উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

দ্বীনি শিক্ষার যে দিকটি ‘তাসাওউফ’ ও ‘তরীকত’ নামে পরিচিত, তা মূলত ইসলামী শরীয়তের নেহায়েত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যা ছাড়া ঈমান ও ইসলাম পরিপূর্ণ হতেই পারে না। প্রকৃতপক্ষে শরীয়তের উপর পরিপূর্ণ আমল করারই অপর নাম ‘তরীকত’ ও ’তাসাওউফ’। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে কিছুলোকের ইলমের কমতি ও গাফলতী এবং কিছু ভ্রান্তপন্থী লোকের অনধিকার চর্চার ফলে তাসাওউফের হাকীকত ও স্বরুপ এমন অস্পষ্ট ও ভেজালপূর্ণ হয়ে গেছে যে, কেউ দরবেশদের কিছু রীতি-প্রথা ও আচার অনুষ্ঠানের নাম তাসাওউফ রেখেছে। কেউবা মানুষের ক্ষমতা বহির্ভূত উন্মাতাল অবস্থা ও অস্বাভাবিক ভাবকে তাসাওউফ বুঝেছে। কেউ কাশফ ও কারামতের নাম তাসাওউফ দিয়েছে। আর কিছু লোক ভুলবশতঃ কিছু বিদআতী কর্মকান্ডকে তরীকতের মধ্যে শামিল করে সেগুলোকেই তাসাওউফ ভাবছে।

এভাবে তাসাওউফের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই অধিকাংশ লোকের দৃষ্টির আড়াল হয়ে গিয়েছে। মাকসুদ ও গায়রে মাকসুদের এই সংমিশ্রণের ফলে নানাবিধ ক্ষতি দেখা দিয়েছে। যেমন-যেসব লোক এখতিয়ার বহির্ভূত উন্মাতাল অবস্থা ও অস্বাভাবিক ভাবকে কিংবা কাশফ ও কারামতকে তাসাওউফ বুঝাছে-যেগুলো মূলত তাসাওউফের কোন আবশ্যকীয় বিষয়ও নয় এবং সবার হাসিলও হয় না এবং সেগুলো হাসিল না হলে ধর্মীয় পরিপূর্ণতায় কোন ত্রুটি বা তাসাওউফের মাকসাদের মধ্যে কোন কমতিও আসে না-এরুপ বুঝের অধিকারী আল্লাহর পথের পথিকগণ যখন মেহনত-মুজাহাদা করা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে এ ধরনের ভাব ও অবস্থা লাভ হতে দেখে না, তখন তাদের মধ্যে নৈরাশ্য দেখা দেয়। তারা ভাবে যে, আমাদের দ্বারা এ পথের সাফল্য লাভ করা অসম্ভব।

অপরদিকে ত্রুটিপূর্ণ আমলের অধিকারী বরং ফাসিক-ফাজির লোকেরও কোন ওযীফা পাঠ বা আমলের মাধ্যমে এ ধরনের ভাব ও অবস্থা হাসিল হলে তারা একেই তাসাওউফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মনে করে অহমিকায় লিপ্ত হয়ে যায়। তারা মনে করে যে, আমাদের এ পথের কামালিয়াত ও পূর্ণতা লাভ হয়েছে। অথচ শরীয়তের হুকুম-আহকাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুগামী হওয়া ছাড়া কারোই তাসাওউফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য লাভ হতেই পারে না। এ ব্যাপারে তাসাওউফ শাস্ত্রের সমস্ত ইমামের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা এ যুগে সাইয়্যেদী হাকীমুল উম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (কুদ্দিসা- সিররুহু)কে তাজদীদী খেদমত তথা সংস্কারমূলক কাজ এবং দ্বীনের ইসলাহী কাজের জন্য মনোনীত করেছিলেন। যার উপর তার রচিত শত শত বই-পুস্তক সাক্ষী।

তাসাওউফ ও তরীকতের হাকীকত তথা স্বরুপকে সুস্পষ্ট করা, তার মাকসুদ ও গায়রে মাকসুদের মধ্যে তারতম্য করা এবং এ পথের সঠিক ও সফল আমলের পন্থাসমূহ শিক্ষাদানের লক্ষ্যে হযরত থানভী(কুদ্দিসা সিররুহু) অনেক বই-পুস্তকই রচনা করেছেন। যেমন, ’আত্-তাকাশশুফ ফি মাসায়িলিত তাসাওউফ’, ’মাসায়িলুস সুলূক’, ‘তা’লীমুদ্দীন’ ইত্যাদি। পরবর্তীতে তার এতদসংক্রান্ত সমস্ত গবেষণার সারসংক্ষেপ এবং তরীকতের পথিকদের জন্য তাদের বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে পৃথক পৃথক কর্মসূচী সম্বলিত ‘কসদুস সাবীল’ নামক পুস্তিকা রচনা করেন। পরবর্তীতে তাসাওউফ ও তরীকতের স্বরুপকে সুস্পষ্ট করার জন্য এবং তাকে সহজবোধ্য করার জন্য মূল পুস্তিকার সঙ্গে পরিশিষ্টরুপে কয়েকটি প্রবন্ধও সংযুক্ত করেন। তিনি পরিশিষ্ট প্রবন্ধ সমষ্টিকে ‘খামসায়ে তাসাওউফ’ এবং ‘পাঞ্জ হাসসায়ে বাতিন’ বা ‘বাতেনী পঞ্চেন্দ্রীয়’ নাম দিয়েছেন। ১৩৫০ হিজরী সনে এ পুস্তিকা প্রথম প্রকাশ পায়।

পুস্তিকাটি একাডেমিক ভাষায় লিখিত ছিলো বিধায় কম শিক্ষিত লোকদের জন্য তা থেকে জ্ঞান আহরণে জটিলতা দেখা দিতো। তাই হযরত হাকীমুল উম্মত(কুদ্দিসা সিররুহ)-এর প্রধান খলীফা, কাশফ ও কারামতের অধিকারী বুযুর্গ হযরত মাওলানা শাহ লুতফে রাসূল সাহেব হযরতের অনুমতিক্রমে সহজবোধ্য ভাষায় পুস্তিকাটির সহজিকরণ করেন। ‘তাসহীলে কসদুস সাবীল’ নামে তা বহুবার প্রকাশিত হয়। ঐ পুস্তিকার সঙ্গে পরিশিষ্টাকারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ইলমের স্বল্পতা এবং মানুষের আরামপ্রিয়তা এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, মানুষ একটি পুস্তিকা পাঠ করে তারপর তার পরিশিষ্টসমূহ পৃথকভাবে অধ্যয়ন করে সবকিছুর সমষ্টি থেকে ফলাফল বের করবে, তা খুবই জটিল হয়ে গেছে। ফলে এ শ্রেণীর মানুষ বুযুর্গদের ইলমী হীরকখন্ডসমূহকে পাঠ করাই কমিয়ে দিয়েছে।

এ সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা অধমের দৃষ্টিতে তাসাওউফ ও তরীকতের হাকীকতকে সুস্পষ্ট করা, তার মাকসুদ ও গায়রে মাকসুদের মধ্যে তারতম্য করা এবং আধ্যাত্মিকতার এ পন্থাকে সহজিকরণের ক্ষেত্রে সাগরকে কলসে ভরার নামান্তর। যার মধ্যে এ পথের প্রাথমিক স্তরের লোকদের থেকে সর্বশেষ স্তরের লোকদের পর্যন্ত সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েতসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। তাই এ অধম বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ের লোকদের সুবিধার্থে এ পুস্তিকার বিষয়বস্ত্তসমূহের সারসংক্ষেপ এমনভাবে লিপিবদ্ধ করার জরুরত উপলব্ধি করি, যার মধ্যে পরিশিষ্টের বিষয়সমূহকে মূল বক্তবের সাথে একীভূত করে লেখা হবে। এবং মূল পুস্তিকার যেখানে কোন জটিলতা বা অস্পষ্টতা আছে, তার ব্যাখ্যা করা হবে।

তাই বর্তমান পুস্তিকায় প্রথম পাঁচ ‘হেদায়াত’ পর্যন্ত কিছু ব্যাখ্যাও সংযোজিত করা হয়েছে। ষষ্ঠ ‘হেদায়াত’ থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘তাসহীলে কসদুস সাবীলের’ প্রায় পুরো বিষয়বস্ত্তই এ পুস্তিকার মূল মাকসাদ। কসদুস সাবীলের এ সারসংক্ষেপ লিখিত হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের লোকদের জন্য। এটি অধ্যয়ন করার দ্বারা বিষয়বস্ত্তর সাথে কিছুটা মোনাসেবাত (পরিচিত ও সম্পর্ক) পয়দা হলে মূল ‘কসদুস সাবীল’ অধ্যয়ন করাও নেহায়েত উপকারী হবে। কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই এবং তারই উপর ভরসা পোষণ করি।

বান্দাহ মুহাম্মাদ শফী’ আফাল্লাহু আনহু
৫ জুমাদাল উলা, ১৩৯৪ হিজরী

ভূমিকা

’যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি মহান মাওলা এবং তারই নিকট সোজা পথের সমাপ্তি। আমাদের সরদার মুহাম্মাদের উপর দরুদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক, পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে যার কোন সমকক্ষ নেই। আর তিনি হলেন সেই সোজাপথের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক। এবং তার বংশধর ও সাহাবাগণের উপর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক, যারা আল্লাহর পথে অল্পবিস্তর জানমাল ব্যয়কারী এবং যারা সম্মানিতদের সম্মান এবং অপমানিতদের অপমানের সাথে আয়াত ও হাদীসসমূহের তাবলীগকারী।
মূলত শরীয়তের উপর পরিপূর্ণ আমল করারই অপর নাম ‘তাসওউফ’ ও ‘তরীকত’। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে এমনই এক অস্পষ্টতা ও অবিমিশ্রণ হয়ে আসছে যে, অনেক অজ্ঞ লোক কিছু কিছু বুযুর্গের রসম ও আচার-অনুষ্ঠানকে এবং অনেক লোক তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত অস্বাভাবিক ভাব ও উন্মাতাল অবস্থাকেই তাসাওউফ বুঝেছে। তাসাওউফের মাকসুদ ও গায়রে মাকসুদের মধ্যে তারতম্য না থাকার ফলে কিছু লোক তাসাওউফকে অত্যন্ত জটিল এবং এর উপর আমল করা অসম্ভব মনে করে হতাশ হয়েছে। আর কিছু লোক শরীয়ত পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকা এবং তাদের স্বভাব-চরিত্র শরীয়তবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও কিছু ভাবের উদ্রেক হওয়া এবং কিছু ভালো স্বপ্ন দেখার ফলে নিজের নফসের ইসলাহ এবং শরীয়তের উপর আমল করার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। এ সমস্ত খারাপ দিকের সংশোধনের উদ্দেশ্য তরীকত ও তাসাওউফের হাকীকত এবং তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসেল করার পন্থা সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী কিছু বিষয় ‘হেদায়াত’ শিরোনামে এ পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করছি।