সামাজিক মুয়ামালাত-মুয়াসারাতের মাসালা সংক্রান্ত আলোচনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: আগলাতুল আওয়াম
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
বিবাহ, তালাক, খোলা ও যিহার:
মাসআলা-১: কতক জায়গার সাধারণ লোকদের মধ্যে এ ধারণা রয়েছে যে, সাক্ষী ছাড়াও নারী ও পুরুষের সম্মতিতে বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। তারা এর নাম ’দেহদান’ রেখেছে। এটি একান্তই ভুল ধারণা। এভাবে মোটেই বিবাহ হয় না। বরং তা ব্যভিচার হয়।
মাসআলা-২: প্রসিদ্ধ আছে যে, পীরের জন্য মহিলা মুরীদকে বিবাহ করা জায়েয নেই। এটি নিছক ভুল কথা। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সকল স্ত্রীর পীর ছিলেন।
মাসআলা-৩: প্রসিদ্ধ আছে যে, বিশটি সন্তান হলে বিবাহ ভেঙ্গে যায়, এটিও একান্তই ভুল কথা।
মাসআলা-৪: কতক সাধারণ লোক বলে যে, হাওয়া (আঃ)কে মন্দ বললে বিবাহ ভেঙ্গে যায়। এটিও নিছক ভুল কথা। তবে হাওয়া (আঃ)কে মন্দ বলা জায়েয নেই।
মাসআলা-৫: সাধারণ লোকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, স্বামী মারা যাওয়ার পর তার জানাযা বাড়ী থেকে বের হওয়ার পূর্বে স্ত্রী তার বাড়ী থেকে বের হয়ে অন্য বাড়ী চলে গেলে তা জায়েয আছে, কিন্তু জানাযা বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর অন্য বাড়ী যাওয়া জায়েয নাই। এ সমস্ত সাধারণ লোকদের ধারণায় যেন ’ইদ্দত’ মৃত্যুর সময় থেকে আরম্ভ হয় না, বরং জানাযা নিয়ে যাওয়ার সময় থেকে ‘ইদ্দত’ আরম্ভ হয়। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৬: কোন বিধর্মী নারী মুসলমান হওয়ার সাথে সাথে কোন মুসলমানের সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়ার ব্যাপক রীতি চালু আছে। এটি মারাত্মক ভুল রীতি। বিধর্মীদের শাসনাধীনে কোন বিধর্মী নারী মুসলমান হলে তিন হায়েয অতিক্রান্ত হওয়ার পর তার উপর তালাক পতিত হবে। তারপর ’ইদ্দতের’ জন্য তিন হায়েয অতিক্রান্ত হতে হবে। মোট ছয় হায়েযের পর তার বিবাহ দুরুস্ত হবে।
মাসআলা-৭: স্ত্রী যদি স্বামীকে বাপ বলে ফেলে তাহলে সাধারণ মানুষ মনে করে যে, তার বিবাহ ভেঙ্গে গেছে। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। বরং স্বামীও যদি স্ত্রীকে মা বা মেয়ে বলে ফেলে, তাতেও বিবাহে ছেদ পড়ে না। তবে কথাটি অর্থহীন। হাঁ, যদি এরূপ বলে যে, তুমি আমার জন্য মা-মেয়ের মত, তাহলে কখনো কখনো স্ত্রী হারাম হয়ে যায়। যার বিস্তারিত বিবরণ প্রয়োজনের সময় আলেমদের নিকট থেকে জানা যেতে পারে।
মাসআলা-৮: কতক সাধারণ মানুষের এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে যে, হায়েয অবস্থায় হয়ত বিবাহ সঠিক হয় না। তাদের এ সন্দেহ ভিত্তিহীন। এ অবস্থাতেও বিবাহ সঠিক হয়। তবে এমতাবস্থায় নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত দেখা, হাত লাগানো ইত্যাদি দুরুস্ত নয়।
মাসআলা-৯: সাধারণ মানুষ মামী, চাচী ও সৎ শাশুড়ীকে বিবাহ করা জায়েয মনে করে না। তাদের এ বিশ্বাস ভ্রান্ত। তবে এমনিতেই সম্মান বা অন্য কোনা কারণে এ ধরনের আত্মীয়কে বিবাহ না করলে সে ভিন্ন কথা।
মাসআলা-১০: কতক সাধারণ লোক মনে করে যে, রাগত অবস্থায় বা ধমকানোর নিয়তে তালাক দিলে তালাক হয় না। এটি একান্তই ভুল কথা। এ অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যাবে।
মাসআলা-১১: সাধারণ লোকদের মাঝে প্রসিদ্ধ আছে যে, দুই ঈদের মধ্যবর্তী সময়ে বিবাহ করবে না। কারণ, এতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বনিবনা হয় না। এ ধারণা শরীয়তবিরোধী।
ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, বন্ধক, শোফা ইত্যাদি:
মাসআলা-১: প্রসিদ্ধ আছে যে, শস্যের ব্যবসা করা নাজায়েজ। একথা সম্পূর্ণ ভুল। তবে যদি এমন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যে, কোন মূল্যেই শস্য পাওয়া যায় না এবং এমতাবস্থায় শস্য বিক্রি না করলে মানুষের কষ্ট হবে তাহলে এমতাবস্থায় শস্য আটকিয়ে রাখা হারাম।
মাসআলা-২: প্রসিদ্ধ আছে যে, কোন জিনিস ক্রয় করার পর বিক্রেতার নিকট অতিরিক্ত চাওয়া গুনাহ। এটি সম্পূর্ণ ভুল কথা। তবে বিক্রেতাকে পীড়াপীড়ি করে বিরক্ত করা হারাম। তবে সে যদি সানন্দে দিয়ে দেয় তাহলে কোন ক্ষতি নেই।
মাসআলা-৩: কতক জমির মালিক মনে করে যে, জমিতে যে সমস্ত ঘাস নিজে নিজেই উৎপন্ন হয়, সেগুলো আটকিয়ে রাখলেই মালিকানাধীন হয়ে যায় এবং তা বিক্রি করা জায়েয হয়ে যায়। এ উভয় কথাই নিছক ভুল।
মাসআলা-৪: কতক জমির মালিককে এ কথাও বলতে শোনা গেছে যে, ফল আসার পূর্বে ফুল বিক্রি করা এমনিতে তো জায়েয নাই, তবে ফুল বিক্রির সঙ্গে যদি কিছু জমিও ভাড়া দেওয়া হয় তাহলে তা জায়েয আছে। এ কথা সম্পূর্ণরূপে ভুল। এভাবে ভাড়া দেওয়ার দ্বারা ঐ বিক্রি জায়েয হয়ে যায় না।
মাসআলা-৫: সাধারণ জমির মালিকদের ধারণা এই যে, বন্ধক রাখার সময় বন্ধকদাতা যদি বন্ধককৃত জমির ফল-ফসল ও উপকারিতাকে হালাল করে দেয় তাহলে তা হালাল হয়ে যায়। একথা মোটেই ঠিক নয়। বরং বন্ধকের ক্ষেত্রে বন্ধকী জমির ফল-ফসল ও উপকারিতা ভোগ করার যদি শর্ত দেয় বা তার প্রচলন থাকে, তাহলেও তা হারাম হবে।
মাসআলা-৬: কতক সাধারণ লোক গাধা ও ঘোড়ার মিলনকে খারাপ মনে করে। এরও কোন ভিত্তি নেই। তবে এর বিনিময় নেওয়া জায়েয নেই।
মাসআলা-৭: কতক সাধারণ লোক মনে করে যে, ’শোফার’ অধিকার পৈত্রিক আত্মীয়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৮: কতক সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, সন্তান থাকাবস্থায় নিজের সম্পত্তির পুরোটা বা কিছু অংশ যদি কাউকে দান করতে চায়, তাহলে তা বাস্তবায়নের জন্য শর্ত হলো, ঐ সম্পদ দানকারী ব্যক্তির নিজস্ব হতে হবে। যদি পৈত্রিক সম্পত্তি হয়, তাহলে জায়েয হবে না। এটি নিছক ভুল কথা। নিজের উপার্জিত হোক আর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হোক শরীয়তে উভয়ের একই বিধান।
শিকার ও জবাইয়ের বর্ণনা:
মাসআলা-১: প্রসিদ্ধ আছে যে, জবাইকারীদের ক্ষমা করা হবে না। এটি ভুল কথা।
মাসআলা-২: কেউ কেউ বলে যে, যে পশু চাকু দ্বারা জবাই করা হবে, তা হালাল হওয়ার জন্য শর্ত হলো, ঐ চাকুর মধ্যে তিনটি পেরেক (কাঁটা) থাকতে হবে।
মাসআলা-৩: প্রসিদ্ধ আছে যে, জারজ সন্তানের জবাই করা পশু খাওয়া দুরুস্ত নাই। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৪: কতক লোক মহিলাদের জবাইকৃত পশু খাওয়া দুরুস্ত মনে করে না। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৫: কতক সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, জবাইকারীর সাহায্যকারীর উপর ’বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলা ওয়াজিব। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৬: কতক সাধারণ লোক মনে করে যে, জবাইর কাজে সাহায্যকারী ব্যক্তি-যেমন, পশুকে যে ধরবে-সে কাফের হলে ঐ জবাইকৃত পশু হালাল নয়। এরূপ মনে করা একদম ভুল।
মাসআলা-৭: প্রসিদ্ধ আছে যে, যখন ডিম ভাঙ্গা হয়, তখন প্রথমে এভাবে তাকবীর বলবে-
(’স্তরে স্তরে সাদা ডিম। নাই তার পা, নাই তার মাথা। খলিলের সুন্নাত, আল্লাহু আকবার।’)-এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-৮: প্রসিদ্ধ আছে যে, মহিলাদের জবাইকৃত পশু খাওয়া জায়িয নেই। এটি ভুল কথা।
পোশাক, সাজসজ্জা ও পর্দা:
মাসআলা-১: সাধারণ লোকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, মহিলা মুরীদের পীরের সাথে পর্দা করতে হবে না। এটি একান্তই ভুল কথা। অন্যান্য পুরুষের সাথে যেমন পর্দা করতে হয়, পীরের সাথেও তেমনি পর্দা করতে হবে।
মাসআলা-২: কতক মহিলা মনে করে যে, যে মহিলার হাতে চুড়ি নাই বা কমপক্ষে একটি নখেও মেহদী নাই, তার হাতের পানি পান করা মাকরূহ। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৩: কতক সাধারণ লোক মনে করে যে, নতুন জুতা এবং নতুন কাপড় পরিধান করলে এর হিসাব দেওয়া তার দায়িত্ব হয়ে যায়। কিন্তু রজব মাস থেকে নিয়ে রমাযানের শেষ জুমুআ পর্যন্ত পরলে বা শেষ জুমুআর দিন পরলে তার আর হিসাব দিতে হয় না। এ কারণে নতুন কাপড় এ সময়ের মধ্যেই পরিধান করবে। তাই কেউ কেউ এ সময়ে কয়েক জোড়া কাপড় এক সঙ্গে পরে। এসব নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৪: কতক মহিলা মনে করে যে, নারী লোকের বাম হাতে নারীসুলভ কোন চিহ্ন যেমন চুড়ি, আংটি থাকা জরুরী। এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলা-৫: কতক মহিলা শুধুমাত্র ’ইদ্দতকালীন’ সময়ে পরপুরুষের সামনে মাথা ঢাকা জরুরী মনে করে, অন্য সময় নয়। এটি নিছক ভুল। সব সময়ই পরপুরুষ থেকে পর্দা করতে হবে।
মাসআলা-৬: কতক লোককে দেখা গেছে যে, পাগড়ি বাঁধার জন্য দাঁড়ানো থেকে বসে যায়, আবার কেউ কেউ বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় এর কোন ভিত্তি নাই।
সালাম-মুসাফাহা, উঠাবসা ও সমাজ-সামাজিকতা:
কতক লোক সালাম দেওয়ার সময় মাথার উপর হাত রেখে বা ঝুকে যায়, আর কেউ কেউ মুসাফাহা করে সীনার উপর হাত রাখে। এ সবই শরীয়ত পরিপন্থী ও ভিত্তিহীন।
পানাহার:
মাসআলা-১: প্রসিদ্ধ আছে যে, দাওয়াত খাওয়ার সময় ক্ষুধা রেখে উঠা নিষেধ। এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা-২: খুব প্রসিদ্ধ আছে যে, এঁটে পানি দাঁড়িয়ে পান করা সওয়াবের কাজ। এর কোন প্রমাণ আমার চোখে পড়েনি এবং বিজ্ঞ কোন আলেমের মুখেও শুনিনি।
মাসআলা-৩: কতক সাধারণ লোক বলে যে, গোশতের মধ্যে হাড্ডি না থাকলে সে গোশত খাওয়া মাকরূহ। এটি নিছক ভিত্তিহীন কথা।
মাসআলা-৪: অধিকাংশ মহিলা পুরুষদের পূর্বে খাবার খাওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে দোষণীয় বলে মনে করে। এটি ভিত্তিহীন।
মাসআলা-৫: অধিকাংশ সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলন আছে যে, কোন ব্যক্তি খাবার খাওয়ার সময় অন্য ব্যক্তিকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকলে আর তার খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে সে উত্তরে বলে যে, ‘বিসমিল্লাহ করো’। এ ক্ষেত্রে যেহেতু এ শব্দ ব্যবহার করা শরীয়তে প্রমাণিত নাই, তাই এ ক্ষেত্রে এর ব্যবহার পরিহার করা উচিত এবং এতদস্থলে অন্য কোন শব্দ যেমন-’বারাকাল্লাহ’ ইত্যাদি বলা উচিত।
Leave a Reply