উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আগলাতুল আওয়াম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

তিলাওয়াত ও তাজবীদ:

মাসআলা-১: কুরআন শরীফের কিছু কিছু জায়গায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে মিলিয়ে পড়লে কেউ কেউ কুফরীর ফতওয়া লিখেছে। এর চেয়েও বড় কথা হলো, সূরা ফাতিহার মধ্যে কতক হরফকে মিলিয়ে পড়লে শয়তানের নাম সৃষ্টি হয় লিখেছে। এ দু’টির কোন ভিত্তি নেই। তবে তিলাওয়াতের নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে এ দু’জায়গায় মিলিয়ে পড়া নিয়মবহির্ভূত ও দোষণীয়। কিন্তু তাই বলে কুফুরী বা শয়তানের নামের দাবী করা নিছক রচনামাত্র।
মাসআলা-২: হাফিয ও অন্যান্যদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, ‘সূরায়ে বারাআত’(তাওবা)এর শুরুতে কোন অবস্থাতেই বিসমিল্লাহ পড়া যায় না। কিন্তু সঠিক কথা হলো, শুধুমাত্র এক অবস্থায় এতে বিসমিল্লাহ পড়তে হয় না। যখন উপর থেকে পড়তে পড়তে ‘সূরা বারাআত’ পড়তে আরম্ভ করবে। কিন্তু যদি এ সূরা থেকেই তিলাওয়াত আরম্ভ করে, বা সুরার মাঝখানে বিরতি দিয়ে তারপর অবশিষ্টাংশ পড়ে তাহলে বিসমিল্লাহ বলবে।

দু’আ, দুরূদ ও যিকর:

মাসআলা-১: সাধারণ লোকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, বিনা ওযুতে দুরূদ শরীফ পড়া ঠিক নয়। এটি সম্পূর্ণ ভুল কথা। বরং কুরআন শরীফও বিনা ওযুতে পড়া দুরুস্ত আছে। তবে বিনা ওযুতে কুরআন শরীফে হাত লাগানো দুরুস্ত নয়।
মাসআলা-২: প্রসিদ্ধ আছে যে, ঠিক দুপুর সময় কুরআন পড়া নিষিদ্ধ। এটি নিছক ভুল কথা। তবে এ সময় নামায পড়া নিষিদ্ধ।
মাসআলা-৩: অনেক তাবিজ লেখকও বিষয়টির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না। তারা বিনা ওযুতেই কুরআনের আয়াত লিখে দেয় এবং ওযুবিহীন মানুষের হাতে তা দিয়ে দেয়। ওযু ছাড়া কুরআনের আয়াত লেখা এবং স্পর্শ করা উভয়টাই নাজায়েয।
মাসআলা-৪: কিছু কিছু পীর-মাশাইখ সশব্দে যিকর করাকে নিঃশর্তভাবে জায়েয মনে করে। এটি ঠিক নয়। সশব্দে যিকর জায়েয হওয়ার একটি অত্যাধিক জরুরী শর্ত হলো, এর কারণে কোন নামাযীর মনের একাগ্রতা বিঘ্নিত না হতে হবে। ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম নষ্ট না হতে হবে। যেখানে এ ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে আস্তে যিকর করবে। যদিও সশব্দে যিকর করার তা’লীম দেওয়া হোক না কেন।

অন্তিম রোগ ও জানাযা:

মাসআলা-১: প্রসিদ্ধ আছে যে, স্বামী স্ত্রীর লাশবাহী খাটের পায়াও ধরবে না। এটিও নিছক ভুল কথা। পরপুরুষের চেয়ে সে অধিক হকদার।
মাসআলা-২: প্রসিদ্ধ আছে যে, লাশ বাড়ীতে বা মহল্লায় থাকলে তা নিয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পানাহার করা গুনাহ। এ কথাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
মাসআলা-৩: সাধারণ লোকেরা বলে থাকে যে, লাশ ধোয়ানো পানির উপর পা রাখা ঠিক না। আর এ কারণেই লাশ ধোয়ানোর জন্য একটি গর্ত খুঁড়ে নেয়, যাতে সমস্ত পানি তার মধ্যে জমা হয়ে থাকে। এটি সম্পূর্ণ ভুল কথা।
মাসআলা-৪: কিছু কিছু সাধারণ মানুষ মুহাররম মাসে কবরে নতুন মাাটি দেওয়া জরুরী মনে করে। এরও কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-৫: কতক সাধারণ লোকের মধ্যে এ ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দেখা যায় যে, মৃত ব্যক্তিকে বাড়ীর পাত্রে গোসল দেওয়ানো যাবে না। বরং নতুন পাত্র এনে গোসল দেওয়াতে হবে। তারপর ঐ সমস্ত পাত্র বাড়ীতে ব্যবহার করা যাবে না। বরং মসজিদে পাঠিয়ে দিবে বা ভেঙ্গে ফেলবে। এটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-৬: সাধারণ লোকদেরকে দেখেছি যে, জানাযা নামাযের তাকবীর বলার সময় মুখ আকাশের দিকে উঠিয়ে থাকে। এটি ভিত্তিহীন কাজ।
মাসআলা-৭: অধিকাংশ জায়গার নিয়ম এই যে, লাশ দাফন করার সময় কবরের মধ্যে লাশকে চিৎ করে শোয়ায়ে শুধুমাত্র তার মুখ কেবলার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এটি ঠিক নয়। সঠিক নিয়ম হলো, পুরো লাশটিকে(ডান কাতে) কেবলামুখী করে শোয়ায়ে দিবে।
মাসআলা-৮: অধিকাংশ সাধারণ লোক মৃত্যুযন্ত্রনার সময় শরবত পান করানোকে জরুরী মনে করে। কেউ পান না করালে তাকে তিরস্কার করে। অথচ এটা জরুরীও নয় এবং পান না করালে তিরস্কার করারও কিছু নেই। বরং এরুপ মনে করাটাই অন্যায়।

রোযা:

মাসআলা-১: প্রসিদ্ধ আছে যে, এক রোযা রাখা ভালো নয়। প্রসিদ্ধ এ কথাটিরও কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-২: কতিপয় লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, মুহাররমের দশ তারিখের রোযা রাখবে না। কারণ, ইয়াযিদের মা এ রোযা রেখেছিলো। একথা নিতান্তই ভুল।
মাসআলা-৩: সাধারণ লোকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসের নফল ছয় রোযা রাখতে চায়, তার জন্য ঈদের পরের দিন একটি রোযা অবশ্যই রাখা উচিত। তা না হলে ঐ ছয় রোযা হবে না। এটি একান্তই ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-৪: কিছু কিছু লোক মনে করে যে, নফল রোযার সাহরী নাই। এটি ভুল কথা। এক্ষেত্রে ফরয ও নফল রোযা সমান।
মাসআলা-৫: কতক সাধারণ লোককে বলতে শোনা গেছে যে, নফল রোযার ইফতার মাগরিব নামাজের পর করবে। এরও কোন ভিত্তি নেই।

যাকাত, হজ্জ, কুরবানী, আকীকা ও মান্নত:

মাসআলা-১: কতক সাধারণ লোক বলে থাকে যে, কুরবানীর ঈদের দিন কুরবানী করার পূর্ব পর্যন্ত রোযা থাকবে। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। তবে কুরবানীর পূর্বে খাবার না খাওয়া মুস্তাহাব। কিন্তু তা রোযা নয়। না খাওয়া ফরযও নয়, এতে রোযার সওয়াবও নেই এবং রোযার নিয়ত নেই।
মাসআলা-২: কতক লোক মনে করে যে, ইহরামের মধ্যে এমন দু’টুকরো কাপড় পরা দুরস্ত নেই, যার মাঝে সেলাই করে জোড়া দেওয়া হয়েছে। এটি নিছক ভিত্তিহীন কথা। তবে পুরুষের জন্য এমনভাবে সেলাই করা কাপড় পরা নিষিদ্ধ, যা দেহের আকৃতিবিশিষ্ট। যেমন, জামা, পায়জামা ইত্যাদি।
মাসআলা-৩: কতক লোক খাসী করা পশু কুরবানী করা দুরুস্ত মনে করে না, তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। বরং খাসী করা প্রাণী কুরবানী করার ফযীলত অধিক। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাসি দুম্বা করবানী করেছিলেন।
মাসআলা-৪: এ কথাটি খুব প্রসিদ্ধ যে, আকীকার গোশত শিশুর মা, বাবা, নানা, নানী, দাদা ও দাদীর খাওয়া দুরুস্ত নয়। এ কথার কোন ভিত্তি নেই। আকীকার গোশতের হুকুম কুরবানীর গোশতের মত।
মাসআলা-৫: কতক সাধারণ লোকের ধারণা এই যে, কাউকে যাকাতের টাকা দিয়ে যদি না বলা হয় যে, এগুলো যাকাতের টাকা, তাহলে হয়ত যাকাত আদায় হয় না। এ ধারণা একান্তই ভুল। না বললেও যাকাত আদায় হয়ে যায়। তবে মনে মনে যাকাতের নিয়ত করতে হবে।
মাসআলা-৬: কতিপয় সাধারণ মানুষের ধারণা এই যে, স্বর্ণ-চান্দির যে সমস্ত অলংকার প্রতিদিন ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর যাকাত নাই। জেনে রাখা উচিত, তুলে রাখা অলংকার এবং ব্যবহৃত অলংকার উভয়ের বিধান একই। উভয়েরই যাকাত দিতে হবে।
মাসআলা-৭: কতক সাধারণ লোককে বলতে শোনা গেছে যে, কসম খাওয়ার সময় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি মুড়িয়ে রাখলে কসম হয় না। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৮: অধিকাংশ সাধারণ লোককে দেখা গেছে যে, মান্নতের শিরনি মসজিদে এনে সবার মাঝে বিতরণ করে। অথচ তাদের মধ্যে কেউ কেউ ’সাইয়্যেদ’ বংশের এবং ধনী লোকও থাকে। আর ’সাইয়্যেদ’ ও ধনী লোককে দেওয়ার দ্বারা মান্নত আদায় হয় না।