উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হায়াতুল মুসলিমীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

দুনিয়ার প্রতি বিরাগ এবং আখেরাতের প্রতি অনুরাগের দ্বারা দ্বীন দৃঢ় এবং অন্তর সবল হয়। এ গুণ অর্জনের জন্য সর্বদা একথা ভাবতে হবে যে, দুনিয়া একটি নিম্নমানের বস্ত্ত এবং অবশেষে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। (বিশেষ করে নিজের জীবন তো দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, অবিলম্বে মৃত্যু সম্মুখে এসে দাঁড়াবে)। পক্ষান্তরে আখিরাত একটি মহিমান্বিত বস্ত্ত, যা সবার নিকট আগমন করবে। তারপর একের পর এক এসব ঘটনা ঘটতে থাকবে-কবরের সওয়াব ও আযাব, কিয়ামতের হিসাব-কিতাব, বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত এবং দোযখের সীমাহীন শাস্তি। এতদবিষয়ক কয়েকটি আয়াত এবং কয়েকটি হাদীস লেখা হচ্ছে।

১. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘(অধিকাংশ) মানুষের (নিকট) তাদের কামনার বস্ত্তসমূহের ভালোবাসা সুশোভিত মনে হয়। যেমন, নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামার। এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্ত্ত। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়। (যা মৃত্যুর পরে কাজে আসবে) (হে রাসূল!) আপনি (তাদেরকে) বলুন যে, আমি কি তোমাদেরকে এ সবের চেয়ে (বহু গুণে) উত্তম বস্ত্তর কথা বলবো? (তাহলে শোনো!) যারা পরহেযগার, আল্লাহর নিকট তাদের জন্য রয়েছে বেহেশত, যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সহধর্মিণীগণ এবং আল্লাহর সন্ত্তষ্টি।’ (সূরা আলে ইমরান ১৩-১৪)

২. আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের কাছে (দুনিয়াতে) যা কিছু আছে, তা (একদিন) নিঃশেষ হয়ে যাবে। (হয় তোমার জীবদ্দশাতে সম্পদই হাতছাড়া হয়ে যাবে, অথবা মৃত্যু সবকিছু থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে) আর যা আল্লাহর কাছে আছে, তা চিরকাল থাকবে।’
(সূরা নাহল-৯৬)

৩. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য এবং চিরস্থায়ী নেক আমলসমূহ আপনার পালনকর্তার কাছে (আখিরাতে দুনিয়ার তুলনায়) সওয়াব ও আশা লাভের জন্য (বহু গুণে) উত্তম।’ (সূরা কাহাফ-৪৬)

অর্থাৎ, নেক আমলের কারণে যত কিছু আশা পোষণ করা হচ্ছে, সে গুলো আখিরাতে পূর্ণ হবে এবং তার চেযেও অধিক সওয়াব লাভ হবে। কিন্ত্ত এর বিপরীত হলো, দুনিয়ার ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি। কারণ, এগুলো দ্বারা এ দুনিয়াতেই আশা পুরা হয় না, আখিরাতে তো এর সম্ভাবনাই থাকবে না। (সূরা কাহাফ-৪৬)

৪. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘তোমরা খুব ভালো করে জেনে রাখো যে, (আখেরাতের তুলনায়) পার্থিব জীবন (লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়ার যোগ্য নয়। কারণ, তা) নিছক ক্রীড়াকৌতুক এবং (বাহ্যিক) সাজসজ্জা এবং (শক্তি ও সৌন্দর্যে এবং জাগতিক জ্ঞান ও ঔৎকর্ষে) পারস্পরিক অহমিকা এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে পারস্পরিক আধিক্য প্রদর্শন ব্যতীত আর কিছু নয়। (এরপর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বকে একটি দৃষ্টান্ত দ্বারা তুলে ধরে ইরশাদ করেন-) আর আখিরাতের অবস্থা এই যে, সেখানে (কাফিরদের জন্য) কঠিন শাস্তি রয়েছে এবং (ঈমানদারদের জন্য) আল্লাহর পক্ষ খেকে ক্ষমা ও সন্ত্তষ্টি রয়েছে।’ (সূরা আল হাদীদ-২০)

৫. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘বস্ত্তত: তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালরে জীবন (দুনিয়ার তুলনায় বহু গুণে) উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।’ (সূরা আল আ’লা ১৬-১৭)

৬. হযরত মুস্তাওরিদ বিন শাদ্দাদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন-
‘খোদার শপথ! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া মাত্র এতটুকু, যেমন তোমাদের কেউ স্বীয় আঙ্গুল সমুদ্রের মধ্যে ডুবালো, তারপর সে দেখুক, সে কতটুকু পানি নিয়ে ফিরলো। (সমুদ্রের তুলনায় এ পানি যতটুকু, আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া অতটুকু)।’ (মুসলিম)

৭. হযরত জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি কানকাটা মৃত ছাগলছানার নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি ইরশাদ করলেন-এটি (মৃত ছাগল ছানাটি) এক দিরহামের বিনিময়ে লাভ করা তোমাদের কে পছন্দ করবে? উত্তরে লোকেরা নিবেদন করলো, (এক দিরহাম তো বড় জিনিস) আমরা তো সামান্য কোন বস্ত্তর বিনিময়েও এটি লাভ করা পছন্দ করবো না। তিনি ইরশাদ করলেন-
‘আল্লাহর শপথ! তোমাদের নিকট এটি যত তুচ্ছ, আল্লাহ তাআলার নিকট দুনিয়া তার চেয়ে অধিক তুচ্ছ।’ (মুসলিম)

৮. হযরত সাহল বিন সা’আদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘দুনিয়া যদি (মূল্যের দিক দিয়ে) আল্লাহর নিকট মাছির পাখা বরাবরও হতো, তাহলে কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করতে দিতেন না।’
(আহমাদ, তিরমিযী. ইবনে মাজা)

৯. হযরত আবু মূসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি নিজের দুনিয়াকে (অধিক) ভালোবাসবে, সে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর যে ব্যক্তি নিজের আথিরাতকে ভালোবাসবে, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই তোমরা অবিনশ্বর জিনিসকে (অর্থাৎ, আখিরাতকে) নশ্বর জিনিসের উপর (অর্থাৎ, ‍দুনিয়ার উপর) প্রাধান্য দাও।’ (আহমাদ, বাইহাকী)

১০. হযরত কা’আব বিন মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘ক্ষুধার্ত দু’টি বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে তারাও ছাগলের এত ধ্বংস করবে না। মানুষের দ্বীনকে পদমর্যাদা ও সম্পদের মোহ যে পরিমাণ ধ্বংস করে।’ (তিরমিযী, দারামী)

ফায়দা: অর্থাৎ, এমন মোহ, যার মধ্যে দ্বীন ধ্বংস হওয়ারও পরোয়া থাকে না। পদমর্যাদার চাহিদাও দুনিয়ার বড় একটি অংশ। চাই ধর্মীয় পদই হোক না কেন। যেমনঃ নেতা, শাসক বা সংগঠনের সভাপতি ইত্যাদি হয়ে নিজের শান-শওকত বা শাসন ক্ষমতা চাওয়া। পবিত্র কুরআনেও এর নিন্দা এসেছে।

১১. ইরশাদ হচ্ছে-
‘এই আখিরাত আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে (নিজেদের জন্য) ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে এবং ফাসাদ (অর্থাৎ, গুনাহ ও অত্যাচার) করতে চায় না।’
(সূরা কাসাস ৮৩)
‘তবে যদি নিজের থেকে না চাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা কাউকে বড়ত্ব দান করেন। আর সে তার বড়ত্বকে দ্বীনের কাজে ব্যবহার করে, তাহলে তা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত। যেমন হযরত আবু হুরাইরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দাকে বলবেন-’আমি কি তোমাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম না?’ (মুসলিম)

এ হাদীস দ্বারা বড়ত্ব যে, একটি নেয়ামত, তা স্পষ্ট হয়ে গেলো। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা (আঃ) কে মর্যাদাসম্পন্ন বলেছেন (সূরা আলে ইমরান)। এমনকি আল্লাহ তাআলা অনেক নবীকে রাজত্বও দান করেছেন। যেমন, হযরত দাউদ (আঃ) এবং হযরত সুলাইমান (আঃ) কে রাজত্ব দান করেছেন। (সূরা সাদ) বরং দ্বীনের খেদমতের জন্য নিজের থেকে নেতৃত্ব চাওয়াতেও দোষ নেই। যেমন, হযরত ইউসুফ (আঃ) মিসরের রাজকোষের কর্তৃত্বের জন্য নিজে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। (সূরা ইউসুফ)

পদ ও নেতৃত্ব নেয়ামত ও জায়েয হওয়া সত্ত্বেও এতে বিপদ ও ঝুঁকি রয়েছে। যেমন-

১২. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি দশজন মানুষের উপরেও কর্তৃত্ব রাখে, তাকে কিয়ামতের দিন পিঠমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় হাজির করা হবে। এমনকি হয় তার ন্যায়বিচার (যা সে দুনিয়ায় করেছে) তার বন্ধন খুলে দিবে, অথবা তার অবিচার (যা সে দুনিয়ায় করেছে) তাকে ধ্বংসে নিপতিত করবে?’ (দারামী)
এ হাদীস দ্বারা কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া স্পষ্ট বুঝা যায়।

১৩. হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লা্হ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চাটাইয়ের উপর শয়ন করলেন। তারপর উঠলেন। ফলে তার পবিত্র দেহে চাটাইয়ের দাগ পড়লো। হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) নিবেদন করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমদেরকে আপনার জন্য (নরম) বিছানা বিছানোর এবং (নরম বিছানা) বানানোর অনুমতি দিন।তিনি ইরশাদ করলেন-
‘দুনিয়ার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক! আমার আর দুনিয়ার দৃষ্টান্ত তো এমন-যেমন কোন আরোহী ব্যক্তি (পথ চলতে চলতে) ছায়া গ্রহণের জন্য কোন বৃক্ষের নীচে থেমে যায়, তারপর তা ছেড়ে (সম্মুখে) পথ ধরে।’ (আহমাদ. তিরমিযী, ইবনু মাজা)

১৪. হযরত আয়েশা (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-তিনি ইরশাদ করেছেন-
‘দুনিয়া ঐ ব্যক্তির ঘর, যার কোন ঘর নেই এবং ঐ ব্যক্তির সম্পদ, যার কাছে কোন সম্পদ নেই এবং একে ঐ ব্যক্তি (প্রয়োজনাতিরিক্ত) সঞ্চয় করে, যার বুদ্ধি নেই।’
(আহমাদ, বাইহাকী)
১৫. হযরত হুযাইফা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি, তিনি খুতবার মধ্যে এ কথাও বলতেন-
‘দুনিয়ার ভালোবাসা সমস্ত পাপের মূল।’ (রাযীন, বাইহাকী)

১৬. হযরত জাবির (রাযিঃ) থেকে দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘এ হলো দুনিয়া, যে সফর করে (পিছনে) চলে যাচ্ছে। আর এ হলো আখিরাত, যে সফর করে (নিকটে) এগিয়ে আসছে এবং এতদুভয়ের মধ্য থেকে প্রত্যেকের কিছু সন্তান রয়েছে। তাই তোমাদের দ্বারা যদি দুনিয়ার সন্তান না হওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তাই করো। কারণ, আজ তোমরা আমলের ঘরে আছো। এখানে হিসাব নেই। আর কালকে তোমরা আখিরাতে থাকবে, সেখানে আমল থাকবে না।’ (বাইহাকী)

১৭. হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি আয়াত পাঠ করলেন, যার অর্থ এই যে, ‘আল্লাহ তাআলা যাকে হেদায়েত করতে ইচ্ছা করেন, তার বক্ষ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।’
তারপর তিনি ইরশাদ করলেন-যখন অন্তরে নূর প্রবেশ করে, তখন তা প্রশস্ত হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করা হলো: হে আল্লাহর রাসূল! এর এমন কোন আলামত আছে কি? যার দ্বারা (এ নূর) চেনা যাবে। তিনি ইরশাদ করলেন-
‘হাঁ, ছলনার ঘর থেকে (অর্থাৎ, দুনিয়া থেকে) বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং চিরস্থায়ী ঘরের প্রতি (অর্থাৎ, আখিরাতের প্রতি) অনুরাগী হওয়া এবং মৃত্যূর জন্য তার আগমনের পূর্বে প্রস্ত্তত হওয়া।’ (বাইহাকী)
এ পর্যন্ত দুনিয়ার প্রতি বিরাগী হওয়ার আলোচনা ছিলো। সম্মুখে আখিরাতের প্রতি অনুরাগী ও যত্নশীল হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

১৮. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যাবতীয় স্বাদ বিনষ্টকারী বস্ত্ত অর্থাৎ, মৃত্যুকে অধিক হারে স্মরণ করো।’
(তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনু মাজা)

১৯. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘মৃত্যু ঈমানদারের জন্য ‍উপঢৌকন।’ (বাইহাকী)

ফায়দা: বিধায় এ উপঢৌকন পেয়ে আনন্দিত হওয়া উচিত। আর যদি কেউ আযাবের ভয় করে, তাহলে তা থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করুক অর্থাৎ, আল্লাহ ও রাসূলের বিধি- বিধান পালন করুক এবং ভুল-ত্রুটির জন্য তওবা করুক।

২০. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উভয় কাঁধ ধরলেন, তারপর ইরশাদ করলেন-
‘দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো, যেমন কিনা তুমি একজন ভিনদেশী। (ভিনদেশে অবস্থান সাময়িক হয়ে থাকে, তাই তাতে কেউ মন বসায় না) কিংবা (এমনভাবে থাকো, যেমন কিনা তুমি) পথ অতিক্রম করছো। (যার কোন অবস্থানই নেই)। হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) বলতেন-যখন সন্ধ্যা হবে, তখন সকালের প্রতী্ক্ষা করো না। আর যখন সকাল হবে তখন সন্ধ্যার প্রতীক্ষা করো
না।’ (বুখারী)

২১. হযরত বারা ইবনে আযিব (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ঈমানদার ব্যক্তি যখন দুনিয়া থেকে আখিরাত অভিমুখে যাওয়ার উপক্রম করে, তখন তার নিকট শুভ্র অবয়বের ফেরেশতাগণ আগমন করেন। তাঁদের কাছে জান্নাতের কাফন এবং জান্নাতের সুগন্ধি থাকে। তারপর মৃত্যূর ফেরেশতা আসে এবং বলে –হে পবিত্র আত্মা! মহান আল্লাহর ক্ষমা ও সন্ত্তষ্টির দিকে চলো। তারপর মৃত্যূর ফেরেশতা যখন তার জান কবয করে, তখন ফেরেশতাগণ সেই আত্মাকে মৃত্যুর ফেরেশতার হাত থেকে নিয়ে জান্নাতী কাফন এবং সুগন্ধির মধ্যে রেখে দেয় এবং তা থেকে মেশকের ন্যায় সুগন্ধি ছড়াতে থাকে। এরপর তাকে নিয়ে (উপর দিকে) আরোহণ করে এবং (জমিনের) ফেরেশতাদের যে দলের নিকট দিয়ে তারা অতিক্রম করে, তাদেরকে জমিনের ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করে, এ পবিত্র আত্মাটি কার? তখন ফেরেশতারা ভালো ভালো উপাধি সহযোগে তার নাম বলে যে, অমুকের ছেলে অমুক। তারপর তাকে দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত পৌঁছায় এবং আসমানের দ্বার উন্মুক্ত করতে বলা হয়। তখন আসমানের দ্বার উন্মুক্ত করা হয় এবং প্রত্যেক আসমানের নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ তাদের নিকটবর্তী আসমান পর্যন্ত তার সঙ্গে গমন করেন। এমনকি তাকে সপ্তম আসমানে পৌঁছানো হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- আমার বান্দার আমলনামা ‘ইল্লিয়ীনে’ রেখে দাও এবং তাকে (প্রশ্নোত্তরের জন্য) জমিনের দিকে নিয়ে যাও। তখন তার আত্মা তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। (কিন্ত্ত দুনিয়ায় যেমন ছিলো, তেমনভাবে নয়, বরং ঐ জগতের উপযোগীভাবে। যার স্বরুপ যখন দেখবে, তখন বুঝে আসবে।

তারপর তার নিকট দু’জন ফেরেশতা আসে এবং জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার রব কে? সে বলে, ‘আমার রব আল্লাহ’। তারপর জিজ্ঞাসা করে,‘তোমার দ্বীন কি?’ সে বলে,‘আমার দ্বীন ইসলাম।’ তারপর জিজ্ঞাসা করে,‘এই ব্যক্তি কে, যাকে তোমার নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল? সে বলে, ‘তিনি আল্লাহর নবী।’ (তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে) এক আহবানকারী আসমান থেকে আহবান করে বলে, আমার বান্দা ঠিক ঠিক উত্তর দিয়েছে।
‘তার জন্য বেহেশতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তাকে বেহেশতের পোশাক পরিয়ে দাও এবং তার জন্য জান্নাতের দিকে দ্বার উন্মুক্ত করে দাও। তখন তার নিকট বেহেশতের বায়ু ও সুগন্ধি আসতে থাকে। (তারপর এ হাদীসেই কাফিরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ এর বিপরীত) (আহমাদ)

ফায়দা: তারপর এ সমস্ত ঘটনা ঘটতে থাকবে-
ক. শিংগায় ফুঁ দেওয়া হবে।
খ. সমস্ত মৃত জীবিত হবে।
গ. হাশর ময়দানের কঠিন বিপদ হবে।
ঘ. হিসাব-কিতাব হবে।
ঙ. আমল পরিমাপ করা হবে, কারো হক অপূর্ণ থাকলে তাকে নেকী দেওয়ানো হবে।
চ. সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা হাউজে কাউসারের পানি লাভ করবে।
ছ. পুলসিরাত অতিক্রম করতে হবে।
জ. কিছু পাপের শাস্তি স্বরুপ জাহান্নামে আযাব হবে।
ঝ. ঈমানদারদের সুপারিশ হবে।
ঞ. বেহেশতীরা বেহেশতে যাবে। সেখানে আল্লাহ তাআলার দর্শন লাভ করবে।

এ সমস্ত ঘটনার বিবরণ অধিকাংশ মুসলমান বারবার শুনেছে। আর যে শুনে নাই বা পুনরায় জানতে চায় সে শাহ রফীউদ্দীন সাহেব রচিত ‘কিয়ামতনামা’ পুস্তকটি পাঠ করবে। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে ভাববে। এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার বেশী সময় যদি না পায়, তাহলে ঘুমানোর সময়ই একটু গভীরভা্বে ভাববে। উপরোক্ত সমস্ত হাদীস মিশকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত।