উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

ইলম শিক্ষা করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তির মঙ্গল কামনা করেন তাকে দ্বীনের ইলম ও বুঝ দান করেন।’ (বুখারী, মুসলিম)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
‘ইলম তলব করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয।’ (ইবনে মাজা)

ইলম শিক্ষা দেওয়া:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যাকে ইলমের কোন কথা জিজ্ঞাসা করা হলো-আর সে জানা সত্ত্বেও তা গোপন করলো-আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পরাবেন।’ (তিরমিযী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা, তার সকল ফেরেশতা, আসমানের অধিবাসীগণ এবং জমিনের অধিবাসীগণ এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে এবং সাগরের পানিতে মাছ পর্যন্ত ঐ ব্যক্তির জন্য কল্যাণের দু’আ করেন, যে মানুষদেরকে কল্যাণের অর্থাৎ, দ্বীনের শিক্ষা দেয়।’(তিরমিযী)

ইলমে দ্বীনের ফযীলত এবং ফরয ইলমের প্রকারসমূহ:
ইলম শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়ার যে সমস্ত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো ইলমে দ্বীনের জন্য নির্ধারিত। বা যে সমস্ত ইলম দ্বীনি ইলমের সেবক-অর্থাৎ, মাধ্যম-সেগুলোর জন্য নির্ধারিত। আর যে সমস্ত জ্ঞান –বিজ্ঞানের দ্বীনি ইলমের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, বা সম্পর্ক থাকলেও দ্বীনি ইলমের সেবায় সেগুলোকে ব্যবহার করা হয় না, সারাজীবন এ অনর্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে জড়িয়ে থাকলেও

এ সমস্ত ফযীলতের সাথে সেগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। বরং এ জাতীয় ইলমের ব্যাপারেই হাদীস শরীফে এসেছে-
‘কতক জ্ঞানও অজ্ঞতা।’ শাইখ (রহঃ) বলেন- ‘যে ইলম সত্যের পথ দেখায় না, তা অজ্ঞতা।’
ইলমে দ্বীনের দু’টি প্রকার রয়েছে-
ক. ফরযে আইন ও খ. ফরযে কিফায়া।
‘ফরযে আইন’ ঐ ইলম, বর্তমানে যার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যেমন, নামায সবার উপর ফরয। তাই তার বিধান জানাও সবার উপর ফরয। যাকাত দেওয়া সম্পদশালীদের উপর ফরয, তাই তার হুকুম জানা তাদের উপরই ফরয হবে। এভাবে যখন যে অবস্থা দেখা দিবে, তার বিধান জানাও ফরয হবে।
আর ‘ফরযে কিফায়া’ হলো, সব জায়গায় দু’-একজন ব্যক্তি এমন থাকা উচিত, যারা ঐ জনপদবাসীর ধর্মীয় প্রয়োজেন পুরো করতে সক্ষম হন এবং ইসলাম বিরোধীদের সন্দেহ, সংশয় ও আপত্তিসমূহের উত্তর দিতে সমর্থ হন।

আলিমগণের উপর দুনিয়া উপার্জন না করার অভিযোগের উত্তর:
এ কথা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, পরিপূর্ণ মনোযোগ ছাড়া কোন বিষয়ে পরিপূর্ণতা লাভ হয় না। আর পরিপূর্ণ মনোযোগ অন্যান্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে একাগ্রতা অর্জন করা ছাড়া সম্ভব হয় না। তাই অন্য কাজে রত থেকে দ্বীনী ইলমের গভীরতা অর্জন এবং তার পরিপূর্ণ খেদমত করা স্বাভাবিকভাবে অসম্ভব। তাই এ যুগের অধিকাংশ নির্বোধ লোকের আলেমগণের ব্যাপারে এ আপত্তি করা যে, তারা অন্য কোন কাজের যোগ্য না, চরম স্বল্প বুদ্ধিতার প্রমাণ।

সাধারণ লোকদের দ্বীনী ইলম অর্জনের পদ্ধতিসমূহ:
যে ইলম শিক্ষা করা ফরযে আইন, তা অর্জনের জন্য আরবী ভাষা জানা জরুরী নয়। বরং ফারসী বা উর্দূ (বা বাংলা) ভাষায় জরুরী মাসআলা ও আকীদার বিষয়সমূহ শিক্ষা করা যথেষ্ট। সব মানুষের নিজের সন্তানদেরকে কমপক্ষে এতটুকু ইলম শিক্ষা দেওয়া উচিত, যেন দু-চার পুরুষ পর দ্বীন থেকে তারা এ পরিমাণ দূরে সরে না যায় যে, দ্বীন ও ইসলামের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক থাকাও তারা লজ্জার কারণ মনে করে। আল্লাহর ওয়াস্তে ধৃষ্টতার এই প্লাবনকে প্রতিহত করার চিন্তা করুন।
কোন ব্যক্তি কোন কারণে উর্দূ-ফারসীও যদি পড়তে না পারে, তাহলে আলেমদের সান্নিধ্যে থেকে নিজের আকীদা ও মাসায়েলসমূহ ঠিক করে নিবে। এবং সন্তানদেরকেও তাকীদ করবে, যেন তারা প্রতিদিন বা তিন চারদিন পরপর দশ-পনের মিনিট কোন সঠিক আকীদার পরহেযগার মুহাক্কেক আলেমের সান্নিধ্যে থেকে ফয়েয লাভ করে। আলেমদের সান্নিধ্যে থাকার বরকত ও উপকারিতা অসাধারণ।
কবি বলেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সান্নিধ্যে বসতে চায়, সে যেন আল্লাহর ওলীদের সান্নিধ্যে বসে।
আল্লাহর ওলীদের সান্নিধ্যে কিছু সময় অবস্থান করা, রিয়ামুক্ত একশ’ বছর ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’

দু’আ করা:
হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘দু’আ ইবাদতের মগজ।’ (তিরমিযী)
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহর নিকট দু’আর চেয়ে অধিক মূল্যবান আর কিছু নাই।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
‘দু’আ এমন বিপদেও উপকারে আসে, যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং এমন বিপদেও উপকার দেয় যা অবতীর্ণ হয়নি। (অর্থাৎ, যে বিপদ অবতীর্ণ হয়েছে তা শেষ হয়ে যায়, আর যে বিপদ অবতীর্ণ হয়নি তা হটে যায়।) হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা নিজেদের উপর দু’আ করাকে আবশ্যক করে নাও।’ (তিরমিযী)
হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে কোন ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে দু’আ করে, তাকে আল্লাহ পাক হয়তো তার প্রার্থিত বস্ত্তই দিয়ে দেন বা কোন বিপদ তার থেকে হটিয়ে দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দু’আ না করে।’ (তিরমিযী)
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলার কাছে এ কথার নিশ্চিত বিশ্বাস রেখে দু’আ করো যে, আল্লাহ কবুল করবেন এবং জেনে রাখো, আল্লাহ তাআলা গাফেল অন্তরের দু’আ কবুল করেন না।’ (তিরমিযী)
ফায়দাঃ উপরোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা কয়েকটি বিষয় জানা গেলো।
প্রথমতঃ দু’আর ফযীলত ও তার প্রভাব। বেশীর ভাগ মানুষ বিপদ-আপদে বিভিন্ন প্রকার চেষ্টা-তদবীর করে থাকে। কিন্ত্ত দু’আর দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করে না। অথচ দু’আ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ তদবীর।
দ্বিতীয় বিষয় এটা জানা গেলো যে, দু’আ কখনো বৃথা যায় না। হয়তো দু’আর প্রার্থিত জিনিসই পাওয়া যায়, কিংবা কোন বিপদ তার থেকে হটে যায়। আর অন্য এক রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, আখিরাতে তার জন্য সঞ্চিত রাখা হয়। মোটকথা, দু’আ অবশ্যই কবুল হয়ে থাকে। আজকাল সন্দেহ করা হয় যে, আমার দু’আ কবুল হয়নি। এ ব্যাখ্যার দ্বারা সে সন্দেহের নিরসন হলো।
তৃতীয় কথা এই জানা গেলো যে, দু’আ কবুল হওয়ার একটি শর্ত এটাও যে, শরীয়ত বিরোধী কোন জিনিসের দু’আ না করতে হবে। দু’আ মনোযোগ সহকারে করতে হবে এবং তা কবুল হওয়ার বিশ্বাস রাখতে হবে। বর্তমানে সবগুলো শর্তের ব্যাপারে অমনোযোগী ও উদাসীন থাকা হয়। এ ব্যাপারে বেশীর ভাগই লক্ষ্য রাখা হয় না যে, আমি যা চাচ্ছি তা আল্লাহ তাআলার অসন্ত্তষ্টির কারণ নয় তো? অপরদিকে দু’আর মধ্যে মনোযোগও থাকে না, বরং অবস্থা হয় এমন-
‘মুখে ‘সুবহানাল্লাহ’ আর অন্তরে গরু-গাধার চিন্তা। এ ধরনের তাসবীহ জপা কি কাজে আসবে?’
যেহেতু আল্লাহ তাআলার দৃষ্টি অন্তরের উপর থাকে তাই অন্তর অন্যমনস্ক হওয়া ঠিক এমনই, যেমন কোন হাকীমের সমীপে দরখাস্ত দিয়ে তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো হলো। এই বিমুখিতার প্রভাব কী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবচেয়ে বড় মুসীবত হলো, দু’আ কবুল হওয়ার বিশ্বাস থাকে না। মনে দ্বিধা থাকে-দেখি কবুল হয় কি হয় না। এর দৃষ্টান্ত ঠিক এমনই, যেমন কেউ কোন শাসক বরাবর চাকুরীর জন্য লিখিত আবেদন করলো। সে আবেদনপত্রের প্রথম দিকে তো খুব প্রশংসা ও তোষামোদ মূলক কথা লিখলো, কিন্ত্ত সর্বশেষে লিখলো যে, আপনি আমাকে চাকুরী দিবেন এমন আশা আমি আপনার থেকে করি না। সবাই জানে এ আবেদনের ফল কি হবে। এ আবেদন তো গ্রহণ হবেই না, বরং উল্টো শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ঠিক একইভাবে অন্তরে যখন দু’আ কবুল হওয়ার বিশ্বাস না থাকে, তখন আল্লাহ তো দিলের অবস্থা জানেন। অন্তরের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রাখা আল্লাহর নিকট এমনই, যেমন দুনিয়ার শাসকদের সম্মুখে কথায় বা লেখায় দ্বিধা প্রকাশ করা। এমন দু’আ তো কবুল হওয়ারই উপযুক্ত না।
দু’আ কবুল হওয়ার এটিও অন্যতম শর্ত যে, খাদ্য ও বস্ত্র হালাল হতে হবে। এ শর্তটিকে তো বর্তমানে একেবারেই অসম্ভব মনে করা হয়। হালাল রুজিকে কাল্পনিক পাখি মনে করা হয়। যা একান্তই ভুল ধারণা। ইসলামী শরীয়ত জীবিকার উপায়-উপকরণের ক্ষেত্রে অনেক প্রশস্ততা দিয়েছে। আলেমদের ফাতওয়া মোতাবেক যেটা হালাল, তাই হালাল বলে গণ্য হবে। আর তাকওয়া তো অনেক উপরের স্তরের বিষয়। সেটা সিদ্দিকীনের মাকাম। সাধারণ লোকদের জন্য আলেমদের ফাতওয়ার উপর আমল করা জায়েয।

আল্লাহর যিকির করা:
হযরত আবু মূসা আশআরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করে আর যে করে না, তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের ন্যায়।’ (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহর যিকির ছাড়া অধিক কথা বলো না, কারণ, আল্লাহর যিকির ছাড়া অধিক কথা বলা অন্তর শক্ত হওয়ার কারণ। ঐ অন্তর আল্লাহ থেকে সর্বাধিক দূরে, যা শক্ত।’ (তিরমিযী)
‘হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘সব জিনিস পরিষ্কার করার একটি উপায় আছে। অন্তর পরিষ্কার করার উপায় হলো আল্লাহর যিকির।’ (বাইহাকী)

তাসাওউফের তরীকা:
উপরোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা আল্লাহর যিকিরের অনেক ফযীলত প্রমাণিত হয়। আল্লাহর ওলীগণ যিকিরের খুব ইহতিমাম করে থাকেন। ফলে তাদের এ পদ্ধতি উন্নত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট। তারা যিকিরের বিভিন্ন পন্থা শিক্ষা দেন। যিকির প্রথমে মৌখিক হয়। ধীরে ধীরে তার প্রভাব অন্তরে গিয়ে পৌঁছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্তরে আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত পয়দা হয়। ফলে আল্লাহর হুকুম মানা সহজ হয়ে যায়। যিকির করার ফলে এছাড়া আরো যে সমস্ত ভাব ও অবস্থার উদ্রেক হয়, যিকিরকারীরা নিজেরাই তা জানতে পারে।
মোটকথা, আল্লাহর যিকির এক অপূর্ব জিনিস। কোন হক্কানী পীরের নিকট থেকে তা শিক্ষা করে সবারই কমবেশী যিকির করা দরকার।

ইস্তিগফার বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া:
আল্লাহর যিকিরের মধ্যে ইস্তিগফারও অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন সত্তরবারের অধিক আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার করি এবং তাওবা করি।’ (বুখারী)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি ইস্তিগফারকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য সমস্ত সংকট থেকে পরিত্রানের পথ করে দিবেন, সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিবেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিযিক দিবেন, যেখানকার সে ধারণাও করেনি।’ (আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)

অনর্থক ও নিষিদ্ধ কথা থেকে বিরত থাকা:
হযরত সাহাল বিন সা’আদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি আমাকে তার উভয় চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্ত্ত অর্থাৎ, জিহ্বা এবং তার উভয় পায়ের মধ্যবর্তী বস্ত্ত অর্থাৎ, লজ্জাস্থান হেফাজতের নিশ্চয়তা দিবে, আমি তার জন্য বেহেশতের দায়িত্ব নেবো।’
হযরত উকবা বিন আমের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করে নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! মুক্তির উপায় কি? তিনি বললেন-নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রনে রাখো। তোমার ঘর তোমার জন্য প্রশস্ত হোক, অর্থাৎ, বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ো না এবং নিজের গুনাহের জন্য কান্নাকাটি করো। (আহমাদ, তিরমিযী)

জিহ্বার আপদসমূহ:
বড় বড় আপদসমূহের অন্যতম হলো, জিহ্বার আপদ। জিহ্বা বাহ্যতঃ হালকা হলেও বাস্তবে তা অনেক জটিল। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নিয়ন্ত্রনে রাখার খুব তাকীদ করেছেন। কারণ, অধিকাংশ আপদ জিহ্বার কারণেই দেখা দেয়। যে পর্যন্ত জিহ্বা না চলবে, সে পর্যন্ত কোন লড়াই-ঝগড়া, মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট-আদালত দেখা দিবে না। কিন্ত্ত যখনই জিহ্বা চললো, তখনই সব এসে হাজির। আল্লাহওয়ালাগণ বিভিন্ন হাদীসের আলোকে জিহ্বার বিপদসমূহ বের করে সেগুলোকে একত্রে সংকলিত করে দিয়েছেন।
হযরত ইমাম গাযযালী (রহঃ) ‘ইহইয়াউল উলূম’ গ্রন্থে এ বিষয়টি অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। উর্দূ ভাষায় হযরত মাওলানা মুফতী এনায়েত আহমদ সাহেব (রহঃ) বিষয়টিকে তার ‘জিমানুল ফিরদাউস’ পুস্তিকায় যথেষ্ট পরিমাণ লিখেছেন। এ পুস্তিকাটি অধ্যয়ন করা বরং নিজের ওযীফা বানিয়ে নেওয়া প্রত্যেকের জন্য জরুরী। গ্রন্থকার এ স্থলে শুধুমাত্র জিহ্বার সাথে সম্পৃক্ত গুনাহসমূহের উল্লেখ করছে, আর এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা ও তার শাস্তিসমূহ দেখার জন্য উপরোক্ত দুই কিতাবের উদ্ধৃতি দিচ্ছে। এখানে সবগুলো বিস্তারিত লেখা কলেবর বৃদ্ধির কারণ এবং নিষ্প্রয়োজন। ইমাম গাযযালী (রহঃ) এর গণনা অনুপাতে জিহ্বার বিপদ বিশটি যথা-
১. উপকারবিহীন বিষয়ে কথা বলা।
২. প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা।
৩. অনর্থক কথায় লিপ্ত হওয়া। যেমন, পরনারীর ঘটনা বর্ণনা করা। কেবলই মনোরঞ্জনের জন্য পাপাচারী ও অত্যাচারী লোকদের ঘটনা বর্ণনা করা। যেমন, কিনা অধিকাংশ আসরেই হয়ে থাকে।
৪. বিতর্ক করা।
৫. ঝগড়া করা।
৬. বানিয়ে ও রং লাগিয়ে কথা বলা।
৭. অশ্লীল কথা বলা।
৮. গালি দেওয়া।
৯. কারো উপর অভিশাপ করা। এ অভ্যাসটি নারীদের মধ্যে খুব বেশী।
১০. গান গাওয়া ও শরীয়তবিরোধী কবিতা আবৃত্তি করা। বর্তমান যুগে এগুলো খুব বেশী হয়ে থাকে।
১১. সীমাতিরিক্ত রসিকতা করা।
১২. এমনভাবে ঠাট্রা করা, যার দ্বারা অন্যের তাচ্ছিল্য হয়, বা তার কাছে খারাপ লাগে।
১৩. কারো গোপন কথা প্রকাশ করা।
১৪. মিথ্যা ওয়াদা করা।
১৫. মিথ্যা কথা বলা। তবে যেখানে তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয় এবং মিথ্যা বলার দ্বারায় অন্যের হক নষ্ট না হয়, সেখানে বলার অনুমতি আছে।
১৬. গীবত করা। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় খাবারে পরিণত হয়েছে। এর দ্বারা মারাত্মক মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। অনেকেই বলে যে, আমি তো সত্য কথা বলছি, তাই গীবত কেন হবে? এ প্রশ্ন একেবারেই অর্থহীন। কারণ, গীবত তো তখনই হয়, যখন তা সত্য হয়। তা না হলে তো সেটা অপবাদ। তবে যে ব্যক্তির দ্বারা কারো দ্বীন বা দুনিয়ার ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে, (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে) তার অবস্থা বলে দেওয়া জায়েয।
১৭. কুটনামী করা। প্রত্যেক দলের নিকট গিয়ে তাদের মনমত কথা বানিয়ে বলা।
১৮. কারো সম্মুখে তার প্রশংসা করা বা তোষামোদ করা। তবে যার প্রশংসা করা হচ্ছে, তার মধ্যে যদি প্রশংসা করার দ্বারা অহংকার সৃষ্টি না হয়, বরং নেককাজ করার আরো বেশী আগ্রহ সৃষ্টি হয় তাহলে দোষ নেই।
১৯. কথাবার্তার মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভুল-ভ্রান্তির প্রতি লক্ষ্য না রাখা। যেমন অনেকেই বলে, ‘উপরে আল্লাহ, নীচে তুমি’। এটা অন্যায় কথা। এতে আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে সমতার আভাস পাওয়া যায়।
২০. আলেমদের নিকট এমন সব প্রশ্ন করা-যেগুলোর সঙ্গে নিজের কোন প্রয়োজন জড়িত নয়।

জিহ্বা নিয়ন্ত্রনে রাখার উপায়:
জিহ্বা সংরক্ষণ করার উপায় হলো-যখনই কোন কথা বলবে নিশ্চিন্তে বলবে না, বরং কমপক্ষে দুই-তিন সেকেন্ড চিন্তা করবে যে, আমি যে কথা বলতে চাচ্ছি, তা আমার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলাকে তো অসন্ত্তষ্ট করবে না? আল্লাহ অসন্ত্তষ্ট না হওয়ার ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিশ্চিত হলে কথা বলবে, আর এ ব্যাপারে সামান্য দ্বিধা থাকলেও চুপ থাকবে। ইনশাআল্লাহ, এভাবে কাজ করলে সহজে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।

শেখ সাদী (রহঃ) কী চমৎকার বলেছেন-
‘চিন্তা না করে একটি কথাও বলো না। ভালো কথাও যদি বলো, একটু দেরীতে বললে অসুবিধাটা কি?’
আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
আল-হামদুলিল্লাহ, এখানে জিহ্বার সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাগুলোর আলোচনা শেষ হলো।