সুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
ঋণের চাপে বা ঋণকে কেন্দ্র করে ছাড় দেওয়ার ফলে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে যে সমস্ত সুবিধা পায়, তা সুদের অন্তর্ভূক্ত।
হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
’কোন ব্যক্তি কাউকে ঋণ দেওয়ার পর ঋণগ্রহীতা যদি তাকে কিছু হাদিয়া দেয়, বা ঘোড়া কিংবা অন্য কোন কিছুতে আরোহণ করায়, তাহলে ঐ ব্যক্তির তাতে আরোহণ করা বা ঐ হাদিয়া গ্রহণ করা উচিত নয়। তবে পূর্ব থেকে এ দু’জনের মধ্যে এ ধরনের প্রচলন থাকলে তা নেওয়ায় কোন সমস্যা নেই।’
(হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজা এবং ইমাম বাইহাকী শুয়াবুল ঈমানে বর্ণনা করেছেন।)
হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
’কোন ব্যক্তি কাউকে ঋণ দিলে তার হাদিয়া নেওয়া উচিত নয়।’
(ইমাম বুখারী (রহঃ) তার ’তারীখে’ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং ‘মুনতাকা’তেও এমনটি রয়েছে।)
আবু বুরদাহ ইবনে আবূ মূসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি মদীনা শরীফ এলাম এবং আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাযিঃ)এর সাক্ষাত পেলাম। তিনি আমাকে বললেন যে, তুমি এমন এক জায়গায় থাকো, যেখানে সুদ বহুল প্রচলিত। তাই কারো দায়িত্বে তোমার কোন হক পাওনা থাকলে এবং এমতাবস্থায় সে তোমার নিকট ভুষি বা ঘাসের আঁটি দিলে তুমি তা নিবে না। কারণ, এটি সুদের অন্তর্ভুক্ত।
(হাদীসটি ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।)
উপরোক্ত তিনটি হাদীসই মিশকাত শরীফ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
এ মূলনীতি দ্বারা অনেক মাসআলাই জানা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরুপ কয়েকটি মাসআলা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
মাসআলাঃ কতক ঋণগ্রস্ত দোকানদার ঋণের সুবাদে ঋণদাতাকে বিনা লাভে সদাই দেয়। উপরোক্ত মূলনীতি দ্বারা জানা গেলো যে, এটা দুরস্ত নয়।
মাসআলাঃ উপরোক্ত মূলনীতি দ্বারা আরো জানা গেলো যে, জমির মালিকদের মধ্যে যে ব্যাপক প্রচলন আছে যে, মাঠের বা বাড়ির জায়গা বন্ধক রেখে তা থেকে উপকৃত হয়, এটা মোটেই জায়েয নয়। কারণ, ফকীহগণ এ মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন যে-
’ঋনের বিনিময়ে যে কোন সুবিধা ভোগ করাই সুদের অন্তর্ভুক্ত।’
কোন কোন কিতাবের ভাষ্য দ্বারা কারো কারো এ ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আসলে এর দ্বারা ঋণের বিনিময়ে সুবিধা গ্রহণকে জায়েয বলা উদ্দেশ্য নয়। তাদের ঐ ভাষ্যের অর্থ হলো, বন্ধকগ্রহীতা বন্ধকদাতার বিনা অনুমতিতে বন্ধকী সম্পদ দ্বারা উপকৃত হলে জরিমানা দিতে হয়, কিন্তু তার অনুমতিক্রমে উপকৃত হলে জরিমানা দিতে হবে না। কিন্তু জরিমানা ওয়াজিব না হলেই তা হালাল এবং বৈধ হয়ে যায় না। যেমন, চোরের হাত কাটা হলে চুরিকৃত সম্পদের জরিমানার হুকুম থাকে না, কিন্তু এর দ্বারা চুরিকৃত সম্পদ হালাল হয়ে যায় না। এ প্রসঙ্গে ‘হিদায়া’ এবং তার টীকা ‘গায়াতুল বায়ান’-র ইবারত তুলে ধরা হচ্ছে-
আর কোন ইবারতে ‘হালাল’ বা ‘মুবাহ’ শব্দ পাওয়া গেলে তার অর্থ হলো- যখন বন্ধকী চুক্তির সময় তা থেকে উপকৃত হওয়ার শর্ত করেনি এবং সেখানে এরুপ করার প্রচলনও নেই এবং ঋণের চাপেও এর অনুমতি দেওয়া হয়নি, বরং এমনিতেই বিনা শর্তে যদি উপকৃত হওয়ার অনুমতি দেয় তাহলে এমতাবস্থায় উপকৃত হওয়া জায়েয আছে। তবে এমতাবস্থায় ঐ জিনিসটি বন্ধক থেকে বের হয়ে নিছক ধার বলে গণ্য হবে। তাই ব্যবহার করতে গিয়ে জিনিসটি হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে তার জরিমানা বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না এবং এটা ঋণের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে না। বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা দরকার। অনেক শিক্ষিত মানুষও এ ভুলের মধ্যে লিপ্ত আছে। আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবীবের উসিলায় সব ধরনের বিপদ থেকে হেফাযত করুন।
মাসআলাঃ জমির মালিকদের মধ্যে ‘বাই’বিলওয়াফা’ নামে এক প্রকারের বেচা-কেনা প্রসিদ্ধ আছে। এর দুটি পদ্ধতি চালু আছে। এর প্রত্যেকটার বিধান ভিন্ন।
একটি পদ্ধতি এই যে, যায়েদ আমরকে বললো যে, আমার এ জমি বা বাগান একশ’ টাকার বিনিময়ে রাখো। উদাহরণত এক বছরের মধ্যে আমি এ টাকা পরিশোধ করে দিলে আমার জমি আমি নিয়ে নিবো, আর যদি এ সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারি তাহলে এ টাকার বিনিময়ে তোমার নিকট এ জমি বিক্রি হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিকে কতক সাধারণ মানুষ ‘বাই’বিলওয়াফা’ বলে থাকে। কিন্তু ফকীহদের পরিভাষায় ‘বাই’বিলওয়াফা’ দ্বারা এ পদ্ধতি উদ্দেশ্য নয়, বরং পরবর্তীতে উল্লেখিত পদ্ধতিই এর উদ্দেশ্য। যাই হোক, এ পদ্ধতির নাম যাই রাখুক না কেন এর হুকুম হলো, এ ধরনের লেনদেন সম্পূর্ণরুপে বাতেল এবং হারাম। বরং এখানে মালিক হওয়া আর না হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় এটি জুয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা কুরআনের আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে হারাম প্রমাণিত। বিশেষভাবে এ পদ্ধতিটির নিষেধাজ্ঞা হাদীস শরীফেও বর্ণিত হয়েছে-
’হিদায়া’র টীকা ‘কিফায়া’তে আছে-
দ্বিতীয় পদ্ধতি-যা ফিকহের কোন কোন কিতাবে উল্লেখ আছে তা এই যে, বন্ধক রাখেনি, বরং শুরু থেকেই বেচা-কেনা করেছে। কিন্তু ক্রেতার থেকে পৃথকভাবে ওয়াদা নিয়েছে-অর্থাৎ, বেচা-কেনার মধ্যে শর্ত করেনি, বরং বেচা-কেনার বাইরে পৃথকভাবে ওয়াদা নিয়েছে যে, আমি উদাহরণতঃ এক বছরের মধ্যে তোমাকে মূল্যের টাকা ফিরিয়ে দিলে তুমি এ বেচা-কেনা বাতিল করে বিক্রিকৃত জিনিসটি আমাকে ফেরত দিবে। প্রাচীন আলেমগণের মতে এ পদ্ধতি জায়েয নেই। কারণ, আসল উদ্দেশ্য তো বন্ধক রাখা, বেচা-কেনা করেছে শুধু কৌশল হিসেবে। তার উদ্দেশ্য শুধু বন্ধকীকৃত জিনিসের লাভ ও উপকারকে বৈধ করা। আর যদি এটাকে বিক্রিও বলা হয়, তবুও এটা জায়েয নয়। কারণ, এর মধ্যে ফাসেদ শর্ত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যদিও বেচা-কেনার সময় এ শর্ত উল্লেখ করেনি, তবে উভয়ের উদ্দেশ্য তো এটাই যে, বেচা-কেনার মধ্যে এ শর্ত অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ কারণেই ক্রেতা ওয়াদা খেলাফী করলে পরস্পরে ঝগড়া হয়ে থাকে। তবে পরবর্তীকালের উলামায়ে কেরাম কিছু তাবিল করে এ পদ্ধতিকে জায়েয বলেছেন। মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
মাসআলাঃ কতক সুদখোর এ কৌশল বের করেছে যে, তাদের কাছে কেউ করয নিতে আসলে তারা একটি রুমালের মধ্যে একশ’ টাকা বেঁধে বলে যে, এ সবকিছু একশ’ পাঁচ টাকা। একশ’ টাকার বিনিময়ে একশ’ টাকা আর রুমালের বিনিময়ে পাঁচ টাকা। দ্বিতীয় পক্ষ তা গ্রহণ করে পরিশোধ করার সময় একশ’ পাঁচ টাকা দেয়। এটি সম্পূর্ণ হারাম। কারণ, আসল উদ্দেশ্য হলো, একশ’ পাঁচ টাকা নেওয়া। রুমাল বিক্রি করা মোটেই উদ্দেশ্য নয়। শুধু কৌশল করার জন্যে বিক্রির নাম দিয়েছে। আর যদি বিক্রি করা উদ্দেশ্য মেনেও নেওয়া হয় তবুও চার পয়সা মূল্যের রুমাল পাঁচ টাকায় শুধু চাপের কারণেই নিয়েছে। কারণ, ক্রয় না করলে ঋণ পাবে না। আর উপরে এ মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে যে, ঋণের চাপে যে লাভ পাওয়া যায় তা সুদের অন্তর্ভুক্ত। হাদীস শরীফে পরিষ্কার ভাষায় এর নিষেধাজ্ঞা এসেছে-
একইভাবে যে ক্ষেত্রে চান্দির বদলে চান্দি বা স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ কম-বেশি পরিমাণে বিক্রি করার ইচ্ছা থাকে, তখন জায়েয করার কৌশল হিসেবে যেদিকে পরিমাণ কম, সেদিকে উদাহরণস্বরুপ এক পাই বা এক পয়সা যুক্ত করে-এটিও মাকরূহ। লেনদেনের ক্ষেত্রে মাকরূহ দ্বারা ‘মাকরূহে তাহরীমী’ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন যে, এমন বিক্রি আমার কাছে পাহাড় সমান ভারী মনে হয়।
(ফাতহুল কাদীর)
এমন আরেকটি পদ্ধতি হলো-যেমন, যায়েদ আমরের নিকট দশ টাকা ধার চাইলো। আমর বললো যে, আমি ধার দেবো না। তবে আমার থেকে দশ টাকার মাল বারো টাকায় নিয়ে যাও। এটি কারো নিকট দশ টাকায় বিক্রি করে তোমার কাজ চালাও। যখন তোমার টাকা হয় এর বারো টাকা মূল্য আমাকে পরিশোধ করে দিও। এটিও মাকরূহ। (হিদায়া)
সুদখোরেরা এ পদ্ধতি বের করেছে। (কিফায়া)
ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ) এ সম্পর্কেও উপরোক্ত কথাই বলেছেন। হাদীস শরীফেও এর নিন্দাবাদ এসেছে। হাদীস শরীফে এ ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে যে, যখন তোমরা এমনটি করবে, তখন তোমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে এবং বিজাতিরা তোমাদের উপর বিজয়ী হবে।
(ফাতহুল কাদীর)
মাসআলাঃ কতক লোক বন্ধকীকৃত জিনিস থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে এ কৌশল অবলম্বন করেছে যে, উদাহরণ স্বরুপ আশি টাকার বিনিময়ে জমি বন্ধক নিয়েছে। তারপর বন্ধকদাতার সঙ্গে এ শর্ত করে যে, জমিটি আমাকে বার্ষিক এক টাকায় ভাড়া দেও। বন্ধকের টাকা থেকে ভাড়ার টাকা পরিশোধ হতে থাকবে। এভাবে আশি বছরে এ টাকা শোধ হয়ে যাবে এবং জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আর এর পূর্বে জমি নিতে চাইলে এ হিসাবে যত টাকা বাকি থাকে তা নিয়ে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। মূলতঃ ঋণের চাপেই বার্ষিক এক টাকায় ভাড়া দিতে সে রাজি হয়েছে-আর উপরে এ মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঋণের চাপে যে সুবিধা ভোগ করা হয় তা হারাম-তাই এ চুক্তিও হারাম এবং এ সুবিধা ভোগ অবৈধ হবে।
Leave a Reply