উৎস:
ইসলাহী নেসাব: তা’লীমুদ্দীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

আধ্যাত্মিকতা সঠিক হওয়ার বর্ণনা

প্রথমতঃ উপরোক্ত আলোচনা (ভূমিকায় উল্লেখিত আলোচনা) দ্বারা আধ্যাত্মিকতা সঠিক হওয়ার বিষয় জানা গেছে। কিন্ত্ত যেহেতু বেশীর ভাগ নিরস প্রকৃতির লোক আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করে, তাই বিষয়টিকে অধিকতর জোরালো ও শক্তিশালী করার জন্য সংক্ষেপে পৃথকভাবে লেখা হচ্ছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আমি (ঘটনাটি) সুলাইমানকে বুঝিয়ে দিলাম।’ (সূরা আম্বিয়া-৭৯)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যে ‘ইলহামের’ অধিকারী লোক অতিবাহিত হয়েছেন। আমার উম্মতের মধ্যে এমন কেউ থাকলে সে হলো, উমর।’ (বুখারী ও মুসলিম)

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
‘এবং আমি তাকে আমার নিকট থেকে ইলম শিক্ষা দিয়েছি।’ (সূরা কাহাফ-৬৫)

কতিপয় বিজ্ঞ আল্লাহওয়ালা বলেন যে, যার ইলমে বাতিনের কিছুই অর্জন হয়নি তার বেঈমান হয়ে মরার আশংকা রয়েছে। কমপক্ষে আধ্যাত্মিকতাকে বিশ্বাস করে ও স্বীকার করে-এতটুকু হলেও থাকা উচিত। আর অস্বীকারকারীর জন্য এ দৌলত থেকে বঞ্চিত থাকার শাস্তিই যথেষ্ট। কবি বলেন-
‘অহংকারীকে আল্লাহর ভালোবাসার ও প্রেমের রহস্যের কথা বলো না। তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। সে অহংকারের ব্যাধিতে মরে যাক।’

উপরোক্ত কথাটি ইমাম গাযযালী (রহঃ) এর কথার সারাংশ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘ইহসান’ হলো, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাকে দেখছো। যদি তুমি তাকে না দেখো, তিনি তো তোমাকে দেখছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে আলোচনার পর ‘ইহসানের’ এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এতে জানা যায় যে, জরুরী আকীদা এবং জাহেরী আমলসমূহ ছাড়া আরো একটি জিনিস রয়েছে, যার নাম এ হাদীসে ‘ইহসান’ রাখা হয়েছে। ইহসানের যে হাকীকত বা মূল তত্ত্ব এ হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, তার দ্বারা জানা যায় যে, ‘ইহসান’ই হলো এই আধ্যাত্মিকতা। কারণ, আধ্যাত্মিকতা লাভ করা ছাড়া ইবাদতের সময় অন্তরের এমন উপস্থিতি কখনোই লাভ হয় না।

তাছাড়া এ ব্যাপারে লক্ষ্য লক্ষ্য নির্ভরযোগ্য মানুষের এমন সাক্ষ্য রয়েছে, যা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাকে বিবেক মেনে নেয় না। যেমন, আধ্যাত্মিক সাধকদের নিকট বসার দ্বারা আকীদা ও জাহেরী আমল ছাড়া আমাদের অন্তরে নতুন এক অবস্থা অনুভূত হয়। যা পূর্বে ছিলো না। যে অবস্থার প্রতিক্রিয়া এই হয় যে, প্রতিনিয়ত ইবাদতের প্রতি আগ্রহ, গুনাহের প্রতি ঘৃণা ও আকীদা-বিশ্বাসের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। আধ্যাত্মিকতা বাস্তব ও সঠিক হওয়ার বিষয়ে এটিও একটি শক্তিশালী দলীল।

তাছাড়া এ ব্যাপারে বুযুর্গদের কাশফ-কারামত এত অধিক পরিমাণে বর্ণিত হয়েছে, যার অন্ত নেই। যদিও কাশফ-কারামত কোন শক্তিশালী দলীল নয়, তবুও শরীয়তের উপর অবিচল থাকার সাথে সাথে যদি অলৌকিক বিষয়সমূহ পাওয়া যায়, তাহলে অলৌকিকতার অধিকারী ব্যক্তিদের কামিল হওয়ার ব্যাপারে এটি অবশ্যই তৃপ্তির কারণ হয়ে থাকে। এ কথাটি কাযী সানাউল্লাহ (রহঃ)-এর কথার সারসংক্ষেপ।

যাই হোক, সাহসিকতার দাবী তো এই যে, রুচি-রসের অধিকারী হও, যদি এতটুকু তাওফীক না হয় তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে এটাকে অস্বীকার তো করো না।


বাইয়াতের বর্ণনা

আল্লাহর নিয়ম এমনই যে, কাংখিত কোন পূর্ণতা উস্তাদ ব্যতীত লাভ হয় না। তাই এ পথে আসার তাওফীক হলে এ পথের উস্তাদ অবশ্যই তালাশ করা উচিত। যার তা’লীমের ফয়েয এবং সুহবতের বরকতে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। কবি বলেন-

অর্থঃ ‘হে মন! এ পথে সফরের বাসনা যদি তোমার থাকে, তাহলে পথপ্রদর্শকের আঁচল ধরো ও যাত্রা করো।’

‘হে ফরিদ’! এ পথের সংকল্পে নির্ভেজাল হও। তাহলে ‘মারেফাতের খাজানার’ চাবি হাতে পাবে।’

‘আল্লাহর প্রেমের পথে যে বন্ধুহীন (শাইখ ছাড়া) পথ চললো, তার সারাজীবন কেটে গেলো, কিন্ত্ত প্রেমের কিছুই জানলো না।’

আলামত ও নিদর্শন ছাড়া যেহেতু শাইখকে চেনা ও তালাশ করা সম্ভব নয়, তাই কামিল শাইখের শর্ত ও আলামতসমূহ এখানে লেখা হচ্ছে।

১. প্রয়োজন পরিমাণ শরীয়তের ইলম রাখে, তা কিতাব পড়ে হোক বা আলিমদের সোহবতে থেকে হোক। যাতে করে ভ্রান্ত আকীদা ও আমল থেকে নিজেও নিরাপদে থাকতে পারে এবং মুরীদদেরকেও নিরাপদে রাখতে পারে। নইলে ‘নিজেই পথভ্রষ্ট, অন্যকে কী পখ দেখাবে’ প্রবাদে পরিণত হবে।

২. মুত্তাকী অর্থা, কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয় না এবং সগীরা গুনাহের উপর অবিচল থাকে না।

৩. দুনিয়াবিরাগী ও আখিরাতের প্রতি অনুরাগী। যাহেরী ও বাতেনী ইবাদতসমূহ নিয়মিতভাবে আমলকারী। তা না হলে মুরীদের কলবের উপর মন্দ প্রভাব পড়বে।

৪. মুরীদদের প্রতি খেয়াল রাখে। তাদের থেকে শরীয়ত ও তরীকত পরিপন্থী কোন কিছু ঘটলে সতর্ক করে।

৫. আল্লাহ ওয়ালাদের সাহচর্যে থেকেছে। তাদের থেকে ফয়েয-বরকত লাভ করেছে।

খাঁটি আল্লাহওয়ালা হওয়ার জন্য কারামত ও অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পাওয়া জরুরী নয়। উপার্জন বর্জনকারী হওয়ারও প্রয়োজন নেই। দুনিয়ার লোভী না হওয়াই যথেষ্ট।
(কওলে জামীল)
এতদসংক্রান্ত অন্যান্য আলোচনা যেমন, পীর ও মুরীদের আদব, একাধিক পীর ধরার বিধান ইত্যাদি বিষয়সমূহ বিস্তারিত আলোচনায় বর্ণনা করা হবে।

ফায়দাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলাম ও জিহাদ ইত্যাদির উপর বাইয়াত গ্রহণ করা ছাড়া আধ্যাত্মিকতার স্তরসমূহেরও বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। যেমন, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কল্যাণকামী হওয়া, আল্লাহর হুকুমের মোকাবেলায় কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় না করা এবং মানুষের নিকট কিছু না চাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। তাই এটি সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য পরবর্তী যুগের বুযুর্গগণ খিলাফতের বাইয়াতের সাথে সাদৃশ্যতার কারণে শুধু শাইখের সান্নিধ্যে থাকার উপরেই যথেষ্ট করেছেন। তারও পরবর্তীতে বাইয়াতের স্থলে ‘খেরকার’ রেওয়াজ চালু হয়। যখন খিলাফতের বাইয়াতের প্রথা পরবর্তী খলীফাদের থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সুফিয়ায়ে কেরাম তখন এ বিলুপ্ত সুন্নাতকে পুনরায় জীবিত করেন। (কওলে জামীল)

বাকী রইলো, সূফী উপাধির সূচনার বিষয়। ‘খাইরুল কুরুন’ তথা স্বর্ণ যুগের লোকদের জন্য ‘সাহাবী’ ‘তাবেয়ী’ ও ‘তাবয়ে তাবেয়ী’ উপাধি সত্যপন্থীদের পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো। তার পরবর্তী যুগে আল্লাহ ওয়ালাদেরকে ‘যাহিদ’ও ‘আবিদ’ বলতে আরম্ভ করা হয়। তারও পরবর্তীকালে যখন বিদআত ও ফিতনা-ফাসাদের প্রসার ঘটে এবং ভ্রান্তপন্থীরাও নিজেদেরকে ‘আবিদ’ ও ‘যাহিদ’ বলতে আরম্ভ করে, তখন সত্যপন্থীরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য ‘সূফী’ উপাধি ধারণ করেন এবং দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর ভিতর এ উপাধি পরিচিতি লাভ করে। (কুশাইরিয়া)

মুজাহাদা বা সাধনা

সংক্ষিপ্ত মুজাহাদার বর্ণনা

সংক্ষিপ্ত মুজাহাদার মূল বিষয় চারটি। যথা-

ক. কম কথা বলা।
খ. কম খাওয়া।
গ. কম ঘুমানো।
ঘ. মানুষের সাথে কম মেলামেশা করা।
উপরোক্ত চার বিষয়ে শাইখে কামেলের দিক-নির্দেশনা মাফিক মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে।

এ কাজগুলো এত অধিক পরিমাণে করবে না যে, অন্তর গাফেল ও শক্ত হয়ে যায়। আবার এত বেশী পরিমাণে কমাবে না যে, দেহের শক্তি ও সুস্থতা নষ্ট হয়ে যায়। সারকথা হলো, নফসের চাহিদা দু’প্রকারের-
ক. নফসের হক ও অধিকারসমূহ।
খ. ভোগবিলাস।

যেগুলোর দ্বারা শরীর সুস্থ থাকে এবং জীবনধারণ করা যায় সেগুলো হলো নফসের হক। আর এর চেয়ে অতিরিক্তগুলোই হচ্ছে ভোগবিলাসের শামিল। তাই নফসের হকসমূহ তাকে যথাযথরুপে প্রদান করবে এবং ভোগবিলাস থেকে তাকে দূরে রাখবে।

গুরুত্বপূর্ণ নোটঃ আল্লাহর পথের পথিকগণ দুঃখ ও দুশ্চিন্তাকে উঁচু স্তরের মুজাহাদা সাব্যস্ত করেছেন। কারণ এর ফলে নফসের মধ্যে ভগ্নতা, তুচ্ছতা ও অক্ষমতা সৃষ্টি হয়। এগুলো দাসত্বের লক্ষণ। এসব বিষয় অভিজ্ঞতার দ্বারা ও বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করার দ্বারা জানা যায়। এ থেকে এ বিষয়টিও ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত যে, সালিক বা আল্লাহর পথের পথিকের যে, অনেক সময় ‘কব্য’ বা মনের সংকীর্ণ ও বদ্ধভাব দেখা দেয়, তা আল্লাহর দরবার থেকে তার দূরত্ব ও বিতাড়িত হওয়ার আলামত নয়। আশ্চর্যের কি আছে যে, হয়তো তার অন্তর পরিষ্কার করা ও মুজাহাদার উদ্দেশ্যে এ অবস্থা হয়ে থাকবে। তাই এ অবস্থা দেখা দিলে কখনই শেকায়েত করবে না। অবনত মস্তকে আপন কাজে ব্যাপৃত থাকবে। কবি বলেন-

অর্থঃ ‘মালী পুষ্পের সান্নিধ্য পেতে চাইলে বিচ্ছেদের কাঁটার আঘাতে বুলবুলির ন্যায় ধৈর্যধারণ করতে হয়।

হে মন! প্রেমিকার কেশরাজির ফাঁদে আটকে অস্থির হয়ে কেঁদো না। বিচক্ষণ পাখি জালে আটকে গেলো ধৈর্যধারণ করে।’

আবু আলী দাক্কাক (রহঃ) বলেন-
অর্থঃ ‘ব্যথিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তি আল্লাহপ্রাপ্তির পথ এত অধিক অতিক্রম করে, যা ব্যথা ও দুশ্চিন্তামুক্ত মানুষ বহু বছরেও অতিক্রম করতে পারে না।’

বিস্তারিত মুজাহাদার বর্ণনা

বিস্তারিত মুজাহাদা দু’প্রকার। প্রথম প্রকার-আখলাকে হামীদা তথা উত্তম গুণাবলী। সেগুলো হলো- তাওবা, সবর, শোকর, খওফ, রাযা, যুহদ, তাওহীদ, তাওয়াক্কুল, মুহব্বত ও শওক, ইখলাস ও সিদক, মুরাকাবা, মুহাসাবা, তাফাক্কুর। এর প্রত্যেকটির পরিচয়, প্রমাণ ও অর্জনের উপায় ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদে বর্ণনা করা হচ্ছে।

এ সমস্ত আলোচনা ইহইয়াউল উলূম কিতাব থেকে নেওয়া হয়েছে। আর যে সমস্ত বিষয় অন্যত্র থেকে নেওয়া হয়েছে তার উদ্ধৃতি টীকায় লিখে দেওয়া হয়েছে।

‘তাওবা’র বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট খাঁটিভাবে তাওবা করো।’ (সূরা তাহরীম-৮)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘হে মানবমন্ডলী! আল্লাহর নিকট তাওবা করো্’ (মুসলিম)

তাওবার মর্মঃ গুনাহের কথা স্মরণ করে মন ব্যথিত হওয়া। তাওবার জন্য গুনাহ পরিত্যাগ করা এবং ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা এবং গুনাহের চাহিদা সৃষ্টি হলে নিজেকে তা থেকে বিরত রাখা আবশ্যকীয়।

তাওবার গুণ অর্জনের উপায়ঃ কুরআন ও হাদীসে গুনাহের বিষয়ে যে সমস্ত ভীতি ও ধমকি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো স্মরণ করবে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। এতে অন্তরে কৃত গুনাহের জন্য অনুতাপ সৃষ্টি হবে। আর এটিই তাওবা।

তাওবার বিধানঃ নামায, রোযা বা অন্য কোন হুকুম ছুটে গিয়ে থাকলে, সেগুলো কাযা করবে। মানুষের হক নষ্ট হয়ে থাকলে, সেগুলো মাফ করিয়ে নিবে বা পরিশোধ করবে।

‘সবর’-ধৈর্যের বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ করো।’ (সূরা আলে ইমরান-২০০)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘বিস্ময় মুমিনের জন্য, তার সব বিষয়ই কল্যাণকর, যা মুমিন ছাড়া আর কারো জন্য নেই। যদি সে আনন্দ লাভ করে, শোকর আদায় করে, আর কষ্টে পতিত হয়, ধৈর্যধারণ করে, যা তার জন্য কল্যাণকর।’ (মুসলিম)

সবরের মর্মঃ মানুষের মাঝে দু’টি শক্তি আছে। যার একটি তাকে দ্বীনের উপর চলতে উদ্বুদ্ধ করে, আর অপরটি উদ্বুদ্ধ করে খাহেশাতের উপর চলতে। দ্বীনের উপর উদ্বুদ্ধকারী শক্তিকে খাহেশাতের উপর উদ্বুদ্ধকারী শক্তির উপর বিজয়ী করাকে ‘সবর’ বলে।

সবরের গুণ অর্জনের উপায়ঃ খাহেশাতের উপর উদ্বুদ্ধকারী শক্তিকে দুর্বল ও নিস্তেজ করতে হবে। তাহলে সবর বা ধৈর্যের গুণ অর্জিত হবে।

‘শোকর’-কৃতজ্ঞতার বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘তোমরা আমার শোকর আদায় করো।’ (সূরা বাকারা-১৫২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘(ঈমানদার ব্যক্তি) যদি আনন্দ লাভ করে শোকর আদায় করে।’ (মুসলিম)

শোকরের মর্মঃ নেয়ামতকে মুনইমে হাকীকী তথা আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে বিশ্বাস করা। আর এ বিশ্বাসের ফলে দু’টি বিষয় অবশ্যই দেখা দিবে-

ক. নেয়ামত দানকারীর প্রতি সন্ত্তষ্ট হওয়া।
খ. তার শোকরগুজারীতে এবং তার আদেশ পালনে তৎপর হওয়া।

শোকরের গুণ অর্জনের উপায়ঃ আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের কথা চিন্তা করবে এবং সেগুলোর কথা স্মরণ করবে।

‘রাজা’-আশার বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না।’ (সূরা যুমার-৫৩)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘কাফিরও যদি আল্লাহর রহমতের প্রকৃত অবস্থা জানতো, তাহলে সেও তার জান্নাত থেকে নিরাশ হতো না।’

‘রাজা’-আশার মর্মঃ প্রিয় জিনিসসমূহ-অর্থাৎ, আল্লাহর অনুগ্রহ, ক্ষমা, নেয়ামত ও জান্নাতের প্রতীক্ষায় অন্তরে শান্তি লাভ করা এবং এ সমস্ত জিনিস লাভ করার জন্য চেষ্টা-তদবীর করা। তাই যে ব্যক্তি রহমত ও জান্নাতের প্রতীক্ষায় থাকে, কিন্ত্ত তা লাভ করার উপকরণসমূহ অর্থাৎ, নেক আমল ও তওবা ইত্যাদি অবলম্বন করে না-তার ‘রাজা’ অর্থাৎ, আশার মাকাম হাসেল হয়নি। সে ধোঁকায় পতিত আছে। তার দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মত, যে বীজ বপণ করলো না, কিন্ত্ত ফসল পাওয়ার প্রতীক্ষা করতে থাকলো। যা কেবলই দূরাশা মাত্র।

‘রাজা’-আশার গুন অর্জনের উপায়ঃ আল্লাহ তাআলার রহমতের বিশালতা এবং তার অনু্গ্রহের বিস্তৃতির কথা মনে করবে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করবে।

‘খওফ’-ভয়ের বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘এবং আমাকে (আল্লাহকে) ভয় করো।’ (সূরা বাকারা-১৫০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘যে ভয় করে, সে রাত থেকেই চলতে থাকে অর্থাৎ, সে আগে আগে কাজ করে। আর যে রাত থেকেই চলতে থাকে, সে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। শুনে নাও! আল্লাহর সদাই অতি মূল্যবান। শুনে নাও! আল্লাহর সদাই জান্নাত।’ (তিরমিযী)

ভয়ের মর্মঃ ভবিষ্যতে অপছন্দীয় ও অবাঞ্ছিত বিষয় সংঘটিত হওয়ার আশংকায় মন ব্যথিত হওয়া।

ভয়ের গুণ অর্জন করার উপায়ঃ আল্লাহ তাআলার আযাব ও ক্রোধের কথা স্মরণ করবে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করবে।

‘যুহদ’-দুনিয়াবিমুখতার বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘যেন তোমরা আক্ষেপ না করো ঐ জিনিসের জন্য, যা তোমাদের হাতছাড়া হয়েছে, এবং আনন্দে আত্মহারা না হও ঐ জিনিসের জন্য, যা তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে দিয়েছেন।’
(সূরা হাদীদ-২৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘এ উম্মতের প্রথম সংশোধনী হলো, ইয়াকীন ও যুহদ অর্থাৎ, বিশ্বাস ও দুনিয়াবিমুখতা এবং এ উম্মতের প্রথম বিকৃতি হলো, কৃপণতা ও দীর্ঘ আকাংখা।’ (বাইহাকী)

যুহদের মর্মঃ কোন প্রিয় জিনিসকে পরিত্যাগ করে তার চেয়ে উত্তম জিনিসের দিকে ধাবিত হওয়া। যেমন, দুনিয়ার আকর্ষণ পরিত্যাগ করে আখিরাতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া।

যুহদ অর্জনের উপায়ঃ দুনিয়ার দোষ, ক্ষতি ও ক্ষণস্থায়ীত্বের কথা এবং আখিরাতের উপকারিতা ও চিরস্থায়ীত্বের কথা স্মরণ করবে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করবে।

‘তাওহীদ’-একত্ববাদের বর্ণনা

এখানে তাওহীদ দ্বারা ‘তাওহীদে আফআলী’ বা কর্মের ক্ষেত্রে একত্ববাদ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তার সমস্ত কাজ-কর্ম একাই সম্পাদন করেন, কেউ তার কাজে শরীক নেই।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের সমস্ত কাজকে।’
(সূরা সাফফাত-৯৬)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
‘তোমরা কোন কিছু চাও না, তবে যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চান।’
(সূরা তাকভীর-২৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘জেনে রেখো! সবাই যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য এক হও, তাহলে কখনোই তারা তোমার উপকার করতে পারবে না, তবে হাঁ অতটুকুই তোমার উপকার করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি সবাই তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য এক হয়, তাহলে কখনোই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না, তবে হাঁ, অতটুকুই ক্ষতি করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন।’ (আহমাদ, তিরমিযী)

তাওহীদের মর্মঃ এ কথার দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হতে পারে না।

তাওহীদ অর্জনের উপায়ঃ সৃষ্টির অক্ষমতা এবং স্রষ্টার সক্ষমতার কথা স্মরণ করবে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে।


‘তাওয়াক্কুল’-আল্লাহর উপর ভরসা করার বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘এবং কেবল আল্লাহর উপরই যেন ঈমানদারগণ ভরসা পোষণ করে।’
(সূরা আলে ইমরান-১৬০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘যখন চাও, আল্লাহর কাছেই চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করো, আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (আহমাদ, তিরমিযী)

তাওয়াক্কুলের মর্মঃ একমাত্র কর্মনির্বাহক আল্লাহর উপরই অন্তর থেকে নির্ভরশীল হওয়া।

তাওয়াক্কুল অর্জনের ‍উপায়ঃ আল্লাহর অনুগ্রহরাজী, তার ওয়াদাসমূহ এবং নিজের অতীত সফলতাসমূহের কথা স্মরণ করা এবং তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা।

মুহাব্বতের বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ভালোবাসেন এবং তারা আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে।’
(সূরা মায়িদা-৫৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়াকে ভালোবাসে আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত হওয়াকে ভালোবাসেন, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়াকে অপছন্দ করে আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত হওয়াকে অপছন্দ করেন।’ (বুখারী, মুসলিম)

মুহাব্বতের মর্মঃ মন এমন কোন জিনিসের দিকে আকৃষ্ট হওয়া, যার দ্বারা স্বাদ অনুভব হয়। এ আকর্ষণ যদি শক্তিশালী হয় তাহলে তাকে ‘ইশক’ বলে।

‘মুহাব্বত’ অর্জন করার উপায়ঃ জাগতিক সম্পর্কসমূহকে ছিন্ন করবে-অর্থাৎ, গাইরুল্লাহর মুহাব্বতকে মন থেকে বের করে দিবে। কারণ, দুই জিনিসের মুহাব্বত এক অন্তরে জমা হতে পারে না। এবং আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব, তার গুণাবলী ও নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করবে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করবে।

‘শওক’-অনুরাগের বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘যে আল্লাহর সাক্ষাতের আশা পোষণ করে, তার জন্য আল্লাহর নির্ধারিত সময় অবশ্যই আসিতেছে।’ (সূরা আনকাবূত-৫)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আপনার পবিত্র চেহারার দর্শন এবং আপনার মোলাকাতের ‘শওক’ ও আগ্রহ প্রার্থনা করছি।’ (নাসায়ী)

শওকের মর্মঃ যে কাংখিত ও প্রিয় বস্ত্ত কিছুটা জানা ও কিছুটা অজানা রয়েছে, তাকে পরিপূর্ণ জানা ও দেখার সহজাত অনুরাগ সৃষ্টি হওয়া।

‘শওক’ অর্জনের উপায়ঃ কাংখিত বস্ত্তর মুহাব্বত পয়দা করা। কারণ, মুহাব্বতের জন্য ‘শওক’ জরুরী বিষয়।

‘উন্‌স’-প্রীতির বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তিনিই ঈমানদারগণের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন।’ (সূরা ফাত্হ-৪)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘যে সকল লোকই আল্লাহর যিকিরে বসে, রহমতের ফেরেশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে রাখে এবং তাদের উপর ‘সাকীনা’ (প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি) অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তাদের কথা তার নিকটবর্তী ফেরেশতাদের মধ্যে আলোচনা করেন।’ (মুসলিম)

‘উনসের’ মর্মঃ যে জিনিস কিছুটা জানা ও স্পষ্ট, আর কিছুটা অজানা ও অস্পষ্ট, তার অস্পষ্টতার কারণসমূহ দেখে তা জানার ও স্পষ্ট করার আগ্রহ জন্মাকে ‘শওক’ বলে। আর স্পষ্টতার কারণসমূহ দেখে আনন্দ ও প্রফুল্লতা সৃষ্টি হলে তাকে ‘উন্‌স’ বলে। এ আনন্দ অনেক সময় এতদূর প্রবল হয় যে, তখন কাংখিত বস্ত্তর ‘জালালী সিফাত’ বা বড়ত্ব, মহত্ব ও তেজোদ্দীপ্ত গুণাবলী ও তার তেজস্ক্রিয়ার বিষয় দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। যার ফলে তার কথা ও কাজের মধ্যে কিছুটা অকৃত্রিমতা চলে আসে-একে ‘ইম্বিসাত’ ও ‘ইদলাল’ বলা হয়। ‘উন্‌স’ যেহেতু মুহাব্বতেরই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া, তাই ‘উন্‌স’ অর্জনের ভিন্ন কোন পন্থা নেই। মুহাব্বত পয়দা করাই তার পন্থা।

‘রাযা’-সন্ত্তষ্টির বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্ত্তষ্ট হয়েছেন এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্ত্তষ্ট হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘মানুষের সৌভাগ্যের অন্যতম হলো, আল্লাহ তাআলা তার জন্য যে ফয়সালা করেন তার উপর রাজি ও সন্ত্তষ্ট থাকা।’ (আহমাদ, তিরমিযী)

‘রাযার’ মর্মঃ আল্লাহর ফয়সালার উপর মুখে বা অন্তরে আপত্তি না করা। কোন কোন সময় এ অবস্থা এমন প্রবল হয় যে, বিপদে-আপদে কষ্ট পর্যন্ত অনুভূত হয় না। এটিও মুহাব্বতেরই অন্যতম প্রভাব। যা অর্জনের ভিন্ন কোন পন্থা নেই।

নিয়তের’ বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘এবং আপনি তাদেরকে তাড়িয়ে দিবেন না, যারা একমাত্র আল্লাহর সন্ত্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে।’ (সূরা আন’আম-৫২)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আমল ধর্তব্য হয় নিয়তের ভিত্তিতে।’

নিয়তের মর্মঃ মন এমন কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ হওয়া, যাকে নিজের লাভ ও স্বার্থের অনুকূল মনে করে।

‘নিয়ত’ অর্জনের উপায়ঃ নিজের লাভ ও উপকারের জিনিস-যেমন, নেক আমল এবং আখিরাতের পথে চলার উপকারিতা ও কল্যাণসমূহের জ্ঞান লাভ করে সেগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির করবে, তাহলো মনের মধ্যে আমলের স্পৃহা জাগবে।

‘ইখলাসের’ বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তাদেরকে এ ছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।’ (সূরা বায়্যিনাহ-৫)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘মানুষ যখন সবার সামনে উত্তমভাবে নামায পড়ে এবং গোপনেও উত্তমভাবে নামায পড়ে, তখন আল্লাহ তাআলা বলেন-এ ব্যক্তি হলো, আমার সত্যিকারের বান্দা।’
(ইবনু মাজা)
ইখলাসের মর্মঃ ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্ত্তষ্টিকে লক্ষ্য বানানো। মানুষকে খুশি করা, তাদের সন্ত্তষ্টি লাভ করা বা নিজের নফসের কোন কামনা পূর্ণ করাকে লক্ষ্য না বানানো।

ইখলাস অর্জনের উপায়ঃ ইখলাস অর্জনের উপায় ‘রিয়ার’ প্রতিকারের মধ্যে জানা যাবে। কারণ, ‘রিয়া’ প্রতিহত করাই ইখলাস অর্জন করার শামিল।

‘সিদক’-নিষ্ঠার বর্ণনা

এখানে ‘সিদক’ দ্বারা ব্যাপক অর্থ উদ্দেশ্য নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার ‘মাকামাত’ বা স্তরসমূহে সত্যিকার অর্থে উন্নতি করা উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘নিশ্চয় খাঁটি মুমিন তারা, যারা আল্লাহ এবং তার রাসূলকে বিশ্বাস করেছে, তারপর আর সন্দেহে পোষণ করে নাই এবং নিজেদের জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারাই খাঁটি ঈমানদার।’ (সূরা হুজরাত-১৫)

অর্থঃ ‘হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর (রাযিঃ)এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন, তখন তিনি তার এক গোলামের উপর লা’নত করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে ফিরলেন এবং বললেন, অভিশাপকারী হয়ে আবার সিদ্দীক! তখন আবু বকর (রাযিঃ) তার একজন গোলামকে মুক্ত করে দিলেন এবং তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বললেন-আর কখনো এরুপ করবো না।’ (বাইহাকী)

‘সিদকের’ মর্মঃ আধ্যত্মিকতার যে স্তরে উপনীত হবে, তার উৎকর্ষতা লাভ করা। যেন তাতে ত্রুটি না থাকে।

‘সিদক’ অর্জনের উপায়ঃ সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে। কখনো কোন কমতি হলে তার ক্ষতিপূরণ করবে। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে ঐ মাকামের পূর্ণতা লাভ হবে।

‘মুরাকাবার’ বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সবকিছুর নিরীক্ষক।’ (সূরা নিসা-১)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘ইহসান’ হলো, তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করো, যেমন কিনা তুমি তাকে দেখছো। তুমি যদিও তাকে দেখছো না, কিন্ত্ত তিনি তো তোমাকে দেখছেন।’ (মুসলিম)

তিনি আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তুমি আল্লাহর প্রতি ধ্যান রাখো, তাকে তোমার সামনে পাবে।’ (আহমাদ, তিরমিযী)

‘মুরাকাবার’ মর্মকথাঃ অন্তর দ্বারা তার প্রতি ধ্যান রাখা, যে তাকে দেখাশোনা করছে।

‘মুরাকাবা অর্জনের উপায়ঃ এ কথা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ তাআলা আমার যাহের ও বাতেন অর্থাৎ, প্রকাশ্য ও গোপন সব জানেন। কোনকিছুই কোন সময়েই তার নিকট গোপন নেই। সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব, মহত্ব ও অসীম ক্ষমতা এবং তার আযাব-গযব ও শাস্তির কথাও স্মরণ করবে। নিয়মিতভাবে একথা স্মরণ করতে থাকলে এবং চিন্তা-ফিকির করতে থাকলে এ ধ্যান বদ্ধমূল হয়ে যাবে। তখন আল্লাহর মর্জির খেলাফ কোন কাজ তার দ্বারা আর সংঘটিত হবে না।

‘ফিকিরের’ বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘এবং আল্লাহ তাআলা মানুষদের জন্য দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা ইবরাহীম-২৫)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘চিরস্থায়ী বস্ত্তকে ক্ষণস্থায়ী বস্ত্তর উপর প্রাধান্য দাও।’ (আহমাদ)

ফিকিরের মর্মঃ জানা দুই জিনিসকে মনে হাজির করা, যার ফলে তৃতীয় জিনিস মনে হাজির হয়ে যায়। যেমন, একটি কথা এটা জানা আছে যে, আখিরাত চিরস্থায়ী, আর দ্বিতীয় কথা এটা জানা আছে যে, চিরস্থায়ী জিনিস প্রাধান্য পাওয়ার উপযুক্ত। এ দুই কথা মিলানোর দ্বারা তৃতীয় কথা এটা জানা গেলো যে, আখিরাত প্রাধান্য পাওয়ানর উপযুক্ত। প্রথম দুই জিনিসকে মনের মধ্যে হাজির করাই তৃতীয়টি অর্জন করার উপায়।

উপরোল্লেখিত আধ্যাত্মিক স্তরসমূহ পরিশুদ্ধ করার দ্বারা আধ্যাত্মিক অন্যান্য স্তরও পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য গুণ যেমন, ‘তাকওয়া’ অর্থাৎ, পরহেযগারী, ‘ওয়ারা’ অর্থাৎ খোদাভীতি, ‘কানাআত’ অর্থাৎ অল্পেতুষ্টি, ‘ইয়াকীন’ অর্থাৎ বিশ্বাস, ‘উবুদিয়াত’ অর্থাৎ দাসত্ব, ‘ইস্তিকামাত’ অর্থাৎ দ্বীনের উপর দৃঢ়তা, ‘হায়া’ অর্থাৎ লজ্জা, ‘হুররিয়্যাত’ অর্থাৎ স্বাধীনতা, ‘ফুতুওয়্যাত’ অর্থাৎ বীরত্ব ও দানশীলতা, ‘খুলুক’ অর্থাৎ সদাচরণ, ‘আদব’ অর্থাৎ শিষ্টাচার, ‘মারিফাত’ অর্থাৎ আল্লাহর পরিচিত লাভ ইত্যাদি গুণাবলীর উল্লেখ নিম্নোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহে রয়েছে-

‘আল্লাহকে ভয় করো।’ (সূরা আলে ইমরান-১০২)

‘মানুষের ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, অনর্থক কাজ-কথা পরিহার করা।’

‘অল্পে তুষ্টি অফুরন্ত ভান্ডার।’

‘এবং তারা আখেরাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে।’ (সূরা বাকারা-৪)

‘তোমার রবের ইবাদত করো। তোমার নিকট সুনিশ্চিত বস্ত্ত (মৃত্যু)) আসা পর্যন্ত।’
(সূরা হিজর-৯৯)

‘নিশ্চয় যারা বলে, আল্লাহ আমাদের রব, তারপর তার উপর অবিচল থাকে।’
(সূরা হা-মীম সিজদা-৩০)

‘আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করো।’

‘তারা নিজেদের উপর অন্যদেরকে প্রাধাণ্য দেয় নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও।’
(সূরা হাশর-৯)

কিয়ামত দিবসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
‘হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মাত! আমার উম্মাত!-বলা।’

‘নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।’ (সূরা কালাম-৪)

‘দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি।’ (সূরা নাজম-১৭)

‘তারা আল্লাহর যথাযথ মূল্যায়ন করেনি।’ (সূরা আন’আম-৯১) (কুশাইরিয়াহ)

উপরোক্ত বিষয়সমূহের বিন্যাস সুস্পষ্ট বিধায়, আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকায় বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করলাম।