উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

’সুলূক’ ও ’তরীকত’- যাকে মানুষ ‘তাসাওউফ’ বলে থাকে-তার হাকীকত বা মূল কথা এই যে, মুসলমান তার যাহের ও বাতেন তথা ভেতর ও বাহিরকে নেক আমল দ্বারা সজ্জিত করবে এবং বদআমল থেকে দূরে রাখবে। এর বিশ্লেষণ এই যে-
মুসলমানের জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলাকে রাজি-খুশি করা। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লাভের উপায় হলো, শরীয়তের হুকুম-আহকাম পরিপূর্ণরুপে মেনে চলা । শরীয়তের হুকুম-আহকাম তথা বিধি-বিধানের মধ্যে কিছু রয়েছে মানুষের বাহ্যিক দিকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমনঃ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি। আরো রয়েছে বিবাহ, তালাক, স্বামী-স্ত্রীর হক আদায় করা, কসম (শপথ) এবং কসমের কাফফারা ইত্যাদি। আরো রয়েছে লেনদেন, মোকদ্দমা পরিচালনা, সাক্ষ্যদান, ওসীয়্যত, উত্তরাধিকার সম্পদ বন্টন ইত্যাদি। আরো রয়েছে সালাম-কালাম, খাওয়া-শোয়া, ওঠা-বসা, মেহমানী-মেযবানী ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধানাবলী। উপরোক্ত সমস্ত বিষয় সংক্রান্ত মাসআলাসমূকে ‘ইলমে ফিকহ’ বলে।

আর কিছু রয়েছে মানুষের অভ্যন্তর তথা অন্তর বিষয়ক বিধান। যেমন- আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসা, তাঁকে ভয় করা, তাকে স্মরণ করা, দুনিয়াকে কম ভালোবাসা, আল্লাহর ইচ্ছার উপর সন্ত্তষ্ট থাকা, লোভ না করা, ইবাদতের সময় অন্তরকে হাযির রাখা, আল্লাহর কাজকে ইখলাসের সাথে আল্লাহকে রাজি করার উদ্দেশ্য করা, কাউকে তুচ্ছ মনে না করা, আত্মশ্লাঘায় লিপ্ত না হওয়া, রাগ নিয়ন্ত্রন করা ইত্যাদি। এ সমস্ত স্বভাব-চরিত্র ও গুনাবলীকে ‘সুলূক’, ‘তরীকত’ ও ‘তাসাওউফ’ বলে।
শরীয়তের বাহ্যিক বিধানাবলী- নামায, রোযা ইত্যাদির উপর আমল করা যেমন ফরয-ওয়াজিব, তেমনিভাবে এ সমস্ত অভ্যন্তরীন বিধানাসমূহের উপর আমল করাও কুরআন ও সুন্নাহের দৃষ্টিতে ফরয-ওয়াজিব। তাছাড়া বাতেনী মন্দ চরিত্রসমূহ থেকে দূরে থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করা এজন্য অধিক জরুরী যে, এ সমস্ত বাতেনী মন্দ চরিত্রের কুপ্রভাব বাহ্যিক আমলসমূহের উপরও পড়ে থাকে। যেমন, আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত কম হওয়ার ফলে নামাজের মধ্যে অলসতা দেখা দিলো বা রুকু-সেজদার হক আদায় না করে দ্রুত পড়ে ফেললো, বা কৃপণতার ফলে যাকাত প্রদানের বা হজ্জ আদায় করার সাহস হলো না, বা অহংকার কিংবা রাগের প্রাবল্যের কারণে কারো উপর জুলুম হয়ে গেলো। সারকথা হলো, শরীয়ত ও তরীকত দু’টি পৃথক জিনিস নয়। শরীয়তের জাহেরী ও বাতেনী সমস্ত হুকুমের উপর পরিপূর্ণ আমল করার নামই ‘তরীকত’। ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) ইলমে ফিকহের সংজ্ঞাই এমনভাবে দিয়েছেন যে, সংজ্ঞায় জাহেরী আমল ও বাতেনী আমল সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কিন্ত্ত পরবতীকালের আলেমগণ ইলম হাসিলের সুবিধার্থে জাহেরী আমলসমূহ যথা- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, বিবাহ, তালাক, ব্যবসা, ভাড়া চুক্তি ইত্যাদি বিষয়সমূহকে পৃথকভাবে সংকলিত করে তার নাম দিয়েছেন-ইলমে ফিকহ। আর বাতেনী আমলসমূহ যথা- ইখলাস, সবর, শোকর, যুহদ ইত্যাদি আমলসমূহের বিধি-বিধানকে পৃথকভাবে সংকলিত করে তার নাম রেখেছেন-তাসাওউফ ও তরীকত। এ পরিভাষা অনুপাতে শরীয়ত ও তরীকতের একটিকে অপরটি থেকে এভাবে পৃথকও বলা যেতে পারে, যেমন কিনা নামায একটি পৃথক ইবাদত এবং রোযা একটি পৃথক ইবাদত। এবং যেমন কিনা মানুষের হাত একটি পৃথক অঙ্গ এবং পা একটি পৃথক অঙ্গ। চোখ এক জিনিস আর কান অন্য জিনিস। অন্তর, কলিজা ও ঠোঁট পৃথক পৃথক অঙ্গ। কিন্ত্ত একটি মানবের পূর্ণতা এসবগুলোর সমন্বিত রুপেই হয়ে থাকে। এগুলোর একটিকে নিয়ে অপরটি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।

এমনিভাবে পরবতীকালের আলেমগণের পরিভাষামতে ইলমে আকায়িদ, ইলমে ফিকহ ও ইলমে তাসাওউফ নিঃসন্দেহে পৃথক পৃথক বিষয় ও শাস্ত্র, কিন্তু সঠিক ও পরিপূর্ণ মানুষ বা মুমিন ও মুসলমান এ সবকিছুর সমন্বয়েই হয়ে থাকে। এবং কুরআন ও সুন্নাহের প্রকৃত অনুসরণ এর সবগুলোর উপর আমল করার দ্বারাই লাভ হতে পারে। এগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিকে নিয়ে অন্যগুলোকে এড়িয়ে চলা এমনই ধ্বংসাত্মক, যেমন ধ্বংসাত্মক কানের হেফাযত করে চোখ নষ্ট করা। বা রোযার হেফাযত করে নামায নষ্ট করা।

হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (কুদ্দিসা সিররুহু) বলেছেন-
’তরীকতহীন শরীয়ত নিরেট দর্শন, আর শরীয়তহীন তরীকত ধর্মহীনতা।’

হযরত কাযী সানাউল্লাহ পানিপতী (রহঃ) ফরমায়েশেন-
’যে ব্যক্তির যাহের পাক নয়, তার বাতেন পাক হতেই পারে না।’

যাহের পাক হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যাহেরী আমলসমূহের পাবন্দী করা, যেগুলো ইলমে ফিকহের মধ্যে বর্ণনা করা হয়। আর বাতেন পাক হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, বাতেনী আমলসমূহের পাবন্দী করা, যেগুলো বর্ণনা করা হয় ইলমে তাসাওউফ ও সুলূকের মধ্যে।

ইমাম সোহরাওয়ার্দী (রহঃ) ’আওয়ারিফুল মাআরিফ’ কিতাবে সুফিয়ায়ে কেরামের মধ্যে যে সমস্ত অস্বাভাবিক ভাব ও অবস্থা দেখা দেয়, সেগুলো সম্পর্কে বলেন যে, হযরত সাহল বিন আবদুল্লাহ বলেছেন-
’যেই উন্মাতাল অবস্থার কোন সাক্ষ্য কুরআন-সুন্নায় মওজুদ নেই, তা বাতেল।’

তারপর তিনি বলেন যে, সুফিয়ায়ে কেরামের ইত্তিবায়ে সুন্নাতের অবস্থা এই, তাই যে জাহেল বা মূর্খ সূফী এর বিপরীত হালতের দাবীদার হবে, সে ফেতনায় নিপততিত, ডাহা মিথ্যুক।
(আওয়ারিফ, ইহয়াউল উলূমের টীকায় উদ্ধৃত খন্ড-১, পৃঃ ২৮০)

হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মশহুর ইমাম আবুল কাসিম কুশাইরী (রহঃ) যে যুগের সুফিয়ায়ে কেরামের নামে ‘রিসালায়ে কুশাইরিয়া’ নামে যে পয়গাম লিখেছিলেন- তার মধ্যে ইত্তিবায়ে সুন্নাতকেই সমস্ত সূফীর প্রকৃত কর্তব্য আখ্যা দিয়েছেন।

এ থেকে জানা গেলো যে, তাসাওউফের কতক মূর্খ দাবীদার যে বলে, শরীয়ত ও তরীকত দু’টি পৃথক রাস্তা। যে কাজ শরীয়তে হারাম তা তরীকতের মধ্যে হালাল হতে পারে। এটি নিশ্চিত ভ্রষ্টতা, সুস্পষ্ট ধর্মহীনতা এবং সমস্ত সুফিয়ায়ে কেরামের মত ও পথের পরিপন্থী কথা।