উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

মাসআলাঃ কতক লোক বিক্রির ওয়াদা দৃঢ় করার জন্যে এক-আধ টাকা অগ্রিম দিয়ে থাকে, একে ’বায়না বলে। কোন কারণে যদি ক্রেতার পক্ষ থেকে ওয়াদা খেলাপী হয়, তাহলে বিক্রেতা সে টাকা ফেরত দেয় না। এটি কোনভাবেই দুরস্ত নয়। যদিও বিনা কারণে ওয়াদা খেলাপ করা অন্যায় কাজ।
মাসআলাঃ কতক লোক এ শর্তে ‘বায়না’ গ্রহণ করে যে, এর অধিক মূল্য কেউ না দিলে এটি তোমাকে দেওয়া হবে, অন্যথায় তোমাকে ‘বায়না’ ফেরত দিয়ে তাকে এ জিনিস দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তিনটি অবস্থা হতে পারে-
১. উল্লেখিত চুক্তির মাধ্যমে বেচা-কেনার শুধু ওয়াদা করা হয়েছে, বেচা-কেনা সম্পন্ন করা হয়নি। তখন এর অর্থ এই দাঁড়াবে যে, আমি এ জিনিস এখনই তোমার নিকট বিক্রি করছি না, বরং অন্য খরিদদারের অপেক্ষায় আছি। অন্য খরিদদার আমার কাঙ্খিত মূল্য দিলে তার হাতে বিক্রি করবো। আর তা না হলে এতো মূল্যে তোমার নিকট বিক্রি করবো। এভাবে চুক্তি সম্পাদন করা বৈধ আছে। তবে যেহেতু এ কথা মেনে নেওয়া হয়েছে যে, এখনো বেচা-কেনা সম্পন্ন হয়নি, তাই ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই এ চুক্তি সম্পন্ন না করার এখতিয়ার থাকবে। কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারবে না। যেমন, অধিক মূল্যের কোন খরিদদার আসলো না এবং এ ক্রেতাও নিতে চাইলো না তাহলে ‘বায়না’ ফেরত দেওয়া ওয়াজিব হবে।
২. দ্বিতীয় অবস্থা এই যে, বেচা-কেনা তখনই সম্পন্ন করা হয়েছে, তবে তা চূড়ান্ত করা হয়নি, বরং ‘খিয়ারে শর্তের’ সাথে করা হয়েছে, অর্থাৎ এ শর্তে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে যে, তিন দিনের মধ্যে এ ক্রয়-বিক্রয় ভেঙ্গে দেওয়ার অধিকার থাকবে-তাহলে এটাও জায়েয আছে। তবে সে ক্ষেত্রে ’খিয়ারে শর্তের’ সমস্ত বিধান প্রযোজ্য হবে। যার বিস্তারিত বিবরণ উপরে আলোচিত হয়েছে।
৩. তৃতীয় অবস্থা এই যে, বেচা-কেনা চূড়ান্ত করা হয়েছে, তারপর উপরোক্ত শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় এ শর্তটি ‘ফাসেদ’ হওয়ার কারণে এ বেচা-কেনা ‘ফাসেদ’ হবে।

মাসআলাঃ বেশির ভাগ লোক বাকিতে মাল নিলে বেশি দাম রাখে। যেমন, নগদে নিলে এক টাকায় বিশ সের শস্য দেয়, আর এক সপ্তাহ-দু’সপ্তাহ পর দাম দিলে তাকে আঠারো সের দেয়। এটি জায়েয আছে। এতে কোন ক্ষতি নেই। তবে এ ক্ষেত্রে জরুরী হলো, আগেই পরিষ্কার করে নিতে হবে যে, দাম নগদ দিবে নাকি বাকি রাখবে। আর যদি বেচা-কেনা স্থগিত রেখে বেচা-কেনা সম্পাদনের সময় একথা বলে যে, তুমি যদি এখন দাম পরিশোধ করো তাহলে একটাকা দিতে হবে, অন্যথা সোয়া টাকা দিতে হবে-এটি জায়েয নেই।
মাসআলাঃ নিজের মাল বিক্রি করে যতো টাকা ইচ্ছা লাভ করার অধিকার রয়েছে। যদি এক পয়সার জিনিস একশ’ টাকায় বিক্রি করে তাহলেও অনুমতি আছে। তবে শর্ত হলো, খরিদদারের সঙ্গে কোনরূপ ধোঁকাবাজি করতে পারবে না। পরিষ্কার বলে দিবে যে, আমি এতো টাকায় বিক্রি করবো, ইচ্ছা হলে নিবে, না হলে না নিবে। তবে যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভের উপর বিক্রি করার চুক্তি হয়ে থাকে বা কোন ব্যক্তি মৌখিক বা লিখিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে থাকে যে, আমার দোকানে এক আনা লাভে মাল পাওয়া যায়-এ দু’ অবস্থায় অধিক লাভ নেওয়া ধোঁকা এবং হারাম।

মাসআলাঃ অস্থাবর জিনিস ক্রয় করে তা নিজের দখলে আনার পূর্বে অন্যের নিকট বিক্রি করা জায়েয নয়। তাই মাল হাতে আসার পূর্বে শুধু নমুনা দেখিয়ে বেচা-কেনা করা দুরস্ত নয়।
মাসআলাঃ এক টাকার বিনিময়ে কোন জিনিস বিক্রি করার পর খরিদদার টাকা না দিয়ে যদি এক টাকার সমপরিমাণ পয়সা দেয়, তাহলে তা নেওয়া জায়েয আছে। একইভাবে যদি উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে ঐ টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট কাপড় বা নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য দেয় তাও জায়েয আছে। তবে এ ধরনের বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুদি লেনদেন থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন, কারো দায়িত্বে বিশ টাকা পরিশোধ করতে হবে, কিন্তু তার পরিবর্তে বিশ টাকার সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার কথা স্থির হলো। তাহলে এমতাবস্থায় যে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে সে বৈঠকেই স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করতে হবে। এমন করা যাবে না যে, সিদ্ধান্ত করে সেখান থেকে পৃথক হয়ে গেলো তারপর অন্য সময়ে স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করলো।

মাসআলাঃ বেচা-কেনা সম্পন্ন করার পর মূল্যের ক্ষেত্রে যদি কিছু সুবিধা দেওয়া হয়-যেমন, বিক্রেতা দাম কিছু কমিয়ে দিলো বা ক্রেতা দাম কিছু বাড়িয়ে দিলো-এটা জায়েয আছে। এতে জানা গেলো যে, অনেক জায়গায় পণ্য নেওয়ার পর কিছু ফাঁও নেওয়ার রীতি আছে-বিক্রেতা যদি খুশি মনে তা দেয় তাহলে এতে দোষ নেই।
মাসআলাঃ কতক লোক পশুকে খাওয়ানোর জন্যে গম, যব ইত্যাদির কাঁচা ক্ষেত (গাছ) ক্রয় করে-এটি জায়েয আছে। কিন্তু কেউ কেউ এমন শর্ত করে নেয় যে, ক্ষেত কাটার পর বিক্রেতা এতে পুনরায় পানি দিবে। এতে পুনরায় যে ফসল হবে তাও আমি এখনই ক্রয় করছি। এক্ষেত্রে প্রথমত, পণ্যের একটি অংশের অস্তিত্ব নেই, দ্বিতীয়ত, পানি দেওয়ার দায়িত্ব বিক্রেতার উপর রাখা হয়েছে-যা একটি শর্তে ফাসেদ-তাই বেচা-কেনা জায়েয হবে না।

মাসআলাঃ কতক জায়গায় বস্তায় ভরা শস্য নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করে বস্তা সহ শস্য ওজন করে। তারপর একটি বস্তা খালি করে সমস্ত বস্তাকে এক ওজনের ধরে সবগুলো হিসাব করে মোট ওজন থেকে সে পরিমাণ বিয়োগ করে, এটা জায়েয নেই। কারণ, সব বস্তার ওজন এক নাও হতে পারে। প্রয়োজনের সময় এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে যে, এ হিসাবে শস্যের যে পরিমাণ ওজন নির্ধারিত হয়েছে বেচা-কেনাকে সেই ওজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে মোটের উপর বলবে যে, এ শস্যগুলোর দাম এতো। শস্যের পরিমাণ বস্তার ওজনের চেয়ে কম হোক বা বেশি হোক উভয় পক্ষ এর উপর সম্মত হলে জায়েয হবে।
মাসআলাঃ কতক জায়গায় ক্ষেতের মধ্যে রাখা ফসল-শস্য শুধু নমুনা দেখিয়ে বিক্রি করে। এ ক্রেতা অন্য ক্রেতার নিকট বিক্রি করে। কতক সময় অনেক দূর পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকে-এটি জায়েয নয়। তবে দুটি শর্তে এটি জায়েয হতে পারে-
১. ক্ষেতের মধ্যে রাখা ফসলের নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ ধারণা করলেও সেই পরিমাণের ভিত্তিতে বেচা-কেনা করবে না। বরং এভাবে বলবে যে, এ ক্ষেতের মধ্যে যে পরিমাণ শস্য আছে তার দাম এতো।
২. প্রথম খরিদদার ঐ ক্ষেতের ফসলকে তার দখলে নিবে তারপর সেও এই একই শর্তে পরবর্তী খরিদদারের নিকট বিক্রি করবে। কিন্তু তখন উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে কমবেশি হলে কোন জবাবদিহিতা থাকবে না।