উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

সুদের মাসআলা বড় নাজুক। অনেক মানুষ সৎ নিয়ত থাকা সত্ত্বেও এই গুনাহে লিপ্ত। তাই প্রথমে একটি মূলনীতি লিখছি, যার দ্বারা হাজার হাজার মাসআলার বিধান জানা যাবে। তারপর দৃষ্টান্ত স্বরুপ কয়েকটি শাখা মাসআলা লিখবো।
মূলনীতিটি বোঝার জন্যে প্রথমে একটি ভূমিকা বুঝতে হবে। তা এই যে-যে সমস্ত জিনিসের লেনদেন হয় সেগুলো তিন প্রকার-
ক. সেগুলো হয় পাল্লা দ্বারা ওজন করে পরিমাপ করা হয়।
খ. বা কোন পাত্র দ্বারা পরিমাপ করা হয়।
গ. অথবা কোন প্রকারে পরিমাপ করা হয় না।

যেমন, শস্য। কোথাও তা পাল্লা দ্বারা ওজন করে পরিমাপ করা হয়, আবার কোথাও পাত্র দ্বারা পরিমাপ করা হয়। এ সমস্ত জিনিসকে ‘ওজনী’ এবং ’কায়লী’ বলা হয়। আর এ বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ‘কদর’। স্বর্ণ-চান্দিও ওজন করেই পরিমাপ করা হয়। স্বর্ণ-চান্দির মুদ্রাও ‘ওজনী’ জিনিস। যদিও সেগুলোর ওজন নির্দিষ্ট হওয়ার কারনে কেউ ওজন করে নেয় না।
যে সমস্ত জিনিস গুণে বা গজ দ্বারা মেপে বিক্রি করা হয় সেগুলো তৃতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, এগুলো ‘ওজনী’ বা ‘কায়লী’ নয়।
দ্বিতীয় জানার বিষয় হলো- সব জিনিসের একটি হাকীকত বা স্বরুপ আছে, যাকে ‘জিনস’ বা ‘জাত’ বলা হয়। যেমন, গমের নিজস্ব একটি ‘হাকীকত’ আছে, তাই এটি একটি ভিন্ন ‘জিনস’ ও ‘জাতে’র জিনিস। চান্দি একটি পৃথক ’জিনস’ বা জাতের জিনিস। এমনিভাবে কাপড় একটি ভিন্ন ‘জিনস’ বা জাতের জিনিস। এখানে এ দুটি পরিভাষা গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে, একটি হলো, ’কদর’ বা পরিমাপের বৈশিষ্ট্য, আর দ্বিতীয়টি হলো ‘জিনস’ বা জাত। এ পরিভাষা দুটি সামনে প্রয়োজন পড়বে।

যে সমস্ত জিনিসের মধ্যে বিনিময় করা হয়, কখনো সেগুলো ‘কদর’ তথা পরিমাপের মধ্যে এক হয় এবং ‘জিনস’ তথা জাতের মধ্যে ভিন্ন হয়। যেমন গম এবং বুট। উভয়টাকে একভাবে পরিমাপ করা হয়, কিন্তু উভয়টা ভিন্ন জাতের। আর কখনো জাত এক হলেও পরিমাপে এক হয় না। যেমন জামার বিনিময়ে জামা বিক্রি করা। এর ‘জিনস’ বা জাত তো এক, কিন্তু ‘কদর’ বা পরিমাপ এক না। কারণ, জামা তো দাঁড়িপাল্লা বা পাত্র দ্বারা পরিমাপই করা হয় না, তাই তার পরিমাপ এক হওয়ার প্রশ্নও আসে না। বা বকরীর বিনিময়ে বকরী বিক্রি করা। এক্ষেত্রে ‘জিনস’ তো এক, কিন্তু পরিমাপ এক নয়। কারণ, এগুলোর পরিমাপই করা হয় না। আর কখনো এমন জিনিসের বিনিময় করা হয়, যার ‘জিনস’ও এক এবং ‘কদর’ বা পরিমাপও এক। যেমন, গমের বিনিময়ে গম বিক্রি করা। এর ‘জিনস’ও এক এবং ‘কদর’ও এক। আর কখনো এমন জিনিসের বিনিময় করা হয়, যার ’জিনস’ও এক এবং ‘কদর’ বা পরিমাপও এক। যেমন, গমের বিনিময়ে গম বিক্রি করা। এর ‘জিনস’ও এক এবং ‘কদর’ও এক। আবার কখনো এমন জিনিসের বিনিময় করা হয়, যার না ‘কদর’ এক, না জিনস এক।

তাই জিনিস চার প্রকারের হলো-
ক. ‘কদর’ এবং ‘জিনস’ উভয়টি এক।
খ. ‘কদর’ এক, কিন্তু ‘জিনস’ এক নয়
গ. জিনস এক, কিন্তু ‘কদর’ এক নয়।
ঘ. ‘জিনস’ ও ‘কদর’ কোনটিই এক নয়।

এ ভূমিকাটি বোঝার পর এবার সেই মূলনীতি বুঝুন। মূলনীতিটি এই যে, দুটি জিনিসের ‘কদর’ এবং ‘জিনস’ যদি এক হয়, তাহলে এ দু’ জিনিসের বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় ওয়াজিব। প্রথমত, উভয়টি সমপরিমাণের হতে হবে। দ্বিতীয়ত, নগদ লেনদেন হতে হবে। যেমন, গমের বিনিময়ে গম নিতে চাইলে উভয় গমের পরিমাণের মধ্যে কমবেশি করা যাবে না। একদিক এক সের আর অপরদিকে সোয়া সের এমন করা যাবে না। উভয় দিকে এক সের হতে হবে অথবা উভয় দিকে সোয়া সের হতে হবে। একইভাবে একটি নগদে নেওয়া আর অপরটি বাকিতে নেওয়াও জায়েয নেই। বরং একই বৈঠকে উভয়ে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে নেওয়া ওয়াজিব।

আর যদি উভয়টির ‘কদর’ এক হয়, কিন্তু ‘জিনস’ এক না হয় বা ‘জিনস’ এক হয়, কিন্তু ‘কদর’ এক না হয় তাহলে কমবেশি নেওয়া তো জায়েয আছে, কিন্তু বাকিতে নেওয়া জায়েয নেই। যেমন, গম এবং বুট বিনিময় করতে চাইলে এতদুভয়ের ‘কদর’ এক, কিন্তু ‘জিনস’ এক নয় বা বকরীর বিনিময়ে বকরী নিতে চাইলে এর জিনস এক কিন্তু কদর এক নয়। কারণ, এর তো পরিমাপই করা হয় না, তাই এর পরিমাপ তথা ‘কদর’ এক হওয়ার প্রশ্নও আসে না। এক্ষেত্রে কমবেশি নেওয়া জায়েয আছে। যেমন, এক সের গমের বিনিময়ে দু’ সের বুট নিতে পারবে। বা একটি বকরীর বিনিময়ে দুটি বকরী নিতে পারবে। কিন্তু একদিকে বাকি আর অপরদিকে নগদ নেওয়া জায়েয নেই। বরং নগদে আদান-প্রদান করা ওয়াজিব।
আর যে দুই জিনিসের ‘কদর’ও এক নয় এবং ‘জিনসে’ও এক নয়, সেগুলোর মধ্যে কমবেশি পরিমাণে নেওয়াও জায়েয আছে এবং নগদ-বাকিতে নেওয়াও জায়েয আছে। যেমন, একশ’ টাকার বিনিময়ে একটি ঘোড়া ক্রয় করলো, তাহলে এখানে ‘জিনস’ও এক নয়, ‘কদর’ও এক নয়। তাই এখানে নগদে লেনদেন হওয়াও জরুরী নয় এবং সমান সমান হওয়াও জরুরী নয়। উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা চারটি মূলনীতি বের হয়ে আসলো-
এক. যে সমস্ত জিনিসের ‘জিনস’ এবং ‘কদর’ উভয়টি এক, সেগুলোর বিনিময়ের ক্ষেত্রে সমান সমান হওয়া এবং নগদ নগদ হওয়া উভয়টি ওয়াজিব।
দুই. যে সমস্ত জিনিসের ‘কদর’ এবং ‘জিনস’ উভয়টি ভিন্ন, সে ক্ষেত্রে সমান সমান হওয়াও জরুরী নয় এবং নগদে হওয়াও ওয়াজিব নয়।
তিন. যে সমস্ত জিনিসের ’জিনস’ এক, কিন্তু ‘কদর’ এক নয়, সেগুলো নগদে আদান-প্রদান ওয়াজিব, কিন্তু সমান সমান হওয়া জরুরী নয়।
চার. যে সমস্ত জিনিসের ‘কদর’ এক, কিন্তু ‘জিনস’ এক নয়, সেগুলোর বিনিময়েও নগদে আদান-প্রদান ওয়াজিব, কিন্তু সমান সমান হওয়া জরুরী নয়।

এই চার মূলনীতির বিপরীত লেনদেন হলেই তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সুদ বলে গণ্য হবে। যেমন, যেখানে নগদ আদান-প্রদান ওয়াজিব, সেখানে যদি কোন একদিকও বাকি থাকে তাহলে সুদ হবে। এবং যেখানে সমান সমান হওয়া জরুরী, সেখানে যদি কম-বেশি হয় তাহলে সুদ হবে। এবং যেখানে সমান সমান হওয়া এবং নগদ নগদ হওয়া উভয়টি ওয়াজিব, সেখানে বাকিতে লেনদেন হলেও সুদ হবে এবং কমবেশি হলেও সুদ হবে। এতদসংক্রান্ত কিছু মাসআলা উল্লেখ করা হচ্ছে।