উৎস:
ইসলাহী নেসাব: তা’লীমুদ্দীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

যাবতীয় গুনাহের কাজ এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাথের সম্পর্ক এ পথের ডাকাততুল্য। তবে তার মধ্যে থেকেও কয়েকটি জরুরী বিষয় কয়েকটি পরিচ্ছেদে বর্ণনা করা হচ্ছে।

পরিচ্ছেদ-১: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বিরুদ্ধাচরণ করা-এ পথের একটি বাধা। এর আলোচনা উপরে এসেছে। আফসোস! এ যুগে রুসুম ও বিদআতের খুব বেশী বিস্তার ঘটেছে এবং এ সমস্ত রুসুম ও প্রথার নামই দেওয়া হয়েছে ‘তাসাওউফ’।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ ‘সত্বরই মানুষের উপরে এমন একটি সময় আসবে, যখন ইসলামের কেবল মাত্র নামটাই টিকে থাকবে এবং কুরআনের কেবলমাত্র নকশাই বাকি থাকবে। (বাইহাকী)

তাসাওউফের হাকীকত বা মূল কথা হলো, ‘ফানা’ ও ‘বাকা’ এর নিসবত হাসিল করা। তারা এর অর্থও জানে না, অথচ বিভিন্ন প্রথার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। আবুল আব্বাস দায়নূরী (রহঃ) তার নিজের যুগের সম্পর্কেই যে কথা বলেছেন, তা সামনে রাখলে আমাদের যুগের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি বলেন-

অর্থঃ ‘লোকেরা তাসাওউফের স্তম্ভসমূহ ভেঙ্গে দিয়েছে। তার পন্থাসমূহ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। তার অর্থসমূহ স্বরচিত নাম দ্বারা বদলে দিয়েছে। তারা লালসার নাম দিয়েছে, আধিক্য। বেয়াদবির নাম দিয়েছে, ইখলাস। সত্য ধর্ম থেকে বের হয়ে যাওয়ার নাম দিয়েছে, ‘শাতাহ’ (বা বুযুর্গী)। মন্দ জিনিসকে উপভোগ করার নাম দিয়েছে, বিনোদন। কামনার পিছে ছোটার নাম দিয়েছে, পরীক্ষা। জাগতিক বিষয়ের দিকে ফিরে আসার নাম দিয়েছে, মিলন। মন্দ চরিত্রের নাম দিয়েছে, প্রভাব। কৃপণতার নাম দিয়েছে, শক্তি। মানুষের কাছে চাওয়ার নাম দিয়েছে, আমল। অশ্লীল কথার নাম দিয়েছে, তিরষ্কার। অথচ হকপন্থীদের পন্থা এটা নয়।

হযরত শাহ ওলীউল্লাহ সাহেব (রহঃ)এ সমস্ত প্রথা সম্পর্কে বলেনঃ সুফীদের ‘নিসবাত’ মহামূল্যবান জিনিস। আর এদের প্রথাসমূহ মূল্যহীন যা (সামান্য) কোন কিছুর বিনিময়েই বিকে না।

পরিচ্ছেদ-২: এ পথের একটি বাধা এই যে, ভুলক্রমে কোন বাতিল পীরের হাতে বায়আত হয়ে সারাজীবন সে মতেই চলতে থাকা। পীর নিজেই যখন আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি, তখন মুরীদকে কি করে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাবে। হযরত বুন্দার (রহঃ) বলেন-

অর্থঃ ‘বিদআতীদের সান্নিধ্য আল্লাহ বিমুখ হওয়ার কারণ হয়।’

শাইখ কিওয়ামুদ্দীন (রহঃ) বলেন-হে দরবেশ! এ কাজের মাপকাঠি হলো, কুরআন, সুন্নাহ এবং এমন পূর্বসূরীদের জীবন চরিত, যারা অনুসরণীয় ছিলেন। শুধুমাত্র ইজাযত লাভ করা এবং বরকতময় স্থানে বসা যথেষ্ট নয়। যেমনঃ কেউ পীরের ছেলে বলে তার স্থলাভিষিক্ত হলো, গদীনসীন হলো। কোন পীরের কোন কাজ যদি এ মাপকাঠিতে না টিকে, তাহলে সে পীর বাতিল ও ভুয়া। অর্থাৎ, পীরের কথা ও কাজ যদি কুরআন হাদীস ও ইজমার পরিপন্থী হয়, তাহলে সে কিছুই নয়। সে পীর হওয়ার ও অনুসরণীয় হওয়ার উপযুক্ত নয়। যে ব্যক্তি এ ধরনের পীরের অনুসরণ করবে, সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। বরং এ বাতিল পীর ছেড়ে দিয়ে কোন কামিল পীরের নিকট মুরীদ হওয়া তার কর্তব্য।

শাইখ সা’দুদ্দীন (রহঃ) বলেন, নিজের অজ্ঞতাবশতঃ কোন জাহিল বা বিদআতী পীরের নিকট মুরীদ হলে, অন্য কোন হকপন্থী পীরের নিকট নতুন করে মুরীদ হবে। এবং তার থেকে খিরকা পরিধান করবে, যেন গোমরাহ না হয়ে যায়।

প্রসিদ্ধ আছে-

অর্থাৎ, আমার পীর সাধারণ হলেও আমার ভক্তিই যথেষ্ট। কিন্ত্ত প্রথম কথা হলো, এমন জাহেল, ফাসেক ব্যক্তির প্রতি ভক্তি টিকে থাকাই মুশকিল। দ্বিতীয়তঃ এটি কোন স্বতঃসিদ্ধ বিষয় নয়। কদাচিৎ এমনটিও ঘটেছে। এ বিষয় সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞানও আছে, সেই জানে যে, লক্ষ্যে পৌঁছার পথ হলো, কামিল শাইখের সুহবাত ও তা’লীম। অর্থাৎ, সাহচর্য ও শিক্ষা। এর কোন বিকল্প নেই। আর কামিল শাইখ সেই, যিনি যাহেরী ও বাতিনী উভয় ইলমেরই অধিকারী। তৃতীয়ত, এর দ্বারা বাতিল পীর উদ্দেশ্য নয়, বরং এ কথার উদ্দেশ্য এই যে, পীর যদি অনেক উঁচু স্তরের কামিল না হয়, কিন্ত্ত শরীয়ত বিরোধীও নয়, তাহলে এরুপ মনে করবে যে, এর চেয়ে অধিকতর কামিল লোক যদিও আছে, কিন্ত্ত আমার জন্য ইনিই যথেষ্ট, আমার ভক্তি, বিশ্বাস আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছাবে।

পরিচ্ছেদ-৩: এ পথের একটি বাধা হলো, বালক ও নারীদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। তাদের সাথে উঠাবসা করা। এ সম্পর্কেও আলোচনা উপরে চলে গেছে। এক বুযুর্গ বলেন, আামি আমার পীরের সঙ্গে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে এক সুন্দর বালককে দেখে আমার পীরকে বললাম, হযরত! আল্লাহ তাআলা কি এমন সুন্দর ছেলেকও শাস্তি দিবেন? তিনি বললেন, তুমি তাকে দেখেছো? সত্বরই তার ফল ভোগ করবে। তিনি বলেন, এ ঘটনার বিশ বছর পর আমি কুরআন শরীফ ভুলে যাই। একইভাবে বেগানা নারীদের সাথে মেলামেশা করা আল্লাহ তাআলা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। এ বিষয়টি ভ্রান্তি নিরসন অধ্যায়ে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

পরিচ্ছেদ-৪: এ পথের আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো, লাগামহীন কথা, কামিল হওয়ার দাবী করা, ওয়াহদাতুল উজুদ এর দাবী করা, শরীয়তের সঙ্গে বা আল্লাহর সঙ্গে বেয়াদবী করা, এর বিবরণও উপরে চলে গেছে।

পরিচ্ছেদ-৫: এ পথের আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো, পীরের তা’লীমের চেয়ে অধিক মেহনত মুজাহাদা করা। যার ফলে কিছুদিনের মধ্যে ঘাবড়ে গিয়ে সে সামান্য তা’লীমও হাতছাড়া হয়ে যায়। অনেক লোকেরই এমনটি ঘটেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

অর্থঃ অতটুকু আমলই আরম্ভ করো, যতটুকুতে বিরক্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা বিরক্ত হননা, যতক্ষণ তোমরা বিরক্ত না হও। (বুখারী, মুসলিম)

পরিচ্ছেদ-৬: একটি বাধা এই যে, শ্রম ও সাধনার ফল লাভের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা হয়। এ রকম মনে করা হয় যে, এতদিন ধরে সাধনা করছি, এখন পর্যন্ত কোন ফল লাভ হলো না। এর পরিণতি এই হয় যে, সে হয়ত তার শাইখের প্রতি কুধারণায় লিপ্ত হয়, কিংবা সাধনা করা ছেড়ে দেয়। মুরীদকে বুঝতে হবে যে, কোন জিনিসই চট করে লাভ হয় না। ভেবে দেখো! এক ব্যক্তি এক সময় শিশু ছিলো। তার যুবক হতে কতদিন লেগেছে। আগে
জাহিল ছিলো, আলিম হতে কতদিন লেগেছে। মোটকথা, এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা নিজের পীরকে ফরমায়েশ করার শামিল। কখনো মন বিচলিত হয়ে উঠলে নীচের কবিতাগুলো পড়ে মনকে প্রবোধ দিবে।

‘একুটি দুরন্ত শিশু পূর্ণ জ্ঞানবান হতে বা সুবক্তা বিদ্বান হতে বহু যুগ সময় লাগে।

একটি খাঁটি পাথর সূর্যতাপে পুড়ে মূল্যবান পাথরে পরিণত হতে বহু বছর সময় লাগে।

মেষের পৃষ্ঠের এক মুষ্টি পশম কোন বুযুর্গের জামা হতে কিংবা কোন গাধার রশি হতে বহু মাস সময় লাগে।

মাটি-পানি থেকে উদগত এক মুষ্টি তুলা কোন বরের জামা হতে কিংবা শহীদের কাফনের কাপড় হতে বহু সপ্তাহ সময় লাগে।

বৃষ্টির পানি ঝিনুক-গর্ভে মনীমুক্তায় পরিণত হতে দিনের পর দিন প্রতীক্ষায় অতিবাহিত করতে হয়।’

পরিচ্ছেদ-৭: একটি প্রতিবন্ধকতা হলো, শাইখের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসায় ভাটা পড়া, আর এর চেয়েও মারাত্মক হলো, শাইখকে কষ্ট দেওয়া। হাদীস শরীফে আছে-

অর্থঃ ‘যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে, আমি তার সঙ্গে লড়াইয়ের ঘোষণা দিলাম।’