উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি আমাদের নিকট সেই উম্মী নবীকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন, যাকে তারা তাওয়াত এবং ইঞ্জীলের মধ্যে লিখিত পায়। যিনি তাদেরকে সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করেন। তাদের জন্যে পবিত্র জিনিসসমূহকে হালাল করেন এবং অপবিত্র জিনিসসমূহকে করেন হারাম। তিনি তাদের বোঝাসমূহ নামিয়ে দেন এবং তাদের উপরে আরোপিত বিষয়সমূহ সরিয়ে দেন।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন, যারা তার প্রতি ঈমান এনেছে, তাকে শক্তিশালী করেছে, তাকে সাহায্য করছে এবং ঐ নূরের অনুসরণ করেছে, যা তার সঙ্গে অবতরণ করা হয়েছে। তারাই সফলকাম। আল্লাহ তাআলার রহমত ও শান্তিসমূহ তার উপর, তার বংশধরগণের উপর এবং তার সাহাবীগণের উপর অবতীর্ণ হোক, যারা সত্যের পথে চলেছেন এবং তার দ্বারা ন্যায়বিচার করেছেন।’

কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট ভাষ্য দ্বারা প্রমাণিত যে, পরিশুদ্ধ লেনদেন এবং বিশুদ্ধ কারবার দ্বীনের অন্যতম অংশ। কোন কোন দিক থেকে এটি বরং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের এ যুগে এ বিষয়েই সর্বাধিক ত্রুটি করা হচ্ছে এবং একে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। তাই এ বিষয়ের অধিক প্রচলিত দিকসমূহের বিধানাবলী সংক্ষেপে সাবলিল ভাষায় সংকলন করে দেওয়ার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করছি। যাতে করে এগুলো জানার মাধ্যমে আমলের তাওফীক হয়।
’আল্লাহর তরফ থেকেই তাওফীক এবং সাহায্য লাভ হয়।’

বেচা-কেনার বর্ণনা

মাসআলাঃ দর ঠিক করে ক্রেতা দাম দিয়ে দেওয়ার এবং বিক্রেতা পণ্য দিয়ে দেওয়ার বর্তমানে ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মৌখিক ‘ইজাব-কবুল’ করা হয় না। এভাবে বেচা-কেনা করা দুরস্ত আছে।
মাসআলাঃ কোন ব্যক্তি কোন ঘর ক্রয় করলে ঐ ঘরের দেওয়াল-ছাদ সবই তার অন্তর্ভূক্ত হবে। এগুলোর নাম পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করা না হলেও অন্তর্ভুক্ত হবে।
এমনিভাবে কোন ব্যক্তি তার জমি বিক্রি করলে সে জমিতে ছোট-বড়, ফলদার-ফলহীন যত বৃক্ষ থাকবে সব বিক্রি হয়ে যাবে। যদিও সেগুলোর পৃথকভাবে উল্লেখ করা না হয়। তবে যদি পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয় যে, ঘরের ছাদ বা জমির গাছসমূহ আমি বিক্রি করছি না, তাহলে এগুলো বিক্রির অন্তর্ভুক্ত হবে না। শুধু জমি বিক্রি হবে।
মাসআলাঃ একটি গাছ বিক্রি করলো, তাতে ফল ধরছে, এমতাবস্থায় বিক্রির সময় যদি ফলের কথাও উল্লেখ করে তাহলে তো ফল বিক্রির অন্তর্ভূক্ত হয়ে ক্রেতার মালিকানায় চলে যাবে। অন্যথায় ফল যথাপূর্ব বিক্রেতারই থেকে যাবে।
এমনিভাবে ফসলওয়ালা জমি বিক্রির সময় যদি ফসলের কথা পরিষ্কার উল্লেখ করে তাহলে তো তা বিক্রির অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্যথায় তা বিক্রেতারই থেকে যাবে। তবে এমতাবস্থায় বিক্রেতাকে বলা হবে যে, নিজের ফল ও ফসল কেটে জমি খালি করে হস্তান্তর করো।
মাসআলাঃ গাছে ফল ধরার পূর্বে সে ফল বিক্রি করা দুরস্ত নেই। এমন বিক্রি সম্পূর্ণরুপে ‘বাতেল’।
মাসআলাঃ গাছে ফল ধরার পর তা বিক্রি করা সম্পূর্ণরুপে ঠিক আছে। তবে এমন শর্ত লাগানো যে, গাছ থেকে ফল পাড়া হবে না বা এমন প্রচলন থাকলে-যেমন, আমাদের দেশে প্রচলন আছে-এতে বেচা-কেনা ‘ফাসেদ’ হয়ে যাবে। তবে যেখানে এ দু’টির কোনটি নেই সেখানে মালিকের অনুমতি নিয়ে গাছে ফল রেখে দেওয়া জায়েয আছে। তবে বিক্রি করার পর ঐ সমস্ত গাছে আরো ফল ধরলে সে সমস্ত নতুন ফল বিক্রেতার বলে গণ্য হবে। আর পূর্বের ফলগুলো ক্রেতার বলে গণ্য হবে। তাই এ পদ্ধতিটিও সংশয়মুক্ত নয়। তাই হয়তো এমন সময় ক্রয় করবে, যখন সমস্ত ফল বের হয়েছে। কিংবা গাছসহ কিনে নিবে। যাতে করে নতুন ফলসমূহও ক্রেতার বলে গণ্য হয়। তারপর মওসুম শেষ হলে গাছ মালিককে ফেরত দিয়ে দিবে এবং গাছের মূল্য ফিরিয়ে নিবে।
মাসআলাঃ আর যদি ক্রয়ের সময় ফল পূর্ণরুপে বের হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো তা ছোট, তবে সেগুলো আরো বড় হবে। তাহলে এ ক্ষেত্রেও পুর্বোক্ত মাসআলার মতো বেচা-কেনা দুরস্ত হবে। তবে গাছে ফল রেখে দেওয়ার যদি শর্ত আরোপ করে বা তার প্রচলন থাকে তাহলে বেচা-কেনা ’ফাসেদ’ হবে। তবে যদি শর্ত না করে এবং এর প্রচলনও না থাকে তাহলে মালিকের অনুমতিক্রমে গাছে ফল রেখে দেওয়া জায়েয হবে। তবে মালিক যে কোন সময় তার অনুমতি প্রত্যাহার করে নিতে পারবে। তখন বিনা বাক্যব্যয়ে ফল পেড়ে নেওয়া ক্রেতার উপর ওয়াজিব হবে।
মাসআলাঃ যদি ফল বড় হয়ে থাকে আর শুধুমাত্র পোক্ত হওয়া বাকি থাকে তাহলে ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)এর মতে এমতাবস্থায় ফল পোক্ত হওয়া পর্যন্ত গাছে রেখে দেওয়ার শর্ত লাগানোও জায়েয আছে। ‘কিফায়া’ কিতাবে আছে যে, ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)এর মতের উপরই ফাতওয়া। আর যদি শর্ত দেওয়া ছাড়াই অনুমতি দেয় তাহলে সর্বসম্মতভাবে তা জায়েয হবে। আমাদের দেশের লোকেরা এমন সময় বিক্রি করলে ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)এর মাযহাব মতে গুনাহ থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।
মাসআলাঃ খরবুজা ও তরমুজের হুকুমও অন্যান্য ফলের মতোই। ক্রয়ের সময় ফল পূর্ণরুপে বের না হয়ে থাকলে এবং ক্রয়ের পর কিছু ফল বের হলে বিক্রি ’ফাসেদ’ হবে। তাই শুধু ফল ক্রয় না করে মূলসহ লতা ক্রয় করবে, তাহলে নতুন করে যে সমস্ত ফল বের হবে বা ফল বড় হবে তা ক্রেতার বলে গণ্য হবে। অন্যান্য তরকারীর বিধানও এই একই।
মাসআলাঃ অনেক লোক পশু চারণের জন্যে কাঁচা ফসলের ক্ষেত ক্রয় করে, এটি জায়েয আছে। তবে তা কেটে নেওয়ার পর বা পশু চরে খাওয়ার পর যাকিছু বৃদ্ধি পাবে তা বিক্রেতার বলে গণ্য হবে। তবে উপরে বর্ণিত মাসআলার মতো শিকড় সহ ক্রয় করলে পরবর্তীতে উৎপন্ন গাছসমূহও ক্রেতার মালিকানা বলে গণ্য হবে। এতোদুভয় মাসআলাতে বিক্রেতার যখন ইচ্ছা তার ক্ষেত খালি করানোর এখতিয়ার থাকবে। তাই বিক্রেতার অনুমতির উপর নিশ্চিন্ত হতে না পারলে নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে ক্ষেত ভাড়া নিবে। এ মেয়াদের মধ্যে সমস্ত কাজ সে স্বাধীনভাবে করতে পারবে।
মাসআলাঃ ’বাইয়ে ফাসেদের’ কারণে বিক্রিত জিনিস শুধু প্রথম ক্রেতার জন্যে হারাম হয়। তাই ঐ বিক্রি ভেঙ্গে দেওয়া তার জন্যে ওয়াজিব। আর যদি এই ক্রেতা অন্য কারো নিকট বিক্রি করে দেয় বা কাউকে হাদিয়া দেয় তাহলে তা দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্যে হালাল হবে। তবে ‘বাইয়ে বাতেল’ হলে যত জনের হাত বদলই হোক না কেন সবার জন্যেই তা হারাম হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ আছে যে, দাম দেওয়ার দ্বারা তা হালাল হয়ে যায়, এটি নিছক ভুল কথা।
মাসআলাঃ বাগানের ফল বিক্রি করে সংখ্যা বা পরিমাপের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফল পৃথক করে নেওয়া জায়েয আছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এমনভাবে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে, যাতে পরবর্তীতে ঝগড়া ও বিতর্ক না হয়।