সুদের বর্ণনা – ২

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
মাসআলাঃ অনেক বাড়ীতে গমের আটা ভুট্রার বিনিময়ে লেনদেন করা হয় সেক্ষেত্রে পরিমাণে কমবেশি হলেও জায়েয হবে। কারণ, উভয়টির ‘কদর’ এক, কিন্তু ‘জিনস’ ভিন্ন। তাই পরিমাণে কমবেশি করা জায়েয হবে, কিন্তু বাকিতে লেনদেন করা জায়েয হবে না।
মাসআলাঃ অনেক সময় নতুন গমের সাথে পুরাতন গমের বিনিময় করা হয়। এ বিনিময় বৈধ হওয়ার জন্যে দুটি শর্ত রয়েছে।
এক. উভয়দিকের গমের পরিমাণ সমান হতে হবে।
দুই. নগদে লেনদেন হতে হবে।
একদিকের গম বেশি দামী এবং অপরদিকের গম কম দামী হলেও বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমাণে কমবেশী করা যাবে না। কারণ, এক্ষেত্রে ‘জিনস’ এবং ‘কদর’ উভয়টি এক তাই কমবেশিতে বা বাকিতে লেনদেন করা জায়েয হবে না।
মাসআলাঃ কোন ক্ষেত্রে মূল্য কমবেশি হওয়ার কারণে একই ‘জিনসের’ জিনিস কমবেশি পরিমাণে বিনিময় করতে চাইলে-যেমন, এক ব্যক্তির কাছে বিশ সের উন্নতমানের গম রয়েছে, আর আরেক ব্যক্তির নিকটে রয়েছে চল্লিশ সের নিম্নমানের গম। এখন সমান সমান বিনিময় করলে একজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অপরদিকে ‘জিনস’ এক হওয়ার কারণে পরিমাণে কমবেশি করা জায়েয নেই-এমতাবস্থায় জায়েয পদ্ধতি এই যে, একজন অপরজনের নিকট নিজের গমগুলো টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে-নগদ টাকা হাতে না থাকলেও অসুবিধা নেই-ঐ টাকা তার দায়িত্বে (পাওনা হিসেবে) ওয়াজিব হয়ে গেলে সে অপরকে বলবে যে, এই টাকার বিনিময়ে আমাকে তোমার গম দাও, আর সে নিজ সম্মতিতে তা দিয়ে দিবে, তাহলে এ বিনিময় জায়েয হবে।
মাসআলাঃ অনেক সময় মহিলারা গমের আটা আর গম সমান সমান বিনিময় করে থাকে, আর গমের সাথে গম ভাঙ্গানোর মজুরি দিয়ে থাকে। মজুরি দিক বা না দিক এভাবে বিনিময় করা জায়েয নেই। একইভাবে গম এবং ছাতু একই শস্যের আটা এবং ছাতুর সাথে বিনিময় করা জায়েয নেই। সমপরিমাণে এবং নগদ নগদ লেনদেন করা হলেও এভাবে বিনিময় করা জায়েয নেই। এর কারণ সাধারণ মানুষের বুঝে আসবে না। এমন প্রয়োজন হলে উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ, একটি দামের বিনিময়ে বিক্রি করে সেই টাকার বিনিময়ে অপরটি কিনে নিবে।
মাসআলাঃ যেক্ষেত্রে দুটি জিনিসের বিনিময় উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বাকিতে লেনদেন নাজায়েয। যেমন, উপরোক্ত মাসআলাদ্বয়ে গম ও ভুট্রার মধ্যে এবং পুরাতন গম ও নতুন গমের মধ্যে বিনিময় করা হয়েছে-এক্ষেত্রে বাকিতে লেনদেন জায়েয নেই। আর যেক্ষেত্রে বিনিময় উদ্দেশ্য নয়, বরং নিজের কাছে একটি জিনিস না থাকার ফলে ধার নিয়ে এ সময়ে কাজ চালানো উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এবং ব্যবস্থা হলে তার পাওনা পরিশোধ করার ইচ্ছা থাকে। সেক্ষেত্রে বাকিতে নেওয়া জায়েয আছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিধান হলো, যেমন জিনিস ধার নিয়েছে, তেমন জিনিসই এবং ঐ পরিমাণ জিনিসই পরিশোধ করতে হবে। কমবেশির শর্ত করাও জায়েয নেই, অন্য মজলিসের নির্ধারণও জায়েয নেই এবং ভালো-মন্দের পার্থক্য করাও জায়েয নেই।
যেমন, একজনের কাছে এ সময় আটা নেই, তাই প্রতিবেশীর নিকট থেকে এক সের পরিমাণ আটা ধার নিলো। বলাবাহুল্য যে, এখানে বিনিময় করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ, তার কাছে থাকলে তো তাই রান্না করতো, তাহলে আর বিনিময় করতো কেন? শুধু উপস্থিত সময়ে কাজ চালানোই তার উদ্দেশ্য। তার আটার ব্যবস্থা হলে পাওনাদারের আটা পরিশোধ করে দিবে। এভাবে ধার নেওয়ায় কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ধার নেওয়ার সময় এরুপ শর্ত করা কোনভাবেই দুরস্ত নয় যে, এক সেরের বদলে সোয়া সের বা ততোধিক দেওয়া হবে। কেউ এমন শর্ত করলে তা সুদ বলে গণ্য হবে। কারণ, এক্ষেত্রে বিনিময় করাই উদ্দেশ্য কিন্তু বিনিময় জায়েয হওয়ার শর্ত এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে যদি স্বেচ্ছায় ও বিনা শর্তে যেমন নিয়েছিলো তার চেয়ে ভালো দেয় বা অপর ব্যক্তিই ছাড় দিয়ে তার চেয়ে নিম্নমানের জিনিস গ্রহণ করে বা পাওনাদার পাওনা নিতে এলে দেনাদার যদি বলে যে, আমার নিকট গমের আটা এখন নেই, তার বদলে ভুট্রার আটা কম বা বেশি পরিমাণে নাও, তখন পাওনাদারও যদি সম্মত হয় এবং উভয়ের সম্মতির সময়ই তা পরিশোধ করে দেয়, তাহলে জায়েয আছে। তবে উভয়ের সম্মতির পর যদি অন্যজাতের জিনিস দিয়ে তখন অর্ধেক পরিশোধ করে, আর অবশিষ্ট অর্ধেক বাকি থাকে তাহলে জায়েয হবে না।
যদি কারো নিকট অর্ধেক পরিমাণ ভিন্ন জাতের জিনিস থাকে তাহলে পুরো পাওনার বিনিময়ে ভিন্ন জাতের জিনিসকে সাব্যস্ত করবে না। বরং বলবে যে, তোমার অর্ধেক পাওনার বিনিময়ে এই ভিন্ন জাতের জিনিস নাও। বাকি অর্ধেকের তুমি যথারীতি পাওনাদার রয়ে গেলে। তারপর বাকি অর্ধেকের বিনিময়ে যদি ঐ একই জাতের জিনিস দেয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। আর যদি ভিন্ন জাতের জিনিস দিতে চায় তাহলে নতুন করে সম্মতির প্রয়োজন পড়বে। আর যখন পরস্পরে সম্মত হবে তখনই নগদ নগদ তা পরিশোধ করা জরুরী। মোট কথা হলো, পুরো পাওনার বিনিময়ে ভিন্ন জাতের জিনিস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে কিছু নগদে দেওয়া আর কিছু বাকি রাখা জায়েয নেই।
মাসআলাঃ সরিষার পরিবর্তে সরিষার তেল নেওয়ার খুব প্রচলন রয়েছে। এক্ষেত্রে হুকুম এই যে, সরিষা থেকে যে তেল বের হবে তার পরিমাণ যদি এই তেল থেকে নিশ্চিতভাবে কম হয় তাহলে এ বিনিময় জায়েয আছে। আর যদি এই তেলের পরিমাণ সরিষা থেকে যে তেল বের হবে তার চেয়ে অধিক হয় বা সমান হয় কিংবা সমান হওয়া বা কমবেশি হওয়ার বিষয় জানা না যায় তাহলে এ বিনিময় জায়েয নেই।
আর যদি এভাবে বিনিময় করতেই হয় তাহলে জায়েয হওয়ার উপরোক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করবে। অথবা টাকার বিনিময়ে বা পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করবে তারপর ঐ টাকা বা পয়সার বিনিময়ে তেল ক্রয় করবে। এ টাকা-পয়সা নগদে না দিয়ে শুধু মৌখিক বেচা-কেনা করলেও জায়েয হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ সুদী ব্যাংকে টাকা রেখে অংশীদার হয়ে তার লাভ নেওয়া দুরস্ত নেই। কারণ, ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ টাকার মালিকদের পক্ষ থেকে উকিল হয়ে থাকে। আর উকিলের কাজ মুওয়াক্কিলের কাজ বলেই গণ্য হয়। তাই এ টাকাওয়ালারা নিজেরাই যেন এ সুদী লেনদেন করলো। তবে যে সমস্ত কারখানায় সুদী লেনদেন নেই এবং অন্য কোন অবৈধ লেনদেনও হয় না, তার সাথে ‘মুযারিবার’ ভিত্তিতে কারবার করা জায়েয আছে।
মাসআলাঃ কেউ কেউ সুদী ব্যাংকে আমানত হিসেবে টাকা জমা রাখে এবং সেখান থেকে লাভ নেয় না। কিন্তু যেহেতু ব্যাংকে হুবহু ঐ টাকা সংরক্ষিত না থাকা নিশ্চিত বিষয়। তারা ঐ টাকা ব্যবসায় লাগিয়ে থাকে, তাই ঐ টাকা আর আমানত থাকে না, বরং করযে পরিণত হয়ে যায়। তাই এ ব্যক্তি যদিও সুদ নিলো না, কিন্তু করয দিয়ে সুদ গ্রহণকারীদের সহযোগিতা করলো। আর গুনাহের সহযোগিতা করাও গুনাহ, তাই ব্যাংকে আমানত হিসেবে টাকা রাখাও জায়েয নেই।
মাসআলাঃ কতক লোক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাদের জমাকৃত টাকা কম বা বেশি টাকার বিনিময়ে অন্যের নিকট বিক্রি করে। এর মধ্যে দুটি খারাপ দিক রয়েছে-এক হলো, নগদে লেনদেন হয় না। দ্বিতীয়ত, সমপরিমাণে হয় না। অথচ টাকার বিনিময়ে টাকা বেচা-কেনা করলে এ উভয় বিষয়ই শর্ত। তাই এটি জায়েয নয়। তবে যদি সমপরিমাণ টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয় তাহলে ‘হাওয়ালা’ হিসেবে জায়েয হবে। একইভাবে যে নোট বিক্রয় করা হয় তাও মূলত ‘হাওয়ালা’। তাও এ শর্তেই জায়েয আছে যে, যত টাকার নোট তত টাকার বিনিময়েই বিক্রি করতে হবে। কমবেশি হলে সুদ হয়ে যাবে।
Leave a Reply