আধ্যাত্মিকতা সংক্রান্ত কিছু মাসআলা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: তা’লীমুদ্দীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
এ অধ্যায়ের অধীনে কয়েকটি পরিচ্ছেদে কিছু জরুরী মাসআলা বর্ণনা করা হবে।
পরিচ্ছেদ-১: আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার পর আর বিতাড়িত হয় না। যারা বিতাড়িত হয়েছে, তারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার পূর্বে বিতাড়িত হয়েছে।
পরিচ্ছেদ-২: আল্লাহর ওলীগণ অন্যদের চেয়ে ইবাদতের অধিক সওয়াব পেয়ে থাকেন। কারণ, তাদের ইবাদতের মধ্যে ইখলাস ও দাসত্ব গুণ অধিক হয়ে থাকে।
পরিচ্ছেদ-৩: অলৌকিক ঘটনা কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। তার এক প্রকারকে বলে ‘কাশফ’। ‘কাশফ’ আবার দুই প্রকার-
ক. কাশফে কাউনী
খ. কাশফে ইলাহী
‘কাশফে কাউনী’ যার হয়, স্থান ও কালের দূরত্ব তার জন্য আড়াল ও অন্তরাল হয় না। সে দূরবর্তী স্থানের বা পরবর্তী সময়ের কোন বস্ত্তর অবস্থা জানতে পারে।
‘কাশফে ইলাহী’ বলা হয়, আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত বা আল্লাহ তাআলার যাত ও সিফাত (সত্তা ও গুণাবলী) সংক্রান্ত কোন বিশেষ জ্ঞান, সূক্ষ্ম জ্ঞান বা রহস্যপূর্ণ জ্ঞান অন্তরে অবতীর্ণ হওয়া। বা ‘আলমে মিসালের’ মধ্যে এগুলো আকৃতি ধারণ করে বিকশিত হওয়া।
অলৌকিকতার দ্বিতীয় প্রকারকে বলে ‘ইলহাম’। ‘ইলহাম’ বলা হয়, আল্লাহর ওলীর অন্তরে ইতমীনানের সাথে কোন ইলম অবতীর্ণ হওয়া বা অদৃশ্য ঘোষকের শব্দ শুনতে পাওয়া।
অলৌকিকতার তৃতীয় প্রকারকে বলে ‘তাসাররুফ’ ও ‘তা’সীর’। এটি আবার দু’ প্রকার। এক হলো, মুরীদের অন্তরে ‘তাসীর’ করা বা প্রভাব বিস্তার করা, যাতে করে তার অন্তর আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার হলো, জগতের অন্যান্য বস্ত্তর মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করা। এটা সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমেও হতে পারে, আবার দু’আর মাধ্যমেও হতে পারে। এতদসংক্রান্ত অসংখ্য ঘটনা আল্লাহর ওলীদের থেকে বর্ণিত রয়েছে।
পরিচ্ছেদ-৪: ‘কাশফ’ ও ‘ইলহাম’ দ্বারা ‘যন্নী’ হাসিল হয়। (এটি শরীয়তের কোন দলীল নয়)। তাই কাশফ ও ইলহাম শরীয়তের বিধানের সাথে সাজুয্যপূর্ণ হলে তা গৃহীত হবে।
আর যদি ‘কাশফ’ ও ‘ইলহাম’ শরীয়তের বিধানের সাথে সাজুয্যপূর্ণ না হয় তাহলে তা পরিহার করা ওয়াজিব। (কারণ, ইসলামী শরীয়ত হলো, চিরস্থায়ী তা কোনভাবেই ‘মানসূখ’ বা রহিত হতে পারে না।)
আর যদি কাশফ শরিয়তবিরোধী না হয়, [তাহলে ব্যবস্থাপনাগত বিষয় বা নিছক দুনিয়াবী বিষয়সমূহে গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যদি] দুই কাশফ পরস্পরবিরোধী হয়, এবং ঐ উভয় কাশফ একই ব্যক্তির হয়, তাহলে সর্বশেষ কাশফ গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি কাশফ দু’টি দুই ব্যক্তির হয় তাহলে স্বাভাবিক, সজাগ ও চৈতন্যের অধিকারী ব্যক্তির কাশফ ভাবোন্মত্ত ব্যক্তির কাশফের চেয়ে অধিক আমলযোগ্য হবে। আর যদি উভয়েই স্বাভাবিক ও সজাগ হয়, তাহলে যার কাশফ অধিকাংশ সময় শরীয়তসম্মত হয় তারটা গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি এ ক্ষেত্রেও উভয়ে সমান হয়, তাহলে যার মধ্যে আল্লাহর নৈকট্য ও কবুলিয়াতের লক্ষণসমূহ অধিক পরিলক্ষিত হয়, তার কাশফ প্রাধান্য পাবে। আর যদি এ বিষয়েও উভয়ে সমান হয় তাহলে যাকে নিজের মন গ্রহণ করে, তার উপর আমল জায়িয আছে।
আর যদি একটি কাশফ একজনের আর অপরটি হয় একাধিক জনের তাহলে একদল লোকের কাশফই শক্তিশালী হবে। তবে যদি পূর্বের ব্যক্তি একাই অন্য সবার চেয়ে অধিক কামিল হয় তাহলে তার কাশফই প্রাধান্য পাবে।
পরিচ্ছেদ-৫: আল্লাহর ওলী হওয়ার জন্য অলৌকিক ঘটনার অধিকারী হওয়া জরুরী নয়। কোন কোন সাহাবী থেকে সারা জীবনেও কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি, অথচ তারা সমস্ত ওলীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ফযীলত ও মর্যাদার ভিত্তি হলো, আল্লাহর নৈকট্য এবং ইবাদতে ইখলাসের উপর। অলৌকিক ঘটনা অনেক যোগী-সন্ন্যাসীদের থেকেও ঘটে থাকে। এটি সাধনার ফল। অলৌকিক ঘটনার মর্যাদা অন্তরের যিকরের চেয়েও কম। ‘আওয়ারিফ’ গ্রন্থের লেখক অলৌকিক ঘটনার অধিকারী নয় এমন লোকদেরকে অলৌকিক ঘটনার অধিকারী লোকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছেন।
আরেফগণের বড় কারামত হলো, শরীয়তের উপর অবিচল থাকা এবং তাদের বড় কাশফ হলো, মুরীদদের আধ্যাত্মিক যোগ্যতা বুঝতে পেরে সে অনুপাতে তাদেরকে তারবিয়্যাত দান করা। শাইখে আকবার লিখেছেন যে, কতক কারামতের অধিকারী আল্লাহর ওলী মৃত্যূর সময় আশা ব্যক্ত করেছেন যে, হায়! যদি আমাদের থেকে কারামত প্রকাশ না পেতো!
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, তাহলে আল্লাহর ওলীদের আল্লাহর ওলী হওয়ার বিষয়টি কিভাবে বোঝা যাবে। এর উত্তর হলো, প্রথমতঃ আল্লাহর ওলী হওয়ার ব্যাপারটি একটি গোপন বিষয়, তা জানতে পারার প্রয়োজনটাই বা কী? আার যদি এটি জানার উদ্দেশ্য হয় তাদের থেকে উপকৃত হওয়া, তাহলে [জেনে রেখ এটা কারামত দিয়ে নির্ণয় করা যায় না, বরং তা ঐ দশটি আলামত দ্বারা নির্ণয় করতে হবে যা কসদুস সাবীলে উল্লেখ রয়েছে। সেসব আলামত যাদের মধ্যে পাবে] তাদের সুহবত ও তা’লীম দ্বারা সৌভাগ্যবান হও। যখন দিনে দিনে নিজের অবস্থার পরিবর্তন দেখতে পাবে তখন নিজে নিজেই জানতে পারবে যে, তার মধ্যে তা’সীর বা প্রভাব প্রয়োগের শক্তি আছে।
পরিচ্ছেদ-৬: পীর খোঁজার পদ্ধতি
বাতেনী কামাল বা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা লাভ করা যখন জরুরী প্রমাণিত হলো, আর আল্লাহ তাআলার নিয়ম এটাই যে, পীরের মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে এ পথ অতিক্রম করা যায় না, তাই একজন হক্কানী পীর তালাশ করে নেওয়াও জরুরী। হক্কানী পীর খুঁজে বের করার পদ্ধতি এই যে, পীরদের মধ্যে যাদেরকে কামেল মনে হবে, তাদের সঙ্গে বেশী বেশী মেলামেশা করতে থাকবে। তাদের কারো দোষ তালাশ করবে না বা কাউকে আল্লাহর ওলী বলে অস্বীকার করার ক্ষেত্রেও তাড়াহুড়া করবে না। আবার তাড়াতাড়ি বাইআতও হবে না।
বরং প্রথমতঃ দেখবে যে, শরীয়তের উপর তিনি প্রতিষ্ঠিত কিনা, যদি শরীয়তের উপর প্রতিষ্ঠিত না হন, তাহলে তার থেকে পৃথক হয়ে যাবে। যদিও তার থেকে অলৌকিক ঘটনা ঘটুক না কেন। আল্লাহ তাআলা হুকুম দিচ্ছেন-
অর্থঃ ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি তাদের মধ্যে থেকে কোন পাপী বা কোন কাফিরের কথা মানবেন না।’ (সূরা দাহ্র-২৪)
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘এবং তার কথা মেনো না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার কামনার অনুসরণ করে এবং তার কাজ সীমাতিক্রম করে গেছে।’
(সূরা কাহাফ-২৮)
আর যদি তিনি শরীয়তের উপর প্রতিষ্ঠিত হন, তাহলে তিনি যে, নেক এবং ওলী তা তো প্রমাণিত হলো, কিন্ত্ত যে ব্যক্তি হক্কানী পীর তালাশ করছে তার তো প্রয়োজন ‘তারবিয়্যাত’, তাই এখনই তার কাছে বাইআত হবে না। বরং তার সঙ্গে কিছুদিন অবস্থান করে দেখবে যে, তার সংসর্গে থাকার দ্বারা অন্তরে কোন প্রভাব (আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত এবং দুনিয়া ও গুনাহের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি) হয় কিনা। কারণ, হাদীস শরীফে আল্লাহর ওলীদের এই পরিচয়ই এসেছে-
‘তাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।’
তবে বেশীর ভাগ সাধারণ মানুষের জন্য অল্প সময়ের সুহবতে এটি বুঝতে পারা কঠিন। এমন সময় তার মুরীদদের মধ্যে থেকে যাকে বুদ্ধিমান এবং সত্যবাদী দেখবে, তার নিকটে শাইখের তা’সীর বা প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তোমরা যদি না জানো, তাহলে যে জানে তাকে জিজ্ঞাসা করো।’ (সূরা নাহ্ল-৪৩)
এবং হাদীস শরীফে এসেছে-
অর্থঃ ‘অজ্ঞতা রোগের ঔষধ হলো, অন্যকে জিজ্ঞাসা করা।’
তাই নির্ভরযোগ্য কোন মানুষ সাক্ষ্য দিলে তা বিশ্বাস করবে। আর একাধিক মানুষ যদি এমনিতেই সাক্ষ্য দেয়, তাহলে তা হবে অধিক তৃপ্তির কারণ। তবে লক্ষণ দ্বারা সাক্ষ্যদাতাদের সত্যবাদী মনে হতে হবে। মুরীদরা সাধারণতঃ পীরকে আকাশে তুলে থাকে এমন যেন না হয়। এভাবে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর তার নিকট বাই’আত হবে এবং তার কথা মত আমল করবে।
পরিচ্ছেদ-৭: একাধিক পীর ধরার বর্ণনা
একজন শাইখের (পীরের) খেদমতে ভক্তি ও সুধারণা সহকারে উল্লেখযোগ্য একটি সময় অবস্থান করা সত্ত্বেও যদি তার কোন উপকারিতা ও প্রতিক্রিয়া না পায়, তাহলে নিজের কাংখিত বস্ত্ত অন্যত্র তালাশ করবে। কারণ, লক্ষ্য হলো, আল্লাহকে পাওয়া, শাইখ মূল লক্ষ্য নয়। কিন্ত্ত পূর্বের শাইখের সম্পর্কে মন্দ বিশ্বাস পোষণ করবে না। এমনও হতে পারে যে, তিনি কামেল ও মুকাম্মিল লোক, কিন্ত্ত তার সফলতা এখানে নেই। একইভাবে উদ্দেশ্য সাধনের পূর্বে শাইখের ইন্তিকাল হয়ে গেলে বা এতদূরে চলে গেলে যে, শাইখের মোলাকাতের আশাই না থাকে, তাহলেও অন্যত্র নিজের লক্ষ্যবস্ত্ত খোঁজ করবে। এরুপ চিন্তা করবে না যে, কবর থেকে ফয়েয নেওয়া যথেষ্ট হবে, অন্য শাইখের কী প্রয়োজন। কারণ, কবর থেকে তা’লীমের ফয়েয লাভ করা যায় না। তবে নিসবতের অধিকারী ব্যক্তির হালাতের উন্নতি ঘটে, আর এ ব্যক্তি তো এখনো তা’লীমের মুখাপেক্ষী। তা না হলে কারোই বাই’আতের জরুরত হতো না। কামেল লোকদের লাখ লাখ কবর বিদ্যমান রয়েছে, বরং নবীগণের কবরও তো বিদ্যমান রয়েছে। তাই হক্কানী ও কামেল জীবিত লোকের নিকট থেকেই তা’লীম-তারবিয়ত গ্রহণ করতে হবে।
পরিচ্ছেদ-৮: বিনা প্রয়োজনে কেবলই শখের বশে কয়েক জায়গায় বাইয়াত হওয়া খারাপ। এতে বাইয়াতের বরকত চলে যায়। শাইখের মন ক্লেদাক্ত হয়। ‘নিসবত’ ছিন্ন হওয়ার আশংকা থাকে।
পরিচ্ছেদ-৯: শাইখের সান্নিধ্যে থাকার ফলে অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে বলে বুঝতে পারলে তার সাহচর্যকে গনীমত মনে করবে। তার মুহাব্বত ও ভালোবাসাকে অন্তরে সুদৃঢ় করবে। তার পুরোপুরি আনুগত্য করবে। তাকে খুশি রাখবে। এমন কোন আচরণ করবে না, যার কারণে শাইখের মনে আবিলতার সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা ‘ফয়েয’ বন্ধ হয়ে যায়। সূরায়ে হুজরাতের প্রথম কয়েক আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কিরূপ আদব বজায় রেখে চলবে, সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে-শাইখ যেহেতু নবীর ওয়ারিস-তাই তার মুহাব্বত ও আদবের বিধানও রয়েছে।
পরিচ্ছেদ-১০: প্রসিদ্ধ আছে যে, নিজের পীরকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করবে। বাহ্যতঃ কথাটি সঠিক মনে হয় না। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
অর্থঃ ‘এবং প্রত্যেক জ্ঞানীর উপর বড় জ্ঞানী রয়েছে।’ (সূরা ইউসুফ-৭৬)
এর উত্তর হলো, যদি ভালোবাসার আতিশয্যে এরুপ মনে করে, তাহলে সে মা’যুর। আর যদি ভালোবাসার উন্মাদনার প্রাবল্য না হয়, তাহলে এতটুকু মনে করবে যে, আমার অনুসন্ধানে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে এর চেয়ে অধিক উপকারী ব্যক্তি আমি পাবো না।
আমার শাইখ আমার মুরশিদ আমার মনিব আলহাজ্জ আলহাফিয মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ (দামাত বারাকাতুহুম) এ কথার ব্যাখ্যায় এমনটিই বলেছেন।
পরিচ্ছেদদ-১১: নিজের শাইখ দ্বারা কদাচিৎ যদি কোন আপত্তিজনক কাজ হয়ে যায়, তাহলে আপত্তি করবে না। হযরত মূসা (আঃ) এবং খিযির (আঃ)এর ঘটনা স্মরণ করবে বা ভালো কোন ব্যাখ্যা গ্রহণ করবে, কিংবা এ কথা মনে করবে যে, ওলীগণ নিষ্পাপ নন তাছাড়া তাওবা করলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তাই তিনিও তাওবা করলে মাফ পেয়ে যাবেন। তবে এ কথাগুলো ঐ শাইখের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যিনি শরীয়তের পাক্কা অনুসারী ও মজবুত, কিন্ত্ত ঘটনাচক্রে তার দ্বারা এমন কোন কাজ হয়ে গেছে। আর যদি সে এমন হয় যে, পাপাচারকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে, তাহলে সে ওলী নয়। তার কথা ও কাজের ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন নেই। তার থেকে দূরে সরে যাবে।
পরিচ্ছেদ-১২: আল্লাহর ওলীদের আদবের ক্ষেত্রে ত্রুটি করা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনিভাবে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করা আরও জঘন্য কাজ। কারণ, এতে আল্লাহ ও রাসূলের শানে কমতি ও ত্রুটি হয়ে থাকে। যেমন তাদেরকে ‘আলিমুল গায়ব’ বা গায়ব সম্পর্কে অবগত মনে করা। এটা একটা কুফুরী বিশ্বাস। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহ ছাড়া আসমান-জমিনের আর কেউই গায়ব জানে না।’ (সূরা নামল-৬৫)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ‘(হে নবী আপনি) বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডারসমূহ রয়েছে এবং আমি একথাও বলি না যে, আমি গায়ব জানি না।’
(সূরা আন’আম-৫০)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তারা আল্লাহর জ্ঞানের কিছুই আয়ত্তে আনতে পারে না, তবে তিনি যা চান।’
(সূরা বাকারা-২৫৫)
আল্লাহর ওলীদেরকে কোন জিনিসকে অস্তিত্ব দেওয়ার বা বিলুপ্ত করার বা সন্তান, রিযিক ইত্যাদি দেওয়ার বা আল্লাহর থেকে জোর-জবরদস্তি দেওয়ানোর উপর ক্ষমতাবান মনে করা এটাও কুফুরী বিশ্বাস। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘(হে নবী আপনি) বলুন যে, আমি আমার নিজের লাভ-লোকসানের মালিক নই, তবে যতটুকু আল্লাহ চান।’ (সূরা আ’রাফ-১৮৮)
আল্লাহর ওলীদের জন্য ইবাদতের কোন পন্থা অবলম্বন করা, যথা তাদের নামে মান্নত করা, তাদের বা তাদের কবরের চতুর্দিকে তওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করা, তাদের নিকট দু’আ করা, তাদের নামকে ইবাদত হিসাবে জপা-এগুলোর কোনটা গুনাহ-বিদআত এবং কোনটা কুফুরী ও শিরকী।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’
(সূরা ফাতিহা-৪)
রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন –
অর্থঃ ‘বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা নামাযের মত ইবাদত।’
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘দু’আ করা একটি বড় ইবাদত।’
তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন-
অর্থঃ ‘এবং তোমাদের প্রতিপালক বলেন যে, আমার কাছে দু’আ করো, আমি তোমাদের দু’আ কবুল করবো। নিঃসন্দেহে যারা ইবাদত করতে অহংকার করে, অতিসত্বর তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সূরা মু’মিন-৬০)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য যাদেরকে তোমরা আহ্বান করো, তারা তোমাদের মতই বান্দা।’
(সূরা আ’রাফ-১৯৪)
পরিচ্ছেদ-১৩: কোন ওলী কখনো কোন নবীর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। ইবাদত কখনো মাফ হতে পারে না, বরং খাস লোকদের অধিক ইবাদতের হুকুম রয়েছে। তবে স্বাভাবিক অনুভূতিহীন ‘মাজযূব’ ব্যক্তি মা’যুর বলে গন্য। ওলীরা নিষ্পাপ নয় এবং কোন সাহাবীর মর্যাদায়ও তারা পৌঁছতে পারে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত।’ (সূরা আলে ইমরান-১১০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘সমস্ত যামানার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো আমার যামানা।’
তাছাড়া এ ব্যাপরে ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত রয়েছে যে, সকল সাহাবী ‘আদেল’ বা বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও পরহেযগার। বিশিষ্ট তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন-
অর্থাৎ, ‘হযরত মুআবিয়া (রাযিঃ) এর ঘোড়ার নাকে যে ধুলা প্রবেশ করেছে, তা হযরত উয়াইস করনী (রহঃ) এবং উমর বিন আবদুল আযীয মারওয়ানী (রহঃ) থেকে শ্রেষ্ঠ।’
পরিচ্ছেদ-১৪: কবরকে বেশী উঁচু করা, কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করা, জাক-জমক ধুমধামের সাথে উরস করা। আলোকসজ্জা করা-যেমন কিনা বর্তমান যুগে প্রচলিত রয়েছে- জীবিত বা মৃতকে সিজদা করা, এ সবই নিষিদ্ধ। তবে কবর যিয়ারত করা, ইসালে সাওয়াব করা এবং ‘সাহেবে নিসবত’ হলে (শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায়) তাদের থেকে ফয়েয নেওয়া-এগুলো ভালো কাজ।
পরিচ্ছেদ-১৫: ক. পীরও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকবে না। আধ্যাত্মিক স্তরসমূহে উন্নতি করতে থাকবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘(হে মুহাম্মাদ!) বলুন, হে আমার প্রতিপালক আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।’
(সূরা ত্বাহা-১১৪)
খ.কামেল হওয়ার দাবী করবে না, তবে নেয়ামতের কথা প্রকাশ করায় ক্ষতি নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতার বর্ণনা দিও না।’ (সূরা নাজম-৩২)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘এবং তোমার প্রতিপালকের নেয়ামতের বর্ণনা দাও।’ (সূরা যুহা-১১)
তরীকতের প্রচার-প্রসারে উদগ্রীব থাকবে-
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘(রাসূল) তোমাদের কল্যাণে উদগ্রীব।’ (সূরা তাওবা-১২৮)
ঘ. মুরীদদের সঙ্গে দয়া-মায়া ও ভালোবাসার আচরণ করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সূরা তাওবা-১২৮)
ঙ. তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আপনি যদি রুক্ষস্বভাবের এবং কঠোর হৃদয়ের হতেন, তাহলে অবশ্যই তারা আপনার নিকট থেকে সরে যেতো, তাই তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)
চ. দুনিয়াদারদের খাতিরে তাদেরকে পৃথক করে দিবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তাদেরকে আপনার নিকট থেকে তাড়িয়ে দিবেন না, যারা তাদের প্রতিপালককে সকাল-সন্ধ্যায় ডাকে, তারা তার সন্ত্তষ্টি কামনা করে। আপনার উপর তাদের কোন হিসাব নেই এবং তাদের উপরও আপনার কোন হিসাব নেই যে, আপনি তাদেরকে হটিয়ে দিবেন, ফলে আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।’ (সূরা কাহফ-২৮)
ছ. মুরীদদের থেকে দুনিয়ার ধনসম্পদ ও দুনিয়াবী উপকার প্রত্যাশা করবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তুমি দুনিয়ার জীবনের সাজসজ্জা কামনা করো।’ (সূরা কাহফ-২৮)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আমি তোমাদের নিকট এর কোন বিনিময় চাই না।’ (সূরা আন’আম-৯০)
জ. মানুষ কষ্ট দিলে ধৈর্যধারণ করবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহ তাআলা আমার ভাই মূসার উপর রহম করুন, তাকে এর চেয়ে বেশী কষ্ট দেওয়া হয়েছে কিন্ত্ত তিনি সবর করেছেন।’
ঝ. নিজেকে গম্ভীর এবং ভাবমূর্তিপূর্ণ রাখবে অন্যথায় মুরীদদের দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে তারা ফয়েয পাবে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
অর্থঃ ‘তাকে দূর থেকে কেউ দেখলে ভয় পেতো, আর যে কাছে থেকে দেখতো সে তাকে ভালোবাসতো।’
বা এর অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে।
ঞ. এক মুরীদকে অন্য মুরীদের উপর প্রাধান্য দিবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন।’ (সূরা ‘আবাসা-১)
তবে কারো মধ্যে আল্লাহকে পাওয়ার চেষ্টা ও পিপাসা অধিক থাকলে তাকে প্রাধান্য দেওয়ার দোষ নেই।
ট. পীর সাহেব এমন কোন আচরণ করবে না, যার দ্বারা মানুষের ভক্তি-বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, এতে আধ্যাত্মিকতার লাইনের উন্নতি রুদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী।’ (সুরা আহযাব-৪৬)
এ অধ্যায়ের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যে সমস্ত বিষয় তুলে ধরা হলো, সেগুলো কাজী সানাউল্লাহ সাহেব পানিপতি (রহঃ) এর উৎকৃ্ষ্টতম গ্রন্থ ‘ইরশাদুত তালিবীন’ থেকে সংগৃহীত।
পরিচ্ছেদ-১৬: শাইখের কল্পনা বা ধ্যান করা
শাইখের কল্পনা করাকে ‘বরযাখ’, ‘রাবেতা’ এবং ‘ওয়াসেতা’ও বলে। আজ পর্যন্ত কোন হকপন্থী বিজ্ঞ আলিম শাইখ এর কল্পনার অর্থ এরুপ বলেননি যে, আল্লাহ তাআলাকে পীরের আকৃতিতে মনে করবে। এটি নিছক বাতেল ধারণা। আর যদি অর্থাৎ, ‘আল্লাহ তাআলা আদমকে তার আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন-এর দ্বারা সন্দেহ সৃষ্টি হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, আকৃতি বলতে কেবল নাক-মুখকেই বুঝায় না, যেমন মানুষ বলে থাকে-এ মাসআলাটির সুরাত বা রুপ এই- অথচ কোন মাসআলার নাক-মুখ থাকে না। সুরত শব্দ দ্বারা গুণ ও বৈশিষ্টও বুঝানো হয়। যেহেতু মানুষকে দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ইত্যাদি প্রদান করা হয়েছে, তাই তাকে আল্লাহর সুরতে সৃষ্টি করা হয়েছে-বলা হয়েছে। মোটকথা, ‘শাইখের কল্পনার’ উপরোক্ত অর্থ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে কেবল এতটুকু উল্লেখে আছে যে, শাইখের আকৃতি, তার গুণাবলী ও উৎকর্ষতার কল্পনা বেশী বেশী করার দ্বারা তার সঙ্গে মুহাব্বত সৃষ্টি হয় এবং ‘নিসবত’ শক্তিশালী হয়। ‘নিসবত’ শক্তিশালী হওয়ার ফলে বিভিন্ন প্রকারের বরকত হয়।
কোন কোন মুহাক্কেক আলেম শাইখের কল্পনার এই উপকারিতা বলেছেন যে, এক কল্পনা অন্য কল্পনাকে প্রতিহত করে। এতে একাগ্রতা লাভ হয় এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর চিন্তা প্রতিহত হয়। হযরত শাহ কালীমুল্লাহ সাহেব (রহঃ) ‘কাশকুল’ গ্রন্থে এ হিকমতই বয়ান করেছেন। তিনি আরো বলেছেন-‘বরযখ’ তথা শাইখের কল্পনা যত সূক্ষ্ম ও অন্তর্নিহিত হবে তত উৎকৃষ্ট হবে, আর যত স্থূল হবে ও প্রতিমূর্তি ধারণ করবে তত নিকৃষ্ট হবে।’
মোটকথা, শাইখের কল্পনা ও ধ্যান করায় যত ফায়দা ও হেকমতই থাক না কেন, লেখকের অভিজ্ঞতা এই যে, এই ‘শোগল’ আধ্যাত্মিকতার পথের বিশেষ লোকদের জন্য তো উপকারী, কিন্ত্ত সাধারণের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, শেষ পর্যন্ত এটা আকৃতি পূজার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ কারণেই ইমাম গাযযালী (রহঃ) প্রমুখ মুহাক্কেক আলেমগণ সাধারণ মানুষকে এ ধরনের ‘শোগল’ শিক্ষা দিতে নিষেধ করেছেন, যার দ্বারা ‘কাশফ’ ইত্যাদি হয়ে থাকে। তাই সাধারণ মানুষদের তো এগুলো থেকে সম্পূর্ণরুপে দূরে থাকা উচিত। আর বিশিষ্টজনেরা করলেও সতর্ক পর্যায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
পীর সাহেবকে হাযির-নাযির অর্থাৎ, সদা সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বদ্রষ্টা এবং সর্বক্ষণ নিজের সাহায্যকারী ও বিপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে করবে না। কারণ, শাইখের অধিক কল্পনার দ্বারা কখনও তার রুপক আকৃতি সম্মুখে চলে আসে-যা কখনও নিছক কল্পনা হয়ে থাকে। আর কখনও কোন গায়েবী ‘লতিফা’ তার রুপে প্রকাশিত হয়ে থাকে। অথচ অধিকাংশ সময় শাইখের এ সম্পর্কে জানাও থাকে না। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ অজ্ঞ মানুষের পদস্খলন ঘটে থাকে।
পরিচ্ছেদ-১৭: মহিলাদেরকে হাত ধরে বাইআত করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও কোন নারীকে বাইআত করতে হাত স্পর্শ করেননি। পরনারীকে স্পর্শ করা হারাম। ‘মাহাবুবুস সালিকীন’ গ্রন্থ প্রণেতা বলেন- নারীদের বাইআত করার পদ্ধতি এই যে, নারী অনুপস্থিত থাকলে তার বংশীয় বা দুগ্ধপোষ্য কোন মাহরামকে উকীল বানিয়ে বাইআত করবে। সেই উকীল বাইআতের শর্তাবলী তার ‘মুয়াক্কেলা’কে বলবে। আর যদি নারী সেখানে উপস্থিত থাকে তাহলে পর্দার আড়াল থেকে মুরীদ করবে। হাত ধরে বাইআত করবে না। হাত ধরে কেবলমাত্র পুরুষদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করবে-নারীদের থেকে নয়। কিতাবে এ কথাও লেখা আছে যে, পুরুষেরা সরাসরি শাইখের কথা অঙ্গীকাররুপে গ্রহণ করবে আর নারীরা গ্রহণ করবে পুরুষদের মধ্যস্থতায়।
পরিচ্ছেদ-১৮: ‘সিমা’-এর আলোচনা
এটি একটি বিরোধপূর্ণ মাসআলা, কিন্ত্ত যারা এটাকে নিষেধ বলেন, তাদের দলীল-প্রমাণকে সম্পূর্ণরুপে বাদ দিলেও যারা এটাকে জায়েয বলেন তারাও অনেক শর্ত সাপেক্ষে জায়েয বলেন। ন্যায়বিচারের সাথে লক্ষ্য করা উচিত যে, এ যুগের ‘সিমা’-এর কোন মজলিস সে সমস্ত আদব ও শর্তসহ হয়ে থাকে কি? এ যুগের মজলিসসমূহে স্থান, কাল, পাত্র ও উপস্থিত লোকজন কোন কিছুর ক্ষেত্রেই আদব ও শর্তের তোয়াক্কা করা হয় না। এখন ‘সিমা’ সম্পূর্ণ প্রথাসর্বস্ব হয়ে গেছে। সব ধরনের মানুষ নানা ধরনের স্বার্থ নিয়ে ‘সিমা’-এর মজলিসে একত্রিত হয়ে থাকে। এদের কাজ ও আচরণে আল্লাহওয়ালাদের তরীকা দূর্নামগ্রস্ত হয়। এখানে শুধুমাত্র হযরত সুলতানুল মাশাইখ (রহঃ)এর কথা ‘ফাওয়াইদুল ফুয়াদ’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করছি-যদি ‘সিমকারী’, ‘সিমার’ বিষয়বস্ত্ত, ‘সিমা’র শ্রোতা ও ‘সিমা’র যন্ত্র সম্পর্কিত নিম্নের শর্তাবলীর সমন্বয় ঘটে তাহলে সেখানে ‘সিমা’ শুনবে।
ক. ‘সিমা’কারী পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হতে হবে। বালক বা নারী হওয়া যাবে না।
খ. ‘সিমা’-এর বিষয়বস্ত্ত অশ্লীল ও অহেতুক কথাপূর্ণ হওয়া যাবে না।
গ. ‘সিমা’র শ্রোতাগণ আল্লাহর স্মরণে মগ্ন হয়ে সঠিক উপায়ে শুনতে হবে।
ঘ. ‘সিমা’এর যন্ত্র শুধু বাঁশি হতে পারবে। ঢোল, তবলা ইত্যাদি হওয়া চলবে না।
এ সমস্ত শর্তসাপেক্ষে ‘সিমা’ হালাল।
এখন ইনসাফ করে দেখুন, আমাদের সমাজে এ সমস্ত শর্তের কতটুকু তোয়াক্কা করা হয়। এ সমস্ত শর্ত বাদ দিলেও একটি বিষয় সবিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, ‘সিমা’য়ের বিশেষ প্রভাব এই যে, ‘সিমা’ মানুষের মনের প্রবল ভাবকে শক্তি যোগায়। বর্তমান যুগে অধিকাংশ মানুষের মনে যেহেতু অশ্লীলতা, অন্যায়-অপকর্ম ও গায়রুল্লাহর মুহাব্বত প্রবল তাই সিমায়ের মাধ্যমে এটাই বৃদ্ধি পায়। আর গায়রুল্লাহর মুহাব্বত যেহেতু হারাম, তখন যার মাধ্যমে এই হারাম জিনিস বৃদ্ধি পায় তাকে কি হালাল বলবেন, না হারাম? একথা নিশ্চিত যে, এটিও হারাম হবে।
পরিচ্ছেদ-১৯: খাজা উবাইদুল্লাহ আহরার (রহঃ) বলেন- ‘ইস্তিগরাক’ তথা ভাবে নিমজ্জিত অবস্থায় আধ্যাত্মিকতার উন্নতি হয় না। কারণ, আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে নিয়মিত আমল করার দ্বারা। আর ভাবে নিমজ্জিত হলে আমল বরং ছুটে যায়।
পরিচ্ছেদ-২০: ‘গুলশানে রায’ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার বলেন যে, ভাবের প্রাবল্য ছাড়া শুধু হালওয়ালাদের অনুসরণ করে শরীয়তবিরোধী কথা মুখ দিয়ে বের করে কাফির হয়ো না। এ সম্পর্কে ‘গুলশানে রায’ গ্রন্থকারের বক্তব্য এই-
অর্থঃ ‘তোমার আধ্যাত্মিক ভাবের প্রাবল্য না থাকলে শুধু হালওয়ালাদের অনুসরণে শরীয়তবিরোধী কথা বলে কাফির হয়ো না।’
পরিচ্ছেদ-২১: ‘মারাজাল বাহরাইন’ গ্রন্থে আছে যে, ভাবোন্মত্ত ও ভাবের প্রাবল্যের অবস্থায় আল্লাহর ওলীর মুখ দিয়ে শরীয়তবিরোধী কোন কথা বের হয়ে গেলে তার উপর আপত্তিও উত্থাপন করবে না, তার অনুসরণও করবে না। চুপ থাকাই নিরাপদ পন্থা। গ্রন্থকার বলেন যে, এ কথার অর্থ হলো, ঐ ব্যক্তির উপর আপত্তি করবে না, তবে তার ঐ কথা অবশ্যই আপত্তিযোগ্য। বিশেষতঃ যদি তা সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে ঐ কথার ভ্রান্তি প্রকাশ করে দেওয়া ওয়াজিব।
পরিচ্ছেদ-২২: কুরআন ও হাদীসের যাহেরী তথা বাহ্যিক অর্থ অস্বীকার করা কুফুরী, তবে যাহেরী তথা বাহ্যিক অর্থ মেনে নিয়ে তার বাতিন তথা অভ্যন্তরকে অতিক্রম করা মুহাক্কেক আলেমগণের অনুসৃত পন্থা। যেমন, হাদীস শরীফে এসেছে যে, ‘যে ঘরে কুকুর থাকে, সেখানে ফেরেশতা যায় না।’
যারা এ হাদীসের শুধু যাহেরী অর্থ নিয়েছে, তারা কুকুর পালাকে অন্যায় ভেবেছে ঠিকই, কিন্ত্ত নিজেদের অন্তরে কুকুরের স্বভাব ধরে রেখেছে। তাদের স্বভাবের এ ত্রুটি থাকলেও ঈমান আছে, বিধায় শাস্তি ভোগ করে হলেও তারা জান্নাত পাবে।
আর যারা হাদীসের যাহেরী অর্থকে অস্বীকার করেছে, তারা কুকুর পালার অনুমতি দিয়েছে, আর বলেছে যে, মৌলভীরা হাদীসের অর্থ বোঝেনি। এ হাদীসে ঘর দ্বারা অন্তরকে বোঝানো হয়েছে, ফেরেশতা দ্বারা গায়েবী নূরকে বোঝানো হয়েছে, আর কুকুর দ্বারা হিংস্র স্বভাবকে বুঝানো হয়েছে। -এ শ্রেণীর লোকেরা শরীয়তকে অস্বীকার করার ফলে কাফির হয়েছে এবং জাহান্নামের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্ত্ত মুহাক্কেক আলেমগণ বলেছেন যে, হাদীসের যাহেরী অর্থ তো ঐটাই, যা প্রথম শ্রেণীর লোকেরা বুঝেছে, তবে এক্ষেত্রে আরো চিন্তা করা উচিত যে, ফেরেশতারা কুকুরকে ঘৃণা করার কারণ কি? এর একমাত্র কারণ হলো, তার নোংরা ও হিংস্র স্বভাব। তার লোভ, ক্রোধ ও পংকিলতাপ্রিয়তা ইত্যাদি। তাহলে বোঝা গেলো, এগুলো মন্দ স্বভাব। বিধায় যাহেরী ঘরের মধ্যে কুকুর রাখা যখন জায়িয নেই, তাহলে বাতেনী ঘর অর্থাৎ অন্তরের মধ্যে এ সমস্ত স্বভাব পোষণ করা কি করে জায়িয হতে পারে? তাই মুহাক্কেক আলেমগণ হাদীসের সরাসরি অর্থ হিসেবে কুকুর পালাকে হারাম বলেছেন। আর তার
আবশ্যকীয় অর্থ হিসেবে এ সমস্ত মন্দ স্বভাবের অধিকারী হওয়াকেও হারাম বলেছেন।
পরিচ্ছেদ-২৩: ‘কাশফের’ অধিকারীরা বলেছেন যে, প্রত্যেক ‘লতিফা’র মধ্যে দশ হাজার করে ‘যুলমানী’ ও ‘নূরানী হিজাব’ তথা দশ হাজার করে অন্ধকার ও আলোর পর্দা রয়েছে। ‘লতিফায়ে কালেবিয়া’ সহ মোট সাতটি লতিফা রয়েছে। তাই মোট সত্তর হাজার পর্দা রয়েছে। যিকিরের মাধ্যমে অন্ধকারের পর্দাসমূহ দূর হয়ে ‘লতিফা’র নূর আধ্যাত্মিক পথের পথিকের দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। যা এ সমস্ত পর্দা উন্মোচিত হওয়ার আলামত। যেমন নফসের পর্দা হলো, তার কামনা। দিলের পর্দা হলো, গায়রুল্লাহর উপর নজর দেওয়া। বুদ্ধির পর্দা হলো, দর্শনের বিষয় নিয়ে চিন্তা করা। রুহের পর্দা হলো, ‘আলমে মেছাল’ উন্মোচিত হওয়া ইত্যাদি। আল্লাহর পথের পথিক এগুলোর কোনটির দিকে ভ্রূক্ষেপ করবে না। মূল লক্ষ্যবস্ত্তর দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখবে। আর লক্ষ্যবস্ত্ত ছাড়া অন্যগুলোকে প্রতিহত করতে থাকবে। কবি বলেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহর প্রেম এমন এক অগ্নিশিখা, যা আল্লাহকে ছাড়া বাকি সবকিছুকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়।’
‘আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর উপর ‘লা’ এর তরবারী দ্বারা আঘাত করো এবং দেখো তারপর আর কি অবশিষ্ট থাকে।’
‘কেবল ‘ইল্লাল্লাহ’ অবশিষ্ট থাকে, আর বাকী সব বিদূরিত হয়ে যায়। অংশীবাদের সংহারক হে প্রেম! তোমাকে মারহাবা।’
পরিচ্ছেদ-২৪: ‘হিজাবে’র প্রকারসমূহ এবং মুরীদের যাত্রাবিরতির বর্ণনা
‘ফাওয়ায়িদুল ফুয়াদ’ গ্রন্থে আছে যে, আধ্যাত্মিকতার পথের পথচারিকে ‘সালিক’ বলে। আর যাত্রাবিরতিকারীকে ‘ওয়াকিফ’ বলে। একজন ‘সালিক’ যখন ইবাদতে ত্রুটি করে, তখন যদি সে দ্রুত তওবা ও ইস্তিগফার করে পুনরায় ইবাদতে তৎপর হয়, তাহলে সে পুনরায় ‘সালিকে’ পরিণত হয়। আর আল্লাহ না করুন যদি সেই গাফলতের মধ্যেই থেকে যায়, তাহলে তার ‘রাজি’ প্রত্যাগমনকারী হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ পথে সাত পর্যায়ের পদস্খলন রয়েছে-
ক. ই’রায
খ, হিজাব
গ. তাফাসুল
ঘ. সলবে মাযীদ
ঙ. সলবে কাদীম
চ. তাসাল্লি
ছ. আদাওয়াত
প্রথম পর্যায়ের গাফলতিকে ‘ই’রায’ বলে। তারপরও তাওবা না করলে ‘হিজাবে’ পরিণত হয়। গাফলতীর উপর আরো অধিক অবিচল থাকলে ‘তাফাসুল’ হয়ে যায়। এরপরও ইস্তিগফার না করলে ইবাদতের অধিক স্বাদ ও ভাব হাতছাড়া হয়ে যায়-একে ‘সলবে মাযীদ’ বলে। এরপরও এ গাফলতি না ছাড়লে ইবাদতের মূল স্বাদও হাতছাড়া হয়ে যায়-একে ‘সলবে কদীম’ বলে। এ পর্যায়েও তাওবা করতে অবহেলা করলে অন্তর এ বিচ্ছেদকে মেনে নিতে থাকে, একে ‘তাসাল্লী’ বলে। এরপরও যদি তার গাফলত বিরাজ করে, তাহলে ভালোবাসা শত্রুতায় পরিণত হয়-একে ‘আদাওয়াত’ বলে। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে এ সমস্ত পদস্খলন থেকে আশ্রয় চাই।
Leave a Reply