উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আদাবুল মুআশারাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

মেহমান হওয়ার আদব
আদব-১৩: যদি কারো নিকট মেহমান হও, আর তোমার খানা খাওয়ার ইচ্ছা না থাকে-তুমি খানা খেয়েছো, বা রোযা রেখেছো বা যে কোন কারণে খাওয়ার ইচ্ছা নেই-তাহলে সেখানে গিয়েই তাকে জানিয়ে দাও যে, আমি এখন খানা খাবো না। এমন যেন না হয় যে, সে খাবারের আয়োজন করলো। এজন্য সে কষ্টও করলো। তারপর খাওয়ার সময় হলে তুমি জানালে যে, খাবার খাবে না। তাহলে সমস্ত আয়োজন ও খাবার বৃথা নষ্ট হলো।
আদব-১৪: একইভাবে মেযবানের অনুমতি না নিয়ে মেহমানের জন্য অন্য কারো দাওয়াত গ্রহণ করা উচিত নয়।
আদব-১৫: মেহমানের উচিত কোথাও গেলে মেযবানকে জানিয়ে যাওয়া, যাতে খানা খাওয়ার সময় তাকে তালাশ করতে গিয়ে পেরেশানী না হয়।
আদব-১৬: কোন প্রয়োজনে কোথাও গেলে সুযোগ পাওয়া মাত্র সে প্রয়োজনের কথা বলে দিবে। দেরী করবে না। কোন কোন লোক আছে, যারা জিজ্ঞাসা করলে বলে যে, এমনি দেখা করতে এসেছি। যখন ঐ ব্যক্তি নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য কোন কাজে লিপ্ত হয় এবং কথা বলার সুযোগ না থাকে, তখন বলে যে, আমার কিছু বলার ছিলো। এতে খুব কষ্ট হয়।
আদব-১৭: যখন কথা বলবে, সম্মুখে বসে কথা বলবে। পিছনে থেকে কথা বলায় কষ্ট হয়।
আদব-১৮: কোন জিনিস একাধিক লোকের ব্যবহারের হলে কাজ শেষে তা পূর্বের জায়গায় রেখে দিবে। এ বিষয়টির প্রতি খুব গুরুত্ব দিবে।
আদব-১৯: কোন কোন সময় ঘুমানো বা বসার জন্য এমন জায়গায় চৌকি বিছানো হয়-যেখানে সবসময় চৌকি বিছানো থাকে না-তাহলে কাজ শেষ হলে সেখান থেকে চৌকি উঠিয়ে একদিকে সরিয়ে রাখবে, যেন কারো কষ্ট না হয়।
আদব-২০: অন্যের চিঠি-যা তোমার বরাবর লিখছে না-দেখো না। সামনাসামনিও না-যেমন কেউ লিখছে, আর কেউ দেখছে এবং গোপনেও না।
আদব-২১: কারো সামনে কাগজপত্র রাখা থাকলে সেগুলো উঠিয়ে দেখো না। হয়তো সে ব্যক্তি কোন কাগজ তোমার থেকে গোপন রাখতে চায়। যদিও তা ছাপানো কাগজ হোক না কেন। কারণ, অনেক সময় এ কাগজ যে, তার কাছে আছে, একথা তুমি জানো-তা সে চায় না।
আদব-২২: যে ব্যক্তি খাবার খেতে যাচ্ছে বা তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে খাওয়ার জায়গা পর্যন্ত যেয়ো না। কারণ, এমতাবস্থায় বাড়ীওয়ালা চক্ষুলজ্জার কারণে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে, অথচ ভিতর থেকে তার অন্তর চায় না। আর অনেক লোক এমন আছে, যারা তাড়াতাড়ি সে প্রস্তাব গ্রহণ করে, এমতাবস্থায় সে বাড়ীওয়ালার আন্তরিক সম্মতি ছাড়া খাবার খেলো। আর যদি প্রস্তাব গ্রহণ না করে তাহলে বাড়ীওয়ালাকে হেয় করা হলো। তাছাড়া অতিরিক্ত লোক দেখে বাড়ীওয়ালা প্রথম ধাক্কাতেই হোঁচট খায়, এটাও কষ্ট দেওয়া।
আদব-২৩: এমন ব্যক্তি, যার নিকট একবার কোন প্রয়োজনের কথা বলেছো, তার নিকট পুনরায় ঐ প্রয়োজনের কথা বলার সময়ও কথাটি পরিপূর্ণ বলা উচিত। ইঙ্গিতের উপর বা আগে বলেছো এর উপর ভরসা করে অসম্পূর্ণ কথা বলবে না। কারণ, হতে পারে যে, ঐ লোক পূর্বের কথা ভুলে গিয়েছে। ফলে সে ভুল বুঝবে বা মোটেই বুঝবে না, ফলে সে কষ্ট পাবে।
আদব-২৪: কোন কোন লোক পিছনে বসে এ উদ্দেশ্যে গলা খাঁকারী দেয় যে, খাঁকরানির শব্দ শুনে ঐ লোক আমাকে দেখবে এবং আমার সাথে কথা বলবে। এ ধরনের আচরণে মারাত্মক কষ্ট হয়ে থাকে। এর চেয়ে তো এটাই ভালো যে, সরাসরি সামনে এসে বসবে এবং যাকিছু বলার আছে বলবে। আর কর্মরত মানুষের সঙ্গে এটাও তখন করবে, যখন তীব্র প্রয়োজন দেখা দিবে। তা নাহলে উত্তম হলো, এমন জায়গায় বসে থাকবে, যাতে সে তার আগমনের কথাও জানতে না পারে। অন্যথায় এতে করেও অনেক সময় কষ্ট হয়ে থাকে। তারপর সে কাজ থেকে অবসর হলে কাছে এসে বসে যাকিছু বলার আছে বলবে এবং শুনবে।
আদব-২৫: যে ব্যক্তি দ্রুত পথ চলছে, মুসাফাহা করার জন্য তাকে আটকিও না। হতে পারে এতে তার কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। একইভাবে এমন সময় তাকে খাড়া করে কথাও বলো না।
আদব-২৬: কতক লোক মজলিসে গিয়ে সবার সাথে পৃথক পৃথকভাবে মুসাফাহা করে। যদিও সবার সাথে তার পরিচয় না থাকে। এতে অনেক সময় ব্যয় হয়। তার মুসাফাহা শেষ হওয়া পর্যন্ত মজলিসের সমস্ত লোক আটকা পড়ে এবং পেরেশান হয়। সমীচীন হলো, যাকে উদ্দেশ্য করে এসেছে, তার সঙ্গে মুসাফাহা করে ক্ষান্ত করবে। হাঁ, অন্যদের সাথেও যদি পরিচয় থাকে, তবে সবার সাথে মুসাফাহা করায় দোষ নেই।
আদব-২৭: কারো নিকট কোন প্রয়োজনের কথা বলতে হলে বা কোন কিছুর আবদার করতে হলে-যেমন, কোন বুযুর্গের নিকট থেকে কোন ‘তাবাররুক’ নিতে হলে-এমন সময় তা বলে দাও এবং আবেদন করো, যেন ঐ ব্যক্তি তা পুরা করার সময় পায়। অনেকে ঠিক বিদায় হওয়ার মুহূর্তে ফরমায়েশ করে। এতে বাড়ীওয়ালার অনেক কষ্ট হয়। তখন সময় থাকে সীমিত। কারণ, মেহমান যাওয়ার জন্য প্রস্ত্তত। হতে পারে যে, এই সীমিত সময়ে তার সুযোগ নেই। সে কোন কাজে ব্যস্ত। তখন না তার নিজের কাজের ক্ষতি করতে চায়, না আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে চায়। ফলে তার অনেক কষ্ট হয়। আর এমন কাজ করা-যার দ্বারা অন্যের কষ্ট হয়-জায়েয নেই। তাছাড়া ‘তাবাররুক’ চাওয়ার সময় এদিকেও লক্ষ্য রাখবে যে, তা যেন ঐ বুযুর্গের সম্পূর্ণ অতিরিক্ত জিনিস হয়। অন্যথায় সহজপন্থা হলো, ঐ জিনিস নিজের তরফ থেকে তাকে দাও এবং বলো যে, এটি আপনি ব্যবহার করে আমাকে দিয়ে দিবেন।
আদব-২৮: এমন অনেকে আছে, যার কথার কিছু অংশ বলে খুব জোরে, আর কিছু অংশ বলে খুব আস্তে, যা শোনাই যায় না বা অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ শোনা যায়। উভয় অবস্থাতেই শ্রোতার ভুল বোঝার, দ্বিধা-সংশয় হওয়ার বা পেরেশান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। উভয়ের ফল হলো কষ্ট পাওয়া। তাই পুরো কথা সুস্পষ্টরুপে বলা উচিত।
আদব-২৯: কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। কোন সন্দেহ- সংশয় থাকলে সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হওয়া উচিত। না বুঝে নিজের বুঝ মত কাজ করা উচিত নয়। অনেক সময় না বুঝে কাজ করায় যার কাজ করা হয় তার কষ্ট হয়ে থাকে।
আদব-৩০: নিজের কোন মুরুব্বী কোন কাজে বললে কাজ শেষ করে তাকে অবশ্যই অবহিত করা উচিত। অনেক সময় তারা প্রতীক্ষায় থাকেন।
আদব-৩১: কোথাও মেহমান হয়ে গেলে সেখানকার ব্যবস্থাপনায় মোটেও নাক গলাবে না। তবে মেযবান ব্যবস্থাপনার বিশেষ কোন কাজ তার উপর চাপালে সে কাজের ব্যবস্থাপনায় দোষ নেই।
আদব-৩২: নিজের চেয়ে বড় কারো সাথে অবস্থান করলে তার অনুমতি ছাড়া অন্য কোন কাজ করা উচিত নয়।
আদব-৩৩: এক আগন্ত্তককে জিজ্ঞাসা করা হলো-তুমি কবে যাবে? সে উত্তর দিলো-যখন হুকুম করবেন। তখন তাকে শিখানো হলো যে, এ উত্তরের কোন অর্থ নেই। তোমার কি অবস্থা, কি সুবিধা-অসুবিধা আছে, কি পরিমাণ সময় তোমার হাতে আছে, আমি তার কি জানি? উচিত হলো, উত্তরে নিজের ইচ্ছা জানিয়ে দেওয়া। যদি খুব বেশী আদব, আনুগত্য ও সমর্পণের প্রাবল্য থাকে তাহলে নিজের ইচ্ছা জানিয়ে বলবে যে, আমার ইচ্ছা তো এই বাকী আপনি যেমন হুকুম করেন। মোটকথা, এমন উত্তর দিও না যে, জিজ্ঞাসাকারীর উপর চাপ সৃষ্টি হয়।
আদব-৩৪: একজন তালিবে ইলম অন্য এক ব্যক্তির প্রসব বেদনার তাবিয চাইলো। তখন তাকে তালিম দেওয়া হলো যে, তালিবে ইলমের জন্য অন্যদের দুনিয়াবী হাজত পেশ করা উচিত নয়। কেউ তাকে এমন ফরমায়েশ করলে সে অক্ষমতা জানিয়ে বলবে যে, আমাকে এ থেকে মাফ করুন। এটি আদবের খেলাফ।
আদব-৩৫: একজন তালিবে ইলম মেহমান হয়ে আসে। সে ইতিপূর্বেও এসেছিলো এবং অন্য জায়গায় অবস্থান করেছিলো। এবার এখানে থাকার ইচ্ছা নিয়ে এসেছিলো, কিন্ত্ত আমাকে বলেনি যে, এবার এখানে অবস্থান করবো। তাই তার জন্য খানা পাঠানো হয়নি। পরে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি যে, সে আমার এখানে অবস্থান করবে, তখন তার জন্য খানা আনানো হয় এবং তাকে বুঝিয়ে দেই যে, এমতাবস্থায় এখানে যে, থাকবে তা নিজের থেকে বলা উচিত ছিলো। না বললে বুঝবো কি করে। তাছাড়া ইতিপূর্বে অন্য জায়গায় অবস্থান করেছিলে বিধায় আমি নিজেও জিজ্ঞাসা করার প্রশ্ন আসেনি।
আদব-৩৬: এক মেহমান অপর এক মেহমানকে বলেছিলো যে, ‘খাবার তৈয়ার হয়েছে।’ অথচ মেহমানের এসব অনর্থক কাজ ও কথার কি প্রয়োজন?
আদব-৩৭: এক মেহমান মেযবানের খাদেমকে এ বলে পানি চায় যে, ‘পানি নিয়ে এসো।’ তখন হযরত বলেন যে, আদেশের সুরে কাজে বলা মোটেই উচিত নয়। এটি অসদ্ব্যবহার। এভাবে বলা উচিত যে, ‘একটু পানি দিবেন?’
আদাব-৩৮: হাদীয়া দেওয়ার একটি আদব এই যে, যাকে হাদীয়া দিচ্ছে, তার কাছে কিছু চাইতে হলে তখন হাদীয়া দিবে না। কারণ, এমতাবস্থায় প্রার্থিত বস্ত্ত দিতে ঐ ব্যক্তি বাধ্য হয়, আর দিতে না পারলে অপমাণিত হয়। একইভাবে অনেকে সফরের হালতে এতো অধিক পরিমাণে হাদীয়া দেয় যে, তা নিয়ে যাওয়া কষ্ট হয়ে যায়। যদি এতই আগ্রহ থাকে তাহলে তার অবস্থান স্থলে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিবে।
আদব-৩৯: প্রথম সাক্ষাতেই শাইখের (শারিরীক) খেদমত করায় মারাত্মক মানসিক চাপ হয়ে থাকে। খেদমতের ইচ্ছাই যদি থাকে তবে আগে অকৃত্রিম সম্পর্ক গড়ো।
আদব-৪০: মজলিসে বিশেষ কোন বিষয়ে যদি আলোচনা হতে থাকে তাহলে নবাগতের সালাম করে নিজের দিকে মনোযোগী করে কথার মাঝে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়। বরং সবার চোখ এড়িয়ে বসে পড়বে পরে সুযোগমত সালাম ইত্যাদি করতে পারবে।
আদব-৪১: মেহমানের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য না করে খাওয়ার জন্য তাকাল্লুফ করা এবং পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়।