উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আদাবুল মুআশারাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

প্রথম কথা
হামদ ও সালাতের পর পাঠক সমীপে নিবেদন এই যে, বর্তমান যুগে দ্বীনের পাঁচটি শাখার মধ্য থেকে সাধারণ মানুষ তো কেবলমাত্র দু’টি শাখাকে অর্থাৎ, আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদত-বন্দেগীকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত মনে করে, শরীয়তের আলেমগণ তৃতীয় শাখা অর্থাৎ, মুয়ামালাত তথা লেনদেন ও কায়-কারবারকেও দ্বীন বলে গ্রহণ করেছেন এবং তরীকতের মাশায়েখগণ পঞ্চম শাখা অর্থাৎ, আখলাক তথা আত্মিক চরিত্রের সংশোধনকেও দ্বীন বলে গণ্য করেছেন, কিন্ত্ত চতুর্থ শাখাটিকে অর্থাৎ, আদাবে মুয়াশারাত তথা সামাজিক শিষ্টাচারকে এ তিন শ্রেণীর প্রায় প্রত্যেকেই (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া),আর বিশ্বাসগতভাবে তো অধিকাংশই দ্বীনের বহির্ভুত ও সম্পর্কহীন গণ্য করেছে। (আর এ কারণেই অন্যান্য শাখার তো বিশেষভাবে বা সাধারণভাবে অর্থাৎ, ওয়াযের মধ্যে কম-বেশী শিক্ষাদান করা হয় ও আলোচনা করা হয়। কিন্ত্ত এ শাখার নাম পর্যন্ত কখনো মুখে উচ্চারিত হয় না।) এ কারণে ইলম ও আমল উভয় দিক থেকে এ শাখাটি সম্পূর্ণরুপে বিস্মৃত হয়ে চলেছে।
আমার মতে পারস্পরিক মিল-মুহাব্বত ও ঐক্যের পিছনে (যার প্রতি শরীয়ত খুব তাকীদ করেছে এবং বর্তমানযুগে বিবেকের দাবীতেও এর পক্ষে খুব জোরে-শোরে চিৎকার করা হচ্ছে।) যে কমতি রয়েছে তার বড় একটি কারণ এই আদাবুল মুয়াশারাতের অভাব তথা সামাজিক শিষ্টাচারহীনতা। কারণ, এর (অনুপস্থিতির) ফলে পরস্পরে মন কষাকষি হয় ও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যা পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও হৃদ্যতার প্রধান ভিত্তি উদারচিত্ততা ও সহনশীলতার বিলুপ্তি ঘটায়। অথচ আদাবুল মুয়াশারাত তখা সামাজিক শিষ্টাচারের দ্বীনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, এই ভ্রান্ত ধারণাকে আয়াত, হাদীস ও ধর্মীয় পন্ডিতদের উক্তি প্রত্যাখ্যান করে থাকে। নমুনা স্বরুপ তার কিছু উল্লেখ করছি।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে বলা হয় যে, মজলিসে স্থান প্রশস্ত করে দাও, তখন তোমরা স্থান প্রশস্ত করে দিও। আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দিবেন। আর যখন বলা হয় যে, উঠে যাও, তখন উঠে যেয়ো।’ (সূরা মুজাদালা-১১)
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন-
‘ হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে (যদিও তা পুরুষের ঘর হোক-যদি তা বিশেষ নির্জন বাসগৃহ হয়) প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না করো এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম না করো।’ (সূরা নূর-২৭)

লক্ষ্য করুন! এ আয়াতে নিজের পার্শ্বস্থ লোকের আরামের প্রতি লক্ষ্য রাখার কিতাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সঙ্গে আহার করার সময় নিজের সাথীদের অনুমতি না নিয়ে এক সঙ্গে দু’টি করে খেজুর খেতে নিষেধ করেছেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)
লক্ষ্য করুন এ হাদীসে একটি অতি সাধারণ বিষয়ে এজন্য নিষেধ করা হয়েছে যে, এটি অভদ্রতা এবং অন্যদের জন্য অপছন্দনীয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি (কাঁচা) পেঁয়াজ বা রসুন খাবে, সে যেন আমাদের থেকে (অর্থাৎ, মজলিস থেকে) দূরে থাকে।’ (বুখারী ও মুসলিম)
লক্ষ্য করুন, অন্যদের সামান্য কষ্টের প্রতি লক্ষ্য করে এ থেকে নিষেধ করেছেন।
তিনি আরো ইরশাদ করেন- ‘মেহমানের জন্য মেযবানের নিকট এত অধিক সময় অবস্থান করা হালাল নয়, যার দ্বারা মেযবান বিরক্ত হয়ে যায়।’ (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীসে এমন বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে যার দ্বারা অন্যের মনে বিরক্তির উদ্রেক হয়।

তিনি আরো ইরশাদ করেন-
‘মানুষের সাথে আহার করার সময় নিজের পেট ভরে গেলেও অন্যেরা খাওয়া শেষ করার আগে হাত গুটিয়ে নিবে না। কারণ, এতে অন্যেরা লজ্জা করে হাত গুটিয়ে নিবে, অথচ হয়তো তাদের আরো খাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’ (ইবনু মাজাহ)
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এমন কাজ করবে না, যার দ্বারা অন্য ব্যক্তি লজ্জা পায়। কতক মানুষ সহজাতভাবেই মানুষের সামনে কিছু গ্রহণ করতে লজ্জাবোধ করে এবং তাতে তাদের কষ্ট হয়। বা তাদের থেকে মানুষের সামনে কিছু চাওয়া হলে দিতে অস্বীকার করতে ও আপত্তি জানাতে লজ্জাবোধ করে। যদিও প্রথম ব্যক্তির গ্রহণ করতে মন চায় এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির দিতে মন চায় না। এমন ব্যক্তিকে মানুষের সামনে কিছু দিবে না এবং মানুষের সামনে তার থেকে কিছু চাবে না।

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে-
একবার হযরত জাবির (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাড়ীর দরজায় হাজির হয়ে করাঘাত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন-‘কে’? তিনি উত্তর দিলেন-‘আমি।’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্তি ভরে বললেন-‘আমি, আমি।’ (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস দ্বারা জানা গেলো যে, স্পষ্টভাবে কথা বলবে, যেন অন্যে কথা বুঝতে পারে। এমন অস্পষ্ট কথা বলা উচিত নয়, যা বুঝতে কষ্ট হয়-কারণ এতে অন্যকে জটিলতায় ফেলা হয়।
হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন-
সাহাবায়ে কেরামের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক প্রিয় আর কেউই ছিলো না। কিন্ত্ত তাকে দেখে সাহাবায়ে কেরাম এ জন্য দাঁড়াতেন না যে, তাদের জানা ছিলো যে, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপছন্দনীয়। (তিরমিযী)
এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেলো যে, বিশেষ কোন আদব বা সম্মান প্রদর্শন বা বিশেষ কোন খেদমত যদি কারো রুচিবিরুদ্ধ হয়, তাহলে তার সঙ্গে সেরুপ আচরণ করবে না। নিজের মন চাইলেও অন্যের চাহিদা ও ইচ্ছাকে নিজের ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দিবে। কতক লোক কতক খেদমতের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করে থাকে, এতে তারা বুযুর্গদেরকে কষ্ট দিয়ে থাকে।

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘এমন দুই ব্যক্তির মাঝে-তাদের অনুমতি ছাড়া-বসা জায়েয নাই। যারা ইচ্ছা করে পাশাপাশি বসেছে।’ (তিরমিযী)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যার দ্বারা অন্যের কষ্ট হয় বা বিরক্তির উদ্রেক হয়।
হাদীস শরীফে আরো এসেছে-
‘হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাঁচি এলে তিনি নিজের মুখ হাত বা কাপড় দ্বারা ঢেকে নিতেন এবং আওয়াজ নীচু করতেন।’ (তিরমিযী)
এ হাদীস দ্বারা জানা গেলো যে, নিজের পার্শ্ববর্তী লোকের প্রতি এতটুকু পর্যন্ত খেয়াল করবে যে, তার যেন উঁচু আওয়াজের কারণেও কষ্ট না হয়, আতংক সৃষ্টি না হয়।
হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আমরা যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসতাম, তখন যে যেখানে জায়গা পেতাম সেখানেই বসে যেতাম।’ (আবু দাউদ)
অর্থাৎ, মানুষের কাতার ভেদ করে বা কাঁধ ডিঙ্গিয়ে সম্মুখে যেতো না। এ হাদীস দ্বারাও মজলিসের আদব প্রমাণিত হয় যে, তাদেরকে এতটুকু কষ্টও দিবে না।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে ‘মওকুফ’ভাবে, হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে ‘মরফু’ভাবে এবং হযরত সাঈদুবনুল মুসায়্যিব (রাযিঃ) থেকে ‘মুরসাল’ভাবে বর্ণিত আছে-
‘রোগী দেখতে গিয়ে রোগীর নিকট বেশী সময় বসবে না। অল্প সময় বসে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।’ (আবু দাউদ, রাযীন, বাইহাকী)
এ হাদীসে কত সূ্ক্ষ্মভাবে এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে যে, কারো কষ্ট বা বিরক্তির কারণও যেন না হয়। কারণ, কোন কোন সময় কারো বসে থাকার কারণে রোগীর পার্শ্ব পরিবর্তন করতে বা পাও ছড়িয়ে দিতে বা কথাবার্তা বলতে এক ধরনের সংকোচ ও আড়ষ্টতা হয়ে থাকে। তবে যার বসে থাকার দ্বারা রোগীর আরাম হয়, সে এর ব্যতিক্রম।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) জুমুআর গোসল জরুরী হওয়ার এ কারণই বর্ণনা করেছেন যে, ইসলামের প্রথম দিকে সিংহভাগ লোক দরিদ্র ও শ্রমজীবি ছিলো। ময়লা কাপড়ে ঘাম নির্গত হওয়ায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে, তাই গোসল ওয়াজিব করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ওয়াজিবের এ বিধান ‘মানসূখ’ বা রহিত হয়ে যায়।
এ হাদীস দ্বারাও জানা গেলো যে, কারো দ্বারা যেন কারো কষ্ট না হয়, এ চেষ্টা করা ওয়াজিব।
নাসায়ী শরীফে হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘শবে বরাতে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা থেকে আস্তে ওঠেন-এ কারণে যে, হযরত আয়েশা (রাযিঃ) ঘুমুচ্ছিলেন, ঘুম ভেঙ্গে তার যেন কষ্ট না হয়। আস্তে করে পবিত্র জুতা পরিধান করেন। আস্তে দরজা খোলেন।’
এ ঘটনায় ঘুমন্ত ব্যক্তির প্রতি কি পরিমাণ লক্ষ্য রাখা হয়েছে যে, এমন কোন আওয়াজও যেন না করা হয়, যার দ্বারা ঘুমন্ত ব্যক্তি হঠাৎ জেগে উঠে পেরেশান হয়।
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত মিকদাদ বিন আসওয়াদ (রাযিঃ) থেকে দীর্ঘ একটি ঘটনায় বর্ণিত আছে যে, ‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহমান ছিলাম এবং তার ওখানেই অবস্থান করছিলাম। আমরা ইশার নামাযের পর যদি শুয়ে থাকতাম আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেরীতে তাশরীফ আনতেন, তখন মেহমানদের ঘুমন্ত ও জাগ্রত থাকার উভয়বিধ সম্ভাবনাই থাকতো। তাই তিনি জাগ্রত থাকার সম্ভাবনার কারণে সালাম করতেন ঠিকই, তবে আস্তে সালাম করতেন, যেন জেগে থাকলে শুনতে পায়, কিন্ত্ত ঘুমিয়ে থাকলে ঘুম ভেঙ্গে না যায়।’

এ হাদীস দ্বারাও ঐ বিষয়ের গুরুত্বই বোঝা গেলো, যা ইতিপূর্বের হাদীসে বোঝা গেছে। এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীসই বর্ণিত আছে। (যে সমস্ত হাদীসের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি, সেগুলো মিশকাত এবং তা’লীমুদ্দীন থেকে নকল করা হয়েছে।
ফিকহের কিাতবে খাবার খাওয়া, পাঠদান বা ওযীফা ইত্যাদিতে রত ব্যক্তিকে সালাম না দেওয়ার কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ দ্বারা পরিষ্কার জানা যায় যে, জরুরী কোন কাজে লিপ্ত ব্যক্তির মনোযোগকে বিনা প্রয়োজন বিক্ষিপ্ত বা অন্যমনস্ক করা শরীয়তে অপছন্দনীয়। একইভাবে মুখের গন্ধের রোগীকে মসজিদে আসতে না দেওয়ার কথাও ফকীহগণ উদ্ধৃত করেছেন। যার দ্বারা পরিষ্কার জানা যায় যে, মানুষকে কষ্ট দেওয়ার পথ ও মাধ্যমসমূহ বন্ধ করা একান্তই জরুরী। এ সমস্ত দলিলের প্রতি সার্বিকভাবে দৃষ্টি দিলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শরীয়ত অত্যন্ত তাকীদ সহকারে এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে যে, কোন ব্যক্তির কোনও আচরণ বা কোনও অবস্থা যেন অন্যদের জন্য সামান্যতম পর্যায়েও কষ্ট, ক্লেশ, বোঝা, চাপ, সংকীর্ণতা, সংকোচ, বিরক্তি, মানসিক কষ্ট, অপছন্দনীয়, শংকা, অস্থিরতা, ভীতি, আতংক বা খটকার কারণ ও মাধ্যম না হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র তার কথা ও কাজ দ্বারাই এর প্রতি গুরুত্বারোপ করার উপর ক্ষান্ত করেননি, বরং কোন সাহাবীর উদাসীনতা ও অমনোযোগীতার ক্ষেত্রে এ সমস্ত আদবের উপর আমল করতে বাধ্য করেছেন এবং তার দ্বারা এ আদব বাস্তবায়ন করিয়ে এগুলো শিক্ষা দিয়েছেন।
একবার এক সাহাবী একটি হাদীয়া নিয়ে তার খেদমতে সালাম প্রদান ও অনুমতি গ্রহণ ছাড়া ভিতরে প্রবেশ করেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন-
‘পুনরায় বাইরে যাও, সালাম দাও এবং অনুমতি গ্রহণ করে ভিতরে প্রবেশ করো।’
মূলতঃ মানুষের সাথে সদাচরণের ভিত্তি ও মূল হলো একটি বিষয় অর্থাৎ, কারো দ্বারা কারো কোন কষ্ট ও আঘাত যেন না লাগে। বিষয়টিকে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন-
‘পরিপূর্ণ মুসলমান সে, যার মুখ ও হাত (এর কষ্ট) থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদে থাকে।’ (বুখারী)
যে কাজ দ্বারা কষ্ট হয়, তা আর্থিক বা দৈহিক খেদমতের রুপে হোক, বা আদব ও সম্মানের রুপে হোক-তাকে সমাজে সদাচরণ মনে করা হলেও তা অসদাচরণের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, আরাম ও শান্তি-যা সদাচরণের প্রাণ-খেদমতের উপর-যা সদাচরণের খোসা সদৃশ-প্রাধান্য পাবে। কারণ, মগজ ছাড়া খোসা যে, বেকার তা বলাই বাহুল্য।
আদাবুল মু’য়াশারাত বা সামাজিক শিষ্টাচার দ্বীনের ‘শি’য়ার’ বা নিদর্শন ও প্রতীক হওয়ার দিক থেকে ফরয ‘আকীদা ও ইবাদতের থেকে যদিও পিছনে, কিন্ত্ত (আকীদা ও ইবাদতের ত্রুটি দ্বারা কেবলই নিজের ক্ষতি হয়, পক্ষান্তরে মু’য়াশারাত বা সামাজিক শিষ্টাচারের ত্রুটির ফলে অন্যদেরও ক্ষতি হয়। আর নিজের ক্ষতি নিজে করার চেয়ে অন্যের ক্ষতি করা অধিকতর মারাত্মক) এদিক থেকে মু’য়াশারাত আকীদা ও ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোন কারণ তো অবশ্যই আছে, যার ফলে আল্লাহ তাআলা সূরা ফুরকানে-
‘যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা (তর্কের) কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম।’ (সূরা ফুরকান-৬৩)
আয়াতকে-যা উত্তম শিষ্টাচারের দিকনির্দেশনা দান করে-ফরয ইবাদত ও আকীদা সংক্রান্ত নামায, খোদাভীতি, ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন ও তাওহীদের আলোচনার উপর অগ্রগণ্য করেছেন। ফরয ইবাদতসমূহের উপর হুসনে মু’য়াশারাত বা উত্তম শিষ্টাচারকে যে, এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তা বিশেষ বিশেষ দিক থেকে দেওয়া হয়েছে। অন্যথা নফল ইবাদতের উপর সব দিক থেকে এর প্রাধান্য রয়েছে।
হাদীস শরীফে এসেছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে দু’জন মহিলার কথা আলোচনা করা হলো। তাদের একজন বেশী বেশী নামায-রোযা করতো। (অর্থাৎ, নফল নামায-রোযা। কারণ, নফল নামায-রোযাই বেশী বেশী করা যায়।) কিন্ত্ত সে তার প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দিতো। অপরজন বেশী নামায-রোযা করতো না। (অর্থাৎ, শুধু জরুরীগুলো পালন করতো।) কিন্ত্ত প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দিতো না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমজনকে দোযখী এবং দ্বিতীয়জনকে জান্নাতী বলেছেন।
উপরোক্ত দিক থেকে ‘আদাবে মুয়াশারাত’ বা সামাজিক শিষ্টাচারের বিষয় ‘মুয়ামালাত’ বা লেনদেন ও কারবারের উপর যদিও অগ্রগণ্য নয়। কারণ, মুয়ালার ক্ষেত্রে সমস্যার কারণেও অন্যদের ক্ষতি ও কষ্ট হয়ে থাকে। কিন্ত্ত অপর একটি দিক থেকে ‘মুয়াশারাত’ ‘মুয়ামালাতে’র থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো, আম বা সাধারণ লোকেরা না হলেও খাস বা বিশেষ লোকেরা ‘মুয়ামালাত’কে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত মনে করে। আর ‘মুয়াশারাত’কে ‘আখাসসুল খাওয়াস’ বা অতি বিশিষ্ট লোকেরা ছাড়া অনেক খাস বা বিশিষ্ট লোকও দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। যারা মুয়াশারাতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তারাও মুয়ামালাতের মত একে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস করে না। আর এ কারণে কার্যত তার প্রতি গুরুত্বও কম আরোপ করে।
আখলাকে বাতেনী বা আধ্যাত্মিক গুণাবলী ও চরিত্রাবলীর ইসলাহ ও সংশোধন ফরয ইবাদতের মতই গুরুত্বপূর্ণ। ইবাদতসমূহের উপর মুয়াশারাতের প্রাধান্য পাওয়ার যে পর্যায় উপরে উল্লেখিত হয়েছে, তা এখানেও প্রযোজ্য। মোটকথা, দ্বীনের এ শাখা অর্থাৎ, মুয়াশারাতের অধ্যায়টি দ্বীনের অন্যান্য শাখার চেয়ে কোনটার থেকে একদিক দিয়ে, আর কোনটার থেকে অন্য দিক দিয়ে-অগ্রগণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলো। কিন্ত্ত এতদসত্ত্বেও সাধারণ মানুষের ব্যাপকভাবে আর কতিপয় বিশেষ লোকের আমলের দিক থেকে এর প্রতি মনোযোগ কম। আর যে নিজে এর উপর আমল করে সে তার সাথে সম্পৃক্ত ও ঘনিষ্ঠজনদের বা অসম্পৃক্তদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা, শিক্ষা দেওয়া ও সংশোধন করা সম্পূর্ণরুপে ছেড়ে দিয়েছে।

এ কারণে বহুদিন ধরেই আদাবে মুয়াশারাত বা সামাজিক শিষ্টাচার সংক্রান্ত কিছু জরুরী আদব-যেগুলোর বেশীর ভাগ সময় মুখোমুখি হতে হয় এবং প্রয়োজন পড়ে-লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিলো। যদিও অধম দীর্ঘদিন ধরে নিজের মুতাআল্লিকীন ও মুরীদদেরকে এ ধরনের ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে ধরপাকড় করে থাকি। যদিও এক্ষেত্রে আমার এ ভুলটুকু অবশ্যই হয়ে থাকে যে, কোন কোন সময় এ ব্যাপারে মেযাজের মধ্যে তেজস্বিতা সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাআলা আমার এ ত্রুটি মাফ করে সংশোধন করে দিন। এবং বেশীর ভাগ ওয়াযের মধ্যেও এ সমস্ত বিষয়ের তা’লীম ও তাবলীগ করে থাকি, কিন্ত্ত বিখ্যাত প্রবাদ-
অর্থাৎ, ‘ইলম হলো শিকার, লেখার মাধ্যমে তাকে বন্দী করতে হয়’-অনুযায়ী লেখার উপকারিতা বলার মধ্যে কি করে হতে পারে? তাই লেখারই প্রয়োজন বোধ হচ্ছিলো। কিন্ত্ত ঘটনাচক্রে কাজটি কেবলই বিলম্বিত হয়ে চলছিলো। কারণ, আল্লাহ তাআলার ইলমে এ কাজের জন্য এ সময়ই নির্দিষ্ট ছিলো। কোনরুপ বিন্যাস ছাড়া যে বিষয় যখন স্মরণ হবে বা সামনে আসবে, সে বিষয়েই লিখতে থাকবো। (আলহামদুলিল্লাহ, এখন সে সুযোগ হয়েছে। আমি প্রত্যেকটি বিষয়ের শিক্ষাদানের জন্য ‘আদব’ শব্দের শিরোনাম বসাবো।) এ পুস্তিকা যদি ছোটদেরকে বরং বড়দেরকেও পড়ানো হয়, তাহলে ইনশাআল্লাহ দুনিয়াতেই বেহেশতের স্বাদ নসীব হবে।
কবির ভাষায়-
‘বেহেশত এমন জায়গা, যেখানে কোন দুঃখ-কষ্ট নেই। কারো সাথে কারো কোন কাজ (ঝগড়া) নেই।’
‘আল্লাহই তাওফীক দানের মালিক এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ বন্ধু।’