উৎস:
ইসলাহী নেসাব: জাযাউল আ’মাল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

কুরআন, হাদীস ও কাশফ দ্বারা জানা যায় যে, এ পার্থিব জগত ছাড়া আরো দু’টি জগত রয়েছে। একটিকে ‘আলমে বরযখ’ বা অন্তরাল জগত ও অপরটিকে ‘আলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জগত বলে। আমরা আখিরাত তথা পরজগত দ্বারা ‍উভয় জগতকে বুঝাবো। আলমে বরযখের আরেক নাম ‘কবর’। মানুষ যখন কোন কাজ করে সাথে সাথে ‘আলমে বরযখ’-এ তার প্রতিবিম্ব অঙ্কিত হয় এবং সেই অস্তিত্বের কিছু প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে একদিন এ সমস্ত আমলের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটবে। যাকে হাশরের দিন বলে। ফলে প্রতিটি কাজের তিনটি স্তর হলো-১. কাজ সংঘটিত হওয়া ২. তার প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হওয়া ও ৩.তা পরিপূর্ণভাবে প্রকৃতরুপে প্রকাশ পাওয়া।

গ্রামোফোন (বা টেপরেকর্ডার) দ্বারা দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি ভালো বুঝে আসবে। যখন মানুষ কথা বলে, তখন তার তিনটি স্তর হয়ে থাকে। প্রথম স্তরে কথাটি মুখ থেকে বের হয়। দ্বিতীয় স্তরে শব্দগুলো গ্রামোফোনে (টেপরেকর্ডারে) আবদ্ধ হয়। তৃতীয় স্তরে গ্রামোফোন (টেপরেকর্ডার) থেকে শব্দগুলো বের করতে চাইলে হুবহু ঐ শব্দই বের হয়ে আসে। কথা মুখ থেকে বের হওয়া পার্থিব জগতে কর্ম সংঘটিত হওয়ার দৃষ্টান্ত। গ্রামোফোনে (টেপরেকর্ডারে) আবদ্ধ হওয়া আলমে বরযখ তথা অন্তরাল জগতে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হওয়ার দৃষ্টান্ত এবং গ্রামোফোন (টেপরেকর্ডার) থেকে হুবহু ঐ শব্দ বের হয়ে আসা অদৃশ্য জগতে আমলের পরিপূর্ণ প্রকাশের দৃষ্টান্ত।

কোন বিবেকবান যেমন এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে না যে, মুখ থেকে যে শব্দ বের হয় তাই গ্রামোফোনে (টেপরেকর্ডারে) আবদ্ধ হয় এবং গ্রামোফোন (টেপরেকর্ডার) থেকে বের করলে সেই কথাগুলোই বের হয়, যেগুলো পূর্বে মুখ থেকে বের হয়েছিলো; তার বিপরীত বের হয় না। ঠিক তেমনিভাবে একজন ঈমানদারের এতে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, যখন কোন আমল তার থেকে সংঘটিত হয় সাথে সাথে তা প্রতিবিম্ব জগতে চিত্রায়িত হয়ে যায় এবং আখিরাতে তারই প্রকাশ ঘটবে।

উপরোক্ত ভিত্তিতে নিশ্চিত প্রমাণিত হলো যে, আখিরাতের বিষয়সমূহ সম্পূর্ণরুপে আমাদের ইচ্ছাধীন। সেখানে কোনরুপ জোর-জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই। যেভাবে গ্রামোফোনের (টেপরেকর্ডারের) মুখোমুখী হলে প্রতিটি কথার প্রতি সজাগ দৃষ্টি থাকে। আমার মুখ দিয়ে এমন কোন কথা যেন বের না হয়, যা ঐ ব্যক্তির সম্মুখে প্রকাশ করা আমার পছন্দ নয়, যার সম্মুখে পরবর্তীতে এ গ্রামোফোন খোলা হবে এবং তখন আর আমার অস্বীকার করার উপায় থাকবে না। কারণ এ যন্ত্রের বৈশিষ্ট্যই হলো, কখনো এর দ্বারা এরুপ হয় না যে, বলেছে একটা, আর রেকর্ড হয়েছে আরেকটা। ঠিক একইভাবে আমল সংঘটিত হওয়ার সময় এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত যে, আমি যা কিছু করছি, তা এক জায়গায় রেকর্ড হচ্ছে এবং কোনরুপ যোগ-বিয়োগ ছাড়া একদিন তা উন্মুক্ত হবে, আর তখন কোন ওজর-আপত্তির সুযোগ থাকবে না। এ সজাগ অবস্থা প্রবল হলে গুনাহ করতেও সেরুপ ভয় হবে, যেরুপ গ্রামোফোনের (টেপরেকর্ডারের) মুখোমুখি গালি দিতে ঐ সময় ভয় হয়, যখন এ বিশ্বাস থাকে যে, বাদশাহর সম্মুখে তা উন্মুক্ত করা হবে এবং আমিও সেখানে উপস্থিত থাকবো।

আরেকটি স্থূল দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বুঝুন- গাছ সৃষ্টি হতে তিনটি স্তর রয়েছে-

প্রথম- বীজ বপন করা, দ্বিতীয়-তা মাটি থেকে অঙ্কুরিত হওয়া, তৃতীয়-বড় হয়ে তাতে ফল ও ফুল ধরা। বিবেকবান বলতেই বুঝে যে, গাছ অঙ্কুরিত হওয়া এবং তাতে ফল ও ফুল আসা প্রাথমিক কর্মকান্ড নয়; বরং তার ভিত্তি বীজবপনের উপর। ঠিক তেমনি দুনিয়াতে আমল করা বীজ বপনতুল্য। ‘বরযখ’ জগতের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাওয়া গাছ অঙ্কুরিত হওয়া তুল্য। আর আখিরাতে এর পরিপূর্ণ ফল প্রকাশ পাওয়া গাছে ফল ও ফুল ধরা তুল্য। বরযখ ও আখিরাত জগতের ফলাফলের ভিত্তি যে, পার্থিব জগতের এখতিয়ারভুক্ত আমলের উপর এ কথা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হলো। যব বপন করে যখন গম হওয়ার আশা করা হয় না, তখন পাপ কাজ করে ভালো ফলের আশা কি করে হতে পারে।

এ থেকে ‘দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্রে’-কথাটির মর্ম বুঝে আসলো।
এক বুযুর্গ বলেন-
‘গম থেকে গম আর যব থেকে যবই উৎপন্ন হয়। তাই আমলের বদলা সম্পর্কে গাফেল হয়ো না।’
যেভাবে যবের বীজ ও যবের গাছের মধ্যে বাহ্যিক সাদৃশ্য থাকে না, কিন্ত্ত অন্তর্নিহিত সম্পর্ক নিশ্চিতরুপেই থাকে এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি তা উপলব্ধিও করে, একইভাবে আমল ও তার প্রতিফলের মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে, যা বোঝার জন্য অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন।

এবং যেভাবে যবের গাছ যারা চেনে তাদের কথা এ ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় এবং গাছ ও বীজের মধ্যে সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য বুঝে আসুক চাই না আসুক তাদের সাথে এ বিষয়ে তর্ক করা হয় না, তেমনিভাবে আমলের ফলাফল চিনে তা বর্ণনাকারীদের (নবী-রসূলগণের) কথা এ ব্যাপারে অবশ্য গ্রহণযোগ্য হবে। চাই আমল ও তার ফলাফলের সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য আমাদের বুঝে আসুক বা না আসুক।

আমি এখানে কতিপয় আমলের এমন কিছু ফলাফল উল্লেখ করছি-যেগুলো মৃত্যু পরবর্তী জীবন তথা বারযখ বা আখিরাতে দেখা দিবে। যেন একথা বুঝে আসে যে, মৃত্যু পরবর্তী কর্মকান্ড প্রাথমিক কর্মকান্ড নয়, বরং ইহকালীন কর্মকান্ডের উপরেই তা নির্ভরশীল এবং তার সাথেই সম্পৃক্ত। তারপর দৃষ্টান্তস্বরুপ কিছু আমল ও তার ফলাফল সংক্রান্ত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের কতিপয় উক্তি উল্লেখ করবো। যেন একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে যা কিছু হবে তা এখানকার আমলেরই ফলাফল। তাহলে আল্লাহ তাআলার নিন্মোক্ত বাণীসমূহের মর্ম বুঝে আসবে।

ক. ‘যে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্ত্তত প্রহরী রয়েছে।’ (সূরা কাফ-১৮)

খ. ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সূরা যিলযাল৭-৮)

গ. ‘যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করবো এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট।’ (আম্বিয়া৪৭)

ঘ. ‘তারা বলবে: হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে, ছোট-বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সূরা কাহাফ-৪৯)

ঙ. ‘সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভালো কাজ করেছে, চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে সুদূর ব্যবধান হতো।’ (সূরা আলে ইমরান-৩০)

চ. ‘আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে মজবুত বাক্য দ্বারা মজবুত করেন। পার্থিব জীবনে এবং পরকালে।’ (সূরা ইবরাহীম-২৭)
ও অন্যান্য আয়াতসমূহ।

অনুচ্ছেদ-১: কতিপয় আমলের আলমে বরযখের প্রতিক্রিয়ার বিবরণ, ‘যা আলমে বরযখে দেখা দিবে, যার দ্বারা ঐ সমস্ত আমলের রুপক আকৃতি বুঝে আসে।

১. ইমাম বুখারী (রহঃ) সাহাবী সামুরা বিন জুন্দুব (রাযিঃ)এর বর্ণনায় উদ্ধৃত করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়শই সাহাবীগণকে জিজ্ঞাসা করতেন যে, তোমরা রাতে কোন স্বপ্ন দেখেছো কি? উত্তরে কোন ব্যক্তি কোন স্বপ্ন ব্যক্ত করলে তিনি তার ব্যাখ্যা বলে দিতেন। সেই অভ্যাস মতো একদিন ভোরে তিনি ইরশাদ করলেন- আজ রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটি এই-দু’জন ব্যক্তি আমার নিকট এলো এবং আমাকে উঠিয়ে বললো-চলো। আমি তাদের সঙ্গে চলতে আরম্ভ করলাম। আমরা এমন এক ব্যক্তির নিকট দিয়ে চলতে আরম্ভ করলাম, যে শুয়ে আছে আর অপর এক ব্যক্তি তার পাশে একটি পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লোকটি তার মাথায় সজোরে পাথরের আঘাত করছে। ফলে তার মাথা পিষে যাচ্ছে এবং পাথরটি ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ছো। লোকটি গিয়ে পুনরায় পাথর উঠিয়ে আনলো এবং সে ফিরে আসার পূর্বেই শায়িত ব্যক্তির মাথা ভালো হয়ে গেলো। সে পাথর নিয়ে এসে পুনরায় একই আচরণ করলো। আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে ঐ দুই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম, সুবহানাল্লাহ! এ দু’জন কারা? তারা বললো-সামনে চলো।

আমরা সম্মুখে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে চিৎ হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম। অপর এক ব্যক্তি লোহার চিমটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং শায়িত ব্যক্তির মুখের একদিকে এসে ঐ চিমটা দ্বারা তার মাথা, নাকের ছিদ্র ও চোখ ঘাড় পর্যন্ত
ফাঁড়ছে। তারপর অপর দিকে এসে একইরুপ করছে। এদিকের কাজ শেষ না হতেই অপরদিক ভালো হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় অপর দিক গিয়ে একই রুপ করছে। আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ! এ দু’জন কারা? তারা বললো, সামনে চলো।

আমরা সম্মুখে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে একটি তন্দুর (চুল্লির) নিকট পৌঁছলাম। তার মধ্যে খুব শোরগোল হচ্ছিলো। আমরা তাতে উঁকি দিয়ে দেখলাম-তার মধ্যে অনেকগুলো নারী-পুরুষ উলঙ্গ অবস্থায় ছিলো। তাদের নিচ থেকে একটি অগ্নিশিখা উঠে আসছিলো। যখন অগ্নিশিখাটি তাদের নিকট চলে আসে, তার তীব্রতায় তারাও উপরে উঠে আসে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ লোকগুলো কারা? তারা উত্তরে বললো- সম্মুখে চলো।

আমরা সম্মুখে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে একটি নদীর নিকট পৌঁছলাম। যা রক্তের ন্যায় লাল বর্ণের ছিলো। ঐ নদীর মধ্যে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। নদীর তীরে অপর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। সে অনেকগুলো পাথর জমা করে রেখেছে। ঐ ব্যক্তি সাঁতার কেটে নিকটে আসলে এ ব্যক্তি তার মুখের উপর একটি পাথর সজোরে ছুড়ে মারে। যার আঘাতে ঐ ব্যক্তি পুনরায় পূর্বের জায়গায় পৌঁছে যায়। সে আবার এগিয়ে আসে। এ ব্যক্তি পুনরায় তাকে হঠিয়ে দেয়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম-এ দু’জন কারা? তারা বললো-সামনে চলো।

আমরা সম্মুখে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে ভীষণ কদাকার চেহারার এক ব্যক্তির নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম। এমন বীভৎস চেহারার আর কাউকে আমি কখনো দেখনি। তার সম্মুখে আগুন রয়েছে। সে তা প্রজ্জ্বলিত করছে এবং তার চতুর্দিকে ঘুরছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যক্তি কে? তারা বললো-সামনে চলো।

আমরা সম্মুখে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে একটি ঘন বৃক্ষ সম্বলিত বাগানে পৌঁছি। তাতে সবধরনের ফলগুচ্ছ ছিলো। সেই বাগানের মধ্যে অত্যাধিক দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি বসে আছে। উচ্চতার ফলে তার মাথা দেখা যাচ্ছে না। তার আশেপাশে বহু সংখ্যক শিশু সমবেত রয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম-এটি কিসের বাগান, আর এই লোকেরাই বা কারা? তারা বললো-সামনে চলো।

আমরা সম্মুখে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে আমরা বিশালাকার এক বৃক্ষের নিকটে পৌঁছলাম। এর চেয়ে বড় ও সুন্দর বৃক্ষ আমি কখনোও দেখিনি। ঐ দু্ই ব্যক্তি আমাকে বললো-এর উপর আরোহণ করো। আমরা আরোহণ করলাম। তখন একটি শহর দেখতে পেলাম। যার ভবনসমূহে একেকটি স্বর্ণের এবং একেকটি রুপার ইট লাগানো ছিলো। আমরা শহরের ফটকে পৌঁছলাম। তা খুলতে বললাম। দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু লোক দেখতে পেলাম। তাদের দেহের অর্ধেকাংশে অত্যাধিক সুন্দর, আর বাকী অর্ধেকাংশ অত্যাধিক কুশ্রী ছিলো। ঐ দুই ব্যক্তি তাদেরকে বললো, যাও ঐ নদীতে ডুব দাও। সেখানে একটি চওড়া নদী প্রবাহিত ছিলো। যার পানি ছিলো দুধের মত সাদা। লোকগুলো গিয়ে তাতে ডুব দিলো, তারপর আমাদের নিকট যখন ফিরে এলো, তখন তাদের খারাপ আকৃতি আর অবশিষ্ট ছিলো না। তারপর ঐ দুই ব্যক্তি আমাকে বললো-এটি ‘জান্নাতে আদন’, আর দেখো, তোমার বাড়ী ওখানে রয়েছে। আমার দৃষ্টি উপরে উঠতেই সাদা মেঘসদৃশ একটি মহল দেখতে পাই। তারা বললো, এটিই তোমার বাড়ী। আমি তাদের দু’জনকে বললাম, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণ করুন। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ওর মধ্যে চলে যাই। তারা বললো-এখনই নয়। পরবর্তীতে যাবে। আমি তাদেরকে বললাম-আজ সারারাত অনেক আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম। আসলে এগুলো কি ছিলো? তারা বললো-আমরা এখনই তোমাকে তা বলছি।

যে ব্যক্তির মাথা পাথর দিয়ে পিষিয়ে ফেলতে দেখেছো, সে এমন এক ব্যক্তি, যে পবিত্র কুরআন শিক্ষা করে তা পরিত্যাগ করে ফরয নামায থেকে গাফেল হয়ে ঘুমিয়ে থাকতো। আর যে ব্যক্তির মাথা, নাক ও চোখ ঘাড় পর্যন্ত চিরতে দেখছো, সে এমন ব্যক্তি, যে সকালবেলা ঘর থেকে বের হতো এবং মিথ্যা কথা বলতো এবং তা বহুদূর পৌঁছে যেতো। আর যে সমস্ত নারী-পুরুষকে তন্দুরের (চুল্লীর) মধ্যে দেখেছো, এরা ব্যভিচারকারী নারী-পুরুষ। আর যে ব্যক্তি নদীর মধ্যে সাঁতার কাটছিলো এবং যার মুখের উপর পাথর মারা হচ্ছিলো, সে সুদখোর, আর যে কদাকার মানুষকে আগুন জ্বালাতে ও তার চতুর্দিকে দৌড়াতে দেখেছো, সে দোযখের দারোগা ‘মালিক’। আর যে দীর্ঘদেহি লোকটিকে বাগানের মধ্যে দেখেছো, তিনি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। আর তার আশপাশে যেসব শিশুকে দেখেছো, তারা ঐ সমস্ত শিশু, যাদের স্বভাব-ধর্মের উপর মৃত্যু হয়েছে।

জনৈক মুসলমান জিজ্ঞাসা করলো- হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের শিশুরাও কি? তিনি বললেন-হাঁ। মুশরিকদের শিশুরাও। আর যে সমস্ত লোকের দেহ অর্ধেক সুশ্রী ও অর্ধেক কুশ্রী ছিলো, তারা ঐ সমস্ত লোক, যারা কিছু নেক আমল করেছে এবং কিছু বদআমল করেছে, যা আল্লাহ তাআলা মাফ করে দিয়েছেন।’

এ হাদীস দ্বারা এ সমস্ত আমলের প্রতিফল পরিষ্কার বুঝে আসলো। এ সমস্ত আমল ও তার প্রতিক্রিয়ার মাঝের সম্পর্ক সুক্ষ্ম। কিন্ত্ত একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসা সম্ভব। যেমন মিথ্যা বলা ও কল্লা চেরার মধ্যে সম্পর্ক সুস্পষ্ট। ব্যভিচারের দ্বারা খাহেশাতের আগুন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, তাই শাস্তির আগুন তাদেরকে বেষ্টন করার মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট। ব্যভিচারের সময় উলঙ্গ হওয়া আর জাহান্নামে উলঙ্গ থাকার মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট। এমনিভাবে সমস্ত আমলকে একইভাবে ভাবা উচিত।

অনুচ্ছেদ-২: যে সম্পদের যাকাত দেওয়া হয় না তা সাপের আকৃতি ধারণ করে তার গলায় বেড়ীর ন্যায় পেঁচিয়ে ধরবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তিই তার সম্পদের যাকাত দিবে না, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার গলায় একটি অজগর সাপ পেঁচিয়ে দিবেন। তারপর তিনি এর সপক্ষে পবিত্র কুরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত করেন-
‘আল্লাহ প্রদত্ত মালের মধ্য যারা কৃপণতা করে, তারা যেন তা তাদের জন্য মঙ্গল মনে না করে, বরং তা তাদের জন্য অমঙ্গল। অচিরেই কিয়ামতের দিন, যে মালের মধ্যে তারা কার্পন্য করতো তা দ্বারা তাদেরকে বেড়ি পরানো হবে।’ (তিরমিযী)

অনুচ্ছেদ-৩: বিশ্বাসঘাতকতা পতাকার রুপ ধারণ করে কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনার কারণ হবে।
হযরত আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে তার প্রাণের নিরাপত্তা দিয়ে হত্যা করবে, তার পিঠের উপর পতাকা গেড়ে দিয়ে উচ্চস্বরে বলা হবে-
‘এটি অমুক ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতা।’

অনুচ্ছেদ-৪: যে বস্ত্তর মধ্যে চুরি ও খিয়ানত করা হবে, তাই শাস্তির উপকরণ হবে।

আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য একটি ক্রীতদাস হাদিয়া স্বরুপ পাঠায়। তার নাম ছিলো ‘মিদআম’। একবার সে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু সামানাপত্র নামাচ্ছিল। আচমকা একটি তীর এসে তাকে বিদ্ধ করে। তীর নিক্ষেপকারী কে তা জানা যায় না। লোকেরা বললো- বেহেশত তার জন্য মোবারক হোক। তিনি বললেন-কখনোই এমন বলো না। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ। সে খাইবারের যুদ্ধের দিন যে কম্বল নিয়েছিলো এবং তা বন্টন হয়েছিল না, তা আগুনে পরিণত হয়ে তাকে জ্বালাচ্ছে। মানুষেরা যখন এ কথা শুনলো তখন এক ব্যক্তি জুতার একটি বা দু’টি ফিতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আনলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘(এখন কি হবে?) এই একটি বা দু’টি ফিতা তো আগুনের।’

হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ননা করেছেন।

অনুচ্ছেদ-৫: গীবত করার রুপক আকৃতি মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার তুল্য। আল্লা্হ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে! তোমরা তো তা অপছন্দ করবে।’ (সূরা হুজুরাত-১২)

এ কারণে স্বপ্নযোগে গীবত উক্ত আকৃতিতে দেখা যায়।

অনুচ্ছেদ-৬: অন্তর্নিহিত মর্ম বিশারদদের উক্তি থেকে কিছু জিনিসের রুপক আকৃতি বর্ণনা করা হচ্ছে। মুহাক্কিক আলিমগণ বলেছেন- প্রত্যেক মন্দ চরিত্রের কোন একটি পশুর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। যে ব্যক্তির মধ্যে যে চরিত্র প্রবল হয়, রুপকাকৃতির জগতে ঐ ব্যক্তির আকৃতিও সেই পশুর ন্যায় হয়ে যায়। পূর্ব যুগের উম্মতদের মধ্যে সেই আকৃতি ইহজগতেই প্রকাশ পেতো। এ উম্মতকে আল্লাহ তাআলা ইহজগতে অপদস্ত হওয়া থেকে হেফাযত করেছেন। কিন্ত্ত অন্য জগতে সেই আকৃতি ঠিকই ধারণ করে। কিয়ামতের দিন তা প্রকাশ পাবে। কাশফের অধিকারীদের নিকট ইহজগতেই তা উন্মুক্ত হয়ে যায়। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহঃ)ও নিম্নের আয়াতের এ তাফসীরই করেছেন-

‘পৃথিবীর উপর বিচরণকারী সকল প্রকার জন্ত্ত এবং যত প্রকার পাখি পাখায় ভর করে উড়ে বেড়ায়, সেগুলো তোমাদের মতই জামাত।’ (সূরা আন’আম-৩৮)

সুফিয়ান (রহঃ) বলেন যে, কিছু লোক হিংস্র প্রাণীর চরিত্রের হয়। কিছু কুকুরের, শূকরের ও গাধার স্বভাবধারী হয়। কিছু সাজসজ্জা করে ময়ূরের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। কিছু লোক গাধার মত অপবিত্র হয়। কিছু লোক মুরগীর ন্যায় স্বার্থপর হয়। কিছু উটের ন্যায় বিদ্বেষপরায়ণ হয়। কিছু মাছি সদৃশ, আর কিছু শৃগাল সদৃশ হয়।

ইমাম সা’লাবী (রহঃ) বলেন-
‘তখন তোমরা দলে দলে সমাগত হবে’ এর তাফসীরে বলেন যে, কিয়ামত দিবসে মানুষ বিভিন্ন আকৃতিতে সমবেত হবে। যে পশুর স্বভাব যার প্রকৃতির মধ্যে প্রবল থাকবে, কিয়ামতের দিন সে তারই রুপ ধারণ করবে।

অনুচ্ছেদ-৭: হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহঃ)এর উক্তিতে কতিপয় আমলের রুপক আকৃতির বিশ্লেষণ-
অর্থ: যখন কোন লোক রুকু বা সেজদাহ করে, তার সেই রুকু-সেজদাহ পরজগতে বাগানের রুপ ধারণ করে।
যখন তোমার মুখ থেকে আল্লাহর প্রশংসা উচ্চারিত হয়ে উড়ে যায়, প্রভাতের প্রভু (আল্লাহ) তাকে জান্নাতের পাখিতে পরিণত করেন।

তোমার তাসবীহ ও প্রশংসাকে তিনি পাখি বানাবেন, যেমন বীর্য দ্বারা বাহুবিশিষ্ট আকাশের পাখি তৈরী করেন।

তোমার হাত থেকে যখন যাকাত ও আত্মত্যাগ সম্পাদিত হয়, এটি সেই জগতে বৃক্ষ ও লতাপাতায় পরিণত হয়।

তোমার ধৈর্যের পানি জান্নাতের স্থায়ী নদীর পানি হয়। তোমার ভালোবাসা বেহেশতের দুধের নহর হয়।

ইবাদতের স্বাদ মধুর নহর হয়। তোমার উদ্দীপনা ও আসক্তি শরাবের নহর হয়।

যেমন তোমার বীর্য তোমার অধীন, তোমার নির্দেশে তা দূরন্ত সন্তানে পরিণত হয়।

তোমার নির্দেশে তোমার সন্তান দৌড়াদৌড়ি করে। তোমার আকর্ষণ আমাকে কর্মব্যস্ত রাখে।

এ জগতে তোমার নির্দেশের এই গুণ রয়েছে। ঐ জগতেও তোমার নির্দেশে প্রবাহিত নহর হবে।
ঐ জগতের বৃক্ষ তোমার নির্দেশ মেনে চলবে, কারণ সেই বৃক্ষ তোমার গুণাবলী দ্বারা বৃদ্ধি পাবে।

এ জগতে তোমার নির্দেশের এ গুণ রয়েছে, ঐ জগতে তোমার নির্দেশের ঐ ফল পাবে।

যখন তোমার হাত দ্বারা কোন নির্যাতিতের উপর আঘাত হবে, ঐ আঘাত থেকে তিক্ত যাক্কুম বৃক্ষ জন্ম নিবে।

তোমার ক্রোধাগ্নি যখন কারো অন্তরকে জ্বালাবে, জাহান্নামের আগুনের উপাদান তুমি তৈরী করবে।

তোমার ক্রোধাগ্নি এ জগতে যেমন মানুষকে জ্বালায়, তা থেকে উৎপাদিত ঐ জগতের আগুনও মানুষকে জ্বালাবে।

তোমার আগুন মানুষকে লক্ষ্য করে ধাবিত হয়। তা থেকে তৈরী আগুনও মানুষের উপর পতিত হয়।

যে সমস্ত কথা সাপ ও বিচ্ছুর ন্যায় দংশন করে, পরজগতে তা সাপ ও বিচ্ছুর ন্যায় কীট- পতঙ্গে পরিণত হয়।

মূলকথা

আয়াত, হাদীস ও উপরোক্ত উক্তিসমূহ দ্বারা উত্তমরুপে প্রমাণিত হলো যে, মানুষ যা কিছু আমল করে, তার অস্তিত্ব টিকে থাকে এবং তা একদিন উন্মোচিত হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সূরা যিলযাল৭-৮)

তাই বেহেশত ও দোযখ মানুষ নিজের হাতে উপার্জন করে।

এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ‘তাকদীর’ বা ভাগ্যের বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। কারণ, ‘তাকদীর’ সম্পর্কে একথা বলা হয়নি যে, কোন জিনিস বিনা কারণে ও বিনা উপাদানে হয়ে যায়। কখনো এরুপ নয়। বরং যা কিছু ভাগ্যে থাকে, তার উপাদান-উপকরণ প্রথমে সমবেত হয়, তারপর সে বিষয়টি সংঘটিত হয়। বেহেশত ও দোযখে প্রবেশের শক্তিশালী উপাদানসমূহের অন্যতম নেকআমল ও বদআমল। এজন্যই সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ) আমলের ফায়দা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থ: আমল করতে থাকো, কারণ, প্রত্যেকের জন্য সেই কাজই সহজ হয়, যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘অতএব যে দান করে এবং খোদাভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করবো। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করবো।’(সূরা আল লাইল ৫-১০)

সারকথা এই যে, এখানে যেমন আমল করবে, বরযখে ও কিয়ামতে তা থেকেই পর্দা অনাবৃত হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –

‘এখন তোমার কাছ থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি, ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতী্ক্ষ্ণ।’
(সূরা কাফ-২২)
হে আল্লাহ! আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং এতটুকু জাগৃতি ও চেতনা নসীব করুন যে, গুনাহ করার সময় তার প্রতিফল সামনে আসে। তারপর তা থেকে বাঁচারও তাওফীক দান করুন। আমীন।