বাইয়ে বাতেল ও বাইয়ে ফাসেদের বর্ণনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
মাসআলাঃ কতক জায়গায় জেলেদের কাছে পুকুর ও নদী ঠিকা দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। অন্যদেরকে সেখান থেকে মাছ ধরতে দেওয়া হয় না, এটি সম্পূর্ণ হারাম। এ ধরনের বেচা-কেনা মোটেই ঠিক নয়, তা সম্পূর্ণরুপে বাতেল। অতএব এখানে মাছ শিকার করতে নিষেধ করা জমিদারের জন্যেও হালাল হবে না এবং ঠিকাদারদের জন্যে জায়েয হবে না। বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে এখান থেকে মাছ শিকার করার অধিকার সবার জন্যেই উন্মুক্ত থাকবে। তবে ঐ ঠিকাদারের জন্যে এখান থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে বৈধ হবে। কারণ, মাছ শিকার করার পর এ মাছ তার মালিকানাভুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য কেউ সেখান থেকে মাছ ধরার পর ঠিকাদার তার থেকে ছিনিয়ে যদি বিক্রি করে, তাহলে তার জন্যে এগুলো বিক্রি করাও বৈধ নয় এবং যে এ সম্পর্কে জানে তার জন্যে তা ক্রয় করাও বৈধ নয়।
মাসআলাঃ এমনিভাবে যে ঘাস কাটা হয়নি তা বিক্রি করা দুরস্ত নয়। তবে যদি কোন ব্যক্তি ঘাস হওয়ার জন্যে জমিতে পানি দেয় এবং যত্ন নেয় ফলে তাতে ঘাস হয়, তাহলে ‘যাখীরা’ এবং ‘মুহীত’ কিতাবের বর্ণনা মতে এমতাবস্থায় সে ঘাস ঐ ব্যক্তির মালিকানাধীন হবে এবং তা বিক্রি করা দুরস্ত হবে। কান্ডবিহীন নিজে নিজে উৎপন্ন সমস্ত উদ্ভিদের এই একই বিধান। আর কান্ডধারী সমস্ত গাছ-তা নিজে নিজে উৎপন্ন হলেও-ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)এর মতে তা বিক্রি করা জায়েয আছে। বিধায় অনেক জায়গায় জমিদাররা যে, ক্ষেতের ঘাস না কেটে ক্ষেতে থাকা অবস্থায় বিক্রি করে বা অন্যদেরকে সেখান থেকে ঘাস কাটতে নিষেধ করে বা প্রজাদের থেকে পশু চরানোর বিনিময় গ্রহণ করে এ সবই জুলুম।
মাসআলাঃ কতক মানুষ নিজে নিজে উৎপন্ন ঘাস বিক্রি করা জায়েয নেই শুনে এ কৌশল অবলম্বন করে যে, ঘাস আমাদের মালিকানাধীন না হলেও জমি তো আমাদের মালিকানাধীন, তাই আমরা আমাদের জমিতে অন্য কাউকে আসতে দেবো না। আমাদের এ অধিকার রয়েছে। এভাবে তারা ঘাস আটকিয়ে রাখে। অতএব ভালো করে বোঝা উচিত যে, এমতাবস্থায় শরীয়তের বিধান এই যে, নিজের জমিতে অন্যকে আসতে না দিলে ঘাস কেটে নিয়ে তাকে দিতে হবে। তবে পার্শ্ববর্তী অন্য জমির ঘাস দ্বারা যদি তার প্রয়োজন পুরা হয়ে যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে বাধা দিতে পারবে। যদি পার্শ্ববর্তী জমিওয়ালাও বাধা দেয় তাহলে এ জুলুমের গুনাহের মধ্যে সবাই অন্তর্ভুক্ত হবে।
মাসআলাঃ মৃত জীবের কাঁচা চামড়া তাজা হলে তা বিক্রি করা দুরস্ত নয়, তবে শুষ্ক হলে বিক্রি করা দুরস্ত আছে। কারণ, শুষ্ক হওয়া ‘দাবাগত’। আর ‘দাবাগত’ কৃত চামড়া বিক্রি করা জায়েয। মৃত জীবের হাড্ডি এবং চুলেরও একই বিধান। তবে মানুষ এবং শূকরের চামড়া ইত্যাদি বিক্রি করা দুরস্ত নয়।
মাসআলাঃ কেউ কেউ গরু, বলদ বা অন্য কোন জিনিস নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয় করে যখন তার দাম পরিশোধ করতে পারে না, তখন কিছু কম দামে তা বিক্রেতার কাছেই বিক্রি করে দেয়, এটি জায়েয নয়। তবে এমন প্রয়োজন পড়লে এ পন্থা অবলম্বন করতে পারে যে, মূল বিক্রেতা কিছু সময়ের জন্যে পূর্ব নির্ধারিত মূল্য পরিমাণ টাকা ক্রেতাকে ঋণ দিবে। ক্রেতা সে টাকা দিয়ে মূল্য পরিশোধ করবে। তারপর জিনিসটি বিক্রেতার কাছে কম মূল্যে বিক্রি করে দিবে। অবশিষ্ট টাকা তার দায়িত্বে ঋণ থাকবে।
মাসআলাঃ যদি এ শর্তে বাড়ি বিক্রি করে যে, উদাহরণ স্বরুপ এক মাস পর্যন্ত বাড়ি খালি করে দিবে না, বরং বিক্রেতা তার দখলে রাখবে তাহলে এটি “শর্তে ফাসেদ’ বলে গণ্য হবে। এর কারণে বিক্রিও ‘ফাসেদ’ হবে। তবে যদি বিক্রির সময় এ শর্ত আরোপ না করে বরং বিনা শর্তে বিক্রি সম্পন্ন হয় এবং কেনার পর ক্রেতা স্বেচ্ছায় বিক্রেতাকে তাতে অবস্থান করার অনুমতি দেয়, তাহলে তা দুরস্ত হবে। এমনিভাবে বেচা-কেনা চুক্তির চাহিদা বিরুদ্ধ যে কোন শর্তের একই হুকুম।
মাসআলাঃ কতক লোক শুধুমাত্র খরিদ্দারকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে মিছামিছি ক্রেতা সাজে এবং বাড়িয়ে দাম বলে, যেন অজ্ঞাত মানুষ ফেঁসে যায়, এমন করা হারাম।
মাসআলাঃ দু’ব্যক্তি কোন পণ্যের ব্যাপারে পরস্পরে কথা বলছে এবং একটি দামের উপর উভয়ে একমত হয়েছে। এখন শুধু ‘ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বেচা-কেনা সম্পন্ন করা বাকি রয়েছে। এমতাবস্থায় দাম বাড়িয়ে বলে ঐ জিনিস ক্রয় করা অন্যের জন্যে জায়েয নেই। তবে যদি এখনো কোন এক মূল্যের উপর উভয়ে একমত না হয়ে থাকে, তখন দাম বাড়ানো জায়েয আছে। যেমন নিলামের মধ্যে হয়ে থাকে।
মাসআলাঃ কতক লোক কোন জিনিসের উপর লটারী করে এবং চাঁদা উঠিয়ে মালিককে মূল্য পরিশোধ করে। তারপর যার নাম বের হয়, সে জিনিস তার বলে গণ্য করা হয়। অন্যদের নাম বিফল যায়, এটি হারাম এবং জুয়া।
মাসআলাঃ বর্তমানে ব্যবসার অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন, জীবন বীমা এবং বিবাহ ফান্ড ইত্যাদি। এগুলোর বেশির ভাগই সুদ এবং জুয়া, বিধায় এগুলোতে অংশ নেওয়া হারাম। তবে দ্বীনদার আলেমগণের গবেষণায় বৈধ কোন পন্থা বের হলে তাতে অংশ নেওয়ায় কোন সমস্যা নেই।
মাসআলাঃ জুমুআর আযানের পর বেচা-কেনা করা নিষিদ্ধ।
ক্রয়মূল্যে বা তার উপর লাভ নিয়ে বিক্রি করার বর্ণনা
মাসআলাঃ ক্রয়মূল্যের সঙ্গে অন্যান্য ব্যয়কে সংযোজন করা জায়েয আছে। তবে এরুপ বলবে না যে, এতো টাকায় ক্রয় করেছি, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। বরং এভাবে বলবে যে, আসল দাম এবং অন্যান্য ব্যয় মিলে এতো পরিমাণ লেগেছে।
মাসআলাঃ কতক লোক এমন করে যে, এক জায়গা থেকে মাল ক্রয় করে নিজের বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান বা কর্মচারীর হাতে কাল্পনিকভাবে বেচা-কেনা করে। তারপর তার নিকট থেকেই অধিক মূল্যে তা ক্রয় করে। যাতে লাভে বিক্রি করার সময় শপথ করে এ কথা বলার সুযোগ হয় যে, আমি এতো টাকায় ক্রয় করেছি। এমন করা সম্পূর্ণ হারাম এবং চরম ধোঁকা। কারণ, ক্রেতা আসল ক্রয় মূল্যই জিজ্ঞাসা করে থাকে এবং তার কথায় এটিই বুঝে থাকে।
Leave a Reply