উৎস:
ইসলাহী নেসাব: কসদুস সাবীল
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

একইভাবে আল্লাহকে ভুলে যাওয়ারও কিছু কিছু ধরন অধিকতর ক্ষতিকর হয়ে থাকে। আর তাহলো, পার্থিব বিভিন্ন সম্পৃক্ততার কারণে যে খোদা-বিস্মৃতির সৃষ্টি হয়। এ বিস্মৃতি যিকির করার দ্বারাও দূর হয় না। যখন যিকিরে লিপ্ত হবে বার বার সে দিকেই মনেোযোগ আকৃষ্ট হবে।

এ ‘দস্তুরুল আমল’ বা ওযীফার একটি জরুরী বিষয় এই যে, এ ওযীফা মত যিকিরকারী ব্যক্তির যে পর্যন্ত কিছুটা শক্তভাবে ‘নিসবতে বাতেনী’ লাভ না হবে (যার ব্যাখ্যা সামনে আসছে) সে পর্যন্ত মানুষের যাহেরী বা বাতেনী কোন প্রকার খেদমতে লিপ্ত হবে না। যেমন, ছাত্রদেরকে পড়ানো, জনসাধারণকে ওয়ায শোনানো, রোগীদের চিকিৎসা করা, তাবীয-কবজ লেখা, পীর-মুরীদী করা এগুলোর কিছুই করবে না। একদম এক কোণায় চুপচাপ পড়ে থাকবে। তবে এগুলোর কোন একটি করতে একান্ত বাধ্য হলে সে ভিন্ন কথা।

বাতেনী নিসবত:

’বাতেনী নিসবত’ লাভ হওয়ার আলামত দু’টি-
প্রথম এই যে, আল্লাহর ইয়াদ অন্তরে এমনভাবে জমে বসবে যে, কখনই তা অন্তর থেকে দূর হবে না। আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য অধিক চিন্তা-চেষ্টা করার প্রয়োজন পড়বে না।

দ্বিতীয় এই যে, আল্লাহ তাআলার সকল বিধি-বিধান-চাই তা আল্লাহর ইবাদত সংক্রান্ত হোক, মানুষের সঙ্গে লেনদেন ও মুআমালাত সংক্রান্ত হোক, উত্তম স্বভাব-চরিত্র সংক্রান্ত হোক বা কথাবার্তা, চালচলন ও আচার-আচরণ সংক্রান্ত হোক, সর্ববিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানমত চলার প্রতি এমন আগ্রহ জন্মাবে এবং একইভাবে যেসব কাজ তিনি নিষেধ করেছেন সেগুলোর প্রতি এমন ঘৃণা জন্মাবে, যেমন আগ্রহ মনের প্রিয় বস্ত্ত এবং যেমন ঘৃণা মনের অপ্রিয় বস্ত্তর প্রতি হয়ে থাকে। মন থেকে দুনিয়ার যাবতীয় মোহ ও লালসা বের হয়ে যাবে এবং তার সমস্ত কর্মকান্ড কুরআনে বর্ণিত বিধান মোতাবেক হবে। তবে সহজাত অলসতা যদি কোন হুকুম বাস্তবায়নে বাধা হয়, বা মনে কোন কুমন্ত্রনা জাগে, কিন্তু সে অনুপাতে যদি আমল না করে তাহলে এরুপ মনে করবে না যে, শরীয়তের হুকুম পালনর আগ্রহ এবং শরীয়তের নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা জন্মায়নি। আল্লাহর স্মরণ ও তার আনুগত্যের ক্ষেত্রেও এ অবস্থানই কাঙ্খিত। আমি যাকে ‘বাতেনী নিসবতের’ আলামত বলে উল্লেখ করলাম, তাকে ‘মুহাব্বতে ইলাহী’ বা আল্লাহর ভালোবাসা বলে।

’বাতেনী নিসবত’ লাভ হওয়ার সাথে সাথে যদি গায়েব থেকে কোন ইলম বা ভেদের কথাও তার অন্তরে উদয় হতে থাকে, তাহলে এ ধরনের ব্যক্তিকে ‘আরেফ’ বলা হয়।

’বাতেনী নিসবত’ লাভ হওয়ার পর পড়ানো, ওয়ায করা, কিতাব লেখায় কোন ক্ষতি নেই, বরং ইলমে দ্বীনের খেদমত করা সবচেয়ে বড় ইবাদত। আর পীর সাহেব যদি তাকে মুরীদ করার এবং যিকির-শোগল শেখানোর অনুমতিও দেন তাহলে আল্লাহর বান্দাদেরকে এ ফায়দা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কার্পণ্য করবে না। কিন্তু নিজেকে বড় মনে করবে না। নিজেকে মানুষের খাদেম ভাববে। আর পীর সাহেব এর অনুমতি না দিলে কখনোই এরুপ দুঃসাহস করবে না এবং নিজের পক্ষ থেকে অনুমতি প্রার্থনাও করবে না। কারণ, এটি মূলতঃ বড়ত্বের প্রার্থনা ও আকাঙ্খা। আর প্রার্থনা করার দ্বারা পীর যদি অনুমতি দেয়ও সে অনুমতি কোন কাজের নয় বরং বড় হওয়ার চেয়ে ছোট থাকা অনেক ভালো। তবে পীর সাহেব হুকুম দেওয়ার পর তার হুকুম না মানাও সমীচীন নয়। যদি সবাই এরুপই করতো তাহলে পীর-মুরীদীর ধারাবাহিকতাই বন্ধ হয়ে যেতো। মুরীদদের থেকে কখনোই মালের আশা করবে না। যদি তারা কিছু নজরানা দেয়ও, তবে তা মুরীদ হওয়ার সময় কখনই গ্রহণ করবে না। কারণ, এটি দৃশ্যত বিনিময় নেওয়ার মত হলো। আর অন্য সময় খুশী হয়ে হালাল উপার্জন থেকে নিজের আয়ের পরিমাণ অনুপাতে যদি এতটুকু দেয়, যার দ্বারা তার পেরেশানী হবে না, তাহলে এমতাবস্থায় হাদীয়া গ্রহণ করা সুন্নাত। এরুপ ক্ষেত্রে হাদীয়া গ্রহণ না করায় মুসলমানের দিল ভাঙ্গা হয় এবং আল্লাহর নাশোকরী করা হয়। যদিও হাদীয়ার পরিমাণ কমই হোক না কেন। এমনকি অন্যদের সামনে দিলেও নিতে লজ্জাবোধ করবে না। কারণ, এও অহংকারের কারণেই হয়ে থাকে।

এখানে এসে ’দস্তুরুল আমল’ বা ওযীফার বিবরণ শেষ হলো। এ ওযীফার আলোচনা কিছুটা দীর্ঘ হয়েছে। কারণ, এতে আলেমদেরকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় সারকথা অল্পই। সারকথাটি এখন পুনরায় এ কারণে লিখে দিচ্ছি যে, এ লম্বা আলোচনার মধ্যে মূল আলোচনার অংশটি বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।

মূল ওযীফার তালিকা এই-
ক. তাহাজ্জুদ নামায।
খ. তাহাজ্জুদ নামাযের পর ‘বার তাসবীহ’।
গ. ফযর নামাযের পর কুরআন তিলাওয়াত এবং এক মঞ্জিল মুনাজাতে মকবুল।
ঘ. তারপর ১২ হাজার থেকে ২৪ হাজার বার ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ যিকির।
ঙ. আসর নামাযের পর পীর সাহেবের নিকট উপস্থিত থাকা বা খোলা মাঠ, বন ইত্যাদিতে ঘোরাফেরা করা এবং আল্লাহর ওলীদের কবর যিয়ারত করা।
চ. মাগরিব নামাযের পর মৃত্যুর মোরাকাবা বা ধ্যান করা।
ছ. এর বাইরে যে সময় বাঁচবে, তখন অগণিতভাবে দরূদ শরীফ পড়া।
জ. প্রয়োজন হলে ‘শুগলে আনহদ’ করা।
ঝ. পরহেযগারীর প্রতি লক্ষ্য রাখা।
ঞ. পাবন্দীর সাথে যিকির করা।
ট. গুনাহ ও আল্লাহ বিস্মৃতি থেকে বেঁচে থাকা।
বিশেষ করে এ সমস্ত গুনাহ থেকে বাঁচা-
১. মানুষকে দেখানোর জন্য কোন আমল করা।
২. নিজেকে বড় মনে করা।
৩. গর্ব করা।
৪. নিজের মনে মনে নিজের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের জন্য খুশি হওয়া ও আত্মশ্লাঘায় লিপ্ত হওয়া।
৫. কারো অসাক্ষাতে তার দোষ চর্চা করা।
৬. অনর্থক কথা বলা ও মানুষের সঙ্গে অধিক মেলামেশা করা।
৭. নামাহরাম নারী ও বালকদের দিকে কুদৃষ্টিতে তাকানো, বা মনে মনে খাহেশাতের সাথে তাদের কল্পনা করা।
৮. বেশী রাগ করা।
৯. একগুঁয়েমী করা।
১০. দুনিয়াবী সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং এ জাতীয় কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা।
ঠ. ‘বাতেনী নিসবত’ লাভ হওয়া পর্যন্ত ওয়ায করা, ছাত্র পড়ানো ইত্যাদি কাজ পরিহার করা।
ড. পীর সাহেবের অনুমতি ছাড়া মুরীদ না বানানো এবং যিকির-শোগল না শিক্ষা দেওয়া।
এসবগুলোর মুল কথা হলো, দু’টি-
১. আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মতো চলা।
২. নিয়মিতভাবে যিকির করা।

গুনাহের দ্বারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যে ফাটল সৃষ্টি হয়, আর যিকিরের কমতির দ্বারা আল্লাহর ইয়াদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আল্লাহর আনুগত্য, নিয়মিত যিকির করা, গুনাহ থেকে বেঁচে চলা এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না হওয়াকে নিজের আসল কাজ মনে করবে। যদি কিছুদিন পর্যন্ত নিয়মিতভাবে এ কাজগুলো করে, তাহলে ইনশাআল্লাহ মাহরূম বা বঞ্চিত হবে না।

এগুলোর উপর আমল করার ফায়দা যদিও শুরু থেকেই হতে আরম্ভ করে, কিন্তু প্রথম প্রথম তা বুঝে আসে না, তবে এমন এক সময় আসবে, যখন সে নিজেও বুঝতে পারবে, কিন্তু ঘাবড়াবে না, তাড়াহুড়া করবে না, অলসতাও করবে না। কারণ, ফায়দা পাওয়ার কোন মেয়াদ নির্ধারিত নাই। কেউ তার দায়িত্বও নিতে পারে না। তবে এ আশা করতে পারে-
অর্থঃ ‘এ পথের পথিককে আমৃত্যু চেষ্টায় লেগে থাকতে হবে। মৃত্যু পর্যন্ত মুহূর্তের জন্য বেফিকির হওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত কোন না কোন সময় এমন আসবে যখন আল্লাহর মেহেরবানী লাভ হবে এবং গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।’ সফলতা লাভ হবে।’

এ সমস্ত আমল ও ওযীফার সাথে সাথে প্রথম দিকে কিছু বেশী এবং তারপর মাঝে মাঝে যদি পীর সাহেবের খেদমতে থাকার সুযোগ হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা-’নূরুন আলা নূর। পীর সাহেবের নিকট অবস্থান করার বহুবিধ ফায়িদার মধ্যে একটি ফায়দা এই যে, পীর সাহেবকে দেখে দেখে তার স্বভাব-চরিত্র ও গুণাবলী নিজের মধ্যে নিয়ে আসবে। যিকির ও ইবাদতের মধ্যে প্রাণ ও সজীবতা সঞ্চার হবে। সাহস বৃদ্ধি পাবে। যে সমস্ত নতুন ‘হালাত’ দেখা দিবে, সে সবের ব্যাপারে পরিপূর্ণ প্রশান্তি লাভ হবে। এগুলো ছাড়া আরো অনেক ফায়দা আছে, যেগুলো পীর সাহেবের নিকট অবস্থান করলে আপনা আপনি লাভ করবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে- রোগী ডাক্তারের নিকটে অবস্থান করা আর দূরে অবস্থান করার মধ্যে আকাশ-পাতালের পার্থক্য।

জনৈক কবি বড় চমৎকার বলেছেন-
অর্থঃ নিরাপদ ও প্রশান্তিময় জায়গা, আল্লাহর মুহাব্বতের নির্ভেজাল শরাব আর স্নেহশীল পীরের সুহবত যদি সদা-সর্বদার জন্য লাভ হয়, তাহলে তা আল্লাহ তাআলার বড় দয়া।
’আল্লাহ সত্য বলেন, আর তিনিই পথ দেখান।’