উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হায়াতুল মুসলিমীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

গুনাহের কাজ এমন যে, যদি তাতে শাস্তির বিধান নাও থাকতো, তবুও একথা চিন্তা করে তা বর্জন করা জরুরী ছিলো যে, এ কাজ করলে আল্লাহ তাআলা অসন্ত্তষ্ট হন। দুনিয়াতে কেউ আমার প্রতি দয়া করলে তাকে অসন্ত্তষ্ট করার সাহস হয় না, বান্দার উপর আল্লাহর দয়ার তো কোন সীমা-পরিসীমা নেই, তাহলে তাকে অসন্ত্তষ্ট করার সাহস কি করে হয়? উরন্ত্ত শাস্তির ভয়তো রয়েছেই। চাই সে শাস্তি দুনিয়াতেও হোক, (যেমন হাদীস শরীফে কুরআনের এ আয়াতের যে কোন মন্দ কাজ করবে, তাকে তার প্রতিফল দেওয়া হবে।’ তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে) অথবা শুধু আখিরাতে দেওয়া হোক। সুতরাং দুনিয়াতে একটি শাস্তি এও হয়ে থাকে- যা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা যায় যে, তার দুনিয়ার প্রতি আসক্তি এবং আখিরাতের প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয়। আর এর ফলে অন্তরের বল এবং দ্বীনের দৃঢ়তা বিলুপ্ত হয়। অতএব এমত পরিস্থিতিতে তো গুনাহের ধারে-কাছেও যাওয়া সমীচীন নয়। তা অন্তরের গুনাহ হোক, বা হাত-পায়ের হোক, বা জিহ্বার। এবং তা আল্লাহর হক সংক্রান্ত হোক, বা বান্দার হক সংক্রান্ত হোক। উপরোক্ত শাস্তি তো সব গুনাহের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তবে কোন কোন গুনাহের ব্যাপারে বিশেষ বিশেষ শাস্তির কথাও এসেছে। নিম্নে এ সমস্ত বিষয় সংক্রান্ত হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।

১. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘কোন ঈমানদার যখন গুনাহের কাজ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। তারপর যদি সে তাওবা ও ইস্তিগফার করে, তাহলে তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যদি (গুনাহের কাজ) পুনরায় করে তাহলে তা (কালো দাগ) আরো বৃদ্ধি পায়। এটিই সেই জং যার উল্লেখ আল্লাহ তাআলা (এ আয়াতে) করেছেন-

‘কখনোই এমন নয় (যেমন তারা মনে করছে) বরং তাদের অন্তরে তাদের (পাপ) কর্মসমূহের জং বসে গেছে।’ (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু মাজা)

২. হযরত মুআয (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখো। কারণ, গুনাহ করার দ্বারা আল্লাহর গযব অবতীর্ণ হয়। (আহমাদ)

৩. হযরত আনাস বিন মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের ব্যাধি ও তার প্রতিকার বলবো না? শুনে নাও! তোমাদের ব্যাধি গুনাহ, আর তার প্রতিকার ইস্তিগফার। অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া। (তারগীব)

৪. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- অন্তরসমূহে এক প্রকারের জং লাগে (অর্থাৎ, পাপসমূহের কারণে,) তার পরিচ্ছন্নতা হলো ইস্তেগফার অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া।’ (তারগীব, বাইহাকী)

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয়ই মানুষ এমন পাপের ফলে রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়, যা সে করে।’
(জাযাউল আ’মাল)
ফায়দা: কখনো বাহ্যিকভাবে বঞ্চিত হয়, আর সর্বদা রিযিকের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।

৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমরা দশ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তিনি আমাদের দিকে মনোযোগী হয়ে ইরশাদ করলেন- পাঁচটি জিনিস এমন রয়েছে, যেগুলোর সাক্ষাৎ তোমরা পাও- তা থেকে আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি। (সেগুলো হলো) যখন কোন জাতির মধ্যে অশ্লীল কাজ প্রকাশ্যে হতে আরম্ভ করবে, তখন তারা প্লেগ রোগে আক্রান্ত হবে এবং এমন সব ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে, যেগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের সময় কখনও দেখা দেয়নি এবং যখন কোন জাতি মাপে কম দিবে, তখন অভাব, দুর্ভিক্ষ ও শাসকদের জুলুমের শিকার হবে। যে জাতিই যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে তাদের উপরই রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি জীবজন্ত্ত না থাকতো, তাহলে আর কখনই বৃষ্টি হতো না এবং যে জাতিই চুক্তি ভঙ্গ করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর ভিন্ন জাতির দুশমন চাপিয়ে দিবেন। তারা জোরপূর্বক তাদের ধনসম্পদ হরণ করে নেবে। (আইনে জাযাউল আ’মাল, ইবনু মাজা)

৭. হযরত ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘যখনই কোন জাতির মধ্যে খিয়ানত প্রকাশ পেয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে ভয় ঢেলে দিয়েছ্নে এবং যে জাতিই অন্যায় বিচার করেছে তার উপর শত্রু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ (মুয়াত্তা মালিক)

৮. হযরত সাওবান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সত্বরই এমন একসময় আসছে, যখন (কাফিরদের) সমস্ত দল তোমাদের বিরুদ্ধে পরস্পরকে আহবান করবে, যেমন আহারকারীরা পরস্পরকে দস্তরখানে আহবান করে। জনৈক ব্যক্তি নিবেদন করলো, আমরা (কি) তখন সংখ্যায় অল্প হবো? তিনি ইরশাদ করলেন, না! বরং তোমরা তখন অনেক হবে। কিন্ত্ত তখন তোমরা তৃণখন্ডের ন্যায় স্থিতিহীন অলস ও অথর্ব হবে, যেমন পানির ঢলের মধ্যে কুটা ভেসে যায়। আল্লা্হ তাআলা শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব ও ভীতি দূর করে দিবেন।
তোমাদের অন্তরে দূর্বলতা ঢেলে দিবেন। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো- এই দুর্বলতা কি জিনিস? (অর্থাৎ, কি কারণে এটা হবে?) তিনি ইরশাদ করলেন- দুনিয়ার মোহ এবং মৃত্যুকে ঘৃণা করা। (আবু দাউদ, বাইহাকী)

৯. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- যখন আল্লাহ তাআলা বান্দাদের থেকে (গুনাহের) প্রতিশোধ নিতে চান, তখন শিশুরা অধিকহারে মৃতূবরণ করে এবং নারীরা বন্ধ্যা হয়ে যায়। (আইনে জাযাউল আ’মাল, ইবনু আবিদ দুনিয়া)

১০. হযরত আবুদ দারদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- আমি রাজা –বাদশাহের মালিক। তাদের অন্তর আমার হাতে রয়েছে। মানুষ যখন আমার আনূগত্য করে, তখন আমি তাদের (রাজা-বাদশাহদের) অন্তরসমূহকে দয়াময় ও করুণাময় করে তাদের দিকে ঘুরিয়ে দেই। আর যখন মানুষ আমার অবাধ্য হয়, আমি তাদের (রাজা-বাদশাহদের) অন্তরসমূহকে ক্রোধ ও প্রতিশোধ গ্রহণকারীরুপে ঘুরিয়ে দিই। তখন তারা তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করে। (সংক্ষেপিত) (আবু নুয়াইম)

১১. হযরত ওহাব (রাযিঃ) বলেন যে, আল্লাহ তাআলা বনী ঈসরাইলকে ইরশাদ করেন- যখন আমার আনুগত্য করা হয়, তখন আমি খুশী হই। যখন আমি খুশী হই, তখন বরকত দান করি। আর আমার বরকতের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। পক্ষান্তরে যখন আমার আনুগত্য করা হয় না, তখন আমি ক্রোধান্বিত হই এবং অভিসম্পাত করি, আর আমার অভিশাপের প্রভাব সাত প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে। (আইনে জাযাউল আ’মাল, আহমাদ)

ফায়দা: এর অর্থ এই নয় যে, সাত প্রজন্ম পর্যন্ত অভিশাপ হয় বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তারা নেককার হলে সন্তান যে বরকত লাভ করত- তা করবে না।

১২. হযরত ওকী’ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাযিঃ) বলেন- মানষ যখন আল্লাহর হুকুম লংঘন করে, তখন তার প্রশংসাকারী আপনা আপনি দুর্নাম করতে আরম্ভ করে। (জাযাউল আ’মাল, আহমাদ)

ফায়দা: এ সমস্ত হাদীসে বেশীর ভাগ সাধারণ গুনাহের খারাপী উল্লেখিত হয়েছে। এখন বিশেষ কিছু গুনাহের বিশেষ বিশেষ খারাপ দিক লেখা হচ্ছে।

১৩. হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সুদ খায় (গ্রহিতা) এবং যে খাওয়ায় (দাতা) এবং লেখক ও তার সাক্ষীর উপর অভিসম্পাত করেছেন এবং তিনি ইরশাদ করেছেন-এরা সবাই সমান (অর্থাৎ,কোন কোন দিক থেকে)। (মুসলিম)

১৪. হযরত আবু মুসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘কবীরা গুনাহসমূহের পর সর্ববৃহৎ গুনাহ এই যে, কেউ মারা গেলো, আর তার উপর ঋণ (অর্থাৎ, কারো আর্থিক হক) রয়ে গেলো, আর তা পরিশোধ করার জন্য কিছু রেখে গেলো না। (সংক্ষেপিত) (আহমাদ, আবু দাউদ)

১৫. হযরত আবু হাররা রুককাশী (রাযিঃ) তদীয় চাচা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘শোনো! জুলুম করো না, শোন! কারো সম্পদ তার খুশীমনের অনুমতি ছাড়া হালাল নয়।’
(বাইহাকী, দারা কুতনী)
ফায়দা: এতে যেমন খোলামেলাভাবে কারো অধিকার হরণ করা বা মেরে নেওয়া অন্তর্ভুক্ত, যেমন, কারো ঋণ বা উত্তরাধিকার অংশ জোর খাটিয়ে হরণ করা, তেমনিভাবে যে সমস্ত চাঁদা চাপ সৃষ্টি করে বা চক্ষুলজ্জায় ও ব্যক্তির প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া হয় তাও অন্তর্ভুক্ত।

১৬. হযরত সালিম (রাযিঃ) তদীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি (কারো) জমিন থেকে অন্যায়ভাবে সামান্যও নিয়ে নিবে- (আহমাদের এক হাদীসে অর্ধহাতের কথা এসেছে)-তাকে কিয়ামত দিবসে সাত তবক জমিনের নিচে ধসিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারী)

১৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুষদাতা ও গ্রহীতার উপর অভিসম্পাত করেছেন।’
(আবু দাউদ, ইবনে মাজা, তিরমিযী)

হযরত সাওবান (রাযিঃ) এর বর্ণনায় এ কথাও রয়েছে যে, এবং যে ব্যক্তি তাদের উভয়ের মাঝে (নির্বাহী) হয় (তার উপরও অভিসম্পাত করেছেন। (আহমাদ, বাইহাকী)

ফায়দা: তবে যেখানে ঘুষ দেওয়া ছাড়া জালেমের জুলুম থেকে বাঁচতে পারবে না, সেখানে ঘুষ দেওয়া জায়িয। কিন্ত্ত ঘুষ নেওয়া সেখানেও হারাম।

১৮.হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাযিঃ) থেকে বর্নিত আছে-
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদ ও জুয়া থেকে বারণ করেছেন।’ (আবু দাউদ)

ফায়দা: মদের মধ্যে সব ধরনের নেশাকর বস্ত্ত অন্তর্ভুক্ত এবং জুয়ার মধ্যে বীমা, লটারী ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত।

১৯. হযরত উম্মে সালামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সব বস্ত্ত থেকে বারণ করেছেন, যেগুলো নেশাকর (অর্থাৎ, জ্ঞান লোপ পায়) বা যেগুলো অনুভূতি শক্তিকে লোপ করে।’
(আবু দাউদ)

ফায়দা: এর মধ্যে আফিম এবং ঐ সমস্ত হুক্কা সেবনও অন্তর্ভুক্ত, যার দ্বারা মস্তিষ্ক ও হাত-পা অনুভুতিহীন হয়ে যায়।

২০. হযরত আবু উমামা (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমাকে আমার প্রভু বাদ্যযন্ত্রসমূহ-যেগুলো হাত দ্বারা বাজানো হয় বা মুখ দ্বারা বাজানো হয়- ধ্বংস করতে নির্দেশ দিয়েছেন।… (আহমাদ)

২১. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘চোখদ্বয়ের ব্যভিচার (কামনার সাথে) দৃষ্টি ক্ষেপণ করা এবং কানদ্বয়ের ব্যভিচার (কামনার সাথে) কথা শ্রবণ করা, জিহ্বার ব্যবিচার (কামনার সাথে) কথোপকথন করা, হাতের ব্যভিচার (কামনার সাথে) কারো (হাত ইত্যাদি) ধরা, পায়ের ব্যভিচার (কামনার সাথে) পা চালিয়ে গমন করা, অন্তর (এর ব্যভিচার হলো) কামনা করাও বাসনা করা…। (মুসলিম)

ফায়দা: বালকদের সঙ্গে কামনার সাথে কথা বলা বা কামনার কাজ করা এর চেয়ে অধিক মারাত্মক গুনাহ। এ হাদীসের সঙ্গে এর পূর্বের হাদীসকে মিলিয়ে দেখা উচিত যে, নাচগানের মধ্যে কত গুনাহের সমন্বয় রয়েছে।

২২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘বড় বড় গুনাহ হলো, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। মা-বাপের (অবাধ্য হয়ে তাদেরকে) কষ্ট দেওয়া। নিরপরাধ লোককে হত্যা করা এবং মিথ্যা শপথ করা।’ (বুখারী)

২৩. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে এ হাদীসে মিথ্যা শপথ করার জায়গায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া বর্নিত হয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)

২৪. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) এসব বিষয় উল্লেখ রয়েছে- এতীমের মাল ভক্ষণ করা, (লড়াকু কাফিরদের সঙ্গে শরীয়তসম্মত) লড়াইয়ের সময় পালিয়ে যাওয়া, নিষ্কলঙ্ক ঈমানদার স্ত্রীদেরকে যাদের (এসব মন্দ বিষয়ের) খবরও নেই- অপবাদ দেওয়া। (বুখারী ও মুসলিম)

২৫. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) এসব বিষয় উল্লেখ রয়েছে- ব্যভিচার করা, চুরি করা, ডাকাতি করা। (বুখারী ও মুসলিম)

২৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্নিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘চারটি স্বভাব এমন রয়েছে, যার মধ্যে এর চারটিই থাকবে সে নির্ভেজাল মুনাফিক। আর যার মধ্যে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি স্বভাব থাকবে, যতক্ষণ সে তা পরিত্যাগ না করবে। (সে স্বভাবগুলো এইঃ) যখন তার নিকট আমানত রাখা হয় (চাই তা অর্থসম্পদ হোক বা কথা) সে খিয়ানত করে, যখন কথা বলে-মিথ্যা বলে এবং যখন চুক্তি করে-ভেঙ্গে ফেলে এবং যখন কারো সঙ্গে ঝগড়া করে, তখন গালি দেয়।

হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) এর এক বর্ণনায় এও আছে যে, যখন অঙ্গীকার করে-ভঙ্গ করে। (বুখারী ও মুসলিম)

২৭. হযরত সফওয়ান বিন ‘আসসাল (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে এও রয়েছে-
‘কোন নিরপরাধ লোককে কোন শাসকের নিকট নিয়ে যেয়ো না, যাতে করে সে তাকে হ্ত্যা করে। (বা তার উপর জুলুম করে) এবং জাদু করো না…।’
(তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী)

নিম্নবর্ণিত গুনাহসমূহের ব্যাপারে আযাবের ধমকী এসেছে-

কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে হাসা, কাউকে তার দোষের কথা বলে লজ্জা দেওয়া, মন্দ আখ্যা দিয়ে ডাকা, কুধারণা করা, কারো দোষ তালাশ করা, বিনা কারণে কাউকে বকা-ঝকা দেওয়া, কুটনামী করা, দ্বিমুখী আচরণ করা- অর্থাৎ, এর সামনে এর মত, আর ওর সামনে ওর মত হওয়া। অপবাদ দেওয়া, ধোঁকা দেওয়া, লজ্জা দেওয়া, কারো ক্ষতি দেখে খুশী হওয়া, অহংকার ও গর্ব করা, জুলুম করা, অভাবগ্রস্তকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাহায্য না করা, কারো মালের ক্ষতি করা, কারো মান-সম্মানে আঘাত করা, ছোটদের প্রতি দয়া না করা, বড়দের শ্রদ্ধা না করা, অন্ন-বস্ত্রহীন লোকদের সামর্থ্য মোতাবেক খেদমত না করা, জাগতিক ব্যাপারে ঝগড়া করে মুসলমানের সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দেওয়া, জীবের ছবি উঠানো, অন্যের জমিতে মিথ্যা উত্তরাধিকারের দাবী করা, সুস্থ-সবল লোকের ভিক্ষা করা। এতদসংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ নবম ও ঊনবিংশতম রূহে চলে গেছে।

দাড়ি মুন্ডানো বা কাটা, কাফির বা ফাসিকদের মত পোশাক পরিধান করা, নারীরা পুরুষদের বেশ ধারণ করা, যেমন পুরুষদের জুতা পরিধান করা। এ সম্পর্কে ইনশাআল্লাহ পঁচিশতম রূহে বর্ণনা আসবে। আরো অনেক গুনাহের কাজ রয়েছে। নমুনাস্বরুপ এ কয়টি লেখা হলো। সবধরনের গুনাহ থেকেই বিরত থাকা উচিত। আর যে সমস্ত গুনাহ অতীতে হয়ে গেছে, সেগুলো থেকে তাওবা করতে থাকবে, কারণ, তাওবার দ্বারা সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

২৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘গুনাহ থেকে তওবাকারী ব্যক্তি এমন- যেমন কিনা তার গুনাহই ছিলো না।’
(বাইহাকী, শরহুস সুন্নাহ)
তবে বান্দার হকের ক্ষেত্রে তওবার জন্য এ শর্তও রয়েছে যে, হকদার ব্যক্তির থেকেও মাফ চাইতে হবে। এ সম্পর্কে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

২৯. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তির দায়িত্বে তার (মুসলমান) ভাইয়ের মান-সম্মান বা অন্য কোন বিষয়ের কোন হক রয়েছে, তার আজই মাফ চাওয়া উচিত। সেদিন আসার পূর্বে, যেদিন টাকা-পয়সা থাকবে না। (অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন)’ (বুখারী)

এ হাদীসের অবশিষ্টাংশ হলো-

৩০. তার নিকট কোন নেক আমল থাকলে তার হক পরিমাণ তার থেকে নিয়ে নেওয়া হবে (এবং পাওনাদারকে দিয়ে দেওয়া হবে), আর যদি তার কাছে নেকী না থাকে, তাহলে অন্যের (পাওনাদারের) গুনাহ নিয়ে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
(আইনে জামউল ফাওয়ায়িদ, মুসলিম, তিরমিযী)
এ সব ক’টি হাদীস মিশকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত। আর যেসব হাদীস অন্য গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলোতে ‘আইন’ শব্দ লিখে দেওয়া হয়েছে।