আকীদা-বিশ্বাস

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: তা’লীমুদ্দীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
আকীদা-১. বিশ্বজগত পূর্বে অস্তিত্বহীন ছিলো। আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি করার মাধ্যমে তা অস্তিত্বলাভ করে।
আকীদা-২. আল্লাহ এক। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি। তিনি কারো থেকে জন্ম নেননি। কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা সমকক্ষ নেই।
আকীদা-৩. তিনি সর্বদা আছেন এবং সর্বদা থাকবেন।
আকীদা-৪. কোন জিনিস তার মত নয়। তিনি সবার থেকে ঊর্ধ্বে ও অতুলনীয়।
আকীদা-৫. তিনি চিরঞ্জীব। তিনি সর্বক্ষম। কোন কিছুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। কোন কিছু তার কাছে গোপন নয়। তিনি সবকিছু দেখেন এবং শুনেন। তিনি যা ইচ্ছে করেন, তা করেন। তিনি কথা বলেন। তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত। তার কোন শরীক-অংশীদার নেই। তিনি বান্দাদের প্রতি দয়ালু। তিনি বাদশাহ। যাবতীয় দোষ থেকে তিনি পবিত্র। তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে সবধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন। তিনি সম্মানের মালিক। বড়ত্বের অধিকারী। সৃষ্টিকর্তা। পাপ ক্ষমাকারী, অত্যাধিক দানশীল, শক্তিমান, জীবিকা দানকারী। যাকে ইচ্ছা করেন, তার জীবিকা সংকুচিত করে দেন, আর যাকে ইচ্ছা করেন, তার জীবিকা প্রশস্ত করে দেন। যাকে ইচ্ছা নীচু করেন, যাকে ইচ্ছা উঁচু করেন। যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। তিনি ন্যায়বিচারক, সহনশীল, কাজ ও সেবার মূল্যায়নকারী, দু’আ কবুলকারী, বেষ্টনকারী, তার কোন কাজ কল্যাণ ও প্রজ্ঞাশূণ্য নয়। তিনি সবার কর্ম নির্বাহক। তিনি সবকিছুকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই কিয়ামত দিবসে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। তিনিই জীবন দেন, তিনিই মৃত্যু দেন। তার নিদর্শনাবলী ও গুণাবলীর মাধ্যমে সবাই তাকে জানে। কিন্ত্ত তার সূক্ষ্ম সত্তা সম্পর্কে কেউ জানতে পারে না। তিনি পাপীদের তাওবা কবুল করেন। যারা শাস্তির উপযুক্ত তাদেরকে শাস্তি দেন। তিনি সুপথ প্রদর্শন করেন। তিনি নিদ্রা যান না। তার তন্দ্রাও আসে না। তিনি সমস্ত জগতের সংরক্ষণ করতে ক্লান্ত হন না। তিনিই সবকিছু ধারণ করে আছেন। এ জাতীয় পূর্ণতার সমস্ত গুণ তার মধ্যে বিদ্যমান।
আকীদা-৬. সৃষ্টির গুণ-বৈশিষ্ট্য থেকে তিনি পবিত্র। কুরআন ও হাদীসের কতক জায়গায় এ ধরনের যে সব বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। হয় সেগুলোর অর্থ আল্লাহর উপর ন্যস্ত করবে যে, তিনিই এ সবের স্বরুপ সম্পর্কে সম্যক অবগত। আমরা বিনাবাক্যে এ সবের উপর ঈমান আনি ও বিশ্বাস করি। আর এটাই উত্তম পন্থা। অথবা তার উপযুক্ত কোন অর্থ করবে, যার দ্বারা তা বুঝে আসে।
আকীদা-৭. বিশ্বজগতে ভালোমন্দ যা কিছু হয়, তার সবকিছু আল্লাহ তাআলা সেগুলো হওয়ার পূর্বে সর্বদা থেকে জানেন এবং সেই জানা মাফিক তা সৃষ্টি করেন। এরই নাম ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য। মন্দ বিষয়সমূহ সৃষ্টি করার পিছনে অনেক রহস্য রয়েছে, সেগুলো সবাই অবগত নয়।
আকীদা-৮. মানুষকে আল্লাহ তাআলা বিবেক ও ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন, যার দ্বারা তারা পাপ ও পূণ্যের কাজ স্বেচ্ছায় করে থাকে। পাপ কাজ দ্বারা তিনি অসন্ত্তষ্ট হন, আর নেককাজ দ্বারা তিনি সন্ত্তষ্ট হন। তবে মানুষের কোন কিছু সৃষ্টি করার শক্তি নেই।
আকীদা-৯. আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন কোন কাজের নির্দেশ দেননি, যা মানুষের শক্তির বাইরে।
আকীদা-১০. কোন জিনিস আল্লাহর দায়িত্বে আবশ্যক নয়। তিনি দয়া করে যা করেন, তা তার অনুগ্রহ।
আকীদা-১১. আল্লা্হ কর্তৃক প্রেরিত অনেক নবী-রাসূল মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য এসেছেন। তারা সকলেই নিষ্পাপ। তাদের সঠিক ও পরিপূর্ণ সংখ্যা আল্লাহ তাআলাই জানেন। তাদের সত্যতার প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের হাতে এমন নতুন ও জটিল বিষয়সসমূহ প্রকাশ করেছেন, যেগুলো অন্য কোন মানুষ করতে সক্ষম নয়। এসব বিষয়কে ‘মুজিযা’ বলে। নবীগনের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন আদম আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । অবশিষ্টরা এতদুভয়ের মাঝে আগমন করেন। তাদের মধ্যে কিছু নবী অত্যাধিক প্রসিদ্ধ। যথাঃ হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসমাইল আলাইহিস সালাম, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম, হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম, হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালমা, হযরত হারুন আলাইহিস সালাম, হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম, হযরত ইয়াহ্ইয়া আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম, হযরত ইলিয়াছ আলাইহিস সালাম, হযরত আল ইয়াসা’ আলাইহিস সালাম, হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম, হযরত লূত আলাইহিস সালাম, হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম, হযরত যুলকিফল আলাইহিস সালাম, হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম, হযরত হুদ আলাইহিস সালাম, হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম।
আকীদা-১২. নবীদের মধ্যে কতিপয় নবীর মর্যাদা অন্য কতিপয় নবীর চেয়ে বেশী। সবার মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদা আমাদের নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের। তার পরে নতুন কোন নবী আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ ও জিন হবে, তিনি তাদের সবার নবী।
আকীদা-১৩. আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে এবং সেখান থেকে সাত আসমানের উপর এবং সেখান থেকে যতদূর আল্লাহর ইচ্ছা হয়েছে নিয়ে গেছেন এবং পুনরায় মক্কায় পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। একে ‘মি’রাজ’ বলে।
আকীদা-১৪. আল্লাহ তাআলা কিছু মাখলুক নূর দ্বারা সৃষ্টি করে তাদেরকে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রেখেছেন। তাদেরকে ফেরেশতা বলে। তাদের পুরুষ বা নারী হওয়ার কোন বর্ণনা দেওয়া হয়নি। অনেক কাজ তাদের হাতে ন্যস্ত। তারা কখনও আল্লাহ তাআলার হুকুমের পরিপন্থী কোন কাজ করেন না। তাদের মধ্যে চারজন ফেরেশতা অধিক প্রসিদ্ধ। হযরত জিবরাঈল (আঃ), হযরত মীকাঈল (আঃ), হযরত ইসরাফীল (আঃ) এবং হযরত ইযরাঈল (আঃ)।
আকীদা-১৫. আল্লাহ তাআলা আগুন দ্বারা কিছু মাখলুক সৃষ্টি করে তাদেরকে আমাদের দৃষ্টির আড়াল করেছেন। তাদেরকে ‘জিন’ বলে। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ সব ধরনের আছে। তাদের সন্তান হয়। তাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ইবলিস শয়তান।
আকীদা-১৬. কোন মুসলমান যখন বেশী বেশী ইবাদত করে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকে, দুনিয়ার ভালোবাসা রাখে না, সবদিক থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুব অনুসরণ করে, তখন সে আল্লাহর বন্ধু এবং প্রিয় হয়ে যায়। এমন ব্যক্তিকে ‘ওলী’ বলে। এমন ব্যক্তি দ্বারা কখনো কখনো এমন সব বিষয় প্রকাশ পায়, যা অন্য লোকদের দ্বারা সম্ভব হয় না, এ ধরনের বিষয়কে ‘কারামত’ বলে।
আকীদা-১৭. কোন ওলী যত উঁচু স্তরেই পৌঁছুক না কেন, কোন নবীর সমতুল্য হতে পারে না।
আকীদা-১৮. কোন মানুষ আল্লাহর যত প্রিয়ই হোক না কেন, যতক্ষণ হুঁশ-জ্ঞান ঠিক আছে, শরীয়তের অনুগামী থাকা ফরয। নামায, রোযা বা অন্য কোন ইবাদত তার জন্য মাফ হয় না এবং কোন গুনাহর কাজও তার জন্য জায়িয হয় না।
আকীদা-১৯. যে ব্যক্তি শরীয়ত বিরোধী কাজ করে সে আল্লাহর ওলী হতে পারে না। তার হাতে বিস্ময়কর কোন কিছু দেখা গেলে, তা হয় যাদু অথবা নফস ও শয়তানের প্রতারণা। তার প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি পোষণ করা ঠিক নয়।
আকীদা-২০. আল্লাহর ওলীগণ ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় কিছু ভেদ ও রহস্যের কথা জানতে পারেন। তাকে ‘কাশফ’ ও ‘ইলহাম’ বলে। সেগুলো শরীয়তসম্মত হলে গৃহীত হবে, আর শরীয়ত পরিপন্থী হলে প্রত্যাখ্যাত হবে।
আকীদা-২১. আল্লাহ ও রাসূল ধর্মের সব বিষয় কুরআন ও হাদীসে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। এখন নতুন কোন বিষয় ধর্মের মধ্যে যোগ করা দুরস্ত নয়। এ ধরনের বিষয়কেই ‘বিদাআত’ বলে। বিদআত মারাত্মক গুনাহ। তবে দ্বীনের কিছু সূক্ষ্ম বিষয়, যেগুলো সবাই বুঝতে সক্ষম নয়-বিজ্ঞ আলেমগণ নিজেদের ইলমের শক্তিতে কু্রআন ও হাদীস থেকে বুঝতে পারেন এবং অন্যদেরকে সেগুলো শিক্ষা দেন। এ ধরনের বিজ্ঞ আলিমকে ‘মুজতাহিদ’ বলে। অনেক মুজতাহিদই গত হয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজন অধিক প্রসিদ্ধ। তারা হলেন-হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রহঃ), হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহঃ), হযরত ইমাম মালিক (রহঃ), হযরত ইমাম আহমাদ (রহঃ)। যার যে মুজতাহিদের প্রতি অধিক ভক্তি-বিশ্বাস হবে সে তার অনুসরণ করবে। পাক-ভারত- বাংলায় হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)এর অনুসারী বেশী। তাদেরকে ‘হানাফী’ বলে।
এমনিভাবে আত্মার পরিশীলন ও সংশোধনের পন্থাসমূহ কুরআন ও হাদীস অনুপাতে আল্লাহর ওলীগণ নিজেদের আত্মার আলোকে বুঝতে পেরে সেগুলো শিখিয়েছেন। এদেরকে ‘শাইখ’ বলে। এদের মধ্যে চারজন অধিক প্রসিদ্ধ। তারা হলেন, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ), হযরত গাউসুল আযম আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ), শাইখ শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহঃ), শাইখ খাজা বাহাউদ্দীন নকশাবন্দী (রহঃ)। যে মুজতাহিদ এবং শাইখের প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস জন্মায় তার অনুকরণ করে অন্যদেরকে খারাপ মনে করা ঠিক নয়। কোন মুজতাহিদ বা শাইখের অনুকরণ ঐ সময় পর্যন্ত করা যাবে, যখন পর্যন্ত তাদের কথা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধী না হবে। তাদের থেকে কোন ভুল হয়ে গেলে তার অনুকরণ করা যাবে না।
আকীদা-২২. আল্লাহ তাআলা ছোট বড় অনেকগুলো কিতাব আসমান থেকে জিবরাঈল (আঃ)এর মাধ্যমে অনেক নবীর উপর অবতীর্ণ করেছেন। যাতে করে তারা নিজ নিজ উম্মতকে দ্বীনের কথা শিক্ষা দিতে পারেন। সেগুলোর মধ্যে চারটি কিতাব অত্যাধিক প্রসিদ্ধ। তাওরাত-হযরত মূসাস (আঃ) লাভ করেন, যাবুর-হযরত দাউদ (আঃ), ইঞ্জীল-হযরত ঈসা (আঃ) এবং কুরআন মাজীদ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অবতীর্ণ করা হয়। কুরআন মাজীদ সর্বশেষ কিতাব। অন্য কোন কিতাব আর আসমান থেকে আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত কুরআনের বিধান বলবৎ থাকবে। অন্যান্য কিতাবের অনেক কিছু পথভ্রষ্ট লোকেরা বিকৃত করেছে। কিন্ত্ত কুরআন শরীফ হেফাযত করার অঙ্গীকার আল্লাহ তাআলা করেছেন। একে কেউ বিকৃত বা পরিবর্তন করতে পারবে ন।।
আকীদা-২৩. আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে সমস্ত মুসলমান দেখেছেন, তাদেরকে ‘সাহাবী’ বলে। কুরআন হাদীসে তাদের অনেক মর্যাদা ও বুযুর্গীর কথা বর্ণিত হয়েছে। তাদের সকলের প্রতি ভালোবাসা ও সুধারণা পোষণ করতে হবে। তাদের পারস্পরিক কোন লড়াই-ঝগড়ার কথা শুনতে পেলে তা তাদের ভুল-ত্রুটি মনে করবে। তাদের নিন্দা করা যাবে না। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় চারজন সাহাবী হলেন-হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযিঃ)। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং ইসলামের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করেন। তাই তাকে প্রথম খলীফা বলা হয়। এ উম্মতের তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তার পর হযরত উমর (রাযিঃ)-দ্বিতীয় খলিফা। তার পর হযরত উসমান (রাযিঃ)-তৃতীয় খলীফা। তার পর হযরত আলী (রাযিঃ)-চতুর্থ খলীফা।
আকীদা-২৪. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তান ও স্ত্রীগণ সকলেই সম্মানিত। তার সন্তানদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী হযরত ফাতিমা (রাযিঃ)। তার স্ত্রীদের মধ্যে হযরত খাদিজা (রাযিঃ) ও হযরত আয়েশা (রাযিঃ) সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী।
আকীদা-২৫. ঈমান তখন সঠিক হয়, যখন আল্লাহ ও রাসূলকে সর্ববিষয়ে সত্যবাদী বিশ্বাস করা হয় এবং সেগুলোকে মান্য করা হয়। আল্লাহ ও রাসূলের কোন কথায় সন্দেহ করা বা মিথ্যা মনে করা বা তার মধ্যে দোষ খোঁজা বা তার সাথে ঠাট্রা-বিদ্রূপ করার দ্বারা ঈমান চলে যায়।
আকীদা-২৬. কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট অর্থ না বলা এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাখ্যা তৈরী করা ধর্মহীনতার কাজ।
আকীদা-২৭. গুনাহকে হালাল মনে করলে ঈমান চলে যায়।
আকীদা-২৮. গুনাহ যত বড়ই হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে খারাপ মনে করা হবে, তার দ্বারা ঈমান চলে যাবে না। তবে দুর্বল হবে।
আকীদা-২৯. আল্লাহ তাআলা থেকে নির্ভয় হওয়া বা নিরাশ হওয়া কুফুরী।
আকীদা-৩০. কারো নিকট গায়েবের কথা জিজ্ঞাসা করা এবং তা বিশ্বাস করা কূফূরী। তবে নবীগণ ওহীর মাধ্যমে এবং অলীগণ কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষ লক্ষণ ও নিদর্শনের মাধ্যমে কোন বিষয় অবগত হতে পারে।
আকীদা-৩১. কাউকে কাফির বলা বা কারো উপর অভিশম্পাত করা মারাত্মক গুনাহ, তবে এভাবে বলা যেতে পারে যে, জালেমদের উপর লা’নত, মিথ্যুকদের উপর লা’নত। তবে যাদের নাম নিয়ে আল্লাহ ও রাসূল লা’নত করেছেন বা তাদের কুফরীর বিষয় জানিয়ে দিয়েছেন তারদেরকে কাফির বা মালাউন (অভিশপ্ত) বলা গুনাহ নয়।
আকীদা-৩২. মানুষ মারা যাওয়ার পর তাকে কবর দেওয়া হলে কবরে, আর কবর দেওয়া না হলে যে অবস্থায় সে থাকে সেখানেই তার নিকট দু’জন ফেরেশতা এসে জিজ্ঞাসা করে-‘তোমার প্রতিপালক কে?’ ‘তোমার দ্বীন কি?’ এবং ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে-‘ইনি কে?’ মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হলে এর সঠিক উত্তর প্রদান করে। তখন তার জন্য সবধরনের সুখ-শান্তির ব্যবস্থা হয়। আর তা না হলে সে সব প্রশ্নের উত্তরে এ কথাই বলে যে, আমি কিছুই জানি না। তখন তার জন্য বড় কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কাউকে কাউকে আল্লাহ তাআলা এ পরীক্ষা থেকে মাফ করে দেন। তবে এ সব বিষয় মৃত ব্যক্তিই শুধু জানতে পারে। অন্যেরা এর কিছুই দেখতে বা জানতে পারে না। যেমন ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে সবকিছু দেখে, কিন্ত্ত তার পাশেই উপবিষ্ট জাগ্রত মানুষ তার কিছুই জানতে পারে না।
আকীদা-৩৩. মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আ করলে বা কিছূ দান করে সওয়াব বখশালে মৃত ব্যক্তি সেই সওয়াব পেয়ে থাকে এবং এতে সে বড় উপকৃত হয়।
আকীদা-৩৪. আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের যত আলামতের কথা বলেছেন, তার সবগুলো অবশ্যই প্রকাশ পাবে। ইমাম মাহদী (আঃ) আগমন করবেন। অত্যন্ত ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে তিনি বাদশাহী করবেন। কানা দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। সে পৃথিবীতে মারাত্মক ফেৎনা সৃষ্টি করবে। তাকে হত্যা করার জন্য হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। ইয়াজুজ-মাজুজ অত্যন্ত শক্তিশালী মানব গোষ্ঠী। তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। অবশেষে আল্লাহর গযবে তারা ধ্বংস হবে। একটি বিস্ময়কর প্রাণী ভূগর্ভ থেকে বের হয়ে আসবে। সে মানুষের সাথে কথা বলবে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয় হবে। পবিত্র কুরআন উঠে যাবে। কিছুদিনের মধ্যে সমস্ত মুসলমান মৃত্যুবরণ করবে এবং সারা পৃথিবী কাফিরদের দ্বারা ভরে যাবে। এমন আরো অনেক কিছু ঘটবে।
আকীদা-৩৫. কিয়ামতের সমস্ত আলামত পুরা হলে কিয়ামত সংঘটনের ব্যবস্থা আরম্ভ হবে। হযরত ইসরাফীল (আঃ) আল্লাহর হুকুমে শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন। এই শিঙ্গাটি বিরাট আকৃতির হবে। শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার ফলে সমস্ত আসমান ও জমিন ফেটে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। সমস্ত সৃষ্টি মৃত্যুবরণ করবে। যারা পূর্বে মারা গিয়েছে, তাদের আত্মা অচেতন হয়ে পড়বে। তবে আল্লাহ তাআলা যাদেরকে বাঁচাতে চাবেন, তারা নিজ অবস্থায় থাকবে। দীর্ঘ একটি সময় এ অবস্থায় অতিবাহিত হবে।
আকীদা-৩৬. তারপর আল্লাহ তাআলার যখন সমস্ত জগতকে পুনর্বার সৃষ্টি করার ইচ্ছা হবে, তখন পুনর্বার শিঙ্গায় ফুক দেয়া হবে, ফলে সারা পৃথিবী পুনরায় অস্তিত্ব লাভ করবে। মৃতরা জীবিত হবে এবং কিয়ামতের মাঠে সবাই একত্রিত হবে। সেখানকার কষ্টে ঘাবড়ে গিয়ে সবাই নবীদের নিকট সুপারিশের জন্য যাবে। অবশেষে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন। ভালো-মন্দ আমল পরিমাপ করা হবে। সেগুলোর হিসাব হবে। তবে কেউ কেউ বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। নেক লোকদের আমলনামা ডান হাতে এবং বদ লোকদের বাম হাতে দেওয়া হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে হাউযে কাউসারের পানি পান করাবেন, যা দুধের চেয়ে অধিক সাদা এবং মধুর চেয়ে অধিক মিষ্টি হবে। পুলসিরাত অতিক্রম করতে হবে। সৎকর্মশীল লোকেরা পুলসিরাত পার হয়ে বেহেশতে যাবে, আর পাপী লোকেরা তার উপর থেকে দোযখে নিপতিত হবে।
আকীদা-৩৭. দোযখ সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে সাপ, বিচ্ছু এবং নানা প্রকারের শাস্তি রয়েছে। দোযখীদের থেকে যাদের মধ্যে সামান্যও ঈমান থাকবে, তারা নিজেদের পাপের শাস্তি ভোগ করে নবী অথবা বুযুর্গদের সুপারিশের মাধ্যমে দোযখ থেকে বের হয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবে। চাই সে যত বড় পাপীই হোক না কেন। যারা কাফির ও মুশরিক তারা সেখানে চিরদিন থাকবে এবং তাদের মৃত্যুও হবে না।
আকীদা-৩৮. বেহেশতও সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে সবধরনের শান্তি ও নেয়ামত রয়েছে। বেহেশতবাসীদের কোনরূপ ভয় ও দুশ্চিন্তা থাকবে না । তারা সেখানে চিরদিন থাকবে। সেখান থেকে বেরও হবে না এবং মারাও যাবে না।
আকীদা-৩৯. আল্লাহ তাআলার এখতিয়ার আছে-চাইলে তিনি ছোট পাপের কারণেও শাস্তি দিকে পারেন এবং চাইলে বড় পাপের জন্যও শাস্তি না দিয়ে মাফ করে দিতে পারেন।
আকীদা-৪০. যেসব লোকের নাম উল্লেখ করে আল্লাহ ও তার রাসূল বেহেশতবাসী হওয়ার কথা বলে দিয়েছেন, তাদের ছাড়া অন্য কারো বেহেশতবাসী হওয়ার কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে ভালো নিদর্শনসমূহ দেখে ভালো ধারণা পোষণ করা এবং আল্লাহর রহমতের আশা রাখা জরুরী।
আকীদা-৪১. বেহেশতের মধ্যে সবচেয়ে বড় নেয়ামত হবে আল্লাহ তাআলার দীদার বা দর্শন। যা বেহেশতীরা লাভ করবে। তার স্বাদের সম্মুখে বেহেশতের সমস্ত নেয়ামত তুচ্ছ মনে হবে।
আকীদা-৪২. পৃথিবীতে জাগ্রত অবস্থায় চর্মচোখে কেউ আল্লাহ তাআলাকে দেখিনি এবং কেউ দেখতেও পারবে না।
আকীদা-৪৩. কেউ সারাজীবন যতই ভালো বা মন্দ থাক না কেন, যে অবস্থায় মৃত্যু হবে, সে অনুপাতেই তার পুরস্কার বা শাস্তি হবে।
Leave a Reply