অন্যান্য অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের বর্ণনা – ১

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: ফুরুউল ঈমান
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
ঈমানের যে সমস্ত শাখা অন্যান্য অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত তা চল্লিশটি। তার মধ্যে ষোলটি ব্যক্তির নিজের সাথে সম্পৃক্ত। সেগুলো এই-
১. পবিত্রতা অর্জন করা। দেহ, পোশাক ও স্থানের পবিত্রতা অর্জন করা। ওযু করা এবং বড় নাপাকী, হায়েয ও নেফাস থেকে পবিত্রতার জন্য গোসল করা এর অন্তর্ভুক্ত।
২. নামায কায়েম করা। এর মধ্যে ফরয, নফল ও কাযা নামায অন্তর্ভুক্ত।
৩. সদকা বা দান করা। যাকাত, সদকায়ে ফিতর, মানুষকে খাবার খাওয়ানো, মেহমানকে সম্মান করা এর অন্তর্ভুক্ত।
৪. রোযা রাখা। ফরয ও নফল রোযা এর অন্তর্ভুক্ত।
৫. হজ্জ ও উমরাহ পালন করা।
৬. ই’তিকাফ করা। শবে কদর তালাশ করা এর অন্তর্ভুক্ত।
৭. নিজের দ্বীনের হিফাযতের জন্য কোথাও চলে যাওয়া। হিজরত এর অন্তর্ভুক্ত।
৮. মান্নত পুরা করা।
৯. কসম-অর্থাৎ, শপথ পুরা করা।
১০. কাফফারা আদায় করা।
১১. নামাযের মধ্যে এবং বাইরে শরীর ঢেকে রাখা।
১২. কুরবানী করা।
১৩. মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো, কাফন পরানো ও দাফন করা।
১৪. ঋণ পরিশোধ করা।
১৫. লেনদেনের ক্ষেত্রে সততা রক্ষা করা এবং শরীয়তবিরোধী কারবার থেকে বেঁচে থাকা।
১৬. সত্য সাক্ষ্য দেওয়া এবং সাক্ষ্য গোপন না করা।
নিজের পরিবার-পরিজন ও অধীনস্তদের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখা ছয়টি-
১. বিবাহ করে চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করা।
২. পরিবার-পরিজনের হক আদায় করা। এর মধ্যে দাস-দাসী ও চাকর-নকরদের সঙ্গে নরম আচরণ করাও অন্তর্ভুক্ত।
৩. মাতাপিতার খেদমত করা এবং তাদেরকে কষ্ট না দেওয়া।
৪. সন্তান প্রতিপালন করা।
৫. আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করা।
৬. মনিবের আনুগত্য করা।
সাধারণ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখা ১৮টি-
১. ন্যায়বিচার করা।
২. মুসলমানদের জামাআতের আনুগত্য করা।
৩. শাসকদের আনুগত্য করা।
৪. মানুষের মাঝে সন্ধি স্থাপন করা। এর মধ্যে খারেজী সম্প্রদায় ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করাও অন্তর্ভুক্ত। কারণ, ফিৎনা দূর করা সন্ধির একটি উপায়।
৫. সৎকাজে সাহায্য করা।
৬. মানুষকে ভালো কাজের কথা বলা।
৭. মন্দ কাজে বাধা দেওয়া।
৮. জিহাদ করা। সীমান্ত পাহারা ও সংরক্ষণ এর অন্তর্ভুক্ত।
৯. আমানত আদায় করা। গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ বের করা এর অ্ন্তর্ভুক্ত।
১০. অভাবীকে ঋণ দেওয়া।
১১. প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা।
১২. সৎভাবে লেনদেন করা।
১৩. সম্পদ তার উপযুক্ত ক্ষেত্রে ব্যয় করা। অপচয় থেকে বাঁচা এর অন্তর্ভুক্ত।
১৪. সালামের উত্তর দেওয়া।
১৫. হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা।
১৬. মানুষকে কষ্ট না দেওয়া।
১৭. অনর্থক ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা।
১৮. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিসঃ যেমন-কাঁটা, ঢিলা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা।
১৬, ৬ ও ১৮ এই মোট ৪০টি শাখা হলো। উপরোক্ত শাখাসমূহের ন্যায় এ সমস্ত শাখারও ফযীলত ও আনুসাঙ্গিক বিষয় কয়েকটি পরিচ্ছেদে বর্ণনা করা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা পুরো করার তাওফীক দান করুন।
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম)
ফায়দাঃ সব ধরনের পরিচ্ছন্নতাই এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
পাঁচটি জিনিস সুস্থ স্বভাবের দাবী-
১. খৎনা করা।
২. ক্ষৌরকার্য করা।
৩. গোঁফ খাটো করা।
৪. নখ কাটা
৫. বগলের লোম উপড়ানো (বগলের লোম উপড়ানো উত্তম, তবে চাঁছাও জায়িয আছে। মূল উদ্দেশ্য হলো তা পরিষ্কার করা) । (বুখারী, মুসলিম)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
‘আল্লাহ তাআলা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন, পরিচ্ছন্নতা তিনি পছন্দ করেন। তাই তোমরা বাড়ীর আঙ্গিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখো।’ (তিরমিযী)
লক্ষ্য করুন, ইসলামী শরীয়ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কি অপূর্ব তা’লীম দিয়েছে। দুঃখের বিষয় যে, আমরা শরীয়তের উপর আমল ছেড়ে দিয়ে নিজেদেরকে বিজাতির হাসির পাত্রে পরিণত করছি এবং শরীয়তের উপর আপত্তি উত্থাপন করাচ্ছি যে, তাদের শরীয়ত সমাজ শোধরানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বিজাতিরা আমাদের নীতি ও বিধান গ্রহণ করে সেগুলো নিজেদের দিকে সম্পৃক্ত করে থাকে ও গর্ব করে থাকে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সাদামাটা কিন্ত্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকো। শরীর, কাপড়, জায়গা সব পরিচ্ছন্ন রাখো। ময়লা থাকা অত্যন্ত অপমানজনক ও অন্যদের কষ্টের কারণ।
নামায কায়েম করা:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাযিঃ) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-
‘একদিন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-যে ব্যক্তি নামাযের হেফাযত করবে, অর্থাৎ, নিয়মিতভাবে শর্তসমূহ পূরণ করে নামায পড়তে থাকবে, তার জন্য ঐ নামায কিয়ামতের দিন আলো, দলীল ও মুক্তির কারণ হবে, আর যে ব্যক্তি নামাযের হিফাযত করবে না, তার জন্য নামায আলো, দলীল বা মুক্তির কারণ হবে না। কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি ফিরআউন, কারুন, হামান ও উবাই বিন খালফ এর সঙ্গে থাকবে।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তোমাদের সন্তানেরা সাত বছর বয়সের হলে তাদেরকে নামাযের জন্য হুকুম করো এবং দশ বছর বয়সের হলে নামাযের জন্য তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। অর্থাৎ, যখন তাদের বুদ্ধি হবে তখন তাদেরকে পৃথক বিছানায় শোয়াও।’ (আবু দাউদ)
ফায়দাঃ নামাযের ফযীলত এবং নামায না পড়ার শাস্তির ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। বেশীর ভাগ মানুষ নামাযের ব্যাপারে খুব বেশী গাফলতী করে থাকে। তারা বিভিন্ন প্রকার খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে থাকে। তাদের বড় সমস্যা হলো, সময়ের অভাব।
বন্ধুগণ! কাজের চাপের সময় যদি পেশাব-পায়খানার চাপ সৃষ্টি হয়, তখন কী করো? নিজের কাজ করতে থাকো, নাকি সব ফেলে দৌড়িয়ে যাও। আফসোস! নামাযের কি এতটুকু দাম বা প্রয়োজন নেই? সর্বাধিক দুঃখের বিষয় হলো, কতক ভন্ড পীর এটাকে জরুরী মনে করে না। বরং সাধারণ ও মূর্খ মানুষদেরকে তারা গোমরাহ করে। পীর-মুরীদী তো করাই হয় এজন্য, যেন পূর্বের তুলনায় অধিক ইবাদত-বন্দেগী করা যায়। দ্বীনের যে কাজ আগে কঠিন মনে হতো তা সহজ হয়। পীর-মুরীদীর উদ্দেশ্য তো এটা নয় যে, ল্যাংড়া, লুলা যেটুকু নামায রোযাও ছিলো, তাও ছেড়ে বসবে। এর চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এরা কুরআন শরীফের আয়াতকে বিকৃত করে নিজেদের দাবী প্রমাণ করার অপচেষ্টা করে।
বন্ধুগণ! তাদের এ সমস্ত প্রমাণের বিস্তারিত উত্তর তো কুরআন হাদীসের ছাত্ররাই বুঝবে। তাদেরকে শুধু এতটুকুই জিজ্ঞাসা করুন যে, কুরআন শরীফ যার উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তিনি কুরআন বেশী বুঝতেন, নাকি তোমরা? তিনি তো সারাজীবন নামায পড়েছেন। তাহলে তোমরা কিসের ভিত্তিতে নামায ছেড়ে দিলে? আসল কথা হলো, এটাও নফসের শয়তানী। পীর-মুরীদীর পর্দার আড়ালে মনের কামনা পুরা করা হচ্ছে। কিংবা আধ্যাত্মিকতার পথে অজ্ঞতার কারণে এবং নিজেকে অন্যান্যদের থেকে বড় মনে করার কারণে নিজেই ধোঁকা খেয়েছে। সে যদি শরীয়ত ও হাকীকত উভয়ের আলেম কোন কামেল ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতো, তাহলে নিজের ভুল বুঝতে পারতো। আল্লাহ তাআলা সব বিপদ থেকে হিফাযত করুন।
যারা নামাযের দিকে মনোযোগী হবে, তাদেরকে পিছনে ছুটে যাওয়া নামাযগুলো কাযা করতে হবে। শুধু তাওবা করার দ্বারা এটা মাফ হয় না। নামায কাযা করার জন্য এটা জরুরী নয় যে, ফজরের কাযা ফজরের ওয়াক্তে এবং যোহরের কাযা যোহরের ওয়াক্তে হতে হবে।
তিনটি সময় ছাড়া অন্য সবসময়ে নামায কাযা করা জায়িয। সময় তিনটি হলোঃ ১. সূর্যোদয়ের সময়। ২. ঠিক মধ্যাহ্নে। ৩. সূর্যাস্তের সময়। তবে এভাবে আদায় করলে অনেক লোকেরই সহজ হয় যে, একেকটি আদায় নামাযের সাথে এক একটি কাযা নামায পড়ে নিলো।
Leave a Reply