গুনাহের ইহকালীন ক্ষতিসমূহের বর্ণনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: জাযাউল আ’মাল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
গুনাহের ইহকালীন ক্ষতি এত অধিক যে, তা গুণে শেষ করা যাবে না। তবে এখানে প্রথমে কিছু আয়াত ও হাদীস দ্বারা সংক্ষেপে গুণাহের কিছু (অশুভ) প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল ব্যক্ত করছি। তারপর কিছুটা বিস্তারিত ও বিন্যস্ত আকারে এ বিষয়টি লিপিবদ্ধ করবো।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নাফরমানদের যে সমস্ত ঘটনা এবং তার শাস্তিসমূহ উল্লেখিত হয়েছে, তা কার জানা নেই?
সেটি কোন জিনিস, যা ইবলিসকে আসমান থেকে জমিনে পতিত করেছে? এই অবাধ্যতার কারণেই তো সে অভিশপ্ত হয়েছে। তার আকৃতি বিকৃত হয়েছে। অন্তর ধ্বংস হয়েছে। রহমতের স্থলে অভিশাপ ভাগ্যে জুটেছে। নৈকট্যের বদলে দূরত্ব লাভ হয়েছে। তাসবীহ ওতাকদীসের পরিবর্তে কুফর ও শিরক, মিথ্যা ও অশ্লীলতার পুরস্কার মিলেছে।
সেটি কোন্ জিনিস ছিলো, যা নূহ (আঃ)-এর যুগে সমস্ত জগতবাসীকে বন্যায় নিমজ্জিত করেছিলো?
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে আদ সম্প্রদায়ের উপর ঝঞ্জা বায়ু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো? এমনকি তাদেরকে মাটিতে আছড়িয়ে আছড়িয়ে মেরে ফেলা হয়?
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে সামুদ জাতির উপর বিকট চিৎকার রুপে আযাব আসে। ফলে তাদের কলিজা ফেটে যায় এবং তারা সবংশে ধ্বংস হয়?
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে লুৎ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের জনপদকে আসমান পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে উল্টে ফেলা হয় এবং উপর থেকে পাথর বর্ষানো হয়?
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে শুয়াইব (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের উপর মেঘের আকারে আযাব আসে এবং তা থেকে আগুন বর্ষিত হয়।
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে ফেরাউনের সম্প্রদায়কে ভূমধ্য সাগরে ডুবিয়ে মারা হয়?
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে কারুনকে ভূমিতে ধসিয়ে দেওয়া হয় এবং তার পিছে পিছে তার ঘরবাড়ী ও আসবাবপত্রও ধ্বংস হয়ে যায়?
সেটি কোন্ জিনিস, যার কারণে একবার বনী ইসরাঈলের উপর এমন যুদ্ধবাজ জাতি চাপিয়ে দেওয়া হয়, যারা তাদের গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদেরকে তছনছ করে ফেলে? এবং পুনরায় একবার তাদের উপর তাদের প্রতিপক্ষকে বিজয়ী করা হয়। ফলে তাদের সাজানো-গোছানো ঘর-বাড়ী পুনর্বার ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যায়।
সেটি কোন্ জিনিস, যা ঐ বনী ইসরাঈলকেই বিভিন্ন বালা-মুসীবতে আক্রান্ত করে? তারা কখনো নিহত হয়, কখনো বন্দী হয়, কখনো তাদের ঘর-বাড়ী উজাড় করা হয়, কখনো অত্যাচারী বাদশাহ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, কখনো তাদেরকে দেশান্তর করা হয়?
সেই জিনিস, যার কারণে এ সমস্ত (অশুভ) প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ও আযাব-গযব দেখা দেয়, তা পাপ ও নাফরমানী ছাড়া আর কি ছিলো?
এ সমস্ত ঘটনাকে পবিত্র কুরআনের জায়গায় জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে, আর অতি সংক্ষেপে তার কারণ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
‘আল্লাহ এমন নন যে, তাদের উপর জুলুম করবেন, কিন্ত্ত তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করতো’ (সূরা আনকবূত-৪০)
লক্ষ্য করে দেখুন! তারা এই গুনাহের কারণেই দুনিয়াতে কত রকম আযাব-গযব ভোগ করেছে।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন যে, যখন ‘কুবরছ’ (সাইপ্রাস) অঞ্চল বিজিত হয়, তখন জুবায়ের বিন নুযাইর আবুদ দারদা (রাযিঃ)কে দেখেন যে, তিনি একাকী বসে কাদঁছেন। তিনি বলেনঃ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আবুদ দারদা! এমন বরকতময় দিনে কান্নার কারণ কি, যেদিন আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সম্মান দিয়েছেন? তিনি উত্তরে বললেন, হে যুবাইর! আফসোস! তুমি বুঝলে না, যখন কোন জাতি আল্লাহর হুকুম লংঘন করে, তখন তারা আল্লাহর নিকট কেমন তুচ্ছ ও মূল্যহীন হয়ে যায়। দেখো! কোথায় এ জাতি শাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিলো, আর আল্লাহর হুকুম পরিত্যাগ করার কারণে আজ তারা লাঞ্ছিত, যা তুমি এখন প্রত্যক্ষ করছো।
হাদীস শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘নিশ্চয়ই মানুষ ঐ পাপের কারণে রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়, যাতে সে লিপ্ত হয়।’
ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমরা দশ ব্যক্তি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি আমাদেরকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করলেন যে, পাঁচটি জিনিস এমন রয়েছে, যেগুলো তোমরা লাভ হওয়া থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
১. যখন কোন জাতির মধ্যে অশ্লীল কাজ প্রকাশ্যে হতে থাকবে, তখন তারা প্লেগ রোগে আক্রান্ত হবে এবং আরো এমন এমন রোগে আক্রান্ত হবে, যেগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের যুগে ছিলো না।
২. যখন কোন জাতি মাপে কম দিবে, তখন তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব ও শাসকদের জুলুম-অত্যাচারের শিকার করা হবে।
৩. যে জাতিই যাকাত দেওয়া বন্ধ করে দিবে, তাদের থেকেই রহমতের বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি জীব-জন্ত্ত না থাকতো, তাহলে কখনই তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ হতো না।
৪. যে জাতিই চুক্তিভঙ্গ করবে, তাদের উপরই আল্লাহ তাআলা কাফির দুশমনকে চাপিয়ে দিবেন। যারা তাদের ধনসম্পদ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিবে।
ইবনু আবিদ দুনয়া বর্ণনা করেন যে, একব্যক্তি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযিঃ)-এর নিকট ভূমিকম্পের কারণ জিজ্ঞাসা করলো। উত্তরে তিনি বললেনঃ যখন মানুষ বৈধ কাজের ন্যায় নির্ভীকভাবে ব্যভিচার করে, মদপান করে এবং বাদ্য বাজায়, তখন আসমানে আল্লাহ তাআলার আত্মমর্যাদায় তা বাধে, তখন তিনি জমিনকে নির্দেশ দেন যে, তাদেরকে প্রকম্পিত করো।
একবার হযরত উমর ইবনে আবদুল আাযীয (রহঃ) বিভিন্ন শহরে হুকুমনামা লিখে পাঠান, যার বিষয়বস্ত্ত ছিলো এই-
হামদ ও সালাতের পর বক্তব্য এই যে, এ ভূমিকম্প আল্লাহ তাআলার ক্রোধের আলামত। আমি সব শহরে লিখে পাঠিয়েছি যে, অমুক মাসের অমুক তারিখে (দু’আ ও কান্না-কাটার উদ্দেশ্যে) ময়দানে বের হবে। যাদের টাকা-পয়সা আছে, তারা দান-খয়রাতও করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘নিশ্চয় সে সাফল্য লাভ করলো, যে পরিশুদ্ধ হলো এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করলো, অতঃপর নামায আদায় করলো।’ (সূরা আ’লা ১৪-১৫)
এবং তোমরা দু’আর মধ্যে বলো, যেমন আদম আলাইহিস সালাম বলেছিলেন-
অর্থঃ ‘হে আমদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের আত্মার উপর জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের উপর রহম না করেন, তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’ (সূরা আ’রাফ-২৩)
এবং যেমন নূহ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন-
অর্থঃ ‘আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমার উপর দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’ (সূরা হুদ-৪৭)
এবং যেমন ইউনুস আলাইহিস সালাম বলেছিলেন-
অর্থঃ ‘আপনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। আমি আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমিই জুলুম করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া-৮৭)
ইবনু আবিদ দুনয়া বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যখন মহান আল্লাহ বান্দাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চান, তখন শিশুরা অধিকহারে মৃত্যুবরণ করে এবং মহিলারা বন্ধ্যা হয়ে যায়।’
মালিক বিন দীনার (রহঃ) বলেন- আমি হিকমতের কিতাবে পড়েছি যে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘আমি আল্লাহ, আমি বাদশাহদের অধিপতি। তাদের অন্তর আমার হাতে। তাই যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করে, আমি ঐ সমস্ত বাদশাহর অন্তর তার উপর করুণাময় করে দেই। আর যে আমার অবাধ্য হয়, আমি তার জন্য ঐ বাদশাহদেরকে শাস্তিরুপে নির্ধারণ করে দেই। তোমরা বাদশাহদের নিন্দাবাদে লিপ্ত হয়ো না। আমার দিকে প্রত্যাবর্তন করো। আমি তাদেরকে তোমাদের প্রতি দয়ার্দ্র করে দিবো।’
ইমাম আহমাদ (রহঃ) ওয়াহাব (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলকে বলেন- ‘যখন আমার আনুগত্য করা হয়, তখন আমি সন্ত্তষ্ট হই। আর যখন আমি সন্ত্তষ্ট হই, তখন বরকত দান করি। আর আমার বরকতের কোন অন্ত নেই। আর যখন আমার আনুগত্য করা করা হয় না, তখন আমি ক্রোধান্বিত হই। আর যখন আমি ক্রোধান্বিত হই, তখন অভিশম্পাত করি। আর আমার অভিশাপের প্রতিক্রিয়া সাত বংশ পরম্পরা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’
ইমাম আহমাদ (রহঃ) ওকী’ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আয়েশা (রাযিঃ) হযরত মুআবিয়া (রাযিঃ)কে পত্রযোগে লেখেন- ‘যখন বান্দা আল্লাহর হুকুম লংঘন করে, তখন তার প্রশংসাকারী নিজেই বিদ্রূপ করতে আরম্ভ করে।’
আরো অনেক হাদীস ও বর্ণনায় গুনাহের পার্থিব ক্ষতিসমূহ উল্লেখিত রয়েছে। এখন বিস্তারিত ও বিন্যস্তভাবে গুনাহের কিছু ক্ষতি লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। সহজে আয়ত্ব করার জন্য বিষয়গুলোকে অনুচ্ছেদাকারে বর্ণনা করা সমীচীন মনে করছি।
অনুচ্ছেদ-১: গুনাহের একটি ক্ষতি এই যে, পাপী ব্যক্তি ইলম থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ইলম হলো আত্মার নূর-জ্যোতি, আর গুনাহের দ্বারা আত্মার সেই নূর নিভে যায়। ইমাম মালিক (রহঃ) ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)কে উপদেশ দিয়েছিলেন-
অর্থঃ ‘আমি দেখছি যে, আল্লাহ তাআলা তোমার অন্তরে একটি নূর দিয়েছেন। তুমি যেন তা গুনাহের কালিমা দ্বারা নিভিয়ে না ফেলো।’
অনুচ্ছেদ-২: গুনাহের একটি দুনিয়াবী ক্ষতি এই যে, এতে রিযিক কমে যায়। এতদসংক্রান্ত হাদীস পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৩: একটি ক্ষতি এই যে, পাপী ব্যক্তির আল্লাহ তাআলার প্রতি এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্কের ভাব থাকে। আর এ বিষয়টি এমন যে, সামান্য রুচিবোধ থাকলেও তা বুঝতে পারে।
জনৈক ব্যক্তি এক আল্লাহওয়ালার নিকট ভীতি ও আতঙ্কের অভিযোগ করলে তিনি বলেন-
অর্থ: ‘গুনাহ যখন তোমাকে আতঙ্কে ফেলে, তখন তুমি আতঙ্ক দূর করতে চাইলে গুনাহ পরিহার করো, আর আল্লাহর প্রীতি লাভ করো।’
অনুচ্ছেদ-৪: একটি ক্ষতি এই যে, গুনাহ করার দ্বারা মানুষের সাথেও ভয় ও আতঙ্কের ভাব সৃষ্টি হয়, বিশেষত: নেক লোকদের সাথে। তাদের নিকট বসতে মন চায় না। আর তাদের সাথে আতঙ্ক যত বৃদ্ধি পাবে, তত তাদের থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হবে এবং তাদের বরকত থেকে বঞ্চিত হবে।
এক বুযুর্গ ব্যক্তি বলেন- আমার দ্বারা কোন সময় পাপ কাজ সংঘটিত হলে তার মন্দ প্রভাব আমার স্ত্রী এবং জীবজন্ত্তর আচরণের মধ্যেও পাই। তারা আর পরিপূর্ণ অনুগত থাকে না।
অনুচ্ছেদ-৫: একটি ক্ষতি এই হয় যে, বেশীর ভাগ কাজে জটিলতা দেখা দেয়। পরহেযগারী তথা গুনাহ থেকে বেঁচে চলার দ্বারা সফলতার পথসমূহ উন্মোচিত হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন।’
(সূরা তালাক-২)
অপরদিকে গুনাহ থেকে না বাঁচার দ্বারা সফলতার পথসমূহ বন্ধ হয়ে যায়।
অনুচ্ছেদ-৬: একটি ক্ষতি এই হয় যে, অন্তরে একপ্রকারের অন্ধকারাচ্ছন্নতা অনুভূত হয়। অন্তরের দিকে একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই অন্ধকারভাব স্পষ্ট বুঝে আসে। এ অন্ধকারের শক্ত প্রভাবে এক ধরনের হতবুদ্ধিতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে মানুষ বিদআত, গোমরাহী ও অজ্ঞতায় লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এবং এ অন্ধকারের মন্দ প্রভাব অন্তর থেকে চোখের মধ্যে চলে আসে। তারপর মুখমন্ডলের এ কালিমা সবার দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। পাপী ব্যক্তি যতই সুন্দর ও সুশ্রী হোক না কেন, তার চেহারায় একপ্রকারের জ্যোতিহীনতা অবশ্যই বিরাজ করে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাযিঃ) বলেন যে, নেক কাজ করার দ্বারা চেহারায় দীপ্তি, অন্তরে জ্যোতি, জীবিকায় প্রশস্ততা, দেহে শক্তি এবং অন্য মানুষের অন্তরে তার প্রতি ভালোবকাসা জন্মায়। আর পাপ কাজ করার দ্বারা মুখমন্ডলে দীপ্তিহীনতা, কবর ও অন্তরে অন্ধকারাচ্ছন্নতা, দেহে অলসতা, জীবিকায় সংকীর্ণতা এবং মানুষের অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
অনুচ্ছেদ-৭: একটি ক্ষতি এই হয় যে, পাপ কাজ দ্বারা দেহ ও অন্তরে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। অন্তরের দুর্বলতা তো স্পষ্ট যে, নেক কাজের সাহস হ্রাস পেতে পেতে নিঃশেষ হয়ে যায়। আর দেহ যেহেতু অন্তরের অধীন, তাই অন্তর দুর্বল হলে দেহও দুর্বল হয়ে যায়। লক্ষ্য করো! রোম ও পারস্যের কাফিররা কেমন দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলো, কিন্ত্ত সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ)-এর সামনে তারা টিকতে পারতো না।
অনুচ্ছেদ-৮: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহের কারণে মানূষ ইবাদত-বন্দেগী থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। আজ এক ইবাদত চলে যায়, কাল আরেক ইবাদত ছুটে যায়, পরশু আরেকটি হাতছাড়া হয়ে যায়, এমনিভাবে পাপ কাজের ফলে ক্রমান্বয়ে সমস্ত নেক কাজ তার হাতছাড়া হয়ে যায়। যেমন কেউ এক গ্রাস সুস্বাদু খাবার এমন খেলো, যার দ্বারা এমন রোগ সৃষ্টি হলো যে, শত-সহস্র সুস্বাদু খাবার থেকে সে বঞ্চিত হয়ে গেলো।
অনুচ্ছেদ-৯: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহের কারণে আয়ু কমে যায় এবং বরকত নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, নেককাজ দ্বারা আয়ু বৃদ্ধির কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, বিধায় পাপ কাজ দ্বারা বয়সের ঘাটতি হওয়ার বিষয় এর দ্বারাই বুঝে নিন। আর এরুপ সন্দেহ নিতান্তই অমূলক যে, বয়স তো নির্ধারিত, তা কিভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে? কারণ, বয়সেরই বা কি বিশেষত্ব রয়েছে, এ সমস্ত বিষয়ও তো নির্ধারিত-সচ্ছলতা, অসচ্ছলতা, সুস্থতা, অসুস্থতা। সব ব্যাপারেই তো একই সন্দেহ হতে পারে। কিন্ত্ত এরপরও বিষয়গুলোকে উপকরণের সাথে সম্পৃক্ত মনে করে সে অনুপাতে চেষ্টা-তাদবীর করা হয়। বয়সের বিষয়টিও একই রুপ বোঝা উচিত।
অনুচ্ছেদ-১০: একটি ক্ষতি এই হয় যে, প্রথম পাপ দ্বিতীয় পাপের কারণ হয়। সেটি তৃতীয়টির কারণ হয়। এমনিভাবে পাপ কাজ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে পাপী ব্যক্তি পাপ কাজ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, পাপ কাজ করতে করতে এমন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় যে, তা পরিত্যাগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আর এই পাপ কাজে স্বাদ বলতে কিছুই থাকে না। কিন্ত্ত না করলে কষ্ট হয়, তাই তা করতে থাকে।
অনুচ্ছেদ-১১: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা তাওবা করার ইচ্ছা দুর্বল হয়ে যায়। এমনকি একেবারেই তাওবার তাওফীক হয় না। তাওবাবিহীন অবস্থাতেই মৃত্যু চলে আসে।
অনুচ্ছেদ-১২: একটি ক্ষতি এই হয় যে, কিছুদিনের মধ্যে ঐ পাপ কাজের ঘৃণা অন্তর থেকে বের হয়ে যায়, তখন ঐ পাপ কাজকে আর অন্যায় মনে করে না। কেউ দেখে ফেলবে তারও পরওয়া করে না। বরং গর্বভরে তার আলোচনা করতে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তি ক্ষমা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। যেমন হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ভাবার্থ: সবার জন্যই ক্ষমার আশা রয়েছে, তবে যারা প্রকাশ্যে পাপ কাজ করে তারা ছাড়া। আর এটাও প্রকাশ্যে পাপ কাজ করার অন্তর্ভুক্তই যে, আল্লাহ তাআলা তো তার পাপ কাজকে গোপন করেছিলেন, কিন্ত্ত সকালবেলা সে নিজে নিজেকে এভাবে লাঞ্ছিত করে যে, হে অমুক! আমি অমুক অমুক দিন অমুক অমুক কাজ করেছিলাম। এভাবে নিজেই নিজের গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়। অথচ আল্লাহ তাআলা তা গোপন করেছিলেন।
আর কখনো গুনাহের ঘৃণ্যতা লোপ পেতে পেতে কৃফর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এ কারণেই এক বুযুর্গ বলেন যে, তোমরা তো গুনাহকে ভয় করো আর আমি কুফরের ভয় করি।
অনুচ্ছেদ-১৩: একটি ক্ষতি এই হয় যে, প্রত্যেক গুনাহই আল্লাহর দুশমনদের উত্তরাধিকার। তাই যেন পাপী ব্যক্তি ঐ অভিশপ্তদের উত্তরাধিকারী হলো। যেমন গুহ্যদ্বারে অপকর্ম করা লূত আলাইহিস সালামের জাতির উত্তরাধিকার। মাপে কম দেওয়া শুয়াইব আলাইহিস সালামের জাতির উত্তরাধিকার। ফেতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করা ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকার। অহংকার ও জোর-জবরদস্তি হুদ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকার। আর এ পাপী ব্যক্তিরা তাদের সাদৃশ্য ও বেশ-ভূষা গ্রহণ করে আছে।
মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থ: যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে ঐ জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
অনুচ্ছেদ-১৪: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা গুনাহগার ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিকট মূল্যহীন ও লাঞ্ছিত হয়ে যায়। আর যখন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট হেয় ও লাঞ্ছিত হয়ে যায়, তখন মানুষের মধ্যেও তার আর কোন সম্মান থাকে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থ: ‘আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন, কেউ তাকে সম্মান দেওয়ার থাকে না।’
(সূরা হাজ্জ-১৮)
কবি বলেন-
অর্থ: ‘যে ব্যক্তিই তার (আল্লাহর) দরবার থেকে মাথা ফিরিয়ে নিলো (অবাধ্য হলো) সে যে দরজাতেই ধর্ণা দিবে, কোন সম্মানই পাবে না।’ যদিও মানুষ পাপী ব্যক্তির জুলুম-অত্যাচারের ভয়ে তাকে সম্মান করে, কিন্ত্ত কারো অন্তরে তার প্রতি শ্রদ্ধা থাকে না।
অনুচ্ছেদ-১৫: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহের অশুভ প্রতিক্রিয়া যেমন গুনাহগারের উপর পতিত হয়, তেমনি তার ক্ষতি অন্যান্য সৃষ্টির উপরও পতিত হয়। ফলে সমস্ত সৃষ্টি তার উপর অভিশাপ করে থাকে। গুনাহের শাস্তি তো হবেই, উপরন্ত্ত এ অভিশাপ তার অতিরিক্ত শাস্তির কারণ হবে।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, যখন মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, তখন জীবজন্ত্ত পাপী ব্যক্তিদের উপর অভিশম্পাত করে আর বলে যে, এটি আদম সন্তানের পাপের মন্দ প্রতিক্রিয়া।
অনুচ্ছেদ-১৬: একটি ক্ষতি এই হয় যে, পাপ কাজ করার দ্বারা বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায় এবং তা বিকৃত হয়ে যায়। কারণ, বুদ্ধি একটি আলোকদীপ্ত জিনিস, পাপ ও কালিমা দ্বারা তা লোপ পেয়ে যায়; বরং পাপ করাটাই নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ। যদি পাপী ব্যক্তির বুদ্ধি ঠিক থাকতো, তাহলে এমতাবস্থায়ও কি পাপ কাজ করতে পারে যে, সে আল্লাহর ক্ষমতাধীন রয়েছে। তার রাজত্বে বসবাস করছে। তিনি সর্বদা দেখছেন। তার ফেরেশতারা সাক্ষী হচ্ছে। কুরআন শরীফ তাকে নিষেধ করছে। ঈমান তাকে বাধা দিচ্ছে। মৃত্যু তাকে বারণ করছে। দোযখ তাকে নিষেধ করছে। পাপ কাজ করার দ্বারা ঐ পরিমাণ স্বাদ ও আনন্দ লাভ হয় না, দুনিয়া ও আখিরাতের যে পরিমাণ লাভ এর দ্বারা হাতছাড়া হয়। আচ্ছা, কোন সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তি কি এত সব সত্ত্বেও পাপ কাজ করতে পারে?
অনুচ্ছেদ-১৭: গুনাহের একটি বড় ক্ষতি এই যে, গুনাহ করার দ্বারা এ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লা’নতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কারণ, তিনি অনেক গুনাহের উপর লা’নত করেছেন। আর যে সমস্ত গুনাহ এ সমস্ত অভিশাপকৃত গুনাহের চেয়ে বড়, সেগুলোর কারণে তো অধিকতর লা’নতের উপযোগী হবে। যেমন-
(১ ও ২)‘আল্লাহ তাআলা ঐ সমস্ত নারীর উপর অভিশাপ করেছেন, যারা উল্কি আঁকে এবং আঁকতে বলে। তিনি আরো অভিশাপ করেছেন, ঐ সমস্ত নারীর উপর, যারা অন্যের চুল নিজের চুলের সঙ্গে যুক্ত করে চুল দীর্ঘ করে এবং যে অন্যের দ্বারা চুল যুক্ত করায়।’
(বুখারী, মুসলিম)
(৩) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিশাপ করেছেন সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং তার সাক্ষীর উপর। (আবু দাউদ, তিরমিযী)
(৪) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিশাপ করেছেন, হালালাহকারীর উপর এবং যার জন্য হালালাহ করা হয় তার উপর। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে পুনরায় নেওয়ার জন্য অন্যের নিকট এই শর্তে বিবাহ দেয় যে, বিবাহের পর সহবাস করে তালাক দিতে হবে এবং যে এ শর্তে বিবাহ করে উভয়ের উপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লা’নত করেছেন।
(৫) আল্লাহ তাআলা চোরের উপর লা’নত করেছেন। সে ডিম ও রশি চুরি করে, ফলে তার হাত কাটা হয়। (বুখারী, মুসলিম)
(৬) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ ব্যক্তির উপর লা’নত করেছেন, যথা-মদ্যপায়ীর উপর, পরিবেশনকারীর উপর, রস নিংড়িয়ে মদ প্রস্ত্ততকারকের উপর, যে রস নিংড়ানোর নির্দেশ দেয় তার উপর, মদ বিক্রেতার উপর, তার ক্রেতার উপর, তার মূল্য ভক্ষণকারীর উপর, মদ বহনকারীর উপর, যার জন্য বহন করে আনা হয় তার উপর। (তিরমিযী)
(৭) আল্লাহ তাআলা অভিশাপ করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে মাতাপিতার উপর লা’নত করে। (নাসায়ী, মুসলিম)
(৮) আল্লাহ পাক লা’নত করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে তার মা-বাবাকে গালি দেয়।
(ইবনু হিব্বান, বাইহাকী)
(৯) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিশাপ করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে জীবিত প্রাণীকে (তীর বা গুলির) টার্গেট বানায়।
(১০) আল্লাহ তাআলা অভিশাপ করেছেন ঐ সমস্ত পুরুষের উপর, যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে এবং ঐ সমস্ত নারীর উপর, যারা পুরুষদের বেশভূষা ধারণ করে।
(১১) আল্লাহ তাআলা অভিশাপ করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে গাইরুল্লাহর নামে জবাই করে।
(১২) আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের অভিশাপ ঐ ব্যক্তির উপর, যে দ্বীনের মধ্যে নতুন জিনিসের উদ্ভব ঘটায় বা এমন ব্যক্তিকে আশ্রয় দেয়। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার ফরয-নফল কোন ইবাদত কবুল করবেন না।
(১৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিশাপ করেছেন ছবি প্রস্ত্ততকারীর উপর।
(১৪) ঐ ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে কওমে লুতের ন্যায় কাজ করে।
(১৫) ঐ ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে কোন পশুর সাথে যৌনকর্ম করে।
(১৬) তিনি অভিশাপ করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে কোন পশুর চেহারায় ছ্যাঁক দেয় বা আঘাত করে। (আবু দাউদ)
(১৭) ঐ ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে কোন মুসলমানকে কষ্ট দেয় বা তার সাথে প্রতারণা করে।
(তিরমিযী)
(১৮) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিশাপ করেছেন ঐ সমস্ত নারীর উপর, যারা কবরস্থানে যায় এবং যারা সেখানে সিজদা করে বা বাতি জ্বালায়। (তিরমিযী)
(১৯) যে কোন নারীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে বা কোন ক্রীতদাসকে তার মনিবের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
(২০) ঐ ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে তার স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে সহবাস করে।
(২১) যে নারী রাগান্বিত হয়ে তার স্বামী থেকে পৃথকভাবে রাত অতিবাহিত করে, ভোর পর্যন্ত ফেরেশতারা তার উপর অভিশম্পাত করে।
(২২) যে ব্যক্তি নিজের পিতাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সাথে তার বংশকে সম্পৃক্ত করে, তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সমস্ত মানুষের লা’নত। (ইবনু মাজাহ)
(২৩) যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের দিকে লোহা দ্বারা (ধারালো অস্ত্র দ্বারা) ইঙ্গিত করে, তার উপর ফেরেশতারা অভিশাপ করে। (তিরমিযী)
(২৪) যারা সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ)এর সমালোচনা করে, তাদের দেখলে তোমরা বলো যে, তোমাদের অপকর্মের উপর আল্লাহর লা’নত।
(২৫-২৬) ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত: তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহ অভিশম্পাত করেন।
(সূরা মুহাম্মাদ, ২২-২৩)
যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকাল ও পরকালে অভিশম্পাত করেন। (সূরা আহযাব, ৫৭)
(২৭) নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব তথ্য এবং হেদায়াতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিশম্পাত এবং অন্যান্য অভিশম্পাতকারীগণেরও। (সূরা আল বাকারা-১৬০)
(২৮) যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহকালে ও পরকালে অভিশপ্ত। (সূরা নূর-২৩)
(২৯) তিনি অভিশাপ করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে মুসলমানদের বিপক্ষে কাফিরদেরকে ঠিক পথের সন্ধান দেয়।
(৩০) আল্লাহ অভিশাপ করেছেন ঐ ব্যক্তির উপর, যে ঘুষ দেয়, যে ঘুষ নেয় এবং যে এর মধ্যস্থতা করে।
এমন আরো অনেক কাজের ব্যাপারেই অভিশাপ এসেছে। গুনাহের অন্য কোন ক্ষতি যদি নাও থাকতো, তবুও আল্লাহ ও রাসূলের অভিশাপপ্রাপ্ত হওয়া কি সামান্য ব্যাপার! নাউযুবিল্লাহ।
অনুচ্ছেদ-১৮: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা ফেরেশতাদের দু’আ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
এ আয়াতের সারকথা এই যে, ‘যে সমস্ত ফেরেশতা আরশ বহন করছেন এবং যে সমস্ত ফেরেশতা তার চারপাশে রয়েছেন, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসা সহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তার প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং তারা ঈমানদারদের জন্য এই বলে মাগফিরাত কামনা করেন যে, ‘হে আল্লাহ! আপনার রহমত এবং ইলম অতি প্রশস্ত। আপনি এমন লোকদেরকে মাফ করে দিন, যারা আপনার দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং আপনার পথের অনুসরণ করে এবং তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সূরা মু’মিন-৭)
লক্ষ্য করুন! এ আয়াত দ্বারা পরিষ্কার জানা গেলো যে, ফেরেশতাগণ ঐ সমস্ত ঈমানদারের জন্য মাগফিরাতের দু’আ করেন, যারা আল্লাহর সন্ত্তষ্টির পথে চলে। বিধায় যারা গুনাহের কাজ করে সে পথ ছেড়ে দিলো, তারা এ মহান দৌলতের হকদার কি করে থাকতে পারে!
অনুচ্ছেদ-১৯: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা পৃথিবীতে নানা ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। পানি, বাতাস, শস্য ও ফলফলাদি কমে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।’ (সূরা রূম-৪১)
ইমাম আহমাদ (রহঃ) একটি হাদীসের আলোচনা সূত্রে বলেন যে, আমি বনী উমায়্যার একটি কোষাগারে খেজুরের বিচির সমান গমের দানা দেখেছি। দানাগুলো একটি থলের মধ্যে ছিলো। সেই থলের উপর লেখা ছিলো যে, এগুলো ন্যায়বিচারের যুগে উৎপন্ন হতো। কোন কোন মরুবাসী বর্ণনা করেছে যে, পূর্ব যুগের ফল বর্তমান যুগের ফলের চেয়ে বড় হতো।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম যখন পুনরায় আগমন করবেন, তখন ইবাদত-বন্দেগী বেশী হবে এবং পৃথিবী গুনাহ থেকে পবিত্র হবে, তখন পুনরায় জমির বরকত ফিরে আসবে। এমনকি সহীহ হাদীসের মধ্যে এসেছে যে, একটি আনার বড় একদল লোকের জন্য যথেষ্ট হবে এবং তারা তার ছায়ায় বসতে পারবে। আঙ্গুরের গুচ্ছ এত বড় হবে যে, তা একটি উটের বোঝা হবে। এতে জানা গেলো যে, দিনের পর দিনের এ বরকততীনতা আমাদের অন্যায়-অপরাধ ও পাপ-পঙ্কিলতার ফল।
অনুচ্ছেদ-২০-: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা লজ্জা ও আত্মমর্যাদাবোধ লোপ পায়। আর যখন লজ্জা থাকে না, তখন সে যাই করুক না কেন তা সামান্যই, তার কোন গুরুত্ব নেই।
অনুচ্ছেদ-২১: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা আল্লাহ তাআলার আযমত ও শ্রেষ্ঠত্ব তার অন্তর থেকে বের হয়ে যায়। আল্লাহর বড়ত্ব যদি তার অন্তরে থাকতোই, তাহলে কি তার বিরুদ্ধাচরণের সাহস পেতো? আর যখন তার অন্তরে আল্লাহর তাআলার বড়ত্ব থাকে না, তখন আল্লাহ তাআলার নজরেও তার কোন মর্যাদা থাকে না। ফলে এ ব্যক্তি অন্যদের দৃষ্টিতেও হেয় ও মর্যাদাহীন হয়ে যায়।
অনুচ্ছেদ-২২: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা নেয়ামতসমূহ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বালা-মুসীবত ঘিরে ধরে। হযরত আলী (রাযিঃ) ইরশাদ করেন-‘যে কোন বিপদই এসেছে, গুনাহর কারণেই এসেছে, আর যে কোন বিপদই কেটে গেছে তাওবার কারণেই কেটে গেছে।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যে সমস্ত মুসীবত তোমাদের উপর আসে, তা তোমাদের কৃতকর্মের দরুনই আসে। আর অনেক বিষয় আল্লাহ তাআলা মাফও করে দেন।’ (সূরা শূরা-৩০)
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
‘এটা এ কারণে যে, আল্লাহ তাআলা কোন জাতিকে যে নেয়ামত দান করেন, তা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।’
(সূরা আনফাল-৫৩)
এ আয়াত দ্বারাও জানা গেলো যে, গুনাহের কারণেই নেয়ামত হাতছাড়া হয়ে যায়।
অনুচ্ছেদ-২৩: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা সম্মান ও প্রশংসার উপাধি হাতছাড়া হয়ে তদস্থলে অপমান ও লাঞ্ছনার আখ্যা জোটে। যেমন, নেক কাজ করার দ্বারা এ সমস্ত উপাধি লাভ হয়-
মুমিন, নেককার, অনুগত, আল্লাহমুখী, ওলী, পরহেজগার, সৎকর্মশীল, ইবাদতগুজার, আল্লাহভীরু, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, পবিত্র, সন্তোষজনক, তাওবাকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, রুকুকারী, সিজদাকারী, মুসলমান, আল্লাহর দিকে ধাবমান, সত্যবাদী, ধৈর্যশীল
আল্লাহর ভয়ে ভীত, দানশীল, রোযাদার, সাধু, যিকিরকারী প্রভৃতি।
পক্ষান্তরে গুনাহের কাজ করার দ্বারা এ সমস্ত আখ্যা জোটে-
পাপী, ফাসিক, গুনাহগার, অবাধ্য, অপরাধী, ফাসাদ সৃষ্টিকারী, দুষ্ট, গজবপ্রাপ্ত, ব্যভিচারী, চোর, খুনী, মিথ্যুক, খেয়ানতকারী, সমকামী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, অহংকারী, অত্যাচারী, অভিশপ্ত, মূর্খ ইত্যাদি।
অনুচ্ছেদ-২৪: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা শয়তানের দল তার উপর চেপে বসে। কারণ, ইবাদত আল্লাহর একটি দুর্গ। যার মাধ্যমে শত্রুদের প্রাবল্য থেকে সংরক্ষিত থাকা যায়। যে-ই দুর্গ থেকে বের হয়ে গেলো, শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেলো। তখন শয়তানের দল যেমন ইচ্ছা তার উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং তার অন্তর, জিহ্বা, হাত, পা, চোখ, কান সমস্ত অঙ্গকে গুনাহই ডুবিয়ে দেয়।
অনুচ্ছেদ-২৫: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা মনের প্রশান্তি দূর হয়ে যায়। মনের মধ্যে কেমন এক ধরনের অশান্তি বিরাজ করতে থাকে। সবসময় ভয় লেগে থাকে যে, কেউ জেনে না ফেলে। কোথাও মান না যায়। কেউ প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ না করে। আমার মতে, (কুরআনে বর্ণিত) ‘সংকীর্ণ জীবন’ এর অর্থ এটাই।
অনুচ্ছেদ-২৬: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করতে করতে তা অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। এমনকি মৃত্যুর সময় কালিমা পর্যন্ত মুখে আসে না। বরং জীবদ্দশায় যে কাজ অধিক পরিমানে করতো, তাই তখনও সংঘটিত হয়। এক ব্যবসায়ী তার এক আত্মীয়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, মৃত্যুর সময় তাকে কালিমা বলে দেওয়া হচ্ছিলো, আর সে এই প্রলাপ বকছিলো যে, এ কাপড়টি অতি সুন্দর, এ খরিদ্দারের লেনদেন খুব ভালো। অবশেষে সে এ অবস্থাতেই মারা যায়।
এক ভিক্ষুকের ঘটনা বর্ণিত আছে যে, মৃত্যুর সময় সে বলছিলো-‘আল্লাহর ওয়াস্তে একটি পয়সা দিন’, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে একটি পয়সা দিন’। অবশেষে এ অবস্থাতেই সে মারা যায়।
এমনিভাবে এক ব্যক্তিকে মৃত্যুর পূর্বে কালিমা পড়াতে লাগলে সে বলে- আহ্! আহ্! আমার মুখ দ্বারা কালিমা বের হচ্ছে না।
মৃত্যুর সময় আরো বিভিন্ন রকমের অবস্থা হয়ে থাকে, যা আমাদের জানাও নেই। আল্লাহই ভালো জানেন, তখন কি কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
অনুচ্ছেদ-২৭: একটি ক্ষতি এই হয় যে, গুনাহ করার দ্বারা আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নৈরাশ্য চলে আসে। ফলে তাওবা করে না। তাওবাহীন অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করে। এক ব্যক্তিকে তার মৃত্যুর সময় বলা হলো যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো। সে গান গাইতে আরম্ভ করলো এবং বলতে লাগলো যে, যে কালিমা আমাকে পড়াচ্ছো তা দ্বারা আমার কি লাভ হবে? কোন গুনাহই তো আমার বাদ নেই। অবশেষে কালিমা ছাড়া মারা গেলো।
আরেক ব্যক্তিকে কালিমা পড়াতে চাইলে সে বললো, এ কালিমা দ্বারা কি হবে? আমি তো কখনো নামাযও পড়ি নাই। সেও এভাবেই মারা গেলো।
আরেক ব্যক্তিকে কালিমা পড়তে বলা হলো। সে বললো-আমি তো এই কালিমা স্বীকারই করি নাই। এ কথা বলে বিদায় হলো।
আরেক ব্যক্তি বলে যে, কেউ আমার জিহ্বা ধরে বসেছে। তাই মুখ দিয়ে কালিমা বের হচ্ছে না।
আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
মূলকথা
এগুলো জাগতিক ক্ষতি, যা গুনাহের কারণে হয়ে থাকে। এগুলো ছাড়া গুনাহের আরো অনেক যাহেরী ও বাতেনী ক্ষতি রয়েছে যেগুলো কুরআন হাদীস নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে এবং মনে মনে ভেবে দেখলেও সহজেই বুঝে আসতে পারে। আর গুনাহের কারণে আখিরাতে যে সমস্ত ক্ষতি রয়েছে, সেগুলো তো পৃথক আছেই। সেগুলোও একটু পরেই সংক্ষেপে উল্লেখ করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
কোন বুদ্ধিমান কখনই পছন্দ করতে পারে না যে, সামান্য মিথ্যা স্বাদের পিছনে পড়ে বিপদ ও কষ্টের এত বড় পাহাড় নিজের মাথায় চাপিয়ে নিবে। প্রত্যহ জাগতিক কারবারে মানুষ ঐ সমস্ত জিনিসের কাছেও ভিড়ে না যেগুলোতে ক্ষতির দিক প্রবল। একই আচরণ গুনাহের সাথেও করা উচিত। আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানকে তার নাফরমানী থেকে হেফাযত করুন। আমীন, আমীন, আমীন।
Leave a Reply