অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের বর্ণনা – ৭

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
‘উজুব’ বা আত্মশ্লাঘা পরিহার করা
ইমাম তাবরানী (রহঃ) হাদীস উদ্ধৃত করেছেন-
‘তিনটি জিনিস ধ্বংসাত্মক-
এক. সেই লালসা, যার আনুগত্য করা হয়।
দুই. রিপুর সেই কামনা, যার অনুসরণ করা হয়।
তিন. আত্মশ্লাঘা।’
নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করা, নিজের বড়ত্ব ও মহত্ব বর্ণনা করাও আত্মশ্লাঘার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তোমরা নিজকে নিজে ভালো মনে করো না।’ (সূরা নাজ্ম-৩২)
রিয়া, তাকাব্বুর ও উজুবের পার্থক্য
‘তাকাব্বুর’ তথা অহংকারের আলোচনা ‘বিনয়ের’ পরিচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে।
স্মর্তব্য যে, ‘তাকাব্বুর’, (অহংকার), ‘উজুব’ (আত্মশ্লাঘা) ও ‘রিয়া’ (প্রদর্শন প্রবৃত্তি) মূলত তিন বস্ত্ত। বাহ্যত এ তিনটির মধ্যে কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। কিন্ত্ত বাস্তবে এ তিনটি পৃথক জিনিস। এগুলোর পার্থক্যের সারকথা হলো- ‘রিয়া’ সর্বদা ইবাদত ও ধর্মীয় বিষয়েই পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ‘উজুব’ ও ‘তাকাব্বুর’ ধর্মীয় ও পার্থিব উভয়বিধ বিষয়সমূহেই পাওয়া যায়। আর ‘তাকাব্বুরের’ মধ্যে মানুষ অন্যকে তুচ্ছ মনে করে। কিন্ত্ত উজুবের মধ্যে মানুষ নিজেকে ভালো মনে করে। যদিও বা অন্যকে তুচ্ছ না মনে করে।
উজুব সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তর
এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন আছে যে, আল্লাহ তাআলা কাউকে কোন উত্তম গুণ দান করলে তাকে উত্তম গুণ মনে না করা তো এক প্রকারের অকৃতজ্ঞতা। পক্ষান্তরে উত্তম গুণ মনে করা ‘উজুব’ তথা আত্মশ্লাঘার কারণ। তাহলে এখন পথ কী? এ প্রশ্নের সমাধান হলো- সেটিকে উত্তম গুণ অবশ্যই মনে করবে, কিন্ত্ত নিজেকে এ গুণের যোগ্য এবং গুণের প্রকৃত অধিকারী মনে করবে না। এ গুণের কারণে গর্ব করবে না। বরং সেটিকে নিছক গায়েবী নিয়ামত, আল্লাহর দান এবং আল্লাহর গুণের প্রতিবিম্ব মনে করে শোকর আদায় করবে। মনে করবে যে, এটি আমার নিকট আমানত। যখন ইচ্ছা আল্লাহ ছিনিয়ে নিতে পারেন। এ মহাসম্পদ আমার নিকট তেমনই, যেমন কোন দয়ালু, দাতা সম্রাট কোন সামান্য চামারের নিকট একটি অমূল্য মুক্তা আমানত রাখলেন, যখন ইচ্ছা তিনি নিয়ে নিতে পারেন। আর ইচ্ছা হলে অনুগ্রহ করে সারাজীবনে নাও নিতে পারেন। বরং ঐ চামারকে তা থেকে উপকৃত হওয়ার অনুমতি দিয়ে তাকে তার স্বজাতির মধ্যে সম্মানিত করতে পারেন। কিন্ত্ত তখনও সে অহংকারে আস্ফালন করে না। বরং পূর্বাধিক ভীত-সম্ভ্রষ্ট থাকে যে, এ অমূল্য রত্নের যেন অবমূল্যায়ন না হয়, হারিয়ে না যায়। জ্যোতিহীন হয়ে না যায়। যে ব্যক্তি নিজের গুণাবলীকে এরুপ মনে করবে, সে কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবে, আত্মশ্লাঘাকারীদের নয়।
কূটনামী ও বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘কূটনামী ও বিদ্বেষ দোযখে নিয়ে যায়। মুসলমানের অন্তরে এ দু’টি থাকতে পারে না।’ (তাবরানী)
হিংসা পরিত্যাগ করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘হিংসা এমনভাবে নেকীকে খেয়ে ফেলে, যেমনভাবে আগুন লাকড়ীকে খেয়ে ফেলে।’ (আবু দাউদ)
ক্রোধ পরিত্যাগ করা
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘এবং ক্রোধ দমনকারীগণ।’ (সূরা আলে ইমরান-১৩৪)
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে নিবেদন করলো যে, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, ‘রাগ করো না।’ লোকটি কয়েকবার একথা বললো। তিনিও প্রতিবারই এ উত্তর দিলেন যে, ‘রাগ করো না।’ (বুখারী)
ক্রোধের অবস্থায় তা নিয়ন্ত্রন করা যদিও কঠিন মনে হয়, কিন্ত্ত এ নিয়ন্ত্রনের ফল সবসময় ভালো হয়। তখন শত্রুও বন্ধু হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘তুমি উৎকৃষ্ট পন্থায় (তাদের আক্রমন) প্রতিহত করো, তাহলে তোমার মাঝে আর যার মাঝে শক্রতা রয়েছে, সে তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হবে।’ (সূরা হা-মীম সিজদা-৩৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘সে ব্যক্তি বীর নয়, যে মল্লযুদ্ধে অন্যকে ধরাশায়ী করে। বীর তো সেই ব্যক্তি, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখে।’ (বুখারী, মুসলিম)
শেখ সা’দী (রহঃ) যেন তার এ কবিতায় এ হাদীসেরই অনুবাদ করেছেন-
অর্থঃ ‘জ্ঞানীদের নিকট সে ব্যক্তি বীরপুরুষ নয়, যে উন্মত্ত হাতির সঙ্গে লড়াই করে। প্রকৃত অর্থে বীরপুরুষ সেই, যে ক্রোধের সময় অনর্থ কথা বলে না।’
হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রন করে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির থেকে নিজের আযাবকে নিয়ন্ত্রন করবেন।’ (বাইহাকী)
জালালুদ্দীন রূমী (রহঃ) তার এ কবিতায় ঐ বিষয়টিই তুলে ধরেছেন-
অর্থঃ ‘একজন বুদ্ধিমান লোক হযরত ঈসা (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলো- দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন জিনিস কি?
তিনি বললেন, প্রিয়! সবচেয়ে কঠিন জিনিস হলো, আল্লাহ তাআলার ক্রোধ। যার ভয়ে জাহান্নামও আমাদের মত কাঁপতে থাকে।
তখন লোকটি জিজ্ঞাসা করলো, আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচার উপায় কি? তিনি বললেন, নিজের ক্রোধ থেকে বিরত থাকা।’
ক্রোধের প্রতিকার
ক্রোধ মারাত্মক ধ্বংসাত্মক জিনিসসমূহের অন্যতম। বরং গভীর দৃষ্টিতে দেখলে হিংসা-বিদ্বেষও ক্রোধেরই প্রতিক্রিয়া। কারণ, যখন কারও উপর পরিপূর্ণরুপে ক্রোধ বাস্তবায়ন করতে না পারে, তখন অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হয়ে হিংসা ও বিদ্বেষ জন্ম হয়। তাই প্রথমেই এর প্রতিকার করা জরুরী।
হাদীস শরীফে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা এই এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর শয়তান সৃষ্টি হয়েছে আগুন থেকে। আর আগুন নিভে যায় পানি দ্বারা। তাই তোমাদের কারো ক্রোধের উদ্রেক হলে সে যেন ওযু করে।’ (আবু দাউদ)
অপর এক হাদীসে অন্য চিকিৎসা এসেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের কারো ক্রোধের উদ্রেক হলে সে দাঁড়ানো থাকলে বসে যাবে। এতে ক্রোধ চলে গেলে তো ভালো, আর তা না হলে শুয়ে পড়বে।’ (আহমাদ, তিরমিযী)
আল্লাহর ওলীরা আরো কিছু প্রতিকারের কথা বলেছেন যা হাদীসের বিভিন্ন ইঙ্গিতের মাধ্যমে। আহরিত তার একটি এই যে, সে বিশ্বাস করবে যে, যে ব্যাপারে আমার রাগের উদ্রেক হয়েছে, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই ঘটেছে। তাহলে কার উপর রাগ করা যাবে?
দ্বিতীয় এই যে, সে স্মরণ করবে যে, আমি এ ব্যক্তির উপর যেমন রাগ করছি, আমার উপর তো আল্লাহ পাকের অনেক ক্ষমতা রয়েছে। তিনি যদি আমার উপর তেমন রাগ করেন, তাহলে আমি কার আশ্রয় গ্রহণ করবো?
তৃতীয় এই যে, সে ব্যক্তি অনতিবিলম্বে ঐ স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে।
ক্রোধ সংযত করার ফলে যদি হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, তাহলে তার প্রতিকার এই যে, স্বেচ্ছায় ঐ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে নানাভাবে তার খেদমত করবে। যাতে তার সঙ্গে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তার অনুগ্রহকে স্বীকার করবে। সহজাত বিষয় হলো, নিজের অনুগ্রহ স্বীকারকারী এবং নিজের সঙ্গে ভালোবাসা পোষণকারী ব্যক্তির সঙ্গে হিংসা বিদ্বেষ থাকে না।
অন্যের অকল্যাণ কামনা না করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি কারো অকল্যাণ কামনা করলো, সে যেন আমার থেকে পৃথক থাকে।’ (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-
‘দ্বীন কল্যাণ কামনা ও নিষ্ঠার নাম।’
অকল্যাণ কামনা করতে গিয়ে যদি কুধারণাও চলে আসে তাহলে তাও হারাম।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ।’ (সূরা হুজরাত-১২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। নিঃসন্দেহে ধারণা করা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। (বুখারী, মুসলিম)
কুধারণা ও কুটনামীর নিন্দা
বর্তমান যুগে অনৈক্য ও অস্থিরতার বহুবিধ কারণের অন্যতম শক্তিশালী কারণ, কুধারণা পোষণ করা। সম্ভাব্য দুর্বল লক্ষণ বা মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে অন্য মুসলমান ভাই সম্পর্কে কুধারণা করা হয়। তারপর সাধারণ সাধারণ লক্ষণের ভিত্তিতে সে কুধারণাকে আরো শক্তিশালী করা হয়। পরিশেষে কুধারণা নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হয়। ফলে নিম্নোক্ত সমস্যাবলী দেখা দেয়-
ক. অন্যকে তুচ্ছ মনে করা।
খ. শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করা।
গ. অন্যের ভালো কাজসমূহকে স্বার্থপরতা আখ্যা দেওয়া।
ঘ. গীবত করা।
ঙ. অন্যের ক্ষতি ও অবমাননায় সন্ত্তষ্ট হওয়া।
চ. এছাড়া আরো নানাবিধ দোষত্রুটি এর ফলে জন্ম নেয়।
মুসলমানদের উচিত শক্তিশালী লক্ষণসমূহ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যতদূর সম্ভব কুধারণা না করা। বরং কোন ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি মন থেকে বের করে দেওয়া। এর চেয়ে বড় কি হতে পারে যে-
‘হযরত ঈসা (আঃ) স্বচক্ষে এক ব্যক্তিকে চুরি করতে দেখে প্রতিবাদ করলেন। তখন লোকটি আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বললো যে, আমি চুরি করি নাই। তখন তিনি বললেন, ‘আমার আল্লাহর নাম সত্য, আমার চোখ মিথ্যা।
তবে মন থেকে দূর করা সত্ত্বেও দূরীভূত না হলে সেজন্য সে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হবে না। তবে সে ধারণা মত আলোচনা করা এবং তার চাহিদা অনুপাতে আচরণ করা অবশ্যই গুনাহ। বিশেষত কূটনামীর কারণে কারো প্রতি কুধারণা পোষণ করা মারাত্মক গুনাহ। চোগলখোরের সহজ চিকিৎসা হলো, প্রথমতঃ তাকে নিষেধ করে দিবে যে, আমার কাছে কারো কথা বলবে না। তারপরও সে না মানলে চোগলখোরী করার সাথে সাথে তার হাত ধরে যার ব্যাপারে চোগলখোরী করেছে তার মুখোমুখি করবে। তখন বেশী সম্ভব এই চোগলখোর মিথ্যুক প্রমাণিত হবে। ফলে সে আর কখনো চোগলখোরী করবে না। আর যদি সে সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে সে ব্যক্তি লজ্জিত হয়ে ভুল স্বীকার করবে। এভাবে কাজ করার ফলে পরস্পরের সম্পর্ক নির্মল হবে এবং সন্ধি স্থাপিত হবে। যে দুই ব্যক্তির মধ্যে মুখোমুখি পরিচ্ছন্নতা হয়ে যায়, তাদের মাঝে কূটনামী করার সাহস অন্যের কমই হয়ে থাকে।
Leave a Reply