উৎস:
ইসলাহী নেসাব: জাযাউল আ’মাল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

যত ইবাদত আছে, সবই উপকারী এবং যত পাপকাজ আছে সবই ক্ষতিকর। তারপরও মৌলিক কিছু আমল আছে, যেগুলো করা বা পরিহার করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলে অন্যান্য আমলের সংশোধনের অধিক আশা করা যায়। এগুলোকে আমি দু’টি অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করছি।

প্রথম অধ্যায়ঃ এমন কিছু আমলের বর্ণনা, যেগুলোর প্রতি যত্ন নিলে অন্যান্য আমলের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা করা যায়।
সেগুলোর একটি হলো, ইলমে দ্বীন অর্জন করা। চাই তা কিতাব পড়ে হোক বা আলিমদের সান্নিধ্যে থেকে হোক। বরং কিতাব পড়ে ইলম হাসিল করার পরও আলিমদের সান্নিধ্যে থাকা জরুরী। আমি আলিম দ্বারা এমন আলিমদেরকে বুঝাচ্ছি, যারা ইলম অনুপাতে আমল করে। যাদের মধ্যে শরীয়ত ও হাকীকতের সমন্বয় ঘটেছে। সুন্নাতের অনুসরণে পাগল। মধ্যপন্থী। অতিরঞ্জন ও অতিশৈথিল্য থেকে দূরে থাকে। মাখলুকের প্রতি স্নেহপরায়ণ। যাদের মধ্যে হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমি নেই।

যদিও বর্তমান যুগেও আল্লাহ তাআলার মেহেরবাণীতে এ ধরনের আলিম অনেক আছেন এবং
সর্বদা থাকবেন- যেমন আমাদের সরদার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওয়াদা রয়েছে-
‘আমার উম্মতের একটি দল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।’

এতদসত্ত্বেও বরকতস্বরুপ কিছু ‍বুযুর্গের নাম আমার এ পুস্তিকায় লিখছি, যেন অনুল্লেখিতদেরকে উল্লেখিতদের দ্বারা পরিমাপ করা যায় এবং যাদের অবস্থা এদের মত হবে, তাদের সংসর্গে থেকে মানুষ উপকৃত হতে পারে।

ক. পবিত্র মক্কায় হযরত সায়্যিদী, মুর্শিদী মাওলানা আলহাজ্জ আশ শাইখ মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ সাহেব (দাঃবাঃ)।
খ. গাঙ্গুহতে হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ সাহেব (দাঃবাঃ)।
গ. সাহারানপুরে জনাব মাওলানা আবুল হাসান সাহেব, মুহতামিম, জামে মসজিদ, সাহারানপুর।
ঘ. দেওবন্দে জনাব মাওলানা মাহমুদ হাসান সাহেব, প্রধান শিক্ষক, দেওবন্দ মাদরাসা।
ঙ. হযরত হাজী মুহাম্মাদ আবেদ সাহেব, ছাত্তা মসজিদ, দেওবন্দ।
চ. আম্বালায় হযরত সাঈ তাওয়াক্কুল শাহ সাহেব (দাঃবাঃ)
(আফসোস বর্তমানে এদের কেউই জীবিত নেই।)

এ ধরনের বুযুর্গদের সোহবত ও খেদমত যতটুকুই নসীব হোক তা অনেক বড় নেয়ামত ও অনেক বড় গনীমত। যদি প্রতিদিন সম্ভব না হয় তাহলে সপ্তাহে আধা ঘন্টা তাদের সানিধ্যে থাকাকে অবশ্যই জরুরী করে নিবে। তার বরকত নিজ চোখেই দেখতে পাবে।

সেগুলোর একটি হলো, নামায। যেভাবে সম্ভব পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত পড়বে। যতদূর সম্ভব জামাআতের সঙ্গে পড়ার চেষ্টা করবে। অপারগ হলে যেভাবে হোক নামায পড়ে নিবে, তাই গনীমত। এতে করে আল্লাহর দরবারের সাথে একটি সম্পর্ক ও যোগসূত্র প্রতিষ্ঠিত থাকবে। এর বরকতে ইনশাআল্লাহ তাআলা তার অবস্থা সংশোধিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয়ই নামায যাবতীয় অশ্লীল ও অসৎকর্ম হতে বিরত রাখে।’ (সূরা আনকাবূত-৪৫)

সেগুলোর একটি মানুষের সাথে কম কথা বলা ও কম মেলামেশা করা। যা কিছু বলার চিন্তা-ভাবনা করে বলবে। শত-সহস্র বিপদ থেকে নিরাপদ থাকার এটি একটি উত্তম উপায়।

এগুলোর একটি ‘মুহাসাবা ও মুরাকাবা’। অর্থাৎ, অধিকাংশ সময় একথা খেয়াল রাখবে যে, আমি আমার মালিকের সামনে অবস্থান করছি। আমার সব কথা, কাজ ও অবস্থা তিনি দেখছেন। এটি হলো ‘মুরাকাবা’। আর ‘মুহাসাবা’ হলো, কোন একটি সময়-যেমন ঘুমানোর পূর্বে একাকী বসে সারাদিনের কাজের কথা স্মরণ করে এরূপ ধারণা করবে যে, এখন আমার হিসাব হচ্ছে, কিন্ত্ত আমি উত্তর দিতে পারছি না।

সেগুলোর একটি হলো, ‘তাওবা’ ও ‘ইস্তেগফার’ করা। যখনই কোন ভুল হয়ে যাবে, বিলম্ব করবে না। কোন সময় বা কোন জিনিসের অপেক্ষা করবে না। অবিলম্বে নির্জন স্থানে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে খুব মাফ চাবে। কান্না আসলে কাঁদবে। তা না হলে কান্নার ভান করবে। এখানে ছয়টি বিষয়ের আলোচনা করা হলো: ক. ইলম, খ. আলিমদের সান্নিধ্য, গ. পাঁচ ওয়াক্ত নামায, ঘ. কম কথা বলা ও কম মেলামেশা করা, ঙ. মুহাসাবা ও মুরাকাবা, চ. তওবা ও ইস্তিগফার। ইনশাআল্লাহ এ ছয় বিষয়ে পাবন্দী করলে- যেগুলো কোন কঠিন কাজও নয়-সমস্ত ইবাদতের দরজা খুলে যাবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ এমন সব গুনাহের বর্ণনা, যেগুলো থেকে বিরত থাকলে আল্লাহর মেহেরবাণীতে অন্যান্য প্রায় সমস্ত গুনাহ থেকে নাজাত পাওয়া যায়

সেগুলোর একটি হলো, ‘গীবত’। এতে দুনিয়া ও আখিরাতে নানাপ্রকারের বিপর্যয় যে, সৃষ্টি হয় তা সুস্পষ্ট। এতে বর্তমানে মানুষ খুব লিপ্ত। এ থেকে বাঁচার সহজ পন্থা এই যে, তীব্র প্রয়োজন ছাড়া কারো ভালো-মন্দ কোন ধরনের আলোচনা করবেও না, শুনবেও না। নিজের জরুরী কাজে লিপ্ত থাকবে। আলোচনা করতে হলে নিজেরটাই করবে। নিজের ধান্দাই কি কম যে, অন্যদের আলোচনার সুযোগ পায়?

সেগুলোর একটি হলো, ‘জুলুম’। চাই তা জানের হোক, বা মালের হোক, বা মুখের হোক। যেমন কারো হক আত্মসাৎ করলো, তা কম হোক বা বেশী হোক, বা কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলো, বা কারো মানহানী করলো।

সেগুলোর একটি হলো নিজেকে বড় মনে করা এবং অন্যদেরকে হেয় মনে করা। জুলুম, গীবত ইত্যাদি পাপকাজ এ রোগ থেকেই সৃষ্টি হয়। হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, ক্রোধ ইত্যাদি রোগও এ থেকেই সৃষ্টি হয়।

সেগুলোর একটি হলো, ‘ক্রোধ’। রাগ হয়ে অনুতপ্ত হতে হয়নি, এমন কখনো মনে পড়ে না। কারণ ক্রোধের অবস্থায় বিবেক-বুদ্ধি পরাভূত হয়ে যায়। তাই তখন যে কাজই সংঘটিত হয় তা বিবেক পরিপন্থীই হয়। যা বলার ছিলো না, তা বলে ফেলে। যা করার ছিলো না তা হয়ে যায়। গোস্বা থেমে যাওয়ার পর যার আর কোন ক্ষতিপূরণ সম্ভব হয় না। কখনো কখনো সারাজীবনের জন্য মনোবেদনায় পড়তে হয়।

সেগুলোর একটি হলো, ‘গায়রে মাহরাম’। তথা পরনারী বা পরপুরুষের সঙ্গে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখা। তাকে দেখা, আনন্দ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে কথা বলা, একাকীত্বে তার পাশে বসা, তাকে খুশী করার জন্য তার মনমত নিজের বেশভূষা ও কথা-কাজকে সাজানো বা মোলায়েম করা। আমি সত্যিই বলছি, এ ধরনের সম্পর্কের দ্বারা যে সমস্ত কুপরিণতির সৃষ্টি হয় এবং যে সমস্ত বিপদ দেখা দেয়, তা লিখে শেষ করা যাবে না। ইনশাআল্লাহ, অন্য কোন পুস্তিকায় বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত করে লিখবো।

সেগুলোর একটি হলো, সন্দেহযুক্ত বা হারাম খাবার খাওয়া। এর দ্বারা সব ধরনের অন্ধকার ও মনের কালিমা সৃষ্টি হয়। হারাম মাল খাদ্যরুপে সমস্ত অঙ্গে ও শিরায় বিস্তার লাভ করে। তাই যেমন খাদ্য হবে, তেমন তার প্রভাব সমস্ত অঙ্গে সৃষ্টি হবে। আর সে মতোই অঙ্গ দ্বারা কর্ম সংঘটিত হবে।

উপরোক্ত এ ছয়টি গুনাহ দ্বারাই অধিকাংশ গুনাহ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এগুলো পরিত্যাগ করলে ইনশাআল্লাহ অন্যগুলো পরিত্যাগ করা সম্ভব হবে। বরং এতে করে আপনা-আপনিই ছুটে যাওয়ার আশা করা যায়। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তাওফীক দান দাও।

এখন জনসাধারণের কতিপয় সন্দেহের উত্তর দেওয়া হচ্ছে। যেগুলোর কারণে তারা নিজেরাও ধোঁকায় পড়ে থাকে এবং অন্যদেরকেও ধোঁকায় ফেলে থাকে। যখনই তাদেরকে নিয়মিতভাবে ইবাদত করার এবং গুনাহ থেকে বাঁচার কথা বলা হয়, তখনই তারা এ সমস্ত প্রশ্ন ও সন্দেহকেই পেশ করে থাকে। এ সন্দেহগুলো দু’ধরনের। প্রথমত, ঐ সমস্ত গুনাহ, যেগুলোর দ্বারা স্পষ্ট কুফুরী হয়ে থাকে। যেমন এরুপ সন্দেহ করা যে, দুনিয়া নগদ আর আখিরাত হলো বাকী। আর নগদ বাকীর চেয়ে উত্তম। বা এরুপ সন্দেহ করা যে, দুনিয়ার মজা নিশ্চিত আর আখিরাতের মজা অনিশ্চিত। তাই অনিশ্চিতের আশায় নিশ্চিতকে কিভাবে ছেড়ে দিবো। যেমন জনৈক কবি বলেছেন-
‘এখন তো মজায় কাটুক, পরিণতির খবর আল্লাহ জানে।’

যেহেতু এখন আমরা ঈমানদারদেরকে লক্ষ্য করে কথা বলছি, তাই এ জাতীয় সন্দেহকে এড়িয়ে যাচ্ছি। (তাছাড়া এ সমস্ত সন্দেহ যে, অর্থহীন তা বিবেকবান বলতেই অবগত। কারণ, আখিরাতের অস্তিত্ব অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা প্রমাণিত। যদি কারো এ সমস্ত বিষয় প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন থাকে তাহলে সেগুলো প্রমাণিত করার জন্য আল্লাহর মেহেরবাণীতে যৌক্তিক প্রমাণসমূহ সর্বদাই বিদ্যমান রয়েছে। আখিরাতের বিষয় প্রমাণিত হওয়ার পর নগদকে বাকীর উপর নিঃশর্তভাবে প্রাধান্য দেওয়া নিছক ভ্রান্তি। এ নিয়ম তো তখন চলতে পারে, যখন বাকী ও নগদ মানে ও পরিমাণে সমান সমান হয়। অন্যথায় জাগতিক সমস্ত বিষয়ে বাকীকে নগদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ক্রেতার উপর একটু বিশ্বাস থাকলে সানন্দে এক পয়সার জিনিস দু্‌ই পয়সায় বাকীতে বিক্রি করে। তখন এ নিয়ম কোথায় যায়।

দ্বিতীয় প্রকারের ঐ সব সন্দেহ, যেগুলোর কারণ অজ্ঞতা ও উদাসিনতা। এখানে সেগুলোর উত্তর দেওয়াই উদ্দেশ্য। কয়েকটি অনুচ্ছেদে সেগুলো লিখছি। আল্লাহর তাওফীক আমাদের ভরসা।

অনুচ্ছেদ-১: একটি সন্দেহ এই হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা বড় ক্ষমাশীল, বড় দয়ালু। আমার গুনাহের সেখানে কি গুরুত্ব আছে। তার উত্তর এই যে, নিঃসন্দেহে তিনি বড় ক্ষমাশীল ও বড় দয়ালু। কিন্ত্ত তিনি তো কঠিন শাস্তিদাতা এবং প্রতিশোধ গ্রহণকারীও। তুমি কি করে জানলে যে, তোমার অবশ্যই ক্ষমা হবে? প্রতিশোধ গ্রহণ ও শাস্তি প্রদানও তো হতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, তিনি ঐ ব্যক্তির জন্য ক্ষমাশীল এবং দয়ালু, যে অতীতের গুনাহ থেকে তাওবা করে এবং ভবিষ্যতে আমলের সংশোধন করে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

‘অতঃপর যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করেছে, তারপর তারা তাওবা করেছে এবং নিজেদের কর্ম সংশোধন করেছে, তোমার প্রতিপালক তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
(সূরা নাহাল-১১৯)
আর যে তাওবা ছাড়া মারা যাবে, সে গুনাহের পরিমাণ অনুপাতে শাস্তির যোগ্য হবে, আর আল্লাহর অনুগ্রহ কেউ ঠেকাতে পারবে না, কিন্ত্ত এ ব্যক্তির নিকট কি প্রমাণ রয়েছে যে, আমার সাথে ক্ষমার ব্যবহারই করা হবে?

অনুচ্ছেদ-২: একটি সন্দেহ এই হয়ে থাকে যে, এতো তাড়াহুড়ার কি আছে? ভবিষ্যতে তাওবা করে নেবো। তাকে এর উত্তরে বলা হবে যে, তুমি কি করে জানলে যে, তুমি আরো বেঁচে থাকবে? হতে পারে রাতে ঘুমুতে ঘুমুতেই তুমি মারা গেলে বা জীবিত থাকলেও তাওবার তাওফীক হলো না। মনে রেখো, গুনাহ যত বাড়তে থাকে, মনের অন্ধকারও তত বাড়তে থাকে। দিনে দিনে তাওবার তাওফীক কম হয়ে যায়। এমনকি বেশীর ভাগ বিনা তাওবায় মারা যায়।

অনুচ্ছেদ-৩: একটি সন্দেহ এই হয় যে, এখন তো গুনাহ করি, তারপর তাওবা করে মাফ
করিয়ে নিবো। এ ধরনের ব্যক্তিকে বলা উচিত যে, তোমার আঙ্গুলটা একটু আগুনের মধ্যে দাও, পরে আমরা মলম লাগিয়ে দেবো। এটা তো কখনোই সহ্য করবে না। তাই আফসোস হয় যে, গুনাহের ব্যাপারে কিভাবে নির্ভীক হয়। সে ব্যক্তি কিভাবে জানলো যে, তাওবার তাওফীক অবশ্যই হবে। বা তাওবা করলেও আল্লাহর দায়িত্বে তা কবুল করা জরুরী হবে। তাছাড়া কতিপয় গুনাহ এমন রয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহর কাছে তাওবা করাই যথেষ্ট নয়, বরং পাওনাদারের থেকে মাফ নেওয়াও জরুরী।

অনুচ্ছেদ-৪: একটি সন্দেহ এই হয় যে, আমরা কি করবো? আমাদের ভাগ্যেই এমন লেখা আছে। এ প্রশ্নটি খুব সস্তা। ছোট বড় সবাই এ থেকে ফায়দা লুটতে চায়। বন্ধুগণ! একটু ইনসাফ করা উচিত যে, যখন গুনাহ করা হয়, তখন কি এ উদ্দেশ্যেই করা হয় যে, ভাগ্যে যেহেতু লেখা আছে তাই সে অনুপাতেই কাজ করি। মোটেই নয়। তখন তো একথা মনেই থাকে না। গুনাহ শেষ করে অবসর সময়ে এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আরম্ভ করা হয়। ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখলে এসব ব্যাখ্যার অর্থহীনতা নিজে নিজেই বুঝতে পারবে। দ্বিতীয় কথা এই যে, ভাগ্যের উপরে যদি এতই ভরসা হয়ে থাকে তাহলে জাগতিক বিষয়ে এ বিশ্বাসের উপর নির্ভরতা থাকে না কেন? কেউ তোমার জানমালের ক্ষতি করলে মোটেই তাকে তিরস্কার করো না? তখনও বুঝে নাও যে, ভাগ্যেই এরূপ লেখা ছিলো যে, সে অনিষ্ট করবে। ক্ষতি করবে। তথন ভাগ্যকে অস্বীকার করো। কিন্ত্ত গুনাহ ছাড়ার কথা বললে এবং নেক কাজ করার কথা বললে ভাগ্যের উপর সর্বাধিক ঈমান তোমারই হয়!

অনুচ্ছেদ-৫: একটি সন্দেহ এই হয় যে, যদি ভাগ্যে জান্নাত লেখা থাকে তাহলে জান্নাতে যাবো, আর দোযখ লেখা থাকলে দোযখে যাবো। পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করা অর্থহীন। এ ধরনের লোকদেরকে বলা উচিত যে, তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জাগতিক ব্যাপারে কেন চেষ্টা-তাদবীর করো? খাওয়ার জন্য কেন এত পরিশ্রম করো? বীজ বপণ করো, হালচাষ করো। শস্য পেষো, আটা ছানো, খামিরা তৈরী করো, পাকাও, লোকমা বানিয়ে মুখের মধ্যে দাও, চাবাও, গেলো-এগুলো কিছুই কোরনা। ভাগ্যে থাকলে নিজে নিজেই তৈরী হয়ে পেটে চলে যাবে। চাকুরী কেন করো? ক্ষেত-খামার কেন করো? এ কবিতা কেন পড়ো?

‘রিযিক নিঃসন্দেহে পৌঁছবে। কিন্ত্ত শর্ত হলো, তার দরজায় তাকে তালাশ করতে হবে।’

সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা হলে বিবাহ কেন করো? তাই তাকদীর প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও এসব বিষয়ের জন্য যেমন বিশেষ উপকরণ সংগ্রহ করো, তেমনিভাবে আখেরাতের নিয়ামতরাজির জন্যও তার উপায়-নেকআমলসমূহ-সংগ্রহ করা জরুরী।

অনুচ্ছেদ-৬: একটি ভ্রান্তি এই হয়ে থাকে যে, হাদীস শরীফে আছে-
‘আমি আমার বান্দার ধারণা অনুপাতে কাজ করি।’

আমাদের প্রভুর সঙ্গে আমাদের সুধারণা রয়েছে। তাই অবশ্যই আমাদের সঙ্গে সদাচারণ করা হবে। খুব মনে রাখা উচিত যে, সুধারণা ও আশা রাখার অর্থ এই যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে তার ফল পাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার দয়ার প্রতি নজর রাখবে। নিজের চেষ্টার উপর নির্ভর করবে না। আর যে উপায়ই গ্রহণ করলো না, তারটা সুধারণা নয় বরং ধোঁকা ও আত্মপ্রবঞ্চনা। এর একটি স্থূল দৃষ্টান্ত এই যে, বীজ বপন করে প্রতীক্ষায় থাকবে যে, এথন আল্লাহর অনুগ্রহে ফসল হবে। এটা হলো আশা। আর যদি বীজই বপণ না করে, আর এই আশায় বসে থাকে যে, এখন ফসল হবে। তাহলে এটা নিছক পাগলামী এবং ধোঁকা। যার পরিণতি আক্ষেপ ও অনুতাপ ছাড়া কিছুই নয়।

অনুচ্ছেদ-৭: একটি ধোঁকা এই হয়ে থাকে যে, আমি অমুক বুযুর্গের সন্তান বা অমুক বুযু্র্গের মুরীদ বা অমুক জীবিত বা মৃত বুযুর্গকে ভালোবাসি তাই আমি যা কিছুই করি না কেন আল্লাহর প্রিয় এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত হবো।

বন্ধুগণ! যদি এ ধরনের সম্পর্কই যথেষ্ট হতো, তাহলে জগতসম্রাট মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আদরের কন্যাকে কখনোই বলতেন না-

অর্থ: হে ফাতিমা (রাযিঃ)! তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও, কারণ, আমি আল্লাহর কাছে কোনই কাজে আসবো না। অর্থাৎ, যদি নিজের কাছে ইলম ও আমলের পুঁজি না থাকে তাহলে শুধু সম্পর্ক যথেষ্ট নয়। আর যদি ঈমান ও তাকওয়ার সাথে উঁচু সম্পর্কও থাকে তাহলে তো সুবহানাল্লাহ! সোনায় সোহাগা। কিয়ামতের দিন তখন এ সম্পর্কও উপকারী হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সঙ্গে তাদের সন্তান-সন্ততিকে মিলিত করবো এবং তাদের আমলের কিছুই কম করবো না।’ (সূরা তূর-২১)

অর্থাৎ, পূর্বপুরুষদের গ্রহণযোগ্যতার বরকতে সন্তানদেরকেও ঐ স্তরেই পৌঁছিয়ে দিবো এবং বাপ-দাদার আমলের মধ্যেও কোন কমতি করবো না।

অনুচ্ছেদ-৮: কারো কারো এই সন্দেহ হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলার আমাদের ইবাদত-বন্দেগীর কি প্রয়োজন?

বন্ধুগণ! একথা সত্য যে, আল্লাহ তাআলার কারো কোন আমলের প্রয়োজন নেই এবং তার কোন লাভও নেই। কিন্ত্ত আপনাদেরও কি এ সমস্ত লাভের প্রয়োজন নেই, যেগুলো নেক আমল করার দ্বারা পাওয়া যায়? আপনাদেরও কি নেক আমলের কোন উপকার নেই? সারকথা এই যে, আমল তো আপনাদের লাভের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার লাভের জন্য নয়। যদিও আল্লাহ তাআলার এর কোন প্রয়োজন নেই, কিনত্ত আপনারা তো প্রয়োজনমুক্ত নন। এর দৃষ্টান্ত তো ঠিক এমনই যে, কোন দয়ালু ডাক্তার কোন রোগীর প্রতি দয়া করে ঔষধ দেয় আর ঐ রোগী- যে তার নিজের জানের শত্রু-একথা বলে তা অগ্রাহ্য করে যে, সাহেব! ঔষধ পান করলে ডাক্তারের কি লাভ। ভালো মানুষ, ডাক্তারের কি লাভ হবে, এতে তোমার লাভ! তুমি রোগমুক্ত হবে!

অনুচ্ছেদ-৯: কতক নিরস আলেমের এই সন্দেহ হয় যে, আমরা অন্যদেরকে ওয়ায-উপদেশ দিয়ে থাকি। তাদের আমলের সওয়াবও আমরা পেয়ে থাকি। আর তা এত অধিক পরিমাণ যে, আমাদের সমস্ত গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। বা এ সন্দেহ হয়ে থাকে যে, আমরা এমন আমল জানি, যেগুলো করলে শত শত বছরের গুনাহ মাফ হয়। যেমন ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ প্রতিদিন একশ’বার পড়া বা আরাফা (যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ) বা আশুরার রোযা রাখা বা মক্কার লোকেরা তাওয়াফ করা ইত্যাদি।

বন্ধুগণ! স্থূল কথা যে, যদি এ সমস্ত আমলই যথেষ্ট হয়, তাহলে শরীয়তের অন্য সব আদেশ-নিষেধ অর্থহীন হয়ে যায়। তাছাড়া হাদীসের মধ্যে সুস্পষ্ট এসেছে-

অর্থাৎ, এ সমস্ত আমল তখন গুনাহের কাফফারা হবে, যখন কবীরাহ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। বাকী রইল তাদের এ কথা যে, আমরা মানুষদেরকে ওয়ায-উপদেশ দিয়ে থাকি। বন্ধুগণ! এমন ব্যক্তির উপর তো অধিক বিপদ আসবে। হাদীস শরীফে বদআমল বক্তা সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ। তাই তা আর লেখার প্রয়োজন মনে করছি না।

অনুচ্ছেদ-১০: একটি সন্দেহ অজ্ঞ পীর-ফকিরদের এই হয়ে থাকে যে, আমরা সাধনার ফলে ‘ফানা’এর স্তরে পৌঁছেছি। আমরা সম্পূর্ণরুপে বিলীন হয়ে গেছি। আমাদের নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নেই। যা কিছু করে সেই করে। এ জাতীয় আরো অনেক প্রলাপ বকে থাকে, যার দ্বারা কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কেউ বলে যে, সাগরের মাঝে বিন্দু বিলীন হয়ে গেছে। কেউ বলে যে, সমুদ্রকে পেশাবের ফোঁটা নাপাক করতে পারে না। কেউ বলে যে, আমরা নিজেরাই তো খোদা, আমাদের আবার ইবাদত কিসের, আমাদের আবার পাপ কিসের? কেউ বলে যে, আসল উদ্দেশ্য আল্লাহকে স্মরণ করা। নামায, রোযা বাইরের খাঁচা মাত্র। এগুলো বাহ্যিক নিয়ম, শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সমস্ত বাজে কথার কারণ তাদের অজ্ঞতা। এ ধরনের লোকদের ‘মাকামে’র হাকীকত সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। এরা আল্লাহর পথ পাওয়া ও আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার তো প্রশ্নই ওঠে না। এগুলো একত্ববাদ নিয়ে বাড়াবাড়ির ফল।

ইনশাআল্লাহ, অন্য কোন পুস্তিকায় এ ব্যাপারে সবিস্তারে গবেষণামূলকভাবে লেখা হবে। এ স্থলে এ মোটা কথাটুকু বোঝা উচিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক কেউ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছেনি, একত্ববাদী হয়নি এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে অধিক কেউ আজ পর্যন্ত তা’লীম পায়নি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ)এর খোদাভীতি, তাওবা, ইস্তিগফার, আমলের ব্যাপারে পরিশ্রম, নফসের বিরুদ্ধে চলার গুরুত্ব এবং বদআমলের শাস্তির বিবরণ দেখে নেওয়া এ সমস্ত সন্দেহ নিরসনের জন্য খুবই যথেষ্ট।

সেগুলোর একটি হলো, ‘গীবত’। এতে দুনিয়া ও আখিরাতে নানা প্রকারের বিপর্যয় যে, সৃষ্টি হয় তা সুস্পষ্ট। এতে বর্তমানে মানুষ খুব লিপ্ত। এ থেকে বাঁচার সহজ পন্থা এই যে, তীব্র প্রয়োজন ছাড়া কারো ভালো-মন্দ কোন ধরনের আলোচনা করবেও না, শুনবেও না। নিজের জরুরী কাজে লিপ্ত থাকবে। আলোচনা করতে হলে নিজেরটাই করবে। নিজের ধান্দাই কি কম যে, অন্যদের আলোচনার সুযোগ পায়?

সেগুলোর একটি হলো, ‘জুলুম’। চাই তা জানের হোক, বা মালের হোক, বা মুখের হোক। যেমন কারো হক আত্মসাৎ করলো, তা কম হোক বা বেশী হোক, বা কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলো, বা কারো মানহানী করলো।

সেগুলোর একটি হলো নিজেকে বড় মনে করা এবং অন্যদেরকে হেয় মনে করা। জুলুম, গীবত ইত্যাদি পাপকাজ এ রোগ থেকেই সৃষ্টি হয়। হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, ক্রোধ ইত্যাদি রোগও এ থেকেই সৃষ্টি হয়।

সেগুলোর একটি হলো, ‘ক্রোধ’। রাগ হয়ে অনুতপ্ত হতে হয়নি, এমন কখনো মনে পড়ে না। কারণ, ক্রোধের অবস্থায় বিবেক-বুদ্ধি পরাভূত হয়ে যায়। তাই যখন যে কাজই সংঘটিত হয় তা বিবেক পরিপন্থীই হয়। যা বলার ছিলো না, তা বলে ফেলে। যা করার ছিলো না তা হয়ে যায়। গোস্বা থেমে যাওয়ার পর যার আর কোন ক্ষতিপূরন সম্ভব হয় না। কখনো কখনো সারাজীবনের জন্য মনোবেদনায় পড়তে হয়।

সেগুলোর একটি হলো, ‘গায়রে মাহরাম’। তথা পরনারী বা পরপুরুষের সঙ্গে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখা। তাকে দেখা, আনন্দ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে কথা বলা, একাকীত্বে তার পাশে বসা, তাকে খুশী করার জন্য তার মনমত নিজের বেশভুষা ও কথা-কাজকে সাজানো বা মোলায়েম করা। আমি সত্যিই বলছি, এ ধরনের সম্পর্কের দ্বারা যে সমস্ত কুপরিণতির সৃষ্টি হয় এবং যে সমস্ত বিপদ দেখা দেয়, তা লিখে শেষ করা যাবে না। ইনশাআল্লাহ, অন্য কোন পুস্তিকায় বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত করে লিখবো।

সেগুলোর একটি হলো, সন্দেহযুক্ত বা হারাম খাবার খাওয়া। এর দ্বারা সব ধরনের অন্ধকার ও মনের কালিমা সৃষ্টি হয়। হারাম মাল খাদ্যরুপে সমস্ত অঙ্গে ও শিরায় বিস্তার লাভ করে।
তাই যেমন খাদ্য হবে, তেমন তার প্রভাব সমস্ত অঙ্গে সৃষ্টি হবে। আর সে মতোই অঙ্গ দ্বারা কর্ম সংঘটিত হবে।

উপরোক্ত এ ছয়টি গুনাহ দ্বারাই অধিকাংশ গুনাহ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এগুলো পরিত্যাগ করলে ইনশাআল্লাহ অন্যগুলো পরিত্যাগ করা সম্ভব হবে। বরং এতে করে আপনা-আপনিই ছু্টে যাওয়ার আশা করা যায়।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তাওফীক দাও।

এখন জনসাধারণের কতিপয় সন্দেহের উত্তর দেওয়া হচ্ছে। যেগুলোর কারণে তারা নিজেরাও ধোঁকায় পড়ে থাকে এবং অন্যদেরকেও ধোঁকায় ফেলে থাকে। যখনই তাদেরকে নিয়মিতভাবে ইবাদত করার এবং গুনাহ থেকে বাঁচার কথা বলা হয়, তখনই তারা এ সমস্ত প্রশ্ন ও সন্দেহকেই পেশ করে থাকে। এ সন্দেহগুলো দু’ধরনের। প্রথমত, ঐ সমস্ত গুনাহ, যেগুলোর দ্বারা স্পষ্ট কুফরী হয়ে থাকে। যেমন এরূপ সন্দেহ করা যে, দুনিয়া নগদ আর আখিরাত হলো বাকী। আর নগদ বাকীর চেয়ে উত্তম। বা এরুপ সন্দেহ করা যে, দুনিয়ার মজা নিশ্চিত আর আখিরাতের মজা অনিশ্চিত। তাই অনিশ্চিতের আশায় নিশ্চিতকে কিভাবে ছেড়ে দিবো। যেমন জনৈক কবি বলেছেন-
‘এখন তো মজায় কাটুক, পরিণতির খবর আল্লাহ জানে।’

যেহেতু এখন আমরা ঈমানদারদেরকে লক্ষ্য করে কথা বলছি, তাই এ জাতীয় সন্দেহকে এড়িয়ে যাচ্ছি।(তাছাড়া এ সমস্ত সন্দেহ যে, অর্থহীন তা বিবেকবান বলতেই অবগত। কারণ, আখিরাতের অস্তিত্ব অকাট্য প্রমানাদি দ্বারা প্রমাণিত। যদি কারো এ সমস্ত বিষয় প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন থাকে তাহলে সেগুলো প্রমাণিত করার জন্য আল্লাহর মেহেরবাণীতে যৌক্তিক প্রমাণসমূহ সর্বদাই বিদ্যমান রয়েছে। আখিরাতের বিষয় প্রমাণিত হওয়ার পর নগদকে বাকীর উপর নিঃশর্তভাবে প্রাধান্য দেওয়া নিছক ভ্রান্তি। এ নিয়ম তো তখন চলতে পারে, যখন বাকী ও নগদ মানে ও পরিমাণে সমান সমান হয়। অন্যথায় জাগতিক সমস্ত বিষয়ে বাকীকে নগদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ক্রেতার উপর একটু বিশ্বাস থাকলে সানন্দে এক পয়সার জিনিস দুই পয়সায় বাকীতে বিক্রি করে। তখন এ নিয়ম কোথায় যায়।

দ্বিতীয় প্রকারের ঐ সব সন্দেহ, যেগুলোর কারণ অজ্ঞতা ও উদাসিনতা। এখানে সেগুলোর উত্তর দেওয়াই উদ্দেশ্য। কয়েকটি অনুচ্ছেদে সেগুলো লিখছি। আল্লাহর তাওফীক আমাদের ভরসা।

অনুচ্ছেদ-১: একটি সন্দেহ এই হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা বড় ক্ষমাশীল, বড় দয়ালু। আমার গুনাহের সেখানে কি গুরুত্ব আছে। তার উত্তর এই যে, নিঃসন্দেহে তিনি বড় ক্ষমাশীল ও বড় দয়ালু। কিন্ত্ত তিনি তো কঠিন শাস্তিদাতা এবং প্রতিশোধ গ্রহণকারীও। তুমি কি করে জানলে যে, তোমার অবশ্যই ক্ষমা হবে? প্রতিশোধ গ্রহণ ও শাস্তি প্রদানও তো হতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, তিনি ঐ ব্যক্তির জন্য ক্ষমাশীল এবং দয়ালু, যে অতীতের গুনাহ থেকে তাওবা করে এবং ভবিষ্যতে আমলের সংশোধন করে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘অতঃপর যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করেছে, তারপর তারা তাওবা করেছে এবং নিজেদের কর্ম সংশোধন করেছে, তোমার প্রতিপালক তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
(সূরা নাহাল-১১৯)
আর যে তাওবা ছাড়া মারা যাবে, সে গুনাহের পরিমাণ অনুপাতে শাস্তির যোগ্য হবে, আর আল্লাহর অনুগ্রহ কেউ ঠেকাতে পারবে না, কিন্ত্ত এ ব্যক্তির নিকট কি প্রমাণ রয়েছে যে, আমার সাথে ক্ষমার ব্যবহারই করা হবে?

অনুচ্ছেদ-২: একটি সন্দেহ এই হয়ে থাকে যে, এতো তাড়াহুড়ার কি আছে? ভবিষ্যতে তাওবা করে নেবো। তাকে এর ‍উত্তরে বলা হবে যে, তুমি কি করে জানলে যে, তুমি আরো
বেঁচে থাকবে? হতে পারে রাতে ঘুমুতে ঘুমুতেই তুমি মারা গেলে বা জীবিত থাকলেও তাওবার তাওফীক হলো না। মনে রেখো, গুনাহ যত বাড়তে থাকে, মনের অন্ধকারও তত বাড়তে থাকে। দিনে দিনে তাওবার তাওফীক কম হয়ে যায়। এমনকি বেশীরভাগ বিনা তাওবায় মারা যায়।

অনুচ্ছেদ-৩: একটি সন্দেহ এই হয় যে, এখন গুনাহ করি, তারপর তাওবা করে মাফ করিয়ে মাফ করিয়ে নিবো। এ ধরনের ব্যক্তিকে বলা উচিত যে, তোমার আঙ্গুলটা একটু আগুনের মধ্যে দাও, পরে আমরা মলম লাগিয়ে দেবো। এটা তো কখনোই সহ্য করবে না। তাই আফসোস হয় যে, গুনাহের ব্যাপারে কিভাবে নির্ভীক হয়। সে ব্যক্তি কিভাবে জানলো যে, তাওবার তাওফীক অবশ্যই হবে। বা তাওবা করলেও আল্লাহর দায়িত্বে তা কবুল করা জরুরী হবে। তাছাড়া কতিপয় গুনাহ এমন রয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহর কাছে তাওবা করাই যথেষ্ট নয়, বরং পাওনাদের থেকে মাফ নেওয়াও জরুরী।

অনুচ্ছেদ-৪: একটি সন্দেহ এই হয় যে, আমরা কি করবো? আমাদের ভাগ্যেই এমন লেখা আছে। এ প্রশ্নটি খুব সস্তা। ছোট বড় সবাই এ থেকে ফায়দা লুটতে চায়। বন্ধুগণ! একটু ইনসাফ করা উচিত যে, যখন গুনাহ করা হয়, তখন কি এ উদ্দেশ্যেই করা হয় যে, ভাগ্যে যেহেতু লেখা আছে তাই সে অনুপাতে কাজ করি। মোটেই নয়। তখন তো একতা মনেই থাকে না। গুনাহ শেষ করে অবসর সময়ে এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আরম্ভ করা হয়। ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখলে এসব ব্যাখ্যার অর্থহীনতা নিজে নিজেই বুঝতে পারবে। দ্বিতীয় কথা এই যে, ভাগ্যের উপরে যদি এতই ভরসা হয়ে থাকে তাহলে জাগতিক বিষয়ে এ বিশ্বাসের উপর নির্ভরতা থাকে না কেন? কেউ তোমার জানমালের ক্ষতি করলে মোটেই তাকে তিরস্কার করো না? তখনও বুঝে নাও যে, ভাগ্যেই এরুপ লেখা ছিলো যে, সে অনিষ্ট করবে। ক্ষতি করবে। তখন ভাগ্যকে অস্বীকার করো। কিন্ত্ত গুনাহ ছাড়ার কথা বললে এবং নেক কাজ করার কথা বললে ভাগ্যের উপর সর্বাধিক ঈমান তোমারই হয়!

অনুচ্ছেদ-৫: একটি সন্দেহ এই হয় যে, যদি ভাগ্যে জান্নাত লেখা থাকে তাহলে জান্নাতে যাবো, আর দোযখ লেখা থাকলে দোযখে যাবো। পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করা অর্থহীন। এ ধরনের লোকদেরকে বলা উচিত যে, তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জাগতিক ব্যাপারে কেন চেষ্টা-তাদবীর করো? খাওয়ার জন্য কেন এত পরিশ্রম করো? বীজ বপণ করো, হালচাষ করো। শস্য পেষো, আটা ছানো, খামিরা তৈরী করো, পাকাও, লোকমা বানিয়ে মুখের মধ্যে দাও, চাবাও, গেলো-এগুলো কিছুই কোরনা। ভাগ্যে থাকলে নিজে নিজেই তৈরী হয়ে পেটে চলে যাবে। চাকুরী কেন করো? ক্ষেত-খামার কেন করো? এ কবিতা কেন পড়ো?
‘রিযিক নিঃসন্দেহে পৌঁছবে। কিন্ত্ত শর্ত হলো, তার দরজায় তাকে তালাশ করতে হবে।’
সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা হলে বিবাহ কেন করো? তাই তাকদীর প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও এসব বিষয়ের জন্য যেমন বিশেষ উপকরণ সংগ্রহ করো, তেমনিভাবে আখেরাতের নিয়ামতরাজির জন্যও তার উপায়-নেকআমলসমূহ-সংগ্রহ করা জরুরী।

অনুচ্ছেদ-৬: একটি ভ্রান্তি এই হয় থাকে যে, হাদীস শরীফে আছে-
‘আমি আমার বান্দার ধারনা অনুপাতে কাজ করি।’

আমাদের প্রভুর সঙ্গে আমাদের সুধারণা রয়েছে। তাই অবশ্যই আমাদের সঙ্গে সদাচারণ করা হবে। খুব মনে রাখা উচিত যে, সুধারণা ও আশা রাখার অর্থ এই যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে তার ফল পাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার দয়ার প্রতি নজর রাখবে। নিজের চেষ্টার উপর নির্ভর করবে না। আর যে উপায়ই গ্রহণ করলো না, তারটা সুধারণা নয় বরং ধোঁকা ও আত্মপ্রবঞ্চনা্ এর একটি স্থূল দৃষ্টান্ত এই যে, বীজ বপন করে প্রতীক্ষায় থাকবে যে, এখন আল্লাহর অনুগ্রহে ফসল হবে। এটা হলো আশা। আর যদি বীজই বপণ না করে, আর এই আশায় বসে থাকে যে, এখন ফসল হবে। তাহলে এটা নিছক পাগলামী এবং ধোঁকা। যার পরিণতি আক্ষেপ ও অনুতাপ ছাড়া কিছুই নয়।

অনুচ্ছেদ-৭: একটি ধোঁকা এই হয়ে থাকে যে, আমি অমুক বুযুর্গের সন্তান বা অমুক বুযু্র্গের মুরীদ বা অমুক জীবিত বা মৃত বুযুর্গকে ভালোবাসি তাই আমি যা কিছুই করি না কেন আল্লাহর প্রিয় এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত হবো।
বন্ধুগণ! যদি এ ধরনের সম্পর্কই যথেষ্ট হতো, তাহলে জগতসম্রাট মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আদরের কন্যাকে কখনোই বলতেন না-
অর্থঃ হে ফাতিমা (রাযিঃ)! তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও, কারণ, আমি আল্লাহর কাছে কোনই কাজে আসবো না। অর্থাৎ, যদি নিজের কাছে ইলম ও আমলের পুঁজি না থাকে তাহলে শুধু সম্পর্ক যথেষ্ট নয়। আর যদি ঈমান ও তাকওয়ার সাথে উঁচু সম্পর্কও থাকে তাহলে তা সুবহানাল্লাহ! সোনায় সোহাগা। কিয়ামতের দিন তখন এ সম্পর্কও উপকারী হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সঙ্গে তাদের সন্তান-সন্ততিকে মিলিত করবো এবং তাদের আমলের কিছুই কম করবো না।’ (সূরা তূর-২১)

অর্থাৎ, পূর্বপুরুষদের গ্রহণযোগ্যতার বরকতে সন্তানদেরকেও ঐ স্তরেই পৌঁছিয়ে দিবো এবং বাপ-দাদার আমলের মধ্যেও কোন কমতি করবো না!

অনুচ্ছেদ-৮: কারো কারো এই সন্দেহ হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলার আমাদের ইবাদত-বন্দেগীর কি প্রয়োজন?
বন্ধুগণ! একথা সত্য যে, আল্লাহ তাআলার কারো কোন আমলের প্রয়োজন নেই এবং তার কোন লাভও নেই। কিন্ত্ত আপনাদেরও কি এ সমস্ত লাভের প্রয়োজন নেই, যেগুলো নেক আমল করার দ্বারা পাওয়া যায়? আপনাদেরও কি নেক আমলের কোন উপকার নেই? সারকথা এই যে, আমল তো আপনাদের লাভের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার লাভের জন্য নয়। যদিও আল্লাহ তাআলার এর কোন প্রয়োজন নেই, কিন্ত্ত আপনারা তো প্রয়োজনমুক্ত নন। এর দৃ্ষ্টান্ত তো ঠিক এমনই যে, কোন দয়ালু ডাক্তার কোন রোগীর প্রতি দয়া করে ঔষধ দেয় আর ঐ রোগী- যে তার নিজের জানের শত্রু-একথা বলে তা অগ্রাহ্য করে যে, সাহেব! ঔষধ পান করলে ডাক্তারের কি লাভ। ভালো মানুষ, ডাক্তারের কি লাভ হবে, এতে তোমার লাভ! তুমি রোগমুক্ত হবে!

অনুচ্ছেদ-৯: কতক নিরস আলেমের এই সন্দেহ হয় যে, আমরা অন্যদেরকে ওযায-উপদেশ দিয়ে থাকি। তাদের আমলের সওয়াবও আমরা পেয়ে থাকি। আর তা এত অধিক পরিমাণ যে, আমাদের সমস্ত গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। বা এ সন্দেহ হয়ে থাকে যে, আমরা এমন আমল জানি, যেগুলো করলে শত শত বছরের গুনাহ মাফ হয়। যেমন ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ প্রতিদিন একশ’বার পড়া বা আরাফা (যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ) বা আশুরার রোযা রাখা বা মক্কার লোকেরা তাওয়াফ করা ইত্যাদি।
বন্ধুগণ! স্থূল কথা যে, যদি এ সমস্ত আমলই যথেষ্ট হয়, তাহলে শরীয়তের অন্য সব আদেশ-নিষেধ অর্থহীন হয়ে যায়। তাছাড়া হাদীসের মধ্যে সুস্পষ্ট এসেছে-
অর্থাৎ, এ সমস্ত আমল তখন গুনাহের কাফফারা হবে, যখন কবীরাহ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। বাকী রইল তাদের এ কথা যে, আমরা মানুষদেরকে ওয়ায-উপদেশ দিয়ে থাকি। বন্ধুগণ! এমন ব্যক্তির উপর তো অধিক বিপদ আসবে। হাদীস শরীফে বদআমল বক্তা সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ। তাই তা আর লেখার প্রয়োজন মনে করছি না।

অনুচ্ছেদ-১০: একটি সন্দেহ অজ্ঞ পীর-ফকিরদে এই হয়ে থাকে যে, আমরা সাধনার ফলে ‘ফানা’ এর স্তরে পৌঁছেছি। আমরা সম্পূর্ণরুপে বিলীন হয়ে গেছি। আমাদের নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নেই। যা কিছু করে সেই করে। এ জাতীয় আরো অনেক প্রলাপ বকে থাকে, যার দ্বারা কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কেউ বলে যে, সাগরের মাঝে বিন্দু বিলীন হয়ে গেছে। কেউ বলে যে, সমুদ্রকে পেশাবের ফোঁটা নাপাক করতে পারে না। কেউ বলে যে, আমরা নিজেরাই তো খোদা, আমাদের আবার ইবাদত কিসের, আমাদের আবার পাপ কিসের? কেউ বলে যে, আসল উদ্দ্যে আল্লাহকে স্মরণ করা। নামায, রোযা বাইরের খাঁচা মাত্র। এগুলো বাহ্যিক নিয়ম, শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সমস্ত বাজে কথার কারণ তাদের অজ্ঞতা। এ ধরনের লোকদের ‘মাকামে’র হাকীকত সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। এরা আল্লাহর পথ পাওয়া ও আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার তো প্রশ্ন ওঠে না। এগুলো একত্ববাদ নিয়ে বাড়াবাড়ির ফল।
ইনশা আল্লাহ, অন্য কোন পুস্তিকায় এ ব্যাপারে সবিস্তারে গবেষণামূলকভাবে লেখা হবে। এ স্থলে এ মোটা কথাটুকু বোঝা উচিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক কেউ আল্লাহ পযন্ত পৌঁছেনি, একত্ববাদী হয়নি এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে অধিক কেউ আজ পযন্ত তা’লীম পায়নি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ)এর খোদাভীতি, তাওবা, ইস্তিগফার, আমলের ব্যাপারে পরিশ্রম, নফসের বিরুদ্ধে চলার গুরুত্ব এবং বদআমলের শাস্তির বিবরণ দেখে নেওয়া এ সমস্ত সন্দেহ নিরসনের জন্য খুবই যথেষ্ট।