উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

প্রথম হেদায়াতের আলোচনায় এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, তাসাওউফ ও তরীকতের হাকীকত তথা প্রকৃত স্বরুপ এটাই যে, শরীয়তের যাহেরী ও বাতেনী সমস্ত বিধানের উপর পরিপূর্ণরুপে আমল করতে হবে। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শরীয়তের সমস্ত বিধানের উপর আমল করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয, ওয়াজিব ও জরুরী। তাই এ ব্যাপারে কোনরুপ গাফলতী বা শৈথিল্য প্রদর্শন না করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। আরো কর্তব্য এই সিরাতে মুস্তকীমের উপর চলার ব্যাপারে পরিপূর্ণ সাহসিকতার পরিচয় দেওয়া।

যে ব্যক্তি এ পথে চলার সংকল্প করবে, তার সর্বপ্রথম কাজ হলো, অতীতে কৃত সমস্ত গুনাহ থেকে পরিপূর্ণরুপে তাওবা করা। তাওবা করার তরীকা সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, তাওবার জন্য আল্লাহ তাআলার যে সমস্ত হক আদায় করা হয়নি, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো আদায়যোগ্য, সেগুলো আদায় করতে হবে। বিশেষ করে বান্দার যে সমস্ত হক নিজ দায়িত্বে রয়েছে- তা আর্থিক হক হোক, যেমন, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেছে, বা শারীরিক হক হোক, যেমন, কাউকে হাত বা মুখ দ্বারা কষ্ট দিয়েছে- এ সমস্ত হক পরিশোধ করা বা পাওনাদারের নিকট থেকে মাফ নিয়ে নেওয়া তাওবার জন্য শর্ত। যে পর্যন্ত কোন মানুষ এ সমস্ত হক থেকে মুক্তি লাভ না করবে, সে যদি সারাজীবনও ইবাদত-বন্দেগীতে কষ্ট-সাধনা করতে থাকে তবুও কস্মিনকালেও আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।

তাওবার হাকীকত ও তার তরীকাঃ

শুধু মুখে ‘তাওবা’ ‘তাওবা’ বলার দ্বারা বা ইস্তিগফারের শব্দ উচ্চারণ করার দ্বারা তাওবা হয় না। বরং প্রকৃত তাওবা হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক বিষয় থাকা জরুরী।
এক. অতীতে কৃত গুনাহসমূহের উপর অনুশোচনা ও আক্ষেপ এবং অন্তরে ব্যথা, বেদনা ও জ্বালা সৃষ্টি হতে হবে।
দুই. তাৎক্ষণিকভাবে সমস্ত গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে।
তিন. অন্তরে পাকাপোক্ত সংকল্প করতে হবে যে, ভবিষ্যতে ঐ সমস্ত গুনাহের কোন একটির কাছেও যাবো না।

তাওবার প্রথম মৌলিক বিষয়, অর্থাৎ, অতীতে কৃত গুনাহসমূহের উপর লজ্জা, অনুশোচনা এবং অন্তরে ব্যথা-বেদনা সৃষ্টি হওয়ার জন্য এ বিষয়ের সঠিক ইলম অর্জন করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। প্রথমতঃ মানুষের এ কথা জানা থাকতে হবে যে, কোন কোন কাজ কবীরা বা সগীরা গুনাহ। দ্বিতীয়তঃ এ কথা জানা থাকতে হবে যে, দুনিয়া ও আখিরাতে এ সমস্ত গুনাহের কারণে কি কি বিপদ-মুসীবত আসে। এ সমস্ত বিষয় এ অধমের লিখিত ‘গুনাহে বেলযযত’ পুস্তিকা থেকেও জানা সম্ভব। এবং বুযুর্গদের অন্যান্য কিতাব থেকেও এগুলো জানা সম্ভব। যেমন, বেহেশতী যেওর, জাযাউল আ’মাল, তা’লীমুদ্দীন, হায়াতুল মুসলিমীন, তাবলীগে দ্বীন ইত্যাদি। এ সমস্ত কিতাব নিয়মিত অধ্যয়ন করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ অন্তরে নিজের গুনাহসমূহের উপর লজ্জা-অনুশোচনা এবং ব্যথা-বেদনা সৃষ্টি হবে।

তাওবার দ্বিতীয় মৌলিক বিষয়, সমস্ত গুনাহের কাজকে অবিলম্বে পরিত্যাগ করা। এ কাজ হিম্মত করা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এই হিম্মত করার তরীকা বুযুর্গ ও নেক লোকদের সাহচর্য গ্রহণ এবং তাদের জীবনী ও ঘটনাবলী পাঠ করা ও শ্রবণ করা ছাড়া আর কিছু নয়।

তাওবার তৃতীয় মৌলিক বিষয়, ভবিষ্যতের জন্য গুনাহের কাছে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। আর এ কাজটি মানুষের এখতিয়ারভুক্ত। মানুষ যে কোন সময় ইচ্ছা করলে এটা করতে পারে।
সব কাজেই যেমন হিম্মত করা জরুরী, তেমনি এ ব্যাপারেও দৃঢ় সংকল্প করতে হবে যে, আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মানতে আমার যত কষ্টই হোক না কেন, জানমালের যত বড় ক্ষতিই হোক না কেন, দুনিয়ার যত স্বার্থই হাতছাড়া হোক না কেন এবং যত মানুষই তিরস্কার করুক না কেন-সব সহ্য করবো, কিন্তু আল্লাহ ও রাসূলের ফরমাবরদারী করা ছাড়বো না। এতটুকু সাহস যদি না থাকে তাহলে বাস্তবে সে আল্লাহকে পেতে চায় না।

ওয়াজিব হকসমূহ পরিশোধ করাঃ

উপরোল্লেখিত কিতাবসমূহে যখন আপনি গুনাহের বিস্তারিত বিবরণ দেখবেন, তখন জানতে পারবেন যে, এ সমস্ত গুনাহের মধ্যে কিছু গুনাহ তো এমন রয়েছে, যেগুলোর দ্বারা শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার হক নষ্ট করা হয়েছে। কোন মানুষ এর দ্বারা কোন কষ্ট পায়নি। আর কিছু গুনাহ রয়েছে এমন, যার দ্বারা অন্য কোন একজন মানুষ বা অনেক মানুষ কষ্ট পেয়েছে। প্রথম প্রকারের হককে ‘হুকূকুল্লাহ’ বা আল্লাহর হক বলে। আর দ্বিতীয় প্রকারের হককে ‘হুকূকুল ইবাদ’ বা বান্দার হক বলে।

আল্লাহর হক:

আল্লাহর হকের মধ্যে কিছু হক রয়েছে এমন, যেগুলোর ‘কাযা’ করা বা কাফফারা দেওয়া সম্ভব। যেমন নামায বা রোযা ছুটে গিয়ে থাকলে সেগুলোর ‘কাযা’ করা ওয়াজিব। বা বিগত সময়ে যাকাত না দিয়ে থাকলে এখন তা প্রদান করা জরুরী। এমনিভাবে হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও হজ্জ না করে থাকলে এখন হজ্জ করতে হবে। বা শপথ করে তা ভাঙ্গা সত্ত্বেও তার কাফফারা প্রদান না করে থাকলে তা প্রদান করা জরুরী।

আল্লাহর হকের দ্বিতীয় প্রকার এমন, যেগুলোর শরীয়তে কোন কাফফারা নির্ধারিত নেই। যেমন মিথ্যা বলা বা কুপ্রবৃত্তির শিকার হয়ে শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। এই দ্বিতীয় প্রকারের গুনাহের তাওবা শুধুমাত্র এই যে, কান্নাকাটি করে আল্লাহ তাআলার নিকট নিজের গুনাহের ক্ষমা ভিক্ষা চাবে এবং সবসময় ইস্তিগফার করতে থাকবে।

আল্লাহর হকের প্রথম প্রকার- যেগুলোর কাযা বা কাফফারা শরীয়তে নির্ধারিত আছে- সে সমস্ত হক ‘কাযা’ বা ‘কাফফারা’র মাধ্যমে পরিশোধ করা আবশ্যক। যেমন ভালোভাবে চিন্তা করে হিসাব করবে যে, সারাজীবনে কতগুলো নামায ছুটে গেছে। কতগুলো রোযা রাখেনি, এখন তার সবগুলো ‘কাযা’ করবে। যদি ছুটে যাওয়া নামায পরিমাণে বেশী হয়, তাহলে শক্তি-সাহস ও সময়-সুযোগ মত কিছু কিছু করে কাযা করতে আরম্ভ করবে। ছুটে যাওয়া নামাযের সবগুলো পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত এভাবে আদায় করতে থাকবে। এমনিভাবে অতীতে সম্পদের যাকাত না দিয়ে থাকলে অনুমানের ভিত্তিতে হিসাব করে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করে সম্ভব হলে পুরোটা একবারে, না হয় অল্প অল্প করে তা পরিশোধ করতে থাকবে।

একইভাবে সদকায়ে ফিতর বা কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো না দিয়ে থাকলে এখন তা দেওয়া এবং কুরবানীর মূল্য দান করা জরুরী, তাই তা দান করবে। এমনিভাবে কসম (শপথ) ভেঙ্গে থাকলে তার কাফফারা দেওয়া ওয়াজিব। তাও আদায় করবে। কেউ রোযা রেখে স্বেচ্ছায় ভেঙ্গে থাকলে তার কাফফারা ওয়াজিব, তাই তার কাফফারাও আদায় করবে।

এভাবে আল্লাহর হকসমূহের মধ্য থেকে যে সমস্ত হকের ‘কাযা’ করা সম্ভব সেগুলোর ‘কাযা’ করবে এবং যেগুলোর ‘কাফফারা’ দেওয়া সম্ভব সেগুলোর ‘কাফফারা’ আদায় করবে। এ ধরনের ছুটে যাওয়া সমস্ত ইবাদতের ‘কাযা’ ও ‘কাফফারা’ থেকে মুক্ত না হলে নিছক মৌখিক তাওবা মোটেই যথেষ্ট নয়।

বান্দার হক:

দ্বিতীয় প্রকারের হক, বান্দার হক। বান্দার হকও দুই প্রকার। প্রথম প্রকার আর্থিক হক। যেমন, কারো থেকে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেনি। বা কোন চুক্তি বা লেনদেনের কারণে কারো কোন অর্থসম্পদ তার দায়িত্বে ছিলো, যা সে পরিশোধ করেনি। বা কারো সম্পদ অবৈধভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে, আত্মসাৎ করেছে বা কারো থেকে ঘুষ নিয়েছে। এ জাতীয় সমস্ত হকেরও তালিকা তৈরী করে সবগুলো পরিশোধ করবে। এক সঙ্গে সব পরিশোধ করতে না পারলে নিজের সামর্থ্য মত পরিশোধ করতে আরম্ভ করবে। এ সমস্ত হকের পাওনাদার যারা, তারা জীবিত থাকলে এবং তাদের ঠিকানা জানা থাকলে তো এগুলো পরিশোধ করা সহজ। তারা মরে গিয়ে থাকলে তাদের ওয়ারিসদেরকে তালাশ করে তাদের হক পরিশোধ করা জরুরী। খোঁজ করা সত্ত্বেও তাদের ঠিকানা জানা না গেলে তাদের প্রাপ্য পরিমাণ অর্থ তাদের তরফ থেকে দান করে দিবে।

বান্দার হকের দ্বিতীয় প্রকার হলো, শারীরিক হক। যেমন কাউকে হাত বা জিহ্বা দ্বারা শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া কষ্ট দিয়েছে, কাউকে গালি দিয়েছে, কারো গীবত করেছে, তাহলে তার থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া জরুরী। কাউকে মারপিট করে থাকলে তাকে বদলা দেওয়ার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে তাকে বলবে যে, তোমার ইচ্ছা, আমাকে মেরে প্রতিশোধও নিতে পারো বা মাফও করে দিতে পারো।

উপরোক্ত বিস্তারিত বিবরণ মোতাবেক বান্দার যাবতীয় আর্থিক ও শারীরিক হক থেকে মুক্তি লাভ না করা পর্যন্ত তাওবা পরিপূর্ণ হতে পারে না। আর তাওবা পরিপূর্ণ হওয়া ছাড়া নফল ইবাদত ও যিকির-শোগলের মধ্যে জীবনভর যতই মেহনত করুক না কেন, কখনই আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না এবং সঠিক পথও লাভ হবে না। মোটকথা, আল্লাহ ও বান্দার পরিশোধযোগ্য সমস্ত হক পরিশোধ করা বা মাফ করানো তাওবার জন্য জরুরী। বিশেষ করে বান্দার হকের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। কারণ, তা পাওনাদার মাফ না করলে কোনভাবেই মাফ হতে পারে না। তাই আল্লাহপ্রাপ্তির পথে পা বাড়ানোর জন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো পরিপূর্ণ তাওবা করা।