উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখা ৩০টি-
১. আল্লাহর উপর ঈমান আনা।
২. আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুকে ধ্বংসশীল ও সৃষ্ট বিশ্বাস করা।
৩. ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনা।
৪. আল্লাহর কিতাবসমূহের উপর ঈমান আনা।
৫. নবীদের উপর ঈমান আনা।
৬. তাকদীর বা ভাগ্যের উপর ঈমান আনা।
৭. কিয়ামতের দিনের উপর ঈমান আনা।
৮. জান্নাতকে বিশ্বাস করা।
৯. জাহান্নামকে বিশ্বাস করা।
১০. আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসা রাখা।
১১. কারো সঙ্গে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা রাখা এবং তারই উদ্দেশ্যে বিদ্বেষ পোষণ করা।
১২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসা।
১৩. ইখলাস।
১৪. তওবা।
১৫. আল্লাহকে ভয় করা।
১৬. আল্লাহর রহমতের আশা করা।
১৭. লজ্জা করা।
১৮. শোকর বা কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
১৯. অঙ্গীকার পুরা করা।
২০. ধৈর্য ধরা।
২১. বিনয়।
২২. সৃষ্টির প্রতি দয়া ও করুণা করা।
২৩. আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্ত্তষ্ট থাকা।
২৪. আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।
২৫. আত্মশ্লাঘা পরিহার করা।
২৬. বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা।
২৭. হিংসা না করা।
২৮. রাগ না করা।
২৯. অকল্যাণকামী না হওয়া।
৩০. দুনিয়ার ভালোবাসা পরিহার করা।

কয়েকটি পরিচ্ছেদে উপরোক্ত শাখাসমূহের ফযীলত এবং এতদসংক্রান্ত কিছু বিষয় সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।

প্রথম পরিচ্ছেদ:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘ঈমান হলো, আল্লাহর উপর, তার ফেরেশতাদের উপর, তার নবীদের উপর, তার কিতাবসমূহের উপর, শেষ দিবসের উপর এবং ভাগ্যের ভালোমন্দের উপর বিশ্বাস রাখা।’ (বুখারী, মুসলিম)

মুসলিম শরীফের অপর একটি বর্ণনায় আছে-
‘জান্নাতের উপর, জাহান্নামের উপর এবং মৃত্যূর পর জীবিত হওয়ার উপর বিশ্বাস রাখা।’

তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় আছে-
‘কোন মানুষ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাগ্যের উপর এবং এ কথার উপর বিশ্বাস করবে না যে, যা আসার তা কখনোই না এসে পারে না, আর যা না আসার তা কখনোই আসতে পারে না।’
ফায়দা: আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান আনার মধ্যে এ সবই অন্তর্ভুক্ত-তার সত্তার উপর ঈমান আনা। তার গুণাবলীর উপর ঈমান আনা। তাকে একক বিশ্বাস করা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য-১: জানা থাকা উচিত যে, যেমন, আল্লাহ তাআলার সত্তা প্রশ্নাতীত ও ধারণাতীত। তেমনিভাবে তার গুণাবলীও প্রশ্নাতীত ও ধারণাতীত। তাই আল্লাহ তাআলার গুণাবলীর ব্যাপারে ধারণা ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে কথা বলা এবং তার ব্যাখ্যা ও রুপরেখা নির্ধারণ করা মারাত্মক বিপজ্জনক। এ বিষয়ে অনেক সাধারণ মানুষের আকীদা খুবই নিরাপদ যে, তারা সংক্ষেপে আল্লাহর গুণাবলীর উপর বিশ্বাস রাখে, তারা এগুলোর ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও অধিক টানা হেঁচড়া করে না এবং পূর্বকালের বুযুর্গ, সাহাবা (রাযিঃ) ও তাবিঈনগনের বিশ্বাসও এমন ছিলো। অতীতকালে বিদআতীদের দল যখন ভারী হয়ে উঠলো এবং তর্ক শাস্ত্রের বিস্তার ঘটলো, তখন আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা বৃদ্ধি পেলো এবং বেশীর ভাগ বিধি-বিধানের ব্যাপারে অসতর্ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। যেমন পবিত্র কু্রআনে আছে-
অর্থঃ ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর সমাসীন হলেন।’ (সূরা ত্বাহা-৫)

এখন এ আয়াত প্রসঙ্গে এই বিশ্লেষণ শুরু করা যে-‘ইসতিওয়া’ বা সমাসীন হওয়া দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে? এর উদ্দেশ্যই বা কি? নিঃসন্দেহে (এ জাতীয় আলোচনা ও গবেষণা) নির্ভীক আচরণ-মানুষ নিজের গুণাবলীর হাকীকত সম্পর্কেই যেখানে পূর্ণ অবগত নয়, সেখানে মহান স্রষ্টার গুণাবলীর মর্ম সম্পর্কে কি জানবে? তাই সহজ সরল কথা হলো, সংক্ষেপে আকীদা পোষণ করবে যে, আল্লাহ তাআলা যা কিছু বলেছেন তা সত্য বলেছেন। তার সত্তা যেমন, তার ‘ইসতিওয়া’ তথা সমাসীন হওয়াও তেমন। অধিক বিশ্লেষণের প্রয়োজনটাই বা কী? আমাদেরকে এভাবে বিশ্লেষণের নির্দেশও দেওয়া হয়নি। আমাদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাও করা হবে না। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখবে যে, তার ‘ইসতিওয়া’ তথা সমাসীন হওয়া আমাদের ‘ইসতিওয়া’ তথা সমাসীন হওয়ার মত নয়।

কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘কোন কিছুই তার মত নয়।’ (সূরা শুরা-১১)
বাকী রইলো তাহলে তার ‘ইসতিওয়া’ বা সমাসীন হওয়া কেমন? এ নিয়ে আলোচনাই করবে না। আল্লাহর উপর সমর্পণ করবে।
কিংবা হাদীস শরীফে এসেছে-
অর্থঃ ‘প্রতি রাতে আমাদের প্রভু দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।’
এখন এ চিন্তায় পড়া যে, অবতরণের অর্থ কি? এবং কিভাবে তিনি অবতরণ করেন? এ সমস্ত অর্থহীন কাজে লিপ্ত হবে না। যার প্রকৃত তথ্য কিয়ামত পর্যন্তও উদ্ধার করতে পারবে না। তাই এ নিয়ে সময় নষ্ট করবে না। বরং এ হাদীস বলার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে লক্ষ্য অর্থাৎ, ঐ সময়ে মানুষ আন্তরিকভাবে এবং আবেগ-উদ্দীপনা সহকারে যিকির ও ইবাদতে মগ্ন থাকবে। আমাদেরও তাই করা উচিত। আল্লাহর এ সমস্ত গুণাবলীর মূল তত্ত্বের ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। তাই এর পিছনে সময় ব্যয় করা নিজের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিতনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তন্মধ্যকার রুপকগুলোর।’ (সূরা আলে ইমরান-৭)

বিশেষ দ্রষ্টব্য-২: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাওহীদের দু’টি অর্থ প্রমাণিত রয়েছে।
একটি হলো, ‘লা মা’বুদা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই।
দ্বিতীয়টি হলো, ‘লা মাকসুদা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কোন মাকসুদ বা উদ্দেশ্য নেই। প্রথম অর্থটি প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি তো দিবালোকের চেয়েও সুস্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘হে কারাগারের সঙ্গীরা! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভালো, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত করো, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছো। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্ত্ত অধিকাংশ লোক তা জানে না।’ (সূরা ইউসুফ-৩৯-৪০)

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।’ (সূরা বায়্যিনাহ-৫)
পুরো কুরআন শরীফ এ বিষয়বস্ত্ততে পরিপূর্ণ। আর এ তাওহীদই হাতছাড়া হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষ কাফির ও মুশরিক হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে তাকে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হতে হয়। এটা কখনই মাফ করা হবে না। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে কাউকে শরীক করে, এছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’ (সূরা নিসা-১১৬)
তাওহীদের দ্বিতীয় অর্থটি এভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রিয়া’ অর্থাৎ, মানুষকে দেখানোর জন্য বা সুনামের জন্য ইবাদত করাকে ‘শিরকে আসগর’ বা ছোট শিরক আখ্যা দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে, ‘রিয়া’র মধ্যে গায়রুল্লাহ মা’বুদ বা উপাস্য হয় না, তবে ‘মাকসুদ’ তথা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তাই ‘গায়রুল্লাহ’ মাকসুদ ও লক্ষ্য হওয়া যখন শিরক সাব্যস্ত হলো, তখন শিরকের বিপরীত তাওহীদের মধ্যে একমাত্র আল্লাহই ‘মাকসুদ’ হবেন, গায়রুল্লাহ কোনভাবেই মাকসুদ হবে না। ‘লা মাকসুদা ইল্লাল্লাহ’-এ কখার অর্থ এটাই। যে হাদীসের মধ্যে ‘রিয়া’কে শিরক বলা হয়েছে, এখন আমি সেই হাদীসটি উদ্ধৃত করছি।
মাহমুদ বিন লাবীদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘অত্যন্ত ভয়ংকর জিনিস-যে ব্যাপারে আমি তোমাদের নিয়ে আশংকা করছি, তা হলো ‘শিরকে আসগর’ বা ছোট শিরক। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসূল! ‘শিরকে আসগর’ কি জিনিস? তিনি বললেন-‘রিয়া’। (মুসনাদে আহমদ, তাফসীরে মাযহারী)
এতদসংক্রান্ত আরও অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাফসীরে মাযহারীতে সূরায়ে কাহাফ-এর শেষে সেগুলো সংকলিত করা হয়েছে। সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এখানে সেগুলো লেখা হলো না। তাওহীদের এ অর্থ না পাওয়া গেলে ইখলাস হাতছাড়া হয়ে যায়। যার পরিণতিতে কিছুটা শাস্তির যোগ্য হয়, কিন্ত্ত চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয় না।