাপারে কোন হাদীস প্রমাণিত নেই।
মাসআলা-৪: কতক সাধারণ মানুষ মনে করে যে, পুরুষের বাম চোখ এবং নারীর ডান চোখ লাফালে কোন দুঃখ-বেদনা ও বিপদ আসে এবং এর বিপরীত হলে আনন্দ দেখা দেয়। এটি নিছক ভুল ধারণা।
মাসআলা-৫: কতক সাধারণ মানুষ ভোরবেলা কোন স্থান যেমন, ‘নানুতা’ ‘কিরানা’ ইত্যাদি বা কোন প্রাণী যেমন, সাপ, শূকর ইত্যাদির নাম নেওয়াকে খারাপ ও অশুভ মনে করে। এটি একেবারেই ভুল কথা।
মাসআলা-৬: কতক সাধারণ লোক বিশেষ কোনদিন বা বিশেষ কোন সময়ে সফর করাকে খারাপ বা ভালো মনে করে। এটি কাফের বা জ্যোতিষীদের বিশ্বাস, ইসলামের নয়।
মাসআলা-৭: অনেক সাধারণ লোক বলে যে, হাতের তালু চুলকালে সম্পদ পাওয়া যায় এবং পায়ের তালু চুলকালে বা জুতার উপর জুতা উঠলে সফর দেখা দেয়। এসব ভিত্তিহীন ও অর্থহীন কথা।
মাসআলা-৮: কতক মহিলা বাড়ীর দেওয়ালের উপর কাক ডাকলে কোন মেহমানের আগমনের লক্ষণ মনে করে। এরূপ ধারণা করা গুনাহ।
মাসআলা-৯: অধিকাংশ সাধারণ লোক মনে করে যে, বড় চামচ দ্বারা আঘাত করলে পেটুক হয়ে যায়। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-১০: সাধারণ লোকদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, অন্য কারো হাতে ঝাড়ুর বাড়ি লাগলে দোষণীয় মনে করে এবং বলে যে, আমি কূপের মধ্যে লবণ ফেলে দিবো, ফলে তোর মুখে দাগ পড়বে। এটিও নিছক ভিত্তিহীন।
মাসআলা-১১: কতক লোকের এরুপ ধারণা আছে যে, ঝাড়ু দ্বারা আঘাত করলে, যাকে আঘাত করা হয় তার শরীর শুকিয়ে যায়। তাই ঝাড়ুর উপর থুথু নিক্ষেপ করো। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-১২: আমাদের এলাকায় প্রচলিত আছে যে, কোন ব্যক্তি কোথাও যাওয়ার সময় পিছন দিক থেকে তাকে কেউ ডাকলে সে ঝগড়া করতে প্রস্ত্তত হয়ে যায় এবং বলে যে, আমাকে তুমি কেন পিছন থেকে ডাকলে? এখন আর আমার কাজ হবে না। শরীয়তে এ কথার কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-১৩: আমাদের এলাকার মহিলারা কাক ডাকলে মেহমান আসার লক্ষণ মনে করে। এটি ভিত্তিহীন।
মাসআলা-১৪: আমাদের এলাকার মহিলারা যাতার হাতল ছুটে গেলে মেহমান আসার লক্ষণ মনে করে। এটি অর্থহীন কথা।
মাসআলা-১৫: সাধারণতঃ মহিলাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, ট্রে থেকে আটা উড়ে গেলে মেহমান আসে, এটি একান্তই ভুল কথা।
মাসআলা-১৬: কতক লোক জুতার উপর জুতা উঠে গেলে সফর দেখা দেওয়ার লক্ষণ মনে করে। এটি ভিত্তিহীন ও অর্থহীন কথা।
মাসআলা-১৭: প্রসিদ্ধ আছে যে, হাতের তালু চুলকালে কিছু লাভ হয়। এ কথার কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-১৮: আমাদের এলাকায় একটি কবিতা প্রসিদ্ধ আছে-
’মঙ্গল ও বুধবারে বাড়ি যাবে না। তাহলে জুতার বাড়ি খাবে।’
এ কথারও কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-১৯: মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, সন্ধ্যার সময় মোরগ ডাকলে, সাথে সাথে ঐ মোরগ জবাই করবে। কারণ, এটি ভালো নয়। এ কথার কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-২০: মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, মুরগী ডাকলে সাথে সাথে তাকে জবাই করবে। কারণ এর দ্বারা মহামারী বিস্তার লাভ করে। এটি ভুল কথা।
মাসআলা-২১: রোগীর জন্য দুই ব্যক্তি চিকিৎসককে ডাকতে গেলে এটাকে খারাপ মনে করা হয় এবং বলা হয় যে, এখন আর রোগী সুস্থ হবে না। এটি ভুল কথা।
মাসআলা-২২: কোন নববধূ কূপ থেকে পানি আনতে গেলে তাকে তাকিদ করে বলা হয় যে, প্রথমে কূপের উপর প্রদীপ জ্বালাবে তার পর পানি আনবে। এটি ভুল, বরং শিরক।
মাসআলা-২৩: কেউ কোথাও যাওয়ার সময় অন্য কেউ হাঁচি দিলে সে ব্যক্তি ফিরে চলে আসে এবং বলে যে, এখন গেলে কাজ হবে না। এটি ভুল কথা।
বিভিন্ন মাসআলা:
মাসআলা-১: সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, টাকা বহুত দিন পর্যন্ত ‘ইয়া আযীযু’ এর ওযীফা পাঠ করেছে। এ কথার কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-২: প্রসিদ্ধ আছে যে, আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে পানাহার করা ভালো নয়। তার কারণ এই লিখেছে যে, মৃত্যুর সময় মৃত্যুপথযাত্রীর নিকট এ সময়ই দেখা দেয়, আর তখন শয়তান পেশাবের পেয়ালা পান করার জন্য নিয়ে আসে। তাই যদি পানাহারের অভ্যাস না থাকে তাহলে তা পান করতে অস্বীকার করবে। শরীয়তে এরও কোন ভিত্তি নেই।
মাসআালা-৩: প্রসিদ্ধ আছে যে, হাতে বেত রাখা ঠিক নয়। কারণ, ইয়াযীদ হাতে বেত রাখতো। এটিও নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৪: প্রসিদ্ধ আছে যে, ঝাউ গাছের লাকড়ি ব্যবহার করা দুরুস্ত নাই। এটিও নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৫: প্রসিদ্ধ আছে যে, স্বামী-স্ত্রী এক পীরের মুরীদ হবে না। অন্যথা ভাই-বোন হয়ে যাবে। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৬: প্রসিদ্ধ আছে যে, হারাম মাল নিঃশর্তভাবে কিনে নিলে হালাল ও পবিত্র হয়ে যায়। এমনিভাবে হারাম মাল বদল করে নিলেও হালাল হয়ে যায়। যেমন, কোন একটি জিনিস চুরি করলো বা ফল আসার পূর্বেই ফুল ক্রয় করলো। তারপর সেই জিনিস বা ফল বিক্রি করার জন্য বাজারে আনলো তখন কতক লোক মনে করে যে, আমি যখন দাম দিয়ে ক্রয় করলাম তাই এ জিনিস আমার জন্য জায়েয হবে। এমনিভাবে কেউ ঘুষ নিলো তারপর সেই ঘুষের টাকা কারো থেকে পরিবর্তন করে নিলো, তখন মনে করে যে, পরিবর্তন করে নেওয়া টাকা হালাল হয়ে গেলো। এ উভয় ধারণা নিছক ভুল। সেই মাসআলা ভিন্ন, যাকে মানুষ ভুল বুঝেছে।
মাসআলা-৭: প্রসিদ্ধ আছে যে, লাকড়ি দিয়ে উঠানো পানি পান করা ঠিক না। এটিও নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৮: প্রসিদ্ধ আছে যে, রাতের বেলা গাছ নাড়াবে না, তাহলে সে অস্থির হয়ে যায়। এটিও নিছক ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-৯: প্রসিদ্ধ আছে যে, তাসবীহ এভাবে সিধা, এভাবে উল্টা এবং এভাবে পড়বে, এভাবে পড়বে না। শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-১০: প্রসিদ্ধ আছে যে, শোয়ার সময় উত্তর মেরুর দিকে পা দিবে না। এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-১১: কতক মহিলা মনে করে যে, বিড়াল ক্ষতি করলেও শুধুমাত্র লাঠির মাথায় তুলা বেঁধে মারা জায়িয আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে মেরেছিলেন। এ মাসআলা এবং হাদীস উভয়টি ভুল।
মাসআলা-১২: গোসলখানা এবং পায়খানায় কথা বলাকে সাধারণ লোকেরা নাজায়েয মনে করে। এর কোন ভিত্তি নেই। তবে বিনা প্রয়োজনে কথা বলবে না।
মাসআলা-১৩: জনসাধারণের মধ্যে চোর সম্পর্কে জানার কিছু আমল প্রচলিত আছে। সেগুলোকে তারা জায়েয এবং চোর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রমাণ মনে করে। কিন্তু ভালো করে বুঝে নেওয়া উচিত যে, সেগুলো জায়েযও নয় এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রমাণ রুপে গ্রহণযোগ্যও নয়। তাছাড়া যে শাস্ত্রের ভিত্তিতে এগুলো করা হয়, তার মূলনীতির নীরিখেও এগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এগুলো সম্পূর্ণ ধারণা ও কল্পনার অধীন কাজ। এমনকি দু’জন কবিরাজ যদি দুই ব্যক্তি সম্পর্কে চুরির ধারণা পোষণ করে তাহলে প্রত্যেক কবিরাজের আমলে ভিন্ন ভিন্ন নাম বের হয়ে আসবে। বরং ঐ কবিরাজদেরকে যদি কাল্পনিক নামও বলে দেওয়া হয় তাহলে তাতে ঐ নামই বের হয়ে আসবে। যার দ্বারা পরিস্কার বোঝা যায় যে, এ সমস্ত আমলের কোনই মূল্য নেই।
মাসআলা-১৪: এ অভ্যাসটি খুবই প্রচলিত যে, যদি পবিত্র কুরআনের সাথে নাউযুবিল্লাহ কোন বেয়াদবী হয়ে যায় তাহলে তার সমপরিমাণ শস্য মেপে দান করা হয়। এর মধ্যে মূল উদ্দেশ্য তো খুবই ভালো এবং ন্যায়সঙ্গত। অর্থাৎ, বেয়াদবীর কাফফারা ও জরিমানা স্বরুপ দান করা। তাছাড়া এতে নিজের মনেরও নিয়ন্ত্রন রয়েছে, কেননা এতে সে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবে। কিন্তু এর মধ্যে দু’টি বিষয় ভিত্তিহীন এবং সংশোধনযোগ্য। একটি হলো, পবিত্র কুরআনকে শস্য মাপার পাল্লায় রাখা হয়। দ্বিতীয় হলো, এ কাজটিকে শরীয়ত প্রবর্তিত ওয়াজিব মনে করা হয়। হাঁ, যদি এমন করে যে, শুধুমাত্র উপরোক্ত উপকারিতাকে সামনে রেখে অনুমাণ করে কিছু শস্যদান করে, তাহলে কোন ক্ষতি নেই।
মাসআলা-১৫: কতক লোক বলে যে, মহিলাদের জন্য ক্ষুর দ্বারা গুপ্তাঙ্গের লোম পরিস্কার করা নিষেধ। এটি ভুল কথা। চিকিৎসা শাস্ত্রের দিক থেকে অনুপযোগী হলে হতে পারে, কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিতে গুনাহ নয়।
মাসআলা-১৬: কতক লোক রাতের বেলা ঝাড়ু দেওয়া, মুখ দ্বারা ফুঁ দিয়ে বাতি নিভানো বা অন্যের অনুমতি সাপেক্ষেও মাথা আচঁড়িয়ে দেওয়াকে খারাপ মনে করে, এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআালা-১৭: মহরের ব্যাপারে কারো কারো থেকে শোনা গেছে যে, কোন প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার মহর নির্ধারণ করতে হলে তৃতীয়বারও অবশ্যই মহর নির্ধারণ করবে। এ কথার কোনই ভিত্তি নেই।
মাসআলা-১৮: কতক লোককে বিশেষ পদ্ধতির ইস্তিখারা এ উদ্দেশ্যে শেখাতে দেখেছি যে, এর দ্বারা অতীত বা ভবিষ্যতের কোন ঘটনা জানা যাবে। কিন্তু শরীয়তে এ উদ্দেশ্যে ইস্তিখারা বর্ণিত হয়নি। বরং ইস্তিখারা কেবলমাত্র কোন কাজ করা বা না করার ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য বর্ণিত হয়েছে। অতীত বা ভবিষ্যতের ঘটনা জানার জন্য নয়। বরং এ ধরনের ইস্তিখারার ফলাফলের উপর বিশ্বাস করাও জায়েয নেই।
মাসআলা-১৯: কতক কবিরাজকে এমনকি কতক আলেম কবিরাজকেও কিছু কিছু কবিরাজির ক্ষেত্রে দিন ইত্যাদি শর্ত মেনে চলতে দেখেছি। এটি মূলত জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিষয়। যা পরিহার করা ওয়াজিব। আর এরুপ ধারণা পোষণ করা যে, এটি এ আমলের শর্ত-এটা ভুল। আমি এ ধরনের আমলের ক্ষেত্রে এ ধরনের শর্ত সম্পূর্ণরুপে বাদ দিয়ে দিয়েছি। এরপরও আল্লাহ তাআলার মেহেরবাণীতে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় কোন কমতি হয় নাই। আমলের প্রতিক্রিয়া বেশীর ভাগ খেয়াল ও মনোযোগের কারণে হয়ে থাকে। এ কাজে এ সমস্ত শর্তের কোন দখল নেই। এগুলো নিছক কবিরাজদের দাবী।
মাসআলা-২০: প্রসিদ্ধ আছে যে, মাটিতে লবণ ফেললে কিয়ামতের দিন চোখের পাতা দিয়ে তা উঠাতে হবে। এটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-২১: কতক সাধারণ লোক বলে যে, হাই আসলে মুখের উপর হাত না রাখলে শয়তান মুখের মধ্যে থুথু নিক্ষেপ করে। এটি ভুল কথা। তবে হাদীস দ্বারা এতটুকু অবশ্যই প্রমাণিত আছে যে, সে সময় মুখে হাত না রাখলে শয়তান পেটের মধ্যে প্রবেশ করে হাসে।
মাসআলা-২২: প্রসিদ্ধ আছে যে, রোগীর জন্য ডাক্তার ডাকতে গেলে ঘোড়ার পিঠে গদি লাগিয়ো না। এটি ভুল কথা।
মাসআলা-২৩: কতক সাধারণ লোক বলে যে, সুরমার শলাইয়ের উপর তিনবার ‘সূরায়ে ইখলাস’ পড়ে ফুঁ দিয়ে চোখে সুরমা লাগানো উচিত। এটি ভিত্তিহীন কথা।
Leave a Reply