হুকুকুল ওয়ালিদাইন – ৪

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হুকুকুল ইসলাম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
পরিশিষ্ট
উস্তাদ, পীর ও স্বামী-স্ত্রীর হকসমূহ
১. উস্তাদ ও পীরের হক অনেক বড়। তবে তাদের হক মা-বাবার হকের চেয়ে কম। এ বিষয়ে কারো কারো থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে।
যারা উস্তাদ ও পীর-মুর্শিদের হককে মা-বাবার হকের উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং মা-বাবার হককে উস্তাদ ও পীরের হকের চেয়ে কম বলেছে। হয়তো তাদের প্রমাণ হলো, মা-বাবা দৈহিক ও বাহ্যিক পরিচর্যা করে থাকে, আর এরা বাতেনী শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করে থাকে। আর দেহের চেয়ে আত্মা যে শ্রেষ্ঠ তা বলাই বাহুল্য। কিন্ত্ত এ প্রমাণ নেহায়েতই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য। কারণ, এটি একটি বিশেষ দিকের শ্রেষ্ঠত্বমাত্র। সার্বিক কোন শ্রেষ্ঠত্ব নয়। তাই বিশেষ একদিকের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য সবদিকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার পরিপন্থী নয়। তাছাড়া কুরআন-হাদীসের কোথাও উস্তাদ ও মুর্শিদের হক এত অধিক গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করা হয়নি, যত অধিক গুরুত্বের সাথে মা-বাবার হক বর্ণনা করা হয়েছে।
উস্তাদ ও পীরের হক হয় শুধুমাত্র শিক্ষাদানের কারণে। পক্ষান্তরে মা-বাবা অসংখ্য কষ্ট সয়ে নিঃস্বার্থভাবে কেবলই ভালবেসে সন্তানের প্রতিপালন করে থাকে। সন্তান বেয়াদবী করা ও অবাধ্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের সহজাত ভালোবাসার কারণে তারা সন্তানের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না। তাদের জন্য মন-প্রাণ কোরবান করে দেন। কিন্ত্ত উস্তাদ ও পীর এর বিপরীত। তাদের জন্য সামান্য বিরক্তি সহ্য করাও কঠিন, অথচ মা-বাবা অসংখ্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে থাকেন। আর কাজ অনুপাতে প্রতিদান হয়ে থাকে। তাই মা-বাবার কাজ যেহেতু অনেক বড়, তাই তাদের মর্যাদাও অনেক বড় হবে। যদিও কদাচিৎ কতক মা-বাবার মধ্যে উস্তাদ ও পীরের চেয়ে স্নেহ কম পাওয়া যায় এবং কতক উস্তাদ ও পীরের মধ্যে মা-বাবার চেয়ে অধিক স্নেহ-মমতা পাওয়া যায়। কিন্ত্ত তা ধর্তব্য নয়। কারণ, এমনটি খুব কমই হয়ে থাকে। কদাচিৎ পাওয়া এ অবস্থা বিধানের ভিত্তি হতে পারে না। বিধানের ভিত্তি তো এটাই, যেটা উপরে বর্ণিত হয়েছে। বিষয়টি খুব ভালো করে আত্মস্থ করো।
পীর-মুর্শিদ ও উস্তাদের হক মনে-প্রাণে আদায় করো। কারণ, তাদের উসীলায় মনুষ্যত্ব ও আল্লাহর সন্ত্তষ্টি নসীব হয়। তবে সীমা মেনে চলো। এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত এ আলোচনাই যথেষ্ট। কেউ কেউ বলে যে, উস্তাদের হুকুমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া জরুরী। এটি নিছক ভুল কথা। সর্বক্ষেত্রে তো মা-বাবারও এত হক নেই-যেমন উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। হাঁ, তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান করবে। প্রয়োজনের সময় অন্যান্যদের মত তাদেরও খেদমত করবে। তবে মা-বাবার মত তাদের আনুগত্য আবশ্যকীয় নয়। হাঁ, যেক্ষেত্রে মা-বাবার আনুগত্য জরুরী, সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য অবশ্যই ওয়াজিবের কাছাকাছি। খুব ভালো করে বুঝে নাও। উস্তাদ যদি ফাসেক অর্থাৎ পাপাচারী বা কাফের হয় তাহলেও তার সম্মান প্রদর্শন ও হক আদায়ে ত্রুটি করবে না, তবে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে।
স্ত্রীর দায়িত্বে স্বামীর হক
স্বামীর খেদমত করা এবং তার মনোবাঞ্ছা পুরা করা স্ত্রীর কর্তব্য এবং ফরয। স্ত্রীর জন্য এমন কোন মুবাহ কাজ করা যাবে না, যার দ্বারা স্বামীর সেবা-যত্নে বিঘ্ন ঘটে। দুনিয়াতে স্ত্রীর দায়িত্বে স্বামীর যত হক আছে, এত অন্য কারো হক কারো উপর নেই। যেমন (মিশকাত শরীফের) হাদীসে আছে যে, জনাব রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। আমি যদি আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো সেজদা করার হুকুম করতাম, তাহলে স্ত্রীকে হুকুম করতাম তার স্বামীকে সেজদা করতে। এ হাদীস দ্বারা স্বামীর কি পরিমাণ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হলো যে, ইবাদত-যা কেবলই আল্লাহর প্রাপ্য-যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য বৈধ হতো, তাহলে তার উপযুক্ত স্বামী ছাড়া আর কেউ হতো না। কিন্ত্ত স্বামীর সব হুকুম মানা জরুরী নয়। স্বামীর ঐ হুকুম, যা পালন না করলে তার কষ্ট হয়, তার খেদমতে ত্রুটি হয় বা যে কাজ করার দ্বারা তার কষ্ট হয়, এমন বিষেয়ে স্বামীর আনুগত্য করা জরুরী। (তবে তা শরীয়তবিরোধী না হতে হবে।) স্বামীর খেদমত করতে ত্রুটি করবে না। কোনভাবেই তার হক আদায়ে কমতি করবে না। এ বিষয়টি মা-বাবার হকের আলোচনায় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। ঠিক একই হুকুম স্বামীর ক্ষেত্রেও। তবে এখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝানোর জন্য নমুনাস্বরুপ কয়েকটি মাসআলা লিখছি।
শরীয়তে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পদ পৃথক
স্বামী ও স্ত্রীর সম্পদ শরীয়তে পৃথক গণ্য করা হয়। যে জিনিসের কেনা-বেচা এবং সর্বপ্রকার হস্তক্ষেপের অধিকার স্ত্রীর রয়েছে, তা তার মালিকানাভুক্ত সম্পদ। আর যে সম্পদে একই ধরনের হস্তক্ষেপের অধিকার স্বামীর রয়েছে, সে সম্পদ স্বামীর মালিকানাভুক্ত। দু’জনের সম্পদ মিলিয়ে ফেলার দ্বারা এবং গড়বড় করার দ্বারা-সম্পদ নেসাব পরিমাণ হলে-যাকাত ইত্যাদি থেকে দায়িত্বমুক্ত হবে না। এমতাবস্থায় স্বামী যদি বলে যে, আমার আর তোমার একই কারবার, তাই তুমি যাকাত দিও না, তাহলে কখনোই তার কথা মানবে না। কারণ, এতে আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা হয়। আর আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করে কোন মানুষের হুকুম মানা জায়েয নেই। মানুষ এ ব্যাপারে অনেক ত্রুটি করে থাকে।
স্বামীর হুকুমে ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত ছাড়া যাবে না
স্বামী যদি স্ত্রীকে তার মালিকানাধীন সম্পদ বৈধ জায়গায় ব্যয় করতে শরীয়তসম্মত কোন কারণ ছাড়া বাধা দেয়, তখন স্ত্রীর জন্য তার হুকুম তামিল করা ওয়াজিব নয়। তবে এটা অবশ্য ঠিক যে, পরস্পরে কলহ সৃষ্টি করা ঠিক নয়। যতদূর সম্ভব খুব একাত্মতার সাথে থাকা উচিত। কতক স্বামী দ্বীনদার না হওয়ার ফলে এমন ক্ষেত্রে বিরোধিতা করে থাকে। এ ধরনের ঝগড়া-ফাসাদ থেকে বাঁচার জন্য স্ত্রী জায়েয ও মাকরুহে তানযিহী বিষয়সমূহে স্বামীর আনুগত্য করতে পারে। হাঁ, ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদা তার কথায় ছাড়তে পারবে না।
স্বামীর অনুপতি ছাড়া কোন বুযুর্গের নিকট বাইয়াত হওয়া জায়েয আছে। হাঁ, কোন কলহের আশংকা থাকলে কলহ দূর করার জন্য বাইয়াত না হওয়াও জায়েয আছে। যেমন, স্বামী বাইয়াত হতে নিষেধ করলো, ওদিকে স্ত্রী বাইয়াত হতে চায়। এমতাবস্থায় স্ত্রী দৃঢ় মনোবলের হলে আল্লাহর উপর ভরসা করে বাইয়াত হয়ে যাবে। পরবর্তীতে এ কারণে কোন দুঃখ-কষ্ট দেখা দিলে সবর করবে, নাশোকরী করবে না। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সামনে বিভিন্ন প্রকারের দুঃখ-কষ্ট এসে থাকে। আখিরাতে এ ধরনের লোকদের উঁচু মর্যাদা রয়েছে। যে সমস্ত কাজ মাকরুহে তানযিহী, স্বামী সেগুলো করার হুকুম করলে তারও এই একই হুকুম।
স্বামীর উপস্থিতিতে নফল ইবাদতের হুকুম
স্বামী বাড়িতে উপস্থিত থাকলে নফল নামায, নফল রোযা ইত্যাদি তার অনুমতি ছাড়া করবে না। কারণ, এতে তার খেদমতে ত্রুটি হতে পারে। তবে তার অনুমতি নিয়ে করবে। হাদীস শরীফে বাড়ীতে উপস্থিত থাকার কথা আছে। তাই বাইরে থাকা অবস্থায় অনুমতি ছাড়া নামায-রোযা করায় ক্ষতি নেই। এ হাদীস দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, যে সমস্ত কাজ ও বিষয় স্বামীর হক আদায়ে বিঘ্ন ঘটায়-সেগুলো স্বামীর অনুমতি ছাড়া করা জায়েয নেই। বাকী সব কাজ শরীয়ত মোতাবেক করা দুরস্ত আছে।
স্বামী যদি নিজের কোন আত্মীয় বা অন্য কোন লোকের কোন জায়েয কাজ কোন অপারগতা ছাড়া নিজের স্ত্রীর দ্বারা করায়, তাহলে সে কাজ করা স্ত্রীর জিম্মায় জরুরী নয়। যেমন, কারো জন্য খাবার রান্না করালো বা কাপড় সেলাই করালো বা এমনই অন্য কোন কাজ করালো। যদি কোন অপারগতার কারণে করায় তাহলে যেহেতু এ কাজ না করায় স্বামীর কষ্ট হবে, তাই এ কাজ করে দেওয়া স্ত্রীর জন্য জরুরী।
গুরুত্বপূর্ণ ফায়দাঃ
স্ত্রী লোক কোন গায়রে মাহরাম লোকের (ভীষণ অপারগতা ছাড়া) কাপড় সেলাই করে দিলে-সে লোক যদি সৎ ও দ্বীনদার হয় এবং কোন ফেতনা ঘটার আশংকা না থাকে-তাহলে কোন গুনাহ নেই। আর যদি সে লোক বদদ্বীন হয় এবং ফেতনা হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে সেলাই করা দুরস্ত নয়। কতক দুশ্চরিত্র লোক সেলাই দেখে স্বাদ গ্রহণ করে থাকে।
অতিরঞ্জন থেকে বাঁচানোর জন্য নমুনাস্বরুপ এ অল্প কয়টি কথা লেখা হলো। যাতে স্বামীর আনুগত্য কোথায় জরুরী আর কোথায় জরুরী নয়, তা জানা যায়। অন্যথা শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে স্বামীর আনুগত্য যত বেশী করা যায়, ততই উত্তম। এ ধরনের নারীর জান্নাতে অনেক উঁচু স্তর লাভ হবে। হাঁ, নফল ইবাদতসমুহের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে। কারণ, মানব সৃষ্টির মূল লক্ষ্য আল্লাহর আনগত্য করা। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ-কোন অবস্থায় আল্লাহর যিকির মা-বাবার অপ্রয়োজনীয় সেবা-যত্নের চেয়ে উত্তম-এর আলোচনায় ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে, সে বিধান এখানেও প্রযোজ্য।
‘এ পৃথিবী ভালোবাসার বস্ত্ত নয়। এটি শিক্ষাগ্রহণের জায়গা, তামাশার বস্ত্ত নয়।’
আলহামদুলিল্লাহ! পরিশিষ্টটি সমাপ্ত হলো। আল্লাহ তাআলা জনাবে রাসূলে কারীম আলাইহিস সালাতু ওয়াত তাসলীমের উসীলায় কবূল করুন এবং উপকারী বানান। আমীন।
Leave a Reply