মুরীদদের জন্য আমলপঞ্জি – ১

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
নিয়্যত দুরুস্ত করে মুরীদ হওয়ার পর সুযোগ থাকলে কিছুদিন পীরের কাছে অবস্থান করবে, আর সুযোগ না হলে দূর থেকেই তার তা’লীম অনুযায়ী আমল করবে। এমনকি মুরীদ হওয়ার জন্যও যদি পীরের খেদমতে যেতে না পারে তাহলে যেখানে আছে সেখান থেকেই পত্রযোগে বা বিশ্বস্ত কোন লোক মারফতে মুরীদ হতে পারে। পীরের কাছে গিয়েই মুরীদ হতে হবে এমনটি জরুরী নয়। মুরীদদেরকে তা’লীম দেওয়ার পদ্ধতি একেক পীরের একেক রকম হয়ে থাকে। তার সবগুলো এ কিতাবে লেখা জরুরী নয়। তাই ছোট একটি আমল বা ওযীফা লিখে দিচ্ছি। এ ওযীফাটি কলেবরে ছোট হলেও এর উপকারিতা এত বেশী যে, একে তাসাওউফের নির্যাস বলা যায়। সীমাহীন কষ্টের ফলেই এ ওযীফা লাভ হয়েছে। এ ওযীফা বর্ণনা করাই এ পুস্তিকা রচনার মূল উদ্দেশ্য।
আল্লাহর পথের যে কোন পথিক পীর ধরার আগ পর্যন্ত এবং আমার যে কোন মুরীদের সর্বদা আমল করার জন্য এ ওযীফা ও আমলপঞ্জী লিখে দিচ্ছি। আল্লাহর কাছে আমি জোরদার আশাবাদী যে, এ ওযীফা অনুপাতে আমলকারী ব্যক্তি মাহরূম থাকবে না।
কোন ব্যক্তি এ ওযীফা মত আমল করতে থাকার পর তার পীর যদি এ ওযীফাই পছন্দ করে এবং এর অনুমতি দিয়ে দেয় তাহলে তো ব্যাপার সহজ হয়ে গেলো। আর যদি পীর সাহেব এ ওযীফা ও আমলের মধ্যে কম-বেশী করে বা অন্য কোন ওযীফা বলে দেয় তাহলে পীর সাহেব যেমন বলবে তেমনি আমল করবে। তবে এ আমলপঞ্জীর শুরুতে যে কথাগুলো লেখা হয়েছে তাতে কম-বেশী হতে পারবে না, সেগুলো একইরুপ থাকবে।
এতে বর্ণিত ‘দস্ত্তরুল আমল’ বা আমলপঞ্জীর সারকথা হলো, আল্লাহর পথের পথিক হয় সাধারণ মানুষ অর্থাৎ, অনালেম হবে অথবা আলেম হবে। এদের প্রত্যেকে আবার আয়-রোজগার এবং বিবি-বাচ্চার হক আদায়ের ফিকিরে ব্যস্ত থাকবে বা এগুলো থেকে বে-ফিকির ও নিশ্চিন্ত থাকবে। তাই আল্লাহর পথের পথিকদের মোট চার শ্রেণী হলো-
এক. সেই সাধারণ লোক, যে আয়-রোজগার ও বউ-বাচ্চার হক আদায় করা থেকে বেফিকির বা নিশ্চিন্ত।
দুই. সেই সাধারণ লোক, যে আয়-রোজগার এবং বউ-বাচ্চার হক আদায়ের ফিকিরে ব্যস্ত।
তিন. সেই আলেম, যে দুনিয়াবী কাজ থেকে মুক্ত।
চার. সেই আলিম, যে আয়-রোজগারের কাজে ব্যস্ত। এ চার শ্রেণীর প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক ‘দস্ত্তরুল আমল’ বা ওযীফা রয়েছে।
দুনিয়াবী কাজে ব্যস্ত অনালেম ব্যক্তির ওযীফাঃ
সর্বপ্রথম নিজের আকীদা-বিশ্বাস ঠিক করবে। জরুরী জরুরী মাসআলাসমূহ শিক্ষা করবে। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ঐ সমস্ত মাসআলার উপর আমল করবে। যখনই নতুন কোন মাসআলার প্রয়োজান পড়বে, কোন আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করে নিবে। আর তার পীর আলেম হলে তিনিই সর্বোত্তম। যাকিছু প্রয়োজন পড়বে তার নিকট জিজ্ঞাসা করে নিবে। সম্ভব হলে শেষ রাতেই তাহাজ্জুদ পড়বে। তা নাহলে ইশার নামাজের পরে বেতের নামাজের পূর্বে কিছু নফল নামায তাহাজ্জুদের নিয়তে পড়ে নিবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর সময় না থাকলে যে সমস্ত নামাযের পর অবসর আছে ঐ সমস্ত নামাযের পর একশ’বার ‘সুবহানাল্লাহ’, একশ’বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, একশ’বার ‘আল্লাহু আকবার’, এবং ঘুমানোর পূর্বে একশ’বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বী মিন কুল্লি যাম্বিউ ওয়া আতুবু ইলাইহি’ পাঠ করবে। উঠতে-বসতে সর্বদা দুরূদ শরীফ পাঠ করতে থাকবে। এতে ওযু থাকা বা নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা পুরা করা জরুরী নয়। ওযু ও বিনা ওযু সর্বাবস্থায় দুরূদ শরীফ পড়তে থাকবে। তবে সব সময় তাসবীহ হাতে নিয়ে ঘুরবে না।
কুরআন শরীফ পড়া জানা থাকলে প্রতিদিন কিছু পরিমাণ কুরআন শরীফও তিলাওয়াত করবে। এ কিতাবের শেষাংশে পুরুষ ও নারীদের জন্য যে নসীহত লেখা হয়েছে, সেগুলো মাঝে মাঝে পাঠ করবে এবং সে অনুপাতে আমল করবে। কখনো কখনো নিজের পীরের নিকট বা অন্য কোন এমন বুযুর্গের নিকট-যিনি পরহেযগার ব্যক্তি এবং তার আকীদা-বিশ্বাস সহীহ-বসবে। তবে পীরের নিকট যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু না কিছু হাদীয়া নিয়েই যেতে হবে, এমন পাবন্দী করবে না। এ লৌকিকতা নিখাদ ভালোবাসার পরিপন্থী।
এর বাইরে যে সময় বাঁচবে তা পরিবার-পরিজনের জন্য হালাল রুজির সন্ধানে লেগে থাকবে। বাল-বাচ্চার জন্য উপার্জন করাও ইবাদত। আর লোকটি যদি সাধারণ মহিলা হয়, তাহলে অবশিষ্ট সময় ঘরের কাজ করা, বিশেষ করে স্বামীর খেদমত করা তার জন্য ইবাদত। তাই সে এ কাজে রত থাকবে। তবে কোন মহিলা তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া পীরের নিকট যাবে না। যেসব দিনে ঋতুস্রাব হয়, সে সব দিনেও ওযীফার সময় ওযু করে ওযীফা পাঠ করবে। তবে কুরআন শরীফ পাঠ করবে না। কারণ, এমতাবস্থায় কুরআন শরীফ পড়া দুরুস্ত নয়।
দুনিয়াবী কাজ থেকে মুক্ত অনালেম ব্যক্তির ওযীফাঃ
এ ব্যক্তির ওযীফাও তাই, যা পূর্বের জনের জন্য বর্ণনা করা হয়েছে। তবে তার ক্ষেত্রে এতটুকু বিষয় অধিক হবে-
(ক) সম্ভব হলে পীরের নিকট গিয়ে পড়ে থাকবে। তবে নিজের পানাহারের ব্যবস্থা এমনভাবে করবে, যেন অন্য কারো উপর এর চাপ না পড়ে। পানাহারের কোন যাহেরী সামানা না হলে কমপক্ষে এতটুকু অবশ্যই থাকা জরুরী যে, অন্যের উপর ভরসা করে থাকবে না। হয় কোন মজদুরী করবে, আর সে সাহস নাহলে আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকবে। কিছু পেলে খাবে, না পেলে সবর করবে।
(খ) আর যদি পীরের নিকট থাকতে না পারে, তাহলে নিজের বাড়ীতে থাকবে, চাই ঘরে হোক, চাই কোন মসজিদে হোক। তবে যতদূর সম্ভব মানুষদের থেকে দূরে থাকবে। কারো নিকট বেশী আসা-যাওয়া করবে না। দ্বীন বা দুনিয়ার কোন কাজ না থাকলে কারো সাথে মেলামেশা করবে না। কোন প্রয়োজনে কারো সঙ্গে মিশতে হলে জিহ্বার প্রতি খুব খেয়াল রাখবে। শরীয়তে নিষিদ্ধ কোন কথা, যেমন-কারো অসাক্ষাতে তার দোষচর্চা করা বা এ জাতীয় কোন কথা যেন মুখ থেকে বের হতে না পারে।
(গ) জামাআতের সাথে নামায আদায় করবে।
(ঘ) প্রয়োজনীয় কাজ এবং বিশ্রামের পর যেটুকু সময় বাঁচবে, সে সময় নির্জনে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করবে, মুনাজাতে মকবুল পড়বে বা নফল নামায, দরুদ শরীফ বা ইস্তিগফার পড়বে।
(ঙ) আর যদি পড়াশোনা জানা থাকে তাহলে কিছু সময় উর্দূ, ফার্সী (বা বাংলা) ভাষায় লেখা দ্বীনী কিতাবসমূহও কোন আলেমকে দেখিয়ে নির্বাচন করে পড়বে। যেখানে বুঝে না আসবে, সেখানে নিজের বুঝ-বুদ্ধিমতো অর্থ না বানিয়ে কোন আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করে নিবে।
(চ) ঐ এলাকার কোথাও কোন তালিবে ইলম বা যিকিরকারী থাকলে তাদের খেদমত করার কাজে নিজের সময়ের বড় একটি অংশ ব্যয় করবে। এতে অন্তরে নূর পয়দা হয় এবং অন্তরে অহমিকা সৃষ্টি হয় না।
(ছ) মাঝে মাঝে নফল রোযাও রাখবে।
এ দুই শ্রেণীর অনালেম মানুষকে এর অতিরিক্ত কোন যিকির-শোগল দেওয়া উচিত নয়। কারণ, এর মধ্যে অনেক অস্বাভাবিক বিষয় দেখা দেয়, যার ফলে খারাপ পরিণতির ভয় আছে। যেগুলো আলেম ছাড়া অন্য মানুষ সহ্য করতে পারবে না। তবে মুরীদের মধ্যে আগ্রহ দেখলে এবং তাকে যোগ্য মনে করলে নির্জনে বসে তিন হাজার থেকে ছয় হাজার বার ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ যিকির করতে বলবে। তবে সশব্দে এবং মাথা দুলিয়ে নয়, বরং নীরবে করতে বলবে। এর অধিক কোন যিকির অনালেম ব্যক্তির জন্য মোনাসেব নয়। বাকী অন্যান্য ওযীফা এবং নফল নামায যত মন চায় পড়বে। তবে অনালেম ব্যক্তি যদি আলেমদের সুহবতে থাকার ফলে আলেমদের মত সমঝদার হয়ে থাকে, তাহলে সে আলিমদের মত বলে গণ্য হবে। তাকে যিকির-শোগল দেওয়ায় ক্ষতি নেই।
দ্বীনী বা দুনিয়াবী কাজে ব্যস্ত আলেম ব্যক্তির ওযীফা:
(ক) অবসর সময়ে যখন মন চিন্তামুক্ত থাকে এবং পেট বেশী ভরাও না এবং বেশী ক্ষুধা কাতরও না, এমন সময় নির্ধারণ করে নির্জনে বসে ওযুর সাথে হালকা আওয়াজে কিছুটা ‘জরবের’ (ধাক্কার) সাথে যিকিরের প্রতি মন লাগিয়ে বার হাজার থেকে চব্বিশ হাজার পর্যন্ত যত বার সম্ভব ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ যিকির করবে।
(খ) পাবন্দীর সাথে তাহাজ্জুদ নামায পড়বে।
(গ) দিনের যে কোন সময়ে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত এবং ‘কুরুবাতুন ইনদাল্লাাহি ওয়া সালাওয়াতুর রাসূল, (আরবী মুনাজাতে মকবুল) এর এক মঞ্জিল নিয়মিত পড়বে।
(ঘ) মাদরাসার মুদাররিস হলে তো ভালো, তা নাহলে কিছু সময় তালিবে ইলমদেরকে পড়ানোর কাজে অবশ্যই ব্যয় করবে।
(ঙ) প্রয়োজন হলে বা শ্রোতারা আগ্রহ প্রকাশ করলে ওয়ায করে জরুরী মাসআলা-মাসায়েল বয়ান করবে। তবে ওয়াযের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না। এমন প্রয়োজনীয় কথা-যা শুনলে সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়-তা অস্পষ্টভাবে এবং কঠোর ভাষায় বলবে না, বরং পরিষ্কার ভাষায় নম্রভাবে বলবে।
(চ) ওয়ায করে বিনিময় নিবে না।
(ছ) সাধারণ লোকদেরকে কড়া বা কর্কশ কথা বলবে না। এতে অনর্থক শত্রুতার সৃষ্টি হয়।
(জ) ‘ইহইয়াউল উলূম’ ও এ জাতীয় অন্যান্য কিতাব অধ্যয়ন করবে।
(ঝ) নিজের পীর থেকে দূরে অবস্থান করে যিকির-শোগল করবে না। তবে পীরের নিকট অবস্থান করে কিছুদিন যিকির-শোগল করে থাকলে এবং পীর সাহেব এখনও তা করার কথা বলে থাকলে কোন অসুবিধা নেই।
Leave a Reply