পীর-মুরীদীর উদ্দেশ্য

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
কামেল পীরের সন্ধান পাওয়ার পর তার হাতে মুরীদ হওয়ার পূর্বে তোমাকে মুরীদ হওয়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে হবে। কারণ, মুরীদ হওয়ার পিছনে মানুষের অনেক রকমের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। কেউ তো চায় যে, আমি কারামতের অধিকারী হবো এবং কাশফের মাধ্যমে এমন অনেক বিষয় জানতে পারবো, যা অন্যদের জানা নেই। কিন্তু তুমি তৃতীয় হেদায়াতের মধ্যে এইমাত্র জেনে এসেছো যে, খোদ পীরের মধ্যেই কারামত থাকা বা তার কাশফের অধিকারী হওয়া-যার দ্বারা সে এমন সব জিনিস সম্পর্কে জানতে পারবে, যা অন্যদের জানা নেই-জরুরী নয়, তাহলে মুরীদ বেচারা এর কী বা আকাংখা করবে?
কেউ এরুপ মনে করে যে, মুরীদ হওয়ার দ্বারা পীর সাহেব গুনাহ মাফের দায়িত্ব নিয়ে নিবে। যত পাপ কাজই করুক না কেন, কিয়ামতের দিন পীর তাকে দোযখে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে। এটাও একান্তই ভুল ধারণা। জনাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তার মেয়ে হযরত ফাতিমা (রাযিঃ)কে বলেছেন-
’হে ফাতিমা! নিজেকে দোযখ থেকে বাঁচাও।’ অর্থাৎ, নেক আমল করো।
কেউ বোঝে যে, পীর সাহেব একনজরে আমাকে কামেল করে দিবে। আমাদের কোন পরিশ্রমও করতে হবে না বা গুনাহ ছাড়ার ইচ্ছাও করতে হবে না। এভাবেই যদি কাজ হয়ে যেতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরামের কিছুই করার প্রয়োজন হতো না। জনাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে কামেল আর কে আছে? যদিও কারামত স্বরুপ কোথাও এরুপও হয়েছে যে, কোন বুযুর্গ একনজরে কাউকে কামিল করে দিয়েছেন। কিন্তু কারামত সবসময় হওয়া তো জরুরী নয়। বা সব আল্লাহর ওলী থেকে হওয়াও জরুরী নয়। তাই এ ভরসায় থাকা মারাত্মক ভুল।
কেউ বলে যে, অনেক আবেগ, উদ্যম, উন্মত্ততা ও উন্মাদনা সৃষ্টি হবে। হৈচৈ করবো। শ্লোগান দেবো। নিজে নিজে গুনাহ ছুটে যাবে। গুনাহ করার ইচ্ছাও থাকবে না। নেক কাজ করার জন্য ইচ্ছাও করতে হবে না, নিজে নিজেই সব নেক কাজ হয়ে যাবে। মনের কুমন্ত্রনা ও খটকা সব মিটে যাবে। মোটকথা, এক আত্মহারা অবস্থা বিরাজ করবে। এ চিন্তাটিকে পূর্বের চিন্তাসমূহের তুলনায় উৎকৃষ্ট মনে করা হয়। কিন্তু এর কারণও অজ্ঞতা। এ সমস্ত অবস্থাকে ‘কাইফিয়্যাত’ ও ‘হালাত’ বলা হয়। কিন্তু ‘হালাত’ ও ভাবের সৃষ্টি হওয়া মানুষের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়। তাছাড়া ‘হালত’ বা ভাবের উদয় হওয়া উত্তম হলেও, তা উদ্দেশ্য নয়। সে বস্ত্তই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হতে পারে, যা অর্জন করা মানুষের এখতিয়ারাধীন। গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা গেছে যে, এ ধরনের খাহেশের পিছনে নফসের কুমতলব নিহিত রয়েছে। আর তা হলো, নফস আরাম, মজা ও প্রসিদ্ধি চায়। যা এ সমস্ত ভাবের মধ্যে পাওয়া যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্ত্তষ্টির অন্বেষী হবে-এ সম্পর্কে পরবর্তীতে আলোচনা আসছে যে, আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্যই হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা- এমন ব্যক্তির এ ধরনের খাহেশের সাথে কী সম্পর্ক? সে তো নিজের অবস্থা এমন বানাবে যে, তার অবস্থাই যেন বলে-
অর্থঃ ’বিরহ আর মিলন সমান। আসল তো হলো তার সন্তুষ্টি। আল্লাহর নিকট তাকে ছাড়া অন্য কিছুর প্রার্থনা করা আফসোসের ব্যাপার।’
অর্থঃ ‘ভাব ও উন্মাদনা চলে গেলে যাক। কোন আক্ষেপ নেই। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক অটুট থাকা চাই, যার মত অন্য কোন কিছু পবিত্র নয়।’
অর্থঃ ‘হে মন! তুমি তো এখনও কুচিন্তাতেই মগ্ন রয়েছো। তুমি যদি আনন্দ ও বেদনার পার্থক্য বুঝতে!’
উপরন্তু এ ধরনের লোক দু’প্রকারের খারাবীতে লিপ্ত হয়ে থাকে। কারণ, এ সমস্ত ভাব ও হালত তার অর্জিত হয় অথবা হয় না। যদি অর্জিত হয়, তাহলে সে যেহেতু একেই বুযুর্গী মনে করে তাই সে নিজেকে কামিল মনে করতে আরম্ভ করে। সে এ সমস্ত হালত ও ভাবকে যথেষ্ট মনে করে প্রকৃত পরহেযগারী ও ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে গাফেল ও নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। নিজের জন্য ইবাদতের জরুরত বোধ করে না। বা কমপক্ষে ইবাদতকে মূল্যহীন মনে করতে থাকে। আর যদি এগুলো হাসেল না হয়, তাহলে এ দুঃখে সে নিঃশেষ হতে থাকে। আর এ অবস্থা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যে কোন ব্যক্তি এমন কিছু অর্জনের ইচ্ছা করবে, যা তার এখতিয়ার বহির্ভূত, সেই দুশ্চিন্তা ও পেরেশানীতে আক্রান্ত হবে।
কেউ বলে যে, পীর সাহেবের নিকট বড় বড় আমল আছে, যা খুব কার্যকরী। যখন প্রয়োজন পড়বে তার থেকে তাবিজ-কবজ চেয়ে নিবো। বা পীর সাহেবের দু’আ খুব কবুল হয়। মামলা-মোকদ্দমায় ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার দ্বারা দু’আ করাবো, ফলে সব কাজ আমার মর্জি মত হবে। যেন সমস্ত ক্ষমতা পীর সাহেবের হাতে রয়েছে। বা তার নিকট থেকে এমন কিছু শিখে নিবো, যার দ্বারা আামি বরকতের অধিকারী হয়ে যাবো। আমি ঝাড়-ফুঁক দিলে বা হাত দিয়ে শরীর মুছে দিলে অসুস্থ লোক সুস্থ হয়ে যাবে। এ ধরনের লোকেরা এ ধরনের আমল ও তার প্রভাবকেই বুযুর্গী মনে করে। এ সমস্ত আমলের বুযুর্গীর সাথে যেহেতু কোন সম্পর্ক নেই, আর এ ধরনের নিয়ত যেহেতু একান্তই দুনিয়া কামনা, তাই এতে দ্বিগুন ভ্রান্তি রয়েছে।
কেউ মনে করে যে, যিকির-শোগল করার দ্বারা আলো দেখা যাবে, বা গায়েবী আওয়াজ শোনা যাবে। এটাও সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ও নির্বুদ্ধিতা। কারণ-
প্রথমত, যিকির ও শোগল দ্বারা আলো দেখা দেওয়া বা আওয়াজ শুনতে পাওয়া কোন জরুরী নয়। তাছাড়া এগুলো যিকির-শোগলের উদ্দেশ্যও নয়।
দ্বিতীয়ত, যিকির-শোকর করার দ্বারা যে আলো দেখা যায়, যে রং দেখা যায়, বা যে শব্দ শোনা যায়, কোন কোন সময় তা যিকিরকারীর মস্তিষ্কের প্রভাব হয়ে থাকে, গায়েবের বিষয় হয় না।
তৃতীয়ত, যদি এ কথা মেনেও নেওয়া হয় যে, গায়েবের বিষয় দেখতে পেয়েছে বা গায়েবের শব্দ শুনতে পেয়েছে, তাহলে তাতে কী লাভ হয়েছে? গায়েবের শব্দ শুনতে পাওয়ার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় না। আল্লাহর নৈকট্য তো তার ইবাদত ও আনুগত্যের দ্বারা লাভ হয়। অনেক সময় শয়তান ফেরেশতার রুপে দেখা দেয়, অথচ প্রকৃত অর্থে সে ফেরেশতা নয় বরং শয়তানই হয়ে থাকে। তাছাড়া মৃত্যুর পর কাফেররা যে, গায়েবের অনেক কিছুই জানতে পারবে তা সবারই জানা কথা। যে জিনিস কাফেরদেরও লাভ হবে তা জানতে পারলে এমন কী কামেল হয়ে গেলো?
যখন এ কথা পরিষ্কার জানা হয়ে গেলো যে, উপরে যত বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনটিই লাভ করা পীর-মুরীদীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়, তাই এ সমস্ত চিন্তা-ফিকির মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভকেই পীর-মুরীদীর প্রকৃত উদ্দেশ্য মনে করবে। যা লাভ করার উপায় হলো, আল্লাহ তাআলার সমস্ত হুকুম পালন করবে এবং নিয়মিতভাবে যিকির করবে। পীর এ কথাই বলে থাকে আর মুরীদ সে অনুপাতেই আমল করে থাকে। যদিও এভাবে চলার দ্বারা তার ধারণা মত কোন ভাব-মত্ততা ও পূর্ণতা লাভ হলো না, কিন্তু আখেরাতে যিকির ও আল্লাহর আনুগত্যের ফায়দা অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টি তার ঠিকই লাভ হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলার দীদার নসীব হবে। দোযখ থেকে রক্ষা পাবে।
বাইয়াত ও পীর-মুরীদীর হাকীকত:
পীর-মুরীদির হাকীকতও এই যে, পীর মুরীদকে যিকির ও আল্লাহর হুকুম বলে দেওয়ার ওয়াদা করে, আর মুরীদ এ কথার স্বীকারোক্তি করে যে, পীর যা বলবে সে তা অবশ্যই পালন করবে। মুরীদ হওয়ার প্রচলিত পদ্ধতি ছাড়াও পীর তা’লীম দিতে এবং মুরীদ তার তা’লীম অনুপাতে আমল করতে পারে। তবে বিশেষ এ পদ্ধতিতে মুরীদ হওয়ার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য ও লাভ রয়েছে যে, এতে করে সেই মুরীদের প্রতি পীরের তাওয়াজ্জুহ বা মনোযোগ অধিক হয়ে থাকে এবং মুরীদেরও পীরের কথা পালন করার ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব ও যত্ন হয়ে থাকে। বলা হয় যে, একজনকেই পীর ধরবে এবং নিজের পীরকে সমকালীন যুগের সকল বুযুর্গ থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে, এর উপকারীতা শুধু এতটুকুই যে, এমতাবস্থায় উভয়ের মাঝে সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
বাকী রইলো, মুরীদ হওয়ার প্রত্যাশী ব্যক্তি কাছে থাকলে পুরুষ হলে হাতের মধ্যে হাত দিয়ে বাইয়াত করা, আর স্ত্রীলোক হলে কাপড় ইত্যাদি ধরিয়ে বাইয়াত করা এটি পীর ও মুরীদের মধ্যে সংঘটিত স্বীকারোক্তিকে দৃঢ় করার জন্য একটি ভালো পন্থা। তবে উভয়ের পক্ষ থেকে এই স্বীকারোক্তি এ পদ্ধতি ছাড়াও হতে পারে। এ কারণে যে ব্যক্তি দূর থেকে মুরীদ হতে চায়, তাকে হাতের মধ্যে হাত রাখা ছাড়াই মুরীদ করে নেওয়া হয়। অনেক হাদীস দ্বারাও জানা যায় যে, হাতের মধ্যে হাত দেওয়ার পদ্ধতিটি ভালো। সুতরাং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, হযরত রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বাইয়াত করতেন, তখন মুরীদদের হাত নিজের পবিত্র হাত দ্বারা ধরে বাইয়াত করতেন। আর কাপড় বা এ জাতীয় কিছু ধরানো হাত ধরানোর পরিবর্তেই করা হয়।
Leave a Reply