উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হুকুকুল ইসলাম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

সূচনা

এবং আপনার প্রভুর চূড়ান্ত নির্দেশ যে, তাকে (আল্লাহ) ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ করো। তোমার সামনে তাদের একজন বা উভয়জন যদি বার্ধক্যে উপনীত হয় (বার্ধক্যের উল্লেখ করা হয়েছে অধিক গুরুত্বদানের জন্য। কারণ, তা অধিক সম্মানের দাবীদার। তাছাড়া এ অবস্থায় তাদের সেবা-যত্নের অধিক প্রয়োজন হয়ে থাকে। এবং এ অবস্থায় (সন্তানের প্রতি) অধিক স্নেহের ফলে সন্তানের প্রতি ক্রোধের উদ্রেক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যথায় বার্ধক্যাবস্থা ছাড়াও একই নির্দেশ। সুতরাং সূরা লোকমানের আয়াত
অর্থাৎ, ‘এবং পৃথিবীতে তাদেরকে সঙ্গদান করো উত্তমভাবে।’ (সূরা লুকমান-১৫)
এ নির্দেশকে নিঃশর্তভাবে প্রমাণিত করে। কারণ, মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া এরুপ সঙ্গদানের পরিপন্থী, যেরুপ সঙ্গদানের নির্দেশ এ আয়াতে দেওয়া হয়েছে।
আর বার্ধক্যাবস্থায় যে ‘উফ’ বা হুঁ’ শব্দ বলা হারাম করা হয়েছে তার কারণ এ শব্দ বলা মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাই তা হারাম করা হয়েছে। বিষয়টি ভালো করে বুঝে নাও।) তুমি তাদেরকে ‘হুঁ’ও বলো না, তাদেরকে ধকম দিও না এবং তাদের সাথে সশ্রদ্ধ কথা বলো এবং তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে বিনয়ের বাহু আনত করো (অর্থাৎ, বিনয়পূর্ণ আচরণ করো)। এবং বলো, হে আমার প্রভু! তাদের প্রতি করুণা করুন, যেমন তারা আমাকে আমার শৈশবে প্রতিপালন করেছেন। তোমাদের প্রভু তোমাদের অন্তর্নিহিত বিষয় খুব জানেন। যদি তোমরা সৎকর্মশীল হও, তাহলে তিনি প্রত্যাবর্তনকারীদের ক্ষমা করেন। (অর্থাৎ, সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করে মা-বাবার খেদমত করা, আর বোঝা মনে না করে তা করা, সবকিছুই আমি খুব ভালো জানি।) তবে যদি নেক নিয়ত থাকে, আর কখনো বিরক্ত বা রাগতাবস্থায় তাদেরকে অসন্তুষ্ট করে ফেলো এবং তারপর তাওবা করো তাহলে আমি আমার নাফরমানী মাফ করে দেবো। (আরও যাদের সাথে অপরাধ করেছো, শক্তি থাকলে তাদের থেকেও মাফ চাওয়া জরুরী। অক্ষম হলে তাদের জন্য বেশী বেশী মাগফিরাতের দু’আ করবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাদের থেকে মাফ করিয়ে দিবেন। সৎকর্মশীল হওয়ার শর্ত বিশেষ ক্ষমার জন্য লাগানো হয়েছে। তা নাহলে যে কোন গোনাহই তো সত্যিকার অর্থে তাওবা করলে মাফ করা হয়।) এবং আত্মীয়কে তার প্রাপ্য দাও এবং অভাবীকে এবং মুসাফিরকে। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। (আল্লাহ তাআলা ভারসাম্য রেখা ঠিক রাখার জন্য মা-বাবার হকের সাথে অন্যান্য হক আদায় করাও ফরয করেছেন। কেননা এমন জোরেশোরে মা-বাবার আনুগত্যের নির্দেশ দেখে কেউ অন্যদের অধিকার আদায়ের বিষয়টিকে নিছক সামান্য ব্যাপার মনে করে তা পালনে ত্রুটি করার এবং মা-বাবার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যেমন মা-বাবা বললো যে, তুমি বউ-বাচ্চাকে কষ্ট দাও, ওয়াজিব পরিমাণ খোরপোষে ত্রুটি করো, তখন সে তাই করতো। তাই করুণাময় দয়ালু আল্লাহ বলে দিলেন যে, প্রত্যেক জিনিসেরই একটি সীমা আছে। মা-বাবার কারণে অন্য কারো অধিকার হরণ করো না। আলোচ্য আয়াতের বিষয়দ্বয়ের মাঝের সম্পর্ক এই। (সূরা বানী ইসরাঈল ২৩-২৬)

দ্বিতীয় কারণ এই যে, প্রথমে মা-বাবার হক বর্ণনা করেছে, যা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ, তারপর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও অপরাপর লোকের হকের কথা আলোচনা করেছে। এভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণটিকে আগে এবং তারচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণটিকে পরে উল্লেখ করা হয়েছে।)
ফায়দাঃ এ আয়াত দ্বারা মা-বাবাকে ‘উফ’ (হুঁ) বলা নিষিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে। (অন্য যে কোন শব্দ বা আচরণ এমনটি (অর্থাৎ, কষ্টদায়ক) হলে তার বিধানও একই।) ‘উফ’ শব্দটি বলা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন এতে মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া হয়। কারণ, এ শব্দ ও এর মত অন্যান্য শব্দ অসম্মান ও মানহানীকর। তাই এ শব্দ এবং এর মত অন্যান্য শব্দ ও আচরণ দ্বারা তারা কষ্ট পান। এ কথা থেকে এ মূলনীতি বের হয় যে, যে কথা বা কাজে মা-বাবার সত্যিই কষ্ট হয় (যা শরীয়তে কষ্ট বলে গণ্য) এ ধরনের যে কোন কথা বা কাজ তাদের সাথে করা নিষিদ্ধ এবং হারাম।
আর যে আচরণে উপরোক্ত শর্ত মত উল্লেখিত পর্যায়ের কষ্ট হয় না, তা নিষিদ্ধ হবে না। সর্বত্র এ বিধান এবং এই কারণের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। সব বিধানের ভিত্তি এই কারণের উপর। এ আয়াতের চেয়ে অধিক শক্তভাবে মা-বাবার হক পবিত্র কুরআনের অন্য কোন আয়াতে বর্ণিত হয়নি। হাঁ এ শব্দটি বা এর মত অন্য কোন শব্দ যদি কোন সমাজে সম্মানসূচক বলে গণ্য হয়,তাহলে মা-বাবার জন্য তখন এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ করা জায়েয হবে। ফুকাহায়ে কেরাম এ কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
এ কারণের উপর ভিত্তি করে নমুনাস্বরূপ কিছু মাসআলা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। তারপর যে সমস্ত হাদীসের কারণে মা-বাবার হকের ব্যাপারে মানুষের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো উল্লেখ করে যুক্তিযুক্ত উত্তর লিপিবদ্ধ করবো। আর এ বিষয়ের যে সমস্ত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়, সেগুলোও গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণসহ উদ্ধৃত করবো।

যে সমস্ত বিষয়ে মা-বাবার হুকুম মানা জরুরী নয়

১. যে ভ্রমনে (তা ব্যবসার উদ্দেশ্যে হোক বা হজ্জ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে হোক, যদি তা ফরয বা ওয়াজিব ভ্রমন না হয়) মৃত্যুর আশংকা প্রবল নয়, তা মা-বাবার অনুমতি ছাড়া করা জায়েয আছে। মা-বাবা এমন ভ্রমন করতে নিষেধ করলে, তাদের নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে ভ্রমন না করা জরুরী নয়। মাসআলাটি ‘দুররে মুখতার’ এবং ‘আলমগিরী’তে উল্লেখ আছে। আর যে ভ্রমন ফরয বা ওয়াজিব তার মধ্যে যে এ বিধান আরো গুরুত্বসহকারে কার্যকর হবে, তা বলাই বাহুল্য। মা-বাবা প্রয়োজনীয় সেবা-যত্নের মুখাপেক্ষী না হলে তখন এ বিধান। সেবা-যত্নের প্রয়োজন না হওয়া দু’কারণে হতে পারে। এক. তাদের সেবা-যত্নের প্রয়োজন নাই। দুই. সেবা-যত্নের প্রয়োজন রয়েছে, তবে তার জন্য অন্য লোক রয়েছে। এর কারণ হলো, উপরোল্লেখিত অবস্থাসমূহে মা-বাবার বাস্তবিক এবং উল্লেখযোগ্য কোন দুঃখ-কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাই এমতাবস্থায় মা-বাবার কথার বিরুদ্ধে কাজ করা ঠিক হবে। হারাম বা মাকরুহ হবে না।
২. মা-বাবার প্রয়োজনীয় অভাব (যাকে শরীয়ত প্রয়োজনীয় বলেছে। যেমন, খাওয়া-পরা ও ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি) পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন না থাকলে এবং সন্তানের নিকট নিজের প্রয়োজনীয় অভাবের তুলনায় অধিক অর্থ-সম্পদ থাকলে, আর মা-বাবা এতদসত্ত্বেও সন্তানের নিকট অর্থ চাইলে তখন সন্তানের জন্য তা দেওয়া জরুরী নয়।
৩. মা-বাবা নিজেদের সেবা-যত্নের প্রয়োজন ছাড়াই যদি নফল নামায পড়তে নিষেধ করে বা অন্য কোন অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে নিষেধ করে, তাহলে এমতাবস্থায় তাদের কথা মানা জরুরী নয়। হাঁ, তারা যদি জরুরী খেদমতের মুখাপেক্ষী হয় এবং নফল ইত্যাদি কাজে রত থাকার কারণে তাদের কষ্ট হয় এবং খেদমত করার অন্য কোন লোকও না থাকে তাহলে সন্তানের জন্য নফল ইত্যাদি ছেড়ে তাদের খেদমত করা জরুরী এবং ওয়াজিব।
৪. মা-বাবা যদি তামাকসেবী হয় এবং তামাক সেবন কোন রোগ-ব্যাধি বা সমস্যার কারণে না হয়, আর এমতাবস্থায় যদি মা-বাবা সন্তানকে তামাক প্রস্ত্তত করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় (তামাক সেবন মারাত্মক ধরনের মাকরুহে তানযিহী। তবে বিশেষ ধরনের কোন তামাক হলে যার দ্বারা কোন প্রকার ক্ষতি বা মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা না থাকে, বা এমন কোন রোগের রোগী হয়, যার তামাক সেবন ছাড়া অন্য কোন চিকিৎসা না থাকে, তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে তামাক সেবন মাকরুহ ছাড়াই জায়িয। ‘মাজালিসুল আবরার’ গ্রন্থের প্রণেতা তামাক সেবনের ক্ষতি ও নিন্দনীয়তা অত্যন্ত বিস্তারিত এবং বিশ্লেষণ সহকারে প্রমাণিত করেছেন।) তাহলে সন্তানের উপর এ নির্দেশ মান্য করা জরুরী নয়। বরং একটি মাকরুহ কাজে লিপ্ত হওয়া, যা শরীয়তে নিন্দনীয়। আর প্রয়োজনের ক্ষেত্রে-যার বিস্তারিত বিবরণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে-তার নির্দেশ পালন করা ওয়াজিব।
৫. কারো স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার মা-বাবা (বাস্তবে) কোন কষ্ট ও যন্ত্রনা পায় না, এরপরও অনর্থক তার মা-বাবা তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দেয়, তাহলে তার জন্য তাদের এ নির্দেশ মান্য করা জরুরী নয়, বরং এমতাবস্থায় তালাক দেওয়া স্ত্রীর উপর এক প্রকারের জুলুম। তালাক আল্লাহর নিকট অত্যন্ত খারাপ একটি জিনিস। যা কেবল অপারগ অবস্থায় জায়িয রাখা হয়েছে। অনর্থক তালাক দেওয়া জুলুম এবং মাকরুহে তাহরীমী। বিবাহের বিধান তো সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দেওয়া হয়েছে, তাই বিনা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ কি করে ঠিক হতে পারে? ইমাম ইবনুল হুমাম ‘ফাতহুল কাদীর’ গ্রন্থে বিষয়টির বিস্তারিত তাহকীকী আলোচনা করেছেন।
৬. মা-বাবা যদি কোন গুনাহের কাজের হুকুম দিয়ে বলে যে, অমুক গুনাহের কাজটি করো। যেমন, বলল যে, সাহায্যের হকদারের সাহায্য করো না বা যাকাত দিও না বা দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করো না বা এ ধরনেরই অন্য কোন বিষয়ের হুকুম দিলো, তাহলে এমতাবস্থায় তাদের কথা মান্য করা হারাম। যদি জরুরী কোন কাজ করতে বাধা দেয়, তাহলে তাদের বিরোধিতা করা ফরয। হাঁ, যদি তাদের (বাস্তবিক ও মারাত্মক) কষ্ট হয়-যেমন, তারা অসুস্থ এবং কোন খাদেমও নাই ওদিকে নামাযের সময় হয়েছে, এখন তাদের খোঁজ-খবর না নিলে তাদের চরম কষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে, তাহলে এমতাবস্থায় তারা নামায কাযা করার নির্দেশ দিলে কাযা করবে এবং পরবর্তীতে কাযা পড়ে নিবে। আর যদি কোন মুস্তাহাব কাজে বাধা দেয়, আর তা (বাস্তব ও মারাত্মক) কোন জরুরী সমস্যার কারণে করে, তাহলে তাদের নির্দেশ পালন করা ওয়াজিব। আর খামাখা বাধা দিলে মানা ওয়াজিব নয়।
৭. মা-বাবা যদি বলে যে, তুমি আমার অমুক সন্তানকে (যে অভাবী নয়) এ পরিমাণ অর্থ দাও তাহলে শক্তি থাকা সত্ত্বেও এ অর্থ দেওয়া ওয়াজিব নয়। (এপর্যন্ত দৃষ্টান্ত সহকারে এ কথার বিবরণ দেওয়া হলো যে, কোথায় মা-বাবার হুকুম মানা ওয়াজিব, কোথায় নিষেধ এবং কোথায় জায়িয। মোটকথা, সব ক্ষেত্রে মা-বাবার আনুগত্য জরুরী নয়।)