উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

ইখলাস

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তিনটি বিষয় এমন, যেগুলো গ্রহণ করতে কোন মুসলমানের অন্তর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করে না।
ক. ইখলাসের সাথে আমল করা।
খ. শাসকদের আনুগত্য করা।
গ. জামাআতের অন্তর্ভুক্ত থাকা।’
হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
‘রিয়া’ ও ‘নিফাক’ তথা প্রদর্শন প্রবৃত্তি ও কপটতা পরিহার করা ইখলাসের অন্তর্ভুক্ত।

ইমাম ইবনে মাজা (রহঃ) শাদ্দাদ বিন আউস (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
‘আমি আমার উম্মতের জন্য যে বিষয়টির সর্বাধিক আশংকা করি, তা হলো আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করা। মনে রেখো! আমি এ কথা বলছি না যে, তারা সূর্য, চন্দ্র বা মূর্তির উপাসনা করবে। কিন্ত্ত তারা গায়রুল্লাহর জন্য এবং প্রবৃত্তির গোপন কামনার জন্য আমল করবে।
নিম্নের আয়াতে শিরকের তাফসীর রিয়া দ্বারা করা হয়েছে-
অর্থঃ ‘এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।’ (সূরা কাহ্ফ-১১০)
ফায়দা: ‘রিয়া’ বা মানুষকে দেখানো ও সুনামের জন্য আমল করা যে শিরকের অন্তর্ভুক্ত তা তাওহীদের আলোচনার পরিচ্ছেদে কিছুটা বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে দেখে নেওয়া উচিত।

‘নিফাকের’ (মুনাফেকী) প্রকারসমূহ

‘নিফাক’ বা কপটতা বলা হয়, অন্তরে কুফুরী রেখে বাইরে ইসলাম প্রকাশ করাকে।
‘নিফাক’ দু’প্রকার।
ক. আকীদাগত নিফাক।
খ. আমলের ক্ষেত্রে নিফাক।
নিফাকের উপরোল্লেখিত সংজ্ঞাটি আকীদাগত নিফাকের। এ প্রকারের নিফাক সম্পর্কেই নিম্নোক্ত ধমকি এসেছে।
অর্থঃ ‘নিশ্চয় মুনাফিকগণ জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে।’ (সূরা নিসা-১৪৫)
নিফাকের দ্বিতীয় প্রকার হলো, আমলের ক্ষেত্রে নিফাক। অর্থাৎ, আকীদা-বিশ্বাস তো মুসলমানের ন্যায় ঠিক আছে, কিন্ত্ত তার দ্বারা এমন কিছু কাজ সংঘটিত হয়, যেগুলো মুনাফিকদের দ্বারা হয়ে থাকে। যেমন, হাদীস শরীফে আবদুল্লাহ বিন আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘চারটি স্বভাব এমন রয়েছে-যার মধ্যে এর প্রত্যেকটি থাকবে সে তো পরিপূর্ণ মুনাফিক এবং যার মধ্যে এর একটি স্বভাব থাকবে তার মধ্যে নিফাকের একটি স্বভাব বিদ্যমান থাকবে যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করে।
ক. তার কাছে কোন আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে।
খ. কথা বললে মিথ্যা বলে।
গ. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে।
ঘ. ঝগড়া করলে গালি দেয়।’
ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

এ হাদীসে নিফাক দ্বারা আমলের নিফাককেই বুঝানো হয়েছে। যেমন কিনা অভিজাত বংশের কোন সন্তান ছোট লোকের কাজ করলে তাকে ‘চামার’ আখ্যা দেওয়া হয়।

‘রিয়া’র ভয়ে নেক আমল ছেড়ে দেওয়া

‘রিয়া’র বিপদ মারাত্মক। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ থেকে বেঁচে থাকা দরকার। তবে এর সাথে এ কথাও মনে রাখা উচিত যে, ধোঁকা দিয়ে নেক আমল বাদ দেওয়ানোর শয়তানের একটি পন্থা এটিও যে, শয়তান কুমন্ত্রনা দেয় যে, এ আমলটি করো না। এতে ‘রিয়া’ হবে। এক্ষেত্রে শয়তানকে উত্তর দেওয়া উচিত যে, ‘রিয়া’ তো তখনই হবে, যখন মানুষকে দেখানো এবং তাকে খুশী করার উদ্দেশ্য হবে এবং নিজেও এটা উপভোগ করার ইচ্ছা থাকবে। কিন্ত্ত আমি নিজেই যখন এটাকে খারাপ মনে করছি এবং তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি, তা প্রতিহত হোক বা না হোক এটা তো ‘রিয়া’ হতে পারে না। এ উত্তর দিয়ে নেক আমল করতে থাকবে। যত কুমন্ত্রনাই শয়তান দিক না কেন, কোন পরোয়াই করবে না। দু’-চারবার কুমন্ত্রনা দিয়ে তারপর শয়তান নিজেই রণে ভঙ্গ দিয়ে সরে পড়বে।
হযরত পীর ও মুর্শিদ মাওলানা আলহাজ্জ আলহাফিয মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ (দাঃবাঃ) ইরশাদ করেন-‘রিয়া’ সবসময় ‘রিয়া’ থাকে না। প্রথমে ‘রিয়া’ হয়। তারপর তা অভ্যাসে পরিণত হয়। অবশেষে অভ্যাস থেকে ইবাদত ও ইখলাসে রুপ নেয়।
এ কথার উদ্দেশ্য হলো, অনিচ্ছাকৃত রিয়ার পরোয়া করবে না এবং এ কারণে আমল ছেড়ে দিবে না।

তাওবা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তাওবা করো, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।’
(সূরা নূর-৩১)
এ সম্পর্কিত অনেক হাদীসও বর্ণিত হয়েছে।
তাওবার পদ্ধতিঃ তাওবার প্রকৃত স্বরুপ জনৈক বুযুর্গ অত্যন্ত সংক্ষেপে এভাবে ব্যক্ত করেছেন-
অর্থাৎ, গুনাহের কারণে অন্তরে জ্বালা ও অনুশোচনা সৃষ্টি হওয়াকে তাওবা বলে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ)-এর এ কথা উপরোক্ত উক্তিকে সুদৃঢ় করে-অর্থাৎ, লজ্জিত হওয়াই তাওবা।

তাওবার অনেকগুলো তাওবা রয়েছে। সংক্ষেপে এভাবে বুঝুন যে, কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিকট ভুল হয়ে গেলে তখন তার কাছে কিভাবে ভুল স্বীকার করা হয়। ক্ষমা ভিক্ষা করা হয়। করজোড়ে, পায়ের উপর টুপি রেখে, তোষামোদমূলক কত কথা বলা হয়। কান্নার ভান করা হয়। নানাভাবে ভুল স্বীকার করা হয়। তাই মহান আল্লাহর মুখোমুখি যখন ভুল স্বীকার করবে, তখন কমপক্ষে এমন অবস্থাতো অবশ্যই সৃষ্টি হওয়া উচিত। এমনভাবে তাওবা করা হলে আল্লাহ পাকের ওয়াদা অনুপাতে তা অবশ্যই কবুল হয়ে থাকে।

ভয়

ইমাম ইস্পাহানী (রহঃ) তারগীব গ্রন্থে মুয়ায (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন-
‘ঈমানদারের অন্তর নির্ভয় হয় না। সে কখনো ভয়মুক্ত হয়ে স্থির হয় না।’

ভয় সৃষ্টি করার পদ্ধতিঃ অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার উপায় এই যে, সর্বদা এ খেয়াল করবে যে, আল্লাহ তাআলা আমার সমস্ত গোপন ও প্রকাশ্য কথা, কাজ ও অবস্থা সবসময় অবগত আছেন। এবং তিনি এসব বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘মানুষের ঈমানের একটি ফযীলত এই যে, সে বিশ্বাস করবে যে, সে যেখানেই থাকুক না কেন, আল্লাহ তাআলা তার সঙ্গে রয়েছেন।’
হাদীসটি ইমাম বাইহাকী ‘শুআবুল ঈমানের’ ভয় অধ্যায়ে এবং ইমাম তাবরানী ‘আওসাত’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করার উত্তম উপায়

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘একমাত্র কাফিররাই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়।’ (সূরা ইউসুফ-৮৭)
এ আয়াত দ্বারা জানা গেলো যে, আল্লাহর রহমতের আশা পোষণ করা ঈমানের অংশ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

‘আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা একটি উত্তম ইবাদত।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)

স্মরণ রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা এবং তার রহমতের আশা রাখার উত্তম উপায় এই যে, তার হুকুম পরিপূর্ণরুপে মেনে চলার চেষ্টা করবে। এটি একটি সহজাত বিষয় যে, যার কথা মেনে চলা হয় তার থেকে সব ধরনের আশা করা যায়। আর কথা অমান্য করা হলে অবশ্য অবশ্যই মনে ভয় ও নিরাশার সৃষ্টি হয়। তাওবা করার সময় আল্লাহর রহমতের আশা রাখার অর্থ এই যে, তার অপার রহমতের প্রতি দৃষ্টি রেখে এ বিশ্বাস করবে যে, আমার ক্ষমা ভিক্ষা অবশ্যই কবুল হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রহমতের আশা করার যে হুকুম দিয়েছেন তার উদ্দেশ্যও এ দু’টিই জানা যায়। ১. নিজের আমল ঠিক করা, ২. তাওবা করা।।
বর্তমান যুগে অধিকাংশ মানুষ গুনাহে লিপ্ত থাকা এবং তাওবা করতে বিলম্ব করার ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি সুধারণা ও তার রহমতের আশার বাহানা দিয়ে থাকে। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্যকে একদম উল্টিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা সঠিক বুঝ দান করুন। আল্লাহ তাআলার অপার রহমত উপলব্ধি করে তো বরং অধিক লজ্জিত হওয়া উচিত ছিলো।
কবি বলেন-
অর্থঃ ‘আল্লাহর জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিতে আমার বড় ভালো লাগে। কারণ, আমি গুনাহের পর গুনাহ করি, আর তিনি দয়ার পর দয়া করেন।’
এ লজ্জা ও সংকোচ যখন প্রবল হবে, তখন কোনভাবেই আর আল্লাহর নাফরমানী হতে পারবে না।