এখতিয়ারী ও গায়রে এখতিয়ারী আমলের বর্ণনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
যে সমস্ত বিষয় এখতিয়ারভুক্ত, সেগুলো করতে ত্রুটি করবে না। আর যেগুলো এখতিয়ারভুক্ত নয়-সেগুলো যদি ভালো হয়, তাহলে সেগুলো অর্জনের পিছনে পড়বে না। আর যদি সেগুলো অবাঞ্ছিত হয়, তাহলে সেগুলো দূর করার ফিকিরে পড়বে না। যেমন, নামায, কুরআন তেলাওয়াত বা যিকিরের মধ্যে জোর করে হলেও মনোযোগ ঠিক রাখা মানুষের এখতিয়ারভুক্ত। এ সমস্ত ইবাদতের মধ্যে মনোযোগ ঠিক রাখার কয়েকটি পদ্ধতি আছে-
এক. উদাহরণ স্বরুপ একটি তরীকা এই যে, ইবাদতের সময় আল্লাহ তাআলার সত্তার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ রাখবে।
দুই. দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, শব্দের অর্থ ও মর্মের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ রাখবে, বা শুধু শব্দের দিকে ধ্যান রাখবে। অর্থাৎ, প্রত্যেকটি শব্দ মনোযোগ সহকারে উচ্চারণ করবে। যাহোক, যে কোন পদ্ধতিতে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার ব্যাপারে ত্রুটি করবে না। তবে নামাযে বা কুরআন তেলাওয়াতে মন না বসা বা মজা না লাগা বা বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা বা কুচিন্তা অধিকহারে উদয় হওয়া-তা যত খারাপই হোক না কেন-মানুষের এখতিয়ারের বাইরে। তাই এজন্য চিন্তা করবে না। শুধু নিজের এখতিয়ারভুক্ত কাজ করে যাবে। এভাবে কাজ করতে থাকার বৈশিষ্ট্য এই যে, ঐ সমস্ত চিন্তা আপনাআপনি কমে যায়। বিশেষ করে ওয়াসওয়াসার প্রতি তো মোটেও ভ্রুক্ষেপ করবে না। ওয়াসওয়াসা আসার কারণে ব্যথিতও হবে না। এতে বরং ওয়াসওয়াসা আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে চরম পেরেশানীতে পড়তে হয়। এর উত্তম সমাধান এই যে, নিজের যিকির ইত্যাদির দিকে নতুন করে মনোযোগ দিবে। ওয়াসওয়াসার দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করবে না। ফলে তা নিজে নিজেই চলে যাবে।
আরেকটি উদাহরণ হলো, আল্লাহর আনুগত্য করা মানুষের এখতিয়ারভুক্ত, তাই আল্লাহর হুকুম পালনে অলসতা করবে না। কিন্তু ভালো স্বপ্ন দেখা, দু’আ কবুল হওয়া, যিকিরের প্রভাবে ছটফট করতে থাকা, অনিচ্ছাকৃত কান্না আসতে থাকা ইত্যাদি লাভ হওয়ার যিকির করবে না, কারণ এসব বিষয় মানুষের এখতিয়ারাধীন নয়।
একইভাবে গুনাহ করা তো মানুষের এখতিয়ারাধীন। তাই তার কাছেও যাবে না। কিন্তু এসব বিষয় এখতিয়ারাধীন নয়, তাই এগুলোর ফিকিরে পড়বে না। যেমন, মন্দ স্বপ্ন দেখা, মন প্রফুল্ল ও সতেজ না থাকা, আয়-রোজগার কমে যাওয়া, যিকির করার সময় কোন জিনিস দেখতে না পাওয়া, বা যিকিরের কোন প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বুঝতে না পারা, অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে পেরেশান হবে না।
আরেকটি উদাহরণ হলো, অনিচ্ছায় কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যাওয়া এখতিয়ারাধীন নয়। এতে কোন গুনাহ বা ক্ষতিও নাই, যদিও এতে কষ্ট হয়ে থাকে। তবে নিম্নের কাজগুলো মানুষের এখতিয়ারভুক্ত-যার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছে তাকে দেখা, তার সাথে কথা বলা, তার কথা শোনা, তার নিকট আসা-যাওয়া করা, মনে মনে তার কল্পনা করা, তার কথা চিন্তা করে মনে মনে স্বাদ উপভোগ করা-তাই এগুলো থেকে বাঁচা জরুরী। আর অনেক সময় এগুলো থেকে বেঁচে চলার ফলে সেই প্রেমও লোপ পায়। কিন্তু এগুলোতে ত্রুটি করলে গুনাহগার হবে এবং মন কালিমাযুক্ত হবে।
একইভাবে কোন গুনাহের দিকে মন ধাবিত হওয়া মানুষের এখতিয়ার বহির্ভূত, তাই তা দূর করার চিন্তায় পড়বে না। তবে ঐ গুনাহের কাজ করা মানুষের এখতিয়ারভুক্ত, তাই তা থেকে দূরে থাকবে। মনের ঐ চাহিদার উপর আমল করবে না।
যে ব্যক্তি এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় লাভ করার বা তা দূর করার ফিকিরে লিপ্ত থাকে, তার সারাটি জীবন পেরেশানীতে কাটে। এমনকি অনেক লোক এসব কারণেই নিজেকে মরদুদ ও বিতাড়িত ভেবেছে। এমনকি এ কারণে কেউ কেউ তো আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। আর অনেকে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকির-আযকার ছেড়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে গেছে। মোটকথা, তারা ঈমানের ক্ষতি করেছে বা ঈমানের সাথে সাথে জানেরও ক্ষতি করেছে। কারণ, আত্মহত্যা করার ফলে প্রাণও হারিয়েছে এবং গুনাহগারও হয়েছে। এর ফলে জান ও ঈমান উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর যিকির ও ইবাদত ছাড়ার কারণে এবং গুনাহ করার কারণে সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং গুনাহগার হয়েছে। যা ঈমানের ক্ষতি। আসল কথা হলো, এখতিয়ার বহির্ভূত যে সমস্ত বিষয় রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো এমন, যেগুলো মনের কাংখিত বস্তু, সেগুলো লাভ হওয়া কখনো কখনো আল্লাহর পথের পথিকের জন্য মন্দ পরিণতির কারণও হয়ে থাকে। যেমন নিজেকে কামেল মনে করতে আরম্ভ করে। ফলে নিজেকে অন্যদের চেয়ে উত্তম ভাবতে থাকে। বা নিজেকে কামেল দাবী করতে আরম্ভ করে বা এর ফলে বুযুর্গ বলে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ফলে তার ক্ষতি হয়। অপরদিকে এগুলো লাভ না হওয়া তার উপকারিতার কারণ হয়। যেমন নিজেকে অযোগ্য ও তুচ্ছ মনে করে।
আর এখতিয়ার বহির্ভূত কিছু বিষয় এমন আছে, যেগুলো হওয়া মানুষের কাছে অপছন্দনীয় হয়ে থাকে। অথচ সেগুলো হওয়া অনেক সময় তার জন্য উপকারী হয়ে থাকে। যেমন তা সহ্য করতে কষ্ট হয়, যা এক প্রকারের মুজাহাদা। সংকীর্ণতা হয়, দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-বেদনা হয়, যার দ্বারা দিল পরিষ্কার হয়। এ সমস্ত ক্ষেত্র প্রসঙ্গেই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ, ’অনেক সময়ই এমন হয়ে থাকে যে, একটি জিনিস হওয়া তোমরা নিজেদের জন্য অপছন্দ করো, কিন্তু বাস্তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। আর অনেক সময় তোমরা কোন জিনিসকে পছন্দ করো, কিন্তু বাস্তবে তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর হয়ে থাকে।’ (সূরা বাকারা-২১৬)
তবে পছন্দনীয় জিনিস যদি নিজের থেকেই লাভ হয়, তাহলে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে শোকর আদায় করবে। আর এ সমস্ত জিনিস অর্জিত না হওয়াকে উপরে বর্ণিত বিশ্লেষণ মত নেয়ামত মনে করে শোকর আদায় করবে। বিষয়টি ভালো করে বুঝে নাও।
Leave a Reply